পরিবহন ধর্মঘট আহ্বানকারীরা আওয়ামী লীগ নেতা
Advertisements

বরিশালে আগামী ৫ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হবে বিএনপির বিভাগীয় গণসমাবেশ। এর আগের দিন ৪ নভেম্বর থেকে ৪৮ ঘণ্টার বাস ধর্মঘট ডেকেছে স্থানীয় বাস মালিকদের দুটি সংগঠন। একই সময়ে বরিশালের থ্রি-হুইলার মালিক ও শ্রমিক সমিতিও দিয়েছে ধর্মঘটের ডাক। এসব সংগঠনের শীর্ষ পদে থাকা সবাই আওয়ামী লীগ নেতা। ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন পর্যায়ে এদের রয়েছে সাংগঠনিক নানা পদ-পদবি। ধর্মঘট প্রশ্নে শুরু থেকেই বিএনপি ক্ষমতাসীন দলকে দায়ী করে এলেও তা অস্বীকার করে আসছে আওয়ামী লীগ। এদিকে পরিবহণ সংগঠনগুলোর নেতৃত্বে থেকে ধর্মঘট আহবান করা আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, ‘রাজনীতি আর পেশাগত সংগঠন পরিচালনা এক নয়। রাজনীতি রাজনীতির জায়গা আর রুটি-রুজি জায়গা এক নয়। এই দুটোকে মেলানো ঠিক নয়। আমরা ধর্মঘট ডেকেছি আমাদের পেশাগত জায়গা থেকে। রাজনীতি কোনোভাবেই আমাদের পেশা নয়।’

এদিকে লঞ্চ মালিক সমিতির নেতারাও বলছেন, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে যে কোনো সময় তারাও যেতে পারেন ধর্মঘটে। সমাবেশে জনসমাগম ঠেকাতে ক্ষমতাসীন দলের নেপথ্য নির্দেশনায় এসব ধর্মঘট ডাকা হয়েছে বলে আগাগোড়া দাবি করে আসছে বিএনপি। এর উত্তরে আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, বিএনপির এই সমাবেশ নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। ধর্মঘট প্রশ্নেও তাদের বক্তব্য পরিষ্কার। পরিবহণ মালিক ও শ্রমিকরা তাদের পেশাগত জায়গা থেকে ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে বলছেন তারা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে ক্ষমতাসীন দল সরাসরি এসব ধর্মঘটের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট না থাকলেও যারা ধর্মঘট ডেকেছেন তাদের প্রায় সবাই আওয়ামী লীগের। দলের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদের দায়িত্বেও রয়েছেন তারা।

৪ ও ৫ নভেম্বর বাস চলাচল বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছেন বরিশাল-পটুয়াখালী মিনিবাস মালিক সমিতি। মহাসড়কে অবৈধ থ্রি-হুইলার চলাচল বন্ধের দাবিতে এই ধর্মঘট ডেকেছে তারা। ইতোমধ্যে ধর্মঘটের ব্যাপারে চিঠি দেওয়া হয়েছে জেলা ও বিভাগীয় প্রশাসনকে। আলোচ্য এই মালিক সমিতির সভাপতি মোমিনউদ্দিন কালু যুবলীগের মহানগর কমিটির সদস্য। এক সময় প্রয়াত মেয়র আওয়ামী লীগ নেতা শওকত হোসেন হিরনের ঘনিষ্ঠ সহচর কালু এখন আছেন বর্তমান সিটি মেয়র মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহর সাহচর্যে। এই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক কাওসার হোসেন শিপন বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের শ্রমবিষয়ক সম্পাদক। একই সময়ে ধর্মঘট ডাকা থ্রি-হুইলার মালিক এবং শ্রমিক ইউনিয়নও চালান ক্ষমতাসীন দলের পদধারী নেতারা। মালিক সমিতির সভাপতি আহম্মেদ শাহরিয়ার বাবু বরিশাল সদর উপজেলার রায়পাশা কড়াপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এবং ওই ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। থ্রি-হুইলার শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি কামাল হোসেন লিটন মোল্লা সদর উপজেলার কাশীপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এবং ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি। এই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক পরিমল চন্দ্র দাস পালন করছেন মহানগর শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব।

৪ ও ৫ নভেম্বর ধর্মঘট ডাকা বাস মালিকদের আরেক সংগঠন বরিশাল জেলা বাস মালিক গ্রুপের সভাপতি গোলাম মাশরেক বাবলু এবং সাধারণ সম্পাদক কিশোর কুমার দে-ও আওয়ামী ঘরানার। এদের এই কমিটি অনুমোদন প্রশ্নে সুপারিশ করেছিলেন বরিশালের সিটি মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ। কেবল এটিই নয়, বরিশাল বিভাগের ৬ জেলার বাস মালিকদের নিয়ে গঠিত সংগঠন ‘বরিশাল বিভাগীয় আঞ্চলিক সড়ক পরিবহণ মালিক ফেডারেশন’র সাংগঠনিক সম্পাদক এবং ‘বরিশাল বিভাগীয় আঞ্চলিক সড়ক পরিবহণ মালিক ও শ্রমিক ঐক্য ফেডারেশন’র যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে আছেন এই কিশোর কুমার। আর এই দুটি সংগঠনেরই সভাপতি বরিশালের সিটি মেয়র মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ। এ তো গেল সড়ক সেক্টরের কথা। ধারণা করা হচ্ছে যে, বিএনপির গণসমাবেশের আগের দিন থেকে বাস এবং থ্রি-হুইলারের মতো লঞ্চ চলাচলও বন্ধ হয়ে যাবে বরিশালে। এর আভাসও দিয়েছে লঞ্চ মালিক সমিতি। বরিশাল জেলা লঞ্চ মালিক সমিতির যুগ্ম আহ্বায়ক সাইদুর রহমান রিন্টু বলেছেন, ‘জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি ও যাত্রী সংকটের কারণে প্রতিদিন বিপুল লোকসান দিচ্ছে লঞ্চ। এই পরিস্থিতিতে যে কোনো সময় লঞ্চ চালানো বন্ধ করে দিতে পারি আমরা।’

পরিচয় গোপন রাখার শর্তে লঞ্চ সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে, রিন্টু সাহেবের বলা এই ইস্যু দেখিয়েই বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশের আগের দিন থেকে পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টা লঞ্চ চালানো বন্ধ রাখবে মালিক সমিতি। এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক কোনো ঘোষণা না দিলেও দু-একদিনের মধ্যে বিষয়টি প্রশাসনসহ গণমাধ্যমকে লিখিতভাবে জানাবে তারা। আলোচ্য এই লঞ্চ মালিক সমিতির যুগ্ম আহবায়ক সাইদুর রহমান রিন্টু বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি এবং বরিশাল সদর উপজেলার চেয়ারম্যান। আওয়ামী লীগ দলীয় মনোনয়নে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন তিনি। এই সংগঠনের আহবায়ক মাহবুবউদ্দিন আহম্মেদ বীরবিক্রমও একজন প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা। বরিশাল সদর আসনে আওয়ামী লীগ দলীয় মনোনয়নে একাধিকবার সংসদ সদস্য পদে নির্বাচন করেছেন তিনি। যদিও কোনোবারই জয়ী হতে পারেননি। দলীয় মনোনয়নে ঢাকার মুন্সীগঞ্জেও নৌকা প্রতীকে সংসদ নির্বাচন করার ইতিহাস রয়েছে তার।

বরিশাল বিভাগের দায়িত্বে থাকা বিএনপির কেন্দ্রীয় সহসাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবুল হক নান্নু বলেন, ‘আমরা তো আগাগোড়াই বলে আসছি ধর্মঘটের পেছনে রয়েছে ক্ষমতাসীন দল। এসব সংগঠন চলে আওয়ামী লীগের ইচ্ছা-অনিচ্ছায়। সভাপতি-সম্পাদক পদে নিজেদের লোক বসিয়েছে তারা। বিএনপির সমাবেশে লোকসমাগম ঠেকাতে আজ তারা ধর্মঘট ডাকছে। কিন্তু এতে লাভ হবে না। সমাবেশ জনসমুদ্রে পরিণত হবে।’

বিএনপি নেতাদের অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে বরিশাল-পটুয়াখালী মিনিবাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক কাওসার হোসেন শিপন বলেন, ‘বাস মালিকদের মধ্যে তো বিএনপি নেতারাও আছেন। রাজনীতির সঙ্গে পেশাজীবী সংগঠনকে জড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। মহাসড়কে থ্রি-হুইলার চলাচলের কারণে দুর্ঘটনা বাড়ছে। আমাদের লোকসান হচ্ছে। এই কারণে থ্রি-হুইলার বন্ধের দাবিতে ধর্মঘট ডেকেছি। এর সঙ্গে বিএনপির সমাবেশের কোনো সম্পর্ক নেই। রাজনীতি আর রুটি-রুজিকে এক করবেন না।’

বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অ্যাড. একেএম জাহাঙ্গীর বলেন, ‘সরকারি আদেশ-নির্দেশ পছন্দ না হলে সারা দেশে বাস-ট্রাক বন্ধ করে দেয় পরিবহণ মালিক এবং শ্রমিকরা। এমন ঘটনা বহুবার ঘটেছে। তখনো কি আওয়ামী লীগ তা বন্ধ করে? পরিবহণ সেক্টর তাদের নিজেদের লাভ-লোকসান বুঝে চলে। এক্ষেত্রে স্বার্থে টান পড়লে তারা কারও কথা শোনে না। বরিশালের ক্ষেত্রেও তাই হচ্ছে। এই ধর্মঘটের সঙ্গে আওয়ামী লীগের কোনো সম্পর্ক নেই। বাস মালিক সমিতিতে বিএনপি-আওয়ামী লীগ-জাতীয় পার্টি সব দলের নেতারা রয়েছেন। তারা তাদের দাবি আদায়ে ধর্মঘট ডেকেছে। এর সঙ্গে আওয়ামী লীগকে জড়ানোর সুযোগ নেই। জনসমাবেশে লোক জড়ো করতে পারবে না বুঝে এসব কথা বলে অগ্রিম ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা করছে বিএনপি।’

সূত্রঃ যুগান্তর

Advertisements