মিয়ানমারে ন্যায়বিচার ছাড়া শান্তি অসম্ভব
Advertisements

আল-জাজিরার মতামত পাতায় প্রকাশিত “তুন খিন” এর লেখাটি ভাওয়াল বার্তার পাঠকদের জন্য তরজমা করা হয়েছে।


এক বছর আগে সামরিক জান্তা ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই দেশের ইতিহাসে আরেকটি রক্তাক্ত অধ্যায়ের সূচনা করে।জান্তা রাষ্ট্রকে পতনের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে। ব্যাপক নৃশংসতা ও সহিংসতা চালিয়ে যাচ্ছে। নিহতের সংখ্যা সংক্রান্ত তথ্য উপাত্ত যদিও যাচাই করার সুযোগ কম। তবে ২০২১ সালের পহেলা ফেব্রুয়ারি সামরিক জান্তার ক্ষমতা দখলের পর থেকে এ পর্যন্ত অন্তত ১,৫০০ মানুষ নিহত হয়েছে। সাম্প্রতি, কায়াহ রাজ্যে ক্রিসমাসের আগে সামরিক জান্তা ৩৫ জনকে হত্যা করেছে। যার মধ্যে নারী ও শিশু এবং দুই মানবাধিকার কর্মী রয়েছে। জান্তা বিরোধী বিক্ষোভের জন্য হাজার হাজার লোককে গ্রেপ্তার করে নির্যাতন করা হচ্ছে। এই নৃশংসতা থেকে বের হতে আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচারের প্রক্রিয়াগুলি অনুসরণ করতে হবে যা দায়ীদের জবাবদিহিতার আওতায় নিয়ে আসবে।

এই সময়ে, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সমাজ, অর্থনীতি ও জীবিকা সবকিছুই ভেঙ্গে পড়েছে। জান্তা প্রধান জ্যেষ্ঠ জেনারেল মিন অং হ্লাইং নতুন বৈদ্যুতিক ট্রেন আনার বিষয়ে বিভ্রান্তির মধ্যে রয়েছেন। দেশের যোগাযোগ ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে। রোহিঙ্গা সংখ্যালঘুদের গণহত্যা চলছে। জান্তা বাংলাদেশে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা রোহিঙ্গাদের গ্রেপ্তার করেছে।চলাফেরার স্বাধীনতার উপর আরও কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। এখন এ দেশটি একটি উন্মুক্ত কারাগারের পরিনত হয়েছে। মিয়ানমারে সামরিক বাহিনী ও বিভিন্ন সংগঠিত সশস্ত্র বেসামরিক গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ বেড়েই চলেছে।

সেনা অভ্যুত্থানের একটা ফায়দা হলো আন্তঃজাতিগত সংহতি তৈরি হয়। একজন রোহিঙ্গা হিসেবে আমি অতীতে সেনাবাহিনীর অপরাধ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করার প্রায়ই নির্যাতনের শিকার হতাম। তখন যারা রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়িয়ে দিত, তাদের কাছে থেকে এখন সমর্থন পাচ্ছি, তাদের সাথে বোঝাপড়া আগের থেকে ভালো হয়েছে। জনগণ বুঝতে পেরেছে যে সামরিক বাহিনী আমাদের অভিন্ন শত্রু। সেনাবাহিনী নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করছে। তারা মানুষের জান মাল ধ্বংস করছে এবং তারা মানুষকে আতঙ্কিত করে তুলেছে। তারা সম্পূর্ণ দায়মুক্তির সাথে এটি করেছে, তারা জানে যে তাদের অপরাধের কোনও পরিণতি নেই। এ জন্যই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসতে হবে এবং ন্যায়বিচারের ক্ষেত্র তৈরি করে দিতে হবে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলিতে এই ন্যায়বিচার পাওয়ার পথের কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে।

২০১৯ সালে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্ত শুরু করে দিয়েছে নেদারল্যাডন্সের দ্য হেগের আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালত (আইসিজে)। একই সময়ে আন্তর্জাতিক আদালতে (আইসিজে) মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গণহত্যার মামলা করে গাম্বিয়া। এই প্রক্রিয়াগুলো সেনা নির্যানতের শিকার মানুষদের আশার আলো দেখাচ্ছে। গত বছর আর্জেন্টিনার বিচার বিভাগও মিয়ানমারের সামরিক নেতৃত্বের বিরুদ্ধে একটি যুগান্তকারী গণহত্যার মামলা নিতে সম্মত হয়। যার প্রক্রিয়াটি শুরু করেছিল আমাদের নিজের সংস্থা বিআরওইউকে। প্রক্রিয়াটি সবে মাত্র শুরু হয়েছে, তবে আমরা আশা করি যে শেষ পর্যন্ত মিন অং হ্লাইং এবং তার সহযোগীরা আদালতে তাদের অপরাধের জন্য কৈফিয়ত দেবে।

এইটাও উৎসাহদায়ক যে, মিয়ানমারের অনেক বেসামরিক নেতা সামরিক অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনার যে কোন প্রচেষ্টাকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। কিন্তু এখন তারা জবাবদিহির আওতায় আনার প্রয়োজনীয়তা দেখছেন। অভ্যুত্থানের পর প্রতিষ্ঠিত জাতীয় ঐক্য সরকার বলেছে, তারা আন্তর্জাতিক বিচার ব্যবস্থায় সহযোগিতা করবে। দিন দিন সামরিক নেতৃত্ব জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে, ফলে তাদের মনোবল দুর্বল হয়ে যাচ্ছে।গত ডিসেম্বরে গণমাধ্যমে একটি তথ্য ফাঁস হয়ে যায়, যেখানে সামরিক নেতৃত্ব তাদের কোনো কর্মীকে আন্তর্জাতিক বিচার সংস্থা বা আর্জেন্টাইন ফেডারেল কোর্টের চিঠির জবাব না দেওয়ার ব্যাপারে সতর্ক করে দেয়।

ন্যায়বিচারের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আরও অনেক কিছু করতে পারে এবং অবশ্যই করতে হবে। চীন মিয়ানমারের বিষয়ে ভেটো প্রস্তাব অব্যাহত রাখার কারণে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ বছরের পর বছর ধরে অচলাবস্থায় রয়েছে। জাতিসংঘের সদস্যদের অবশ্যই রাজনীতিকে জনগণের জীবনের ঊর্ধ্বে রাখা বন্ধ করতে হবে। কানাডা ও নেদারল্যান্ডসের মত আইসিজেতে গাম্বিয়ার করা মামলায় সমর্থন করা। জাতিসংঘের নিজস্ব মানবাধিকার বিশেষজ্ঞদের দ্বারাও মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্তে উৎসাহিত করা। সম্প্রতি জার্মানিতে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে সিরিয়ার এক কর্মকর্তাকে দোষী সাব্যস্ত করার ঘটনা প্রমাণ করে যে, এটি এমন একটি প্রক্রিয়া যা ন্যায়বিচার আনতে পারে।

এক বছর আগে, তাতমাদো একটি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে মিয়ানমারকে সংকটের মধ্যে ফেলে দেয়, তার জনগণের বিরুদ্ধে কয়েক দশক ধরে চলা সন্ত্রাস অব্যাহত রাখে। বিশ্বকে এখন তাতমাদোকে দেখাতে হবে যে তারা তাদের অপরাধের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ, এবং যারা দায়ী তাদের জন্য লুকানোর জায়গা নেই। মিয়ানমারের জনগণ দীর্ঘদিন ধরে ভুগছে। তাদেরকে ন্যায়বিচার পাইয়ে দিয়ে হবে।

Advertisements