সিলেটের ভারপ্রাপ্ত ডিআইজি প্রিজন্স কামাল আরও বেপরোয়া
Advertisements

সিলেটের ভারপ্রাপ্ত ডিআইজি প্রিজন্স কামাল হোসাইনের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির পাহাড়সম অভিযোগ ওঠার পরও কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় তিনি দিন দিন আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন।

অভিযোগ-ভারপ্রাপ্ত ডিআইজি প্রিজন্স হিসাবে যোগ দিয়েই তিনি ভুল ঠিকানা দিয়ে চাকরি নেওয়া অর্ধশতাধিক কারারক্ষীকে চাকরিচ্যুত করার ভয় দেখিয়ে মোটা অঙ্কের অর্থ আদায় করেন। এ ছাড়া নানা অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে তিনি কোটি কোটি টাকা অবৈধ উপায়ে আয় করেছেন।

এর আগে চট্টগ্রামের সিনিয়র জেল সুপার থাকাকালে কামাল হোসাইনের বিরুদ্ধে কারাবন্দি জঙ্গি ও বিএনপি-জামায়াত নেতাদের বিশেষ সুবিধা দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। কারাগারে টাকার বিনিময়ে মাদক সরবরাহ এবং বন্দিদের ঘিরে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ তার বিরুদ্ধে।

এসব উল্লেখ করে কামালের বিরুদ্ধে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বরাবর লিখিত অভিযোগও দেন চট্টগ্রাম মহানগরের এক আওয়ামী লীগ নেতা।

অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে ২০২১ সালের ৭ জুলাই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগ থেকে কামাল হোসাইনকে প্রত্যাহার ও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়।

উপসচিব (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মোহাম্মদ আবু সাঈদ মোল্লা স্বাক্ষরিত স্মারকে এ নির্দেশ দেওয়া হলেও তার বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। রহস্যজনক কারণে তার অনিয়ম-দুর্নীতির তদন্তও হয়নি। এ কারণে কামাল হোসাইন আরও বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। কারা সংশ্লিষ্টরা এমন দাবি করেছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কারা অধিদপ্তরের কয়েকজন সিনিয়র কর্মকর্তা জানান, সিলেটে ভুল ঠিকানা দেখিয়ে চাকরি করা অর্ধশতাধিকের বেশি কারারক্ষীর কাছ থেকে জনপ্রতি তিন থেকে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুস নিয়েছেন কামাল হোসাইন।

টাকা না দিলে এসব কারারক্ষীকে চাকরিচ্যুত করার এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) ভয় দেখানো হয়। কর্মকর্তাদের আরও দাবি, কারা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক আবরার হোসাইনের প্রশ্রয়ে কামাল হোসাইন বেপরোয়া হয়ে ওঠেন।

এর আগেও চট্টগ্রামের সিনিয়র জেল সুপার থাকাকালে তার বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ উঠলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তদন্তকালে উলটো কামাল হোসাইনকে পদোন্নতি পাইয়ে দিয়েছেন অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক আবরার হোসাইন। বিশেষ ক্ষমতা বলে তিনি এটা করেছেন বলে দাবি কর্মকর্তাদের।

ভুক্তভোগী কারারক্ষীদের কয়েকজন পরিচয় গোপন রাখার শর্তে জানান, কামাল হোসাইনকে প্রত্যাহার করে কারাবিধি অনুযায়ী ঘুস আদায় ও দুর্নীতির বিষয়ে তদন্ত করা হলে তাদের অনেকেই সাক্ষ্য দিতে রাজি আছেন। তবে তাকে কর্মস্থল রেখে তদন্ত করলে তারা মুখ খুলবেন না।

১৯৮৫ সালের আধুনিক প্রশাসন ব্যবস্থাপনা আইনে সরকারি কর্মচারী শৃঙ্খলা ও আপিল বিধিমালায় ৩ ও ৪ এর ডি ধারায় স্পষ্ট বলা আছে-যদি কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী অনিয়ম বা স্বেচ্ছাচারিতা ও তার কর্মস্থলে ক্রমাগত অভিযোগে অভিযুক্ত হন সে ক্ষেত্রে তার বর্তমান কর্মস্থল থেকে সাময়িক অব্যাহতিপূর্বক সংস্থায় বা অধীনস্থ মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত করার বিধান রয়েছে।

অন্য এক ধারায় বলা হয়েছে-অভিযুক্ত ব্যক্তির অভিযোগ তদন্তকালে যেন কোনো প্রকার প্রভাব বিস্তার বা তদন্তকাজ ব্যাহত না হয় সেজন্য অভিযুক্তকে কর্মস্থলে রাখা সমীচীন নয়। অভিযুক্তকে কর্মস্থলে বহাল রেখে তদন্ত করলে তদন্ত কাজ ব্যাহত হয়।

