বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘মনে হয় যে তারা তাদের পৈত্রিক সম্পত্তি দিয়ে তৈরি করেছে। একজন তো বলছে, বিএনপি ওপর দিয়ে যাবে না নিচ দিয়ে? মানে এটা তাদের পৈত্রিক সম্পত্তি!’ ‘বিএনপি পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে যাবে না নিচ দিয়ে যাবে’ তথ্যমন্ত্রীর এমন বক্তব্যের তীব্র সমালোচনা করে এমন মন্তব্য করেন ফখরুল।
সোমবার বিকালে সংবাদ সম্মেলন করে এই বিষয় ছাড়াও পদ্মা সেতু, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাংচুরের প্রতিবাদে সরকারি কর্মকর্তাদের সমাবেশ, রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরসহ নানা বিষয়ে দলের অবস্থান জানান মির্জা ফখরুল।
তিনি বলেন, “এখন যেটা দেশে চলছে সেটা একটা লুটপাট। পুরোপুরি একটা ব্লান্ডারিং, ইন দ্য নেইম অব ডেভেলপমেন্ট এই ব্লান্ডারটা করা হচ্ছে।
“যেটা আমরা বলছি যে, প্রত্যেকটা জায়গায় তারা মুনাফা খোঁজে, প্রফিট খোঁজে। প্রফিটটাই তারা বের করে নিয়ে আসে।তাদের ফিনান্সিয়াল প্রফিট। যেমন বাড়ি-ঘর বানাবে, উড়াল সেতু বানাচ্ছে, মেগা প্রজেক্ট বানাচ্ছে, মেগা দুর্নীতি করছে।”
দেশের কোনো খাতই এখন ‘ভালো অবস্থায় নেই’ দাবি করে মির্জা ফখরুল বলেন, “ইকোনমিক সেক্টরে ব্যাংকিং সিস্টেম টোটালি কলাপসড- এটা আমার কথা না। কালকেও আমাদের ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদের (অর্থনীতির অধ্যাপক) একটা বক্তব্য আছে, ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদেরও (বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর) একটা বক্তব্য আছে, যে সিস্টেমে চলছে সেই সিস্টেমে ভয়ঙ্কর একটা অবস্থা তৈরি হচ্ছে। এসব নিরপেক্ষ অর্থনীতিবিদ যারা আছেন তারা বিশ্লেষণ করছেন।”
পদ্মা সেতু নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের বক্তব্যের সমালোচনা করে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, “আমরা সব সময় উন্নয়নের পক্ষে, আমাদের দলই হচ্ছে উন্নয়নের পক্ষে, সৃজনশীলতার পক্ষে। আমরা কখনোই কোনো নেগেটিভ রাজনীতি করি না। আমরা পজিটিভ পলিটিক্স করি। আমরা সত্যকে সত্য, মিথ্যাকে মিথ্যা বলতে চাই, আমরা সাদাকে সাদা, কালোকে কালো বলতে চাই। সেটা বলতে গেলেই তাদের গায়ের মধ্যে জ্বালা ধরে যায়।
“মনে হয় যে, তাদের পৈত্রিক সম্পত্তি নিয়ে তৈরি করেছে। একজন বলছেন যে, উপর দিয়ে যাবে না, নিচ দিয়ে যাবে বিএনপি। যেন এটা তাদের সম্পদ। এটা মানুষের পকেট কেটে কেটে কিন্তু নেওয়া হচ্ছে। প্রত্যেকটি মানুষ এখানে ট্যাক্স দিচ্ছে। যেখানে এক টাকা ট্যাক্স দিত সেখানে ১০ টাকা ট্যাক্স দিচ্ছে।”
বিএনপি যে উন্নয়ন করেছে ‘তার ওপর ভর করেই দেশ দাঁড়িয়ে আছে’ দাবি করে দলটির মহাসচিব বলেন, “এদেশের উন্নয়নের শুরুটা হচ্ছে বিএনপিকে দিয়ে। ১৯৭৫ সালে পট পরিবর্তনের পর শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান যখন দেশের দায়িত্ব নিলেন প্রথম যে কাজগুলো শুরু করেছিলেন সেটা হচ্ছে অর্থনৈতিক সংস্কার ও উন্নয়ন। উন্নয়ন বলতে শুধু গুটিকতক লোকের উন্নয়ন নয়, উন্নয়ন বলতে সাধারণ মানুষের কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষের উন্নয়নের কথা বলেছিলেন। সেটা নিয়ে তিনি কাজ শুরু করেছিলেন। সেটার যে ভিত্তি তৈরি হয়েছে তার উপরই আজকে বাংলাদেশ দাঁড়াচ্ছে।
“আজকে বিদেশ থেকে যে রেমিটেন্স আসছে, এই রেমিটেন্স শুরুর প্রক্রিয়াটা জিয়াউর রহমান সাহেবের সময় থেকে। আজকে যে গার্মেন্টের ওপর ভিত্তি করে যেটা দাঁড়িয়েছে সেটারও পুরোপুরি ভিত্তি হচ্ছে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সময়ে। কৃষিতে যে বিপ্লব ১৯৭৪ সালে আওয়ামী লীগের আমলে যে দুর্ভিক্ষ সেটাকে পাশ কাটিয়ে উঠে ১৯৭৬ সালের মধ্যে কৃষিতে স্বনির্ভরতা অর্জন করা, সেটাও জিয়াউর রহমান সাহেবের সময়ে। তাই আজকে কোনো একটা ব্রিজ তৈরি হওয়া, কোনো একটা রাস্তা তৈরি হওয়া- এটাকে আমরা মনে করি যে, দিস ইজ নট…, উন্নয়ন নিঃসন্দেহে। উন্নয়ন হচ্ছে সাধারণ মানুষের আর্থিক অবস্থার কতটুকু পরিবর্তন হল- এটা হচ্ছে সবচেয়ে বড় কথা।”
হেফাজতে ইসলামের নেতাদের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য স্থাপনের বিরোধিতার বিষয়ে বিএনপির নীরবতা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে মির্জা ফখরুল বলেন, “এই মুহূর্তে আমাদের কাছে প্রধান চ্যালেঞ্জ দুটো। একটি হচ্ছে- মানুষের জীবন রক্ষা করা করোনার হাত থেকে, ভ্যাকসিন সরবারহ করা এবং যারা করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন তাদের চিকিৎসা করা, তাদের জীবন দান করা।
“দ্বিতীয়টি হচ্ছে, গণতন্ত্রকে মুক্ত করা, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে নিয়ে আসা। এগুলোই আমাদের চ্যালেঞ্জ।”
‘একদলীয় শাসনে দেশ’
গত শনিবার প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা, নিম্ন আদালতের বিচারকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাংচুরের প্রতিবাদ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, “এই ঘটনাগুলো প্রমাণ করেছে, যে কথাটা আমরা বার বার বলে আসছি, উদ্বেগ প্রকাশ করছি, যে বাংলাদেশ মূলত একটি একদলীয় শাসনের দেশে পরিণত ইতোমধ্যে হয়ে গেছে। ইতিহাস যারা পর্যালোচনা করেন দেখবেন যে, ১৯৭২ সালের পর থেকে একই ধরনের প্রায় ঘটনা ঘটেছে। বিশেষ করে বাকশাল ঘোষণা হওয়ার পর থেকে এভাবে তারা সব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ে তারা দলবেঁধে লাইন ধরে ধরে বাকশালে যোগদান করার জন্য বাধ্যতামূলক ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তারই আমরা একটা চিত্র দেখতে পারছি যে, উদ্বেগজনক যে, বিচারকরাও এই কাজগুলো করছেন।
“উদ্দেশ্যটাই একটা যে, পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রকে একদলীয় শাসন ব্যবস্থার মধ্যে যেটা আমরা বলি যে, তাদের একটা মানসিক অবস্থা তৈরি করা এবং সেই মানসিক অবস্থা তৈরি করার জন্য তারা এটা করছেন। মূল সমস্যাগুলোকে ডাইভার্ট করার জন্য তারা এটা করছেন।”
তিনি বলেন, “আজকে জাতির সামনে চ্যালেঞ্জটা কী? প্রধানত দুইটা। একটি হচ্ছে কোভিড থেকে মানুষকে রক্ষা করা আর দ্বিতীয়টা ভ্যাকসিন সংগ্রহ করা। এখানে আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী গতকাল একটা বক্তব্য দিয়েছেন যার সাথে বাস্তবতার কোনো মিল নাই। এভাবে তিনি মিথ্যাচার করে আসছেন প্রথম থেকে।
“এই সরকারের দৃষ্টি একটা- যে কোনো মূল্যে ক্ষমতায় থাকতে হবে। সেজন্য রাষ্ট্রের সব কিছু তাদের ব্যবহার করতে হবে। এই যে গণতন্ত্রের কথা- এটা হলো তাদের লিফ সার্ভিস। তাদের সমস্ত দুর্বত্তায়ন, মানুষের অধিকার হরণ সমস্ত কিছুকে জায়েজ করার জন্য গণতন্ত্রের লেবেলটা তাদের রাখতে হয়। বলা হচ্ছে গণতন্ত্রের কথা, করা হচ্ছে পুরো উল্টোটা।”
‘ভাসানচরে রোহিঙ্গা স্থানান্তর’
জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার আপত্তির মধ্যে ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর ঠিক হচ্ছে না বলে মনে করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
এই স্থানান্তর প্রক্রিয়া সামগ্রিক বিচারে সরকারের ‘কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যর্থতার সুস্পষ্ট উদাহরণ’ বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।
ফখরুল বলেন, “রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে কূটনৈতিক তৎপরতা মুখ থুবড়ে পড়ায় জনগণের দৃষ্টিকে অন্যদিকে ঘোরাতে এবং দুর্নীতির এক নতুন মহোৎসব সৃষ্টির হীন প্রয়াস থেকেই ভাসানচরের প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। আমরা মনে করি সীমাহীন কূটনৈতিক ব্যর্থতা আড়াল করতে সরকার এই কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়েছে।”
তিনি বলেন, “আমরা বিশ্বাস করি, রোহিঙ্গা শরণার্থীরা বাংলাদেশে অস্থায়ীভাবে কেবলমাত্র স্বল্প সময়ের জন্য নিরাপদ আশ্রয়ে অবস্থান করছেন। ভাসানচরে এ ধরনের স্থায়ী বাসস্থান নির্মাণ মূল সমস্যা সমাধানে নতুন প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করবে। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য ভাসানচরে যেসব স্থায়ী অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে ও হচ্ছে, তার ফলে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষসহ তাদের সমর্থক গোষ্ঠীসমূহের মাঝে এমন ধারণার সৃষ্টি হতে পারে যে, টেকসই আবাসনের ব্যবস্থা করার মাধ্যমে বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের স্থায়ীভাবে গ্রহণ করে নিচ্ছে।
“আন্তর্জাতিক মহলের আপত্তি সত্ত্বেও ভাসানচরে রোহিঙ্গা শরণার্থী স্থানান্তর কার্যক্রম মূল সংকটকে আরও ঘনীভূত করতে পারে। অপরদিকে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী নিয়ন্ত্রিত প্রোপাগান্ডা সেল ও মিয়ানমার সরকার কূটনৈতিক পরিমণ্ডলে দাবি করতে পারে যে, বাংলাদেশে আশ্রয়প্রাপ্ত রোহিঙ্গা শরণার্থীরা জাতিগতভাবে বাঙালি বলেই বাংলাদেশে এদের বসবাসের স্থায়ী ব্যবস্থা করে আত্মীকরণ সম্ভব হয়েছে।
“এতে মিয়ানমারের উগ্র বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীগুলো ও সেনাবাহিনী জাতিগত নির্মূল অভিযান সম্পন্ন করতে আরও উৎসাহী হবে এবং অবশিষ্ট যে লাখ পাঁচেক রোহিঙ্গা এখনও আরাকানে রয়েছে তাদেরও বিতাড়নের প্রক্রিয়া নতুন করে জোরদার হতে পারে।”
রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরের নামে ‘অহেতুক সময়ক্ষেপণ’ না করে সবাইকে সাথে নিয়ে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে মিয়ানমারের ওপর বহুমাত্রিক চাপ বাড়ানোর পরামর্শ দেন তিনি।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, “এই প্রত্যাবর্তনকে শুধুমাত্র কাগুজে চুক্তিতে বন্দি না রেখে দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় চুক্তির কার্যকর প্রয়োগের পথে এগোতে হবে। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে জাতিসংঘ, আঞ্চলিক সংস্থা এবং বিশ্ব শক্তিগুলোর স্ব স্ব ভূমিকা সুনিশ্চিত করতে হবে। কার্যকর কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মহলকে বাংলাদেশের সীমাবদ্ধতার কথা উপলব্ধি করাতে হবে।”
দেশে ‘একটি গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা’ হলে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে ভূমিকা রাখতে পারবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।