ভূমধ্যসাগরে নিজেদের দাবী নিয়ে বর্তমানে তুরস্ক আর গ্রীস এর বিরোধ চরমে পৌঁছেছে। কিন্তু বর্তমান বিরোধ নিয়ে তিনটা কথা বলার আগে তাদের অতীত বিরোধ নিয়ে দুটো কথা বলা প্রয়োজন।
উসমানিয়া ( অটোম্যান ) সাম্রাজ্য কেনো ভেঙেছিল, কাদের মদদে ভেঙেছিল আমি সেই আলোচনায় যাচ্ছি না। কেবল আলোকপাত করতে চাচ্ছি যে ১৯১৮ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে মিত্র শক্তির প্রধান অবজেক্টিভ ছিল উসমানিয়া সাম্রাজ্য ভেঙ্গে নিজেদের মাঝে ভাগবাটোয়ারা করে নেয়া। সেই সময় দুর্বল উসমানিয়াদের সাথে মিত্র বাহিনীর কিছু চুক্তি হয়, সেই সব চুক্তির বলে মিত্র বাহিনী সাম্রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় ঘাটি গাড়ে।
এই লক্ষ্যে সর্ব প্রথম ফ্রেঞ্চ বাহিনী ইস্তাম্বুলে সেনা সামন্ত নিয়ে ঢুকে পড়ে, এর পর আসে ব্রিটিশ, গ্রীক, ইতালি, আমেরিকা…। গ্রীকরা এই সুযোগে ফের তাদের হারানো রাজ্য ফিরে পেতে ঝাপিয়ে পড়ে। এরপরের কাহিনী হচ্ছে কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্বে তুরস্কের স্বাধীনতার যুদ্ধ , যেই যুদ্ধের পরাজিত হয় মিত্র বাহিনী আর জন্ম হয় স্বাধীন রাষ্ট্র রিপাবলিক অফ তুরস্ক। কিন্তু তুরস্ককে ছেড়ে দিতে হয় অনেক জায়গা, সেই সময় তারা হারায় এজিয়ান আর ভূমধ্যসাগরের নানান দ্বিপ দ্বীপান্তর যেসব হয়ে পরে গ্রীসের অংশ। এই লক্ষ্যে দুইটা ম্যাপ দিলাম। প্রথম ম্যাপ ১৯২০ সালের উসমানিয়া সাম্রাজ্যের একদম শেষের দিকের আর দ্বিতীয় ম্যাপ বর্তমানের।
আরেকটি ব্যাপার উল্লেখ করতে চাই, তা হচ্ছে রাশিয়ার কারনে সাইপ্রাস তুরস্কের হাতছাড়া হয়ে যায়। ব্রিটিশদের সহযোগিতার আশায় সাইপ্রাস ব্রিটিশদের লিজ দিলেও ব্রিটেন কখনই তা তুরস্ককে ফেরত দেয় নাই। পরে সাইপ্রাসের একাংশ তুরস্ক জোর করে দখলে নেয়।
উসমানিয়া সাম্রাজ্যকে যারা এক সময় ভাগ করে নিতে চেয়েছিল তারা এরপর আর কোন কালেই চায় নাই তুরস্ক ফের শক্তিশালী কোন রাষ্ট্রে পরিনত হোক। তুরস্ক শক্তিশালী হলে তারা যে নিজেদের দাবী নিয়ে বিশ্বমঞ্চে ফের আবির্ভাব হবে তা তারা জানে। এক ইরান কি কম জ্বালাচ্ছে, তার উপর এখন গোদের উপর বিষ ফোড়া এরদোয়ান।
কিন্তু ভূমধ্যসাগরের সীমানা তুরস্কের জন্য নতুন কোন ইস্যু নয়। এখানে ইউএনসিএলওএস বা আনক্লস মেনে ভুমধ্যসাগরে যে সীমানাজেগ্তারিস দাবী করছে আর পশ্তেচিম মেনে নিচ্ছে তাতে গ্রীসের কেবল মুল ভুখন্ড নয়, একই সাথে গ্রীসের প্রীতিটি দ্বিপের চারিদিকেও তাদেরকে ম্যাক্সিমাম সমুদ্র দেয়া হয়েছে সেখানে তুরস্ককে না ইকুইডিস্টেন্ট না ইকুইটির ভাগ দেয়া হয়েছে। তুরস্কের সবচেয়ে বড় মুল ভূখণ্ডের সিমানা থাকা সবতবেও তাদের চরম ভাবে অপমান আর অবহেলা করা হয়েছে। এসব কারনে তুরস্ক কখনই ইউএনসিএলওএস এর সিগনেটরি দেশ হয়নি। তারা কখনই গ্রীসকে দেয়া সমুদ্র সীমানা মেনে নেয় নাই।
আনক্লসে গ্রীসের সমুদ্র সীমা তুরস্কের সাথে গ্রীসের করা লুইজান চুক্তির বরখেলাপ। এই সুত্রে তৃতীয় ম্যাপ উল্লেখ্য। যেখানে দেখা যাচ্ছে কিভাবে তুরস্ককে ভুমধ্যসাগরে চেপে রাখা হয়েছে। কেবল এরদোয়ান কেনো, তুরস্কের কোন সরকার এই সীমানা অতীতেও মানে নাই, ভবিষ্যতেও শান্তিপূর্ণ ভাবে মানবে না। কারন তুরস্কের মুল ভূখণ্ডের এতো বড় কোস্টাল লাইন থাকতে এতো কম সমুদ্র সম্পদের ভাগ পাওয়া তুরস্কের চোখে অত্যন্ত অন্যায্য।
পাঠকের জানার সুবিধার্তে বলছি সমুদ্রে যার সীমানা যতটুকু সেই সেই অঞ্চলের মাছ থেকে শুরু করে, হাইড্রোকার্বনের (তেল, গ্যাস) মালিক। সমুদ্র সীমা ইস্যু এরদোয়ানের একক ইস্যু নয়, বরং এটা বহুত আগে থেকে তুরস্কের জাতীয় ইস্যু। অবশেষে এখন যখন তুরস্ক সামরিক দিক দিয়ে শক্তিশালী হয়ে একক শক্তি হিসাবে বিশ্ব মঞ্চে আসার সাহস পেয়েছে তখন তারা ন্যায্যতার দাবীতে ভুমধ্যসাগরে তাদের সীমানা নির্ধারণ করতে নেমেছে। তার লিবিয়ার সাথে নতুন করে চুক্তি করে তাদের সাথে লিবিয়া পর্যন্ত এক্সক্লুসিভ ইকোনোমিক জোন টেনেছে। এই বিষয়ে ম্যাপ ৪ দৃষ্টব্য। ইয়োরোপ যাকে ইলিগ্যাল বলছে, কিন্তু সাহস করছে না ধাক্কা দিয়ে তুরস্ককে সরাতে, কারন তারাও জানে আগে যেভাবে গ্রীসকে সমুদ্র দেয়া হয়েছে তা ন্যায্য হয় নাই। আর এটাই লিবিয়ায় জাতিসংঘ সমর্থিত সেরাজ সরকারকে তুরস্কের সাপোর্টের প্রধান কারন।
তুরস্ককে যতই অর্থনৈতিক ভাবে কোণঠাসা করে দুর্বল করার, কিংবা ক্যু করে সরকার পতন করার চেষ্টা করা, অথবা অপপ্রচারে এরদোয়ানকে অথোরোটোরিয়ান শাসক হিসাবে দেখানো হউক না কেন, ভিতরে ভিতরে তুরস্ক এখন বেশ শক্তিশালি দেশ। যদিও তুর্কি লিরার অধঃপতন হচ্ছে দিনকে দিন। এটাও পশ্চিম ইচ্ছা করেই করছে যাতে এরদোয়ান নতজানু হয়। কিন্তু এরদোয়ান কিছুতেই মানছে না, বিশ্বব্যাংকের সাহায্য নিবে না বলে এডামেন্ট স্ট্যান্ড নিয়েছে। কিন্তু যতই তুরস্ককে দুর্বল বলা হোক না কেনো, তুরস্ক শক্তিশালী না হলে একক ভাবে নিজেদের জাতীয় স্বার্থে ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া, এই তিন ফ্রন্টে সেনা নামিয়ে মাঠ দখলে রাখা চাট্টিখানি কথা নয়। এই মুহূর্তে শান্তি আর ন্যাশনাল চুক্তিতে তুর্কি সেনা মোতায়েন করা আছে আফগানিস্তান, আযারবাইজান, কাতার, আর সোমালিয়ায়। তুরস্ক কেবল সেনা পাঠিয়ে থেমে যাচ্ছে না, সেখানে স্কুল কলেজ, হাসপাতাল ,বিদ্যুতকেন্দ্র, কমার্শিয়াল জোন, রেসিডেনশিয়াল জোন তৈরি করে লোকাল মানুষের হার্ট আর মাইন্ড জেতার চেষ্টা করছে, যাতে তারা সফল হচ্ছে।
বর্তমানে ভূমধ্যসাগরে সমুদ্রসীমা সীমানা নির্ধারণ এবং সেখানে হাইড্রোকার্বন সম্পদ অনুসন্ধানের অধিকার নিয়ে তুরস্ক ও গ্রিসের মতবিরোধ চরমে পৌঁছেছে। গ্রীসকে সরাসরি মদদ দিচ্ছে ফ্রান্স আর আরব আমিরাত। আমেরিকাও এই সুযোগে সাইপ্রাসের উপর থেকে অস্ত্র বিক্রির নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে। দুই পয়সা কামাই আর পুরাতন শত্রুকে কাবু করার এই সুযোগ আমেরিকাও হাতছাড়া করছে না। তুরস্ক থেকে মাত্র দুই কিলোমিটার দুরের এক গ্রীক দ্বিপে চুক্তি ভঙ্গ করে গ্রীস সেনা মোতায়েন করেছে। আর তুরস্ক গতকাল থেকে তুর্কি সাইপ্রাসের সাথে মিলে তাদের বার্ষিক মিলিটারি এক্সারসাইজ শুরু করেছে। ফ্রান্স ঘোষণা দিয়েছে তারা গ্রীক সাইপ্রাসে ন্যাভাল ঘাটি বসাবে।
তুরস্কের নৌবাহিনী ভূমধ্যসাগর এবং এজিয়ান সমুদ্রে টহল দিচ্ছে । পাল্টাপাল্টি টহল দিচ্ছে ফ্রান্সের সহায়তায় গ্রীস। কিন্তু তুরস্ক এখন পর্যন্ত কারো ভয়ে পিছাচ্ছেনা তাদের কোন ফ্রন্ট থেকে। ভুমধ্যসাগরে তুরস্কের আছে সবচেয়ে বড় সীমানা, কিন্তু গ্রীসের ছোটছোট দ্বীপ গুলোকে দেয়া হয়েছে অনেক বেশী সমুদ্র যা এমনকি ব্রিটেন পর্যন্ত অন্য জায়গায় নিজেদের দ্বীপ নিয়ে দাবী করে নাই বা পায় নাই। সে জন্যই এরদোয়ান বলেছেন, ” ভূমধ্যসাগরে আমাদের দাবী থেকে আমরা পিছিয়ে আসব না’।
গ্রীসের সাথে তুরস্ক দ্বিপাক্ষিক আলোচনার জন্য আহ্বান করেছে, ইইউ আর ন্যাটর মধ্যস্ততায় তুরস্ক আলোচনায় এসেছে, কিন্তু ফ্রান্স আর আমিরাতের উস্কানিতে গ্রীস আলোচনায় এক পা আগায় তো দুই পা পিছায়। তবে আলোচনার মাধ্যমে সুরাহা না করে তাদের উপায় নাই। এখানে কোন দেশই অর্থনৈতিক ভাবে দীর্ঘ যুদ্ধ চালানোর অবস্থায় নাই।