চট্টগ্রাম কারাগারে সিনিয়র জেল সুপার থাকাকালে কামাল হোসাইনের বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের লালখান বাজার ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক দিদারুল আলম মাসুদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে লিখিত অভিযোগ দেন।

চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি থাকা অবস্থায় নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি লেখেন, টাকার বিনিময়ে জঙ্গি ও কারাবন্দি বিএনপি-জামায়াতর নেতাকর্মীদের অবৈধ সুবিধা দিয়েছেন কামাল হোসাইন।

কারাগারে জেলকোড অনুযায়ী বন্দিদের মানসম্পন্ন খাবার দেওয়া হয় না। সরবরাহকারীদের কাছ থেকে কমিশন নিয়ে নিম্নমানের খাবার পরিবেশন করা হয়।

দিদারুল আলম মাসুদ আরও লেখেন-কারাগারের ভেতর মাদক সরবরাহের সুযোগ করে দেন কামাল হোসাইন। আদালতে হাজিরা থাকলে জেলকোড অনুযায়ী বন্দিদের দুপুরের খাবার বাবদ টাকা দেওয়ার বিধান থাকলেও তার নির্দেশে তা দেওয়া হচ্ছিল না।

প্রতিবাদ করার পর থেকে জনপ্রতি ২৬ টাকা করে দেওয়া হয়। সাধারণ বন্দিদের চেয়ে চিহ্নিত অপরাধীদের মোবাইল ফোনে কথা বলার সুযোগ বেশি দেওয়া হয়। কারা অভ্যন্তরে প্রতিবাদ করায় আমি কামাল হোসাইনের রোষানলের শিকার হয়েছি।

কামাল হোসাইনের বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাবেক কারা মহাপরিদর্শককে নির্দেশ দেন। এ ছাড়া কামাল হোসাইনকে প্রত্যাহার করে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে দুদকের পক্ষ থেকে কারা মহাপরিদর্শককে গত বছরের ৭ জুলাই চিঠি দেওয়া হয়।

কিন্তু এখনো তার বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। অথচ অভিযোগের তদন্তকালে ২০২০ সালের অক্টোবরে পদোন্নতি দিয়ে কামাল হোসাইনকে ডিআইজি (প্রিজন্স) হিসাবে দায়িত্ব দেওয়া হয়।

এ ছাড়া কারা অধিদপ্তরে দাম্ভিকতা দেখিয়ে কামাল অনেকবার ভাগিয়ে নিয়েছেন ভালো জেলায় পোস্টিং। এতে তাকে সাহায্য করেছেন বিএনপি-জামায়াতপন্থি কারা অধিদপ্তরের সিনিয়র কর্মকর্তারা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের কারা অনু শাখার একজন অতিরিক্ত সচিবও তাকে সহযোগিতা করেছেন।

অনিয়ম ও দুর্নীতি করে পার পেতে কামাল হোসাইন সব সময় কারা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক আবরার হোসাইন ও অতিরিক্ত সচিবসহ শীর্ষ কর্মকর্তাদের নাম ব্যবহার করেন। ঘনিষ্ঠ লোক হিসাবেও তিনি সর্বত্র তাদের পরিচয় দিয়ে আসছেন।

এ কারণে হাজারো অভিযোগ থাকলেও তার বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। বরং উলটো তার পছন্দের বিভাগে পোস্টিং ও পদোন্নতি দেওয়া হয়। কামাল হোসাইনের বিরুদ্ধে দুদক, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দপ্তর থেকে ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করা হলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

যে কারাগারেই কামাল হোসাইন দায়িত্ব পালন করেছেন সেখানে অনিয়ম-দুর্নীতি করেছেন। কারারক্ষী বদলি বাণিজ্য, ক্যান্টিন বাণিজ্য, কারারক্ষী নিয়োগ বাণিজ্য, কারা ঠিকাদারদের কাছ থেকে কমিশন বাণিজ্য ও কারারক্ষীদের ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়ের অভিযোগ রয়েছে।

তার বিরুদ্ধে আনা উল্লেখযোগ্য অভিযোগগুলো হলো-চট্টগ্রাম কারাগারের এমডি খাতের টাকা লোপাট, টাকার বিনিময়ে বন্দিদের সঙ্গে স্বজনদের সাক্ষাৎ এবং বন্দিদের খাবার ওজনে কম দেওয়া, লালমনিরহাটে তুষভাণ্ডার বাজারে শ্বশুরের নামে কোটি টাকার মার্কেট, স্ত্রীর নামে বহুতল ভবন ও ফসলি জমি, সিলেটে প্রিজম হাউজিং নামে একটি কোম্পানির অর্ধেক শেয়ার ক্রয়, সাবেক ও বর্তমান দুই কারা কর্মকর্তার সঙ্গে গোপন চুক্তিতে রিয়েল এস্টেট ব্যবসা, নারায়ণগঞ্জ ইউরো বাংলা রিয়েল এস্টেট কোম্পানিতে নিজ নামে পাঁচ কাঠার প্লট, ঢাকায় স্ত্রী শিরিন শবনম ও শ্বশুর সফিকুল ইসলামের নামে ফ্ল্যাট ও একাধিক প্লট ক্রয়। রিয়েল এস্টেট ব্যবসার মূল অর্থ কামাল হোসাইন ও ডেপুটি জেলার আব্দুস সালাম তালুকদারের যৌথ বিনিয়োগ হলেও শেয়ার হোল্ডার হিসাবে নাম রয়েছে সাবেক জেলার শামশুল ইসলামের।

চট্টগ্রামের কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার থাকাকালে কামাল হোসাইন এমডি খাতের ছয় লাখ টাকা স্টোর অর্ডার ছাড়াই তড়িঘড়ি করে তুলে নেন। যা এজি অফিসের ২০২০ সালের হিসাব খাতে সংরক্ষণ করা রয়েছে। এ অর্থ লোপাটের বিষয়ে চট্টগ্রাম বিভাগের ডিআইজি একেএম ফজলুল হক বলেন, বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে তদন্ত করে দেখা হবে।

সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারের ডেপুটি জেলার আব্দুস সালাম তালুকদার জানান, আমার ও আমার শ্বশুরের সঙ্গে কামাল হোসাইনের কোনো ব্যবসা নেই। এ কথা বলার পর তিনি ফোনের সংযোগ কেটে দেন। পরে তার মোবাইল ফোনে খুদে বার্তা পাঠিয়েও কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

কামাল হোসাইন ও ডেপুটি জেলার আব্দুস সালাম তালুকদারের টাকা বিনিয়োগ করে সিলেটে রিয়েল এস্টেট কোম্পানির পরিচালক হিসাবে ব্যবসা পরিচালনা করেছেন-এমন প্রশ্নের জবাবে সাবেক জেলার শামশুল ইসলাম বলেন, সব অভিযোগ মিথ্যা। তিনি আরও বলেন, কামাল ও সালামের সঙ্গে আমার কোনো ব্যবসা নেই। কোনো প্রতিষ্ঠানেও আমার কোনো শেয়ার নেই।

অভিযোগের বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত ডিআইজি কামাল হোসাইন বলেন, আমার ব্যাপারে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে সেগুলো সঠিক নয়। তবে চট্টগ্রামের অভিযোগগুলো আমার মনে নেই। রিয়েল এস্টেট ব্যবসা নিয়ে কারও সঙ্গে আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। দুদকের অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, আমি একা অভিযুক্ত নই।

আমার জুনিয়র ও সিনিয়র একাধিক কর্মকর্তাকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আপনার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কারা মহাপরিদর্শককে নির্দেশ দিয়েছিলেন। এর পরও আপনি কিভাবে আবার সিলেটে পদোন্নতি নিয়ে এলেন-এমন প্রশ্নের কোনো সদুত্তর কামাল হোসাইন দিতে পারেননি।

কারা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক আবরার হোসাইন বলেন, কামাল হোসাইনের অনিয়মের বিষয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্তও চলছে। তদন্তে অনিয়মের প্রমাণ পেলে মন্ত্রণালয়কে অবহিত করা হবে। অভিযুক্ত ব্যক্তিকে কর্মস্থলে বহাল রেখে তদন্ত করলে তদন্ত কাজ ব্যাহত হবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিষয়টি মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ার।

জানা গেছে, লালমনিরহাটের বাসিন্দা কামাল হোসাইন ২০০৮ সালে কারা অধিদপ্তরে জেল সুপার হিসাবে চাকরিতে যোগ দেন। রংপুর কারমাইকেল কলেজ থেকে এইচএসসি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএসএস পাস করেন তিনি। কারমাইকেল কলেজে পড়ার সময় তিনি শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন।

তার বাবা মকবুল আহমেদ বিএনপির নেতা ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় কামাল হোসাইন ছাত্রদলের নেতা বনে যান। এ ছাড়া তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠভাজন ছাত্রদলের ক্যাডার সোহেলের মাধ্যমে কামাল হোসাইন তার (তারেক) আস্থাভাজন হন।

সূত্রঃ যুগান্তর

Advertisements