টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিয়ে বৈশ্বিক আলোচনার কেন্দ্রে স্থান পাচ্ছে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা। জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি গড়ে তুলতে প্রযুক্তি ও পেশাগত দক্ষতাসম্পন্ন মানুষের চাহিদা ব্যাপক হারে বাড়ছে। এক্ষেত্রে ডক্টরাল গবেষণাকে গুরুত্ব দিয়ে আসছে উন্নত অর্থনীতির দেশগুলো। এর কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, ডক্টর অব ফিলোসফি (পিএইচডি) বা সমমানের গবেষণায় জ্ঞানের গভীরতার পাশাপাশি তার প্রায়োগিক দক্ষতা অর্জন করতে হয়। ফলে পিএইচডি গবেষকরা সামাজিক রূপান্তরে বড় প্রভাব রাখতে পারেন।
পিএইচডি বা সমমানের গবেষণার ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী বিজ্ঞান, প্রকৌশল, প্রযুক্তি, চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিষয়গুলোই প্রাধান্য পেয়ে আসছে। বাংলাদেশেও সংখ্যাতাত্ত্বিক বিচারে পিএইচডি গবেষকের সংখ্যা বাড়ছে। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি গবেষণায় বিজ্ঞান বা প্রকৌশল নয়, গুরুত্ব পাচ্ছে কলা ও সামাজিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়। গত এক দশকে বিশ্ববিদ্যালয়টি থেকে দেয়া পিএইচডি গবেষণায় সবচেয়ে এগিয়ে ইসলামিক স্টাডিজ, বাংলা ও আরবি বিভাগ।
জার্মান তথ্য সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান স্ট্যাটিস্টার তথ্যমতে, ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষে যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে পিএইচডি ও সমমানের ডিগ্রি দেয়া হয়েছে ১ লাখ ৮৭ হাজার ৫৬৮টি। এর মধ্যে ৮২ হাজার ৮৯৫টি ডক্টরেট ডিগ্রিই দেয়া হয়েছে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বিষয়ে গবেষণার জন্য। যা দেশটিতে ওই শিক্ষাবর্ষে দেয়া মোট ডক্টরেট ডিগ্রির ৪৪ শতাংশ। একই শিক্ষাবর্ষে লিগ্যাল প্রফেশনস অ্যান্ড স্টাডিজ বিষয়ে পিএইচডি বা সমমানের ডিগ্রি পেয়েছেন ৩৪ হাজার ৩৮৭ জন। আইন বিষয়ে পিএইচডির এ সংখ্যা মোট ডক্টরেট ডিগ্রির ১৮ শতাংশ। দেশটিতে ওই সময়ে শিক্ষা বিষয়ে গবেষণার জন্য পিএইচডি ডিগ্রি দেয়া হয়েছে ১৩ হাজার ২০ জনকে, যা মোট ডিগ্রির ৭ শতাংশ। একই প্রবণতা দেখা যায় যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পিএইচডি গবেষণার ক্ষেত্রে।
তবে পিএইচডি গবেষণায় সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র দেখা যাচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০১০-১১ থেকে ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষ—এক দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মোট ৭৫৩ জনকে পিএইচডি ডিগ্রি দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে কলা অনুষদে দেয়া হয়েছে ২৮৮টি পিএইচডি, যা অনুষদভিত্তিক হিসাবে সর্বোচ্চ। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা জীববিজ্ঞান অনুষদ থেকে পিএইচডি ডিগ্রি দেয়া হয়েছে ১৩৭ জনকে। আর সামাজিক বিজ্ঞানে গবেষণার জন্য পিএইচডি ডিগ্রি দেয়া হয়েছে ৯২ জনকে। একই সময়ে ব্যবসায় শিক্ষায় ৬৭, বিজ্ঞানে ৪০, প্রকৌশলে ২৬, ফার্মেসিতে ১৯ ও মেডিকেল অনুষদে ১৪ জনকে পিএইচডি ডিগ্রি দেয়া হয়েছে। এর বাইরে আইনে নয়জন, পরিবেশ বিজ্ঞানে ছয় ও চারুকলা অনুষদ থেকে চারজন পিএইচডি ডিগ্রি পেয়েছেন।
বিভাগভিত্তিক হিসেবে পিএইচডি ডিগ্রি দেয়ার ক্ষেত্রেও শীর্ষ তিন বিভাগই কলা অনুষদের। ২০১০-১১ থেকে ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষ—এক দশকে সবচেয়ে বেশি পিএইচডি ডিগ্রি দেয়া হয়েছে ইসলামিক স্টাডিজে। এ বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি দেয়া হয়েছে ৮১ জন গবেষককে, যা এক দশকে বিশ্ববিদ্যালয়টি থেকে দেয়া পিএইচডি ডিগ্রির ১০ শতাংশের বেশি। পরের অবস্থানে থাকা বাংলা বিভাগ থেকে পিএইচডি ডিগ্রি পেয়েছেন ৬৬ জন। আরবি বিষয়ে গবেষণার জন্য পিএইচডি ডিগ্রি দেয়া হয়েছে ৪৩ জনকে। একই সময়ে প্রাণিবিদ্যায় ৩৭, মার্কেটিংয়ে ৩১, উদ্ভিদবিজ্ঞানে ২৯ ও অণুজীববিজ্ঞানে ২৭ জন গবেষককে পিএইচডি ডিগ্রি দেয়া হয়েছে। এর বাইরে মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশে ১৬, প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণবিজ্ঞানে ১৫ ও লোকপ্রশাসনে ১৪ জন পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেছেন।
উন্নত দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেখানে বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, প্রকৌশল কিংবা স্বাস্থ্য-চিকিৎসায় সবচেয়ে বেশি পিএইচডি ডিগ্রি দিচ্ছে, সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিন্ন চিত্র কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান বলেন, বিজ্ঞান কিংবা প্রকৌশলের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোয় পিএইচডি ডিগ্রি কম থাকার প্রধান কারণ আর্থিক। বিজ্ঞান ও প্রকৌশলের শিক্ষকরা অর্থ উপার্জনের জন্য বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে খণ্ডকালীন চাকরি করেন। এ কারণে গবেষণার জন্য তাদের হাতে সময় অনেক কম। অন্যদিকে কলা অনুষদের শিক্ষকদের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজের সুযোগ সেই অর্থে নেই। সেজন্য তারা পিএইচডি শিক্ষার্থী নেন, যাতে সেখান থেকে কিছু অর্থ উপার্জন হয়। গবেষণা তত্ত্বাবধানে ভাতার পরিমাণ কম হওয়ায় বিজ্ঞানের শিক্ষকরা পিএইচডি শিক্ষার্থী নেয়ার ক্ষেত্রে আগ্রহী নন।
তিনি বলেন, ‘‘বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডির যে পরিসংখ্যান, এটা নিছক সংখ্যা ছাড়া আর কিছু নয়। মান বিবেচনায় এর সিংহভাগ পিএইচডির কাতারেই পড়ে না। নিবিড় গবেষণার জন্য চাকরি থেকে ছুটি নিয়ে পিএইচডি করতে হয়। আমাদের এখানে দেখি চাকরিও করছে, আবার পিএইচডিও করছে। এগুলো গবেষণা নয়; নামের আগে ড. বসানোর উপায়।”
গুণগত মানের পিএইচডি গবেষণার জন্য আগে শিক্ষকদের বেতন-ভাতা বাড়ানো প্রয়োজন উল্লেখ করে ড. কামরুল হাসান বলেন, ভারতে একজন অধ্যাপক মাসে আড়াই লাখ টাকার মতো বেতন পান। একজন পিএইচডি গবেষক মাসে ৫০ হাজার টাকার ফেলোশিপ পান। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় পিএইচডি গবেষক ও তাদের পরিবারের জন্য উন্নত আবাসন সুবিধা রয়েছে। সেখানে আমাদের অবস্থান কোথায়? সত্যিকারার্থে ভালো মানের গবেষণা করতে হলে বিশ্ববিদ্যালয়ে শক্তিশালী ও পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধাসংবলিত পিএইচডি প্রোগ্রাম চালু করতে হবে।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, কয়েক দশক ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি ডিগ্রি প্রদানের হার বাড়ছে। ১৯৯০-৯১ শিক্ষাবর্ষে নেতৃস্থানীয় উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি থেকে দেয়া পিএইচডি ডিগ্রির সংখ্যা ছিল ২২। এর এক দশক পর ২০০০-০১ শিক্ষাবর্ষে সেটি বেড়ে দাঁড়ায় ৩০টিতে। আর ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি দেয়া হয় ৭৩ জনকে। ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষে এসে পিএইচডি ডিগ্রির সংখ্যা কিছুটা কমে ৬৩ হলেও এর আগের কয়েক বছর সেটি অনেক বেশি ছিল। এ সংখ্যা ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষে ৯৯ ও ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষে ৮৬ ছিল।
পিএইচডি গবেষণার ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগগুলোর মতো একই চিত্র এর ইনস্টিটিউটগুলোতেও। উচ্চশিক্ষায় ইনস্টিটিউটের ধারণা এসেছে মূলত বিশেষায়িত গবেষণা ও প্রশিক্ষণের জন্য। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়টির ইনস্টিটিউটগুলো পরিচালিত হচ্ছে অনেকটা বিভাগের মতো করেই। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে পাঠদান নিয়েই ব্যস্ত থাকছেন সেখানকার শিক্ষকরা। এতে ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্য অর্জিত হচ্ছে না। পরিসংখ্যান বলছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউটগুলোয় পিএইচডি গবেষণার হার খুবই কম। ২০১০-১১ থেকে ২০১৯-২০—এই ১০ শিক্ষাবর্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউটগুলো থেকে পিএইচডি ডিগ্রি পেয়েছেন মাত্র ৫১ জন গবেষক। এর মধ্যে সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইআর) থেকে ১২টি করে পিএইচডি ডিগ্রি দেয়া হয়েছে। এর বাইরে পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞানে আট, ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটে (আইবিএ) সাত, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় ছয়, স্বাস্থ্য অর্থনীতিতে তিন, পরিসংখ্যানে দুই ও আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের (আইএমএল) অধীনে একজন গবেষককে পিএইচডি ডিগ্রি দেয়া হয়েছে।
বছরভিত্তিক বিবেচনায় ডিগ্রির সংখ্যা বাড়লেও গবেষণার মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে বলে মনে করেন উচ্চশিক্ষা-সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, পিএইচডি ডিগ্রি বৃদ্ধির সংখ্যাগত এ চিত্র দিয়ে গবেষণার উন্নয়ন ঘটেছে, এটা দাবি করার সুযোগ নেই। কারণ পিএইচডি গবেষণার মাধ্যমে যে প্রভাব ও সাফল্য আসার কথা, সেটি দৃশ্যমান নয়। যখন একটি পিএইচডি গবেষণার নিবন্ধ মানসম্মত ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর ও পিআর রিভিউড জার্নালে প্রকাশিত হয়, তখন আন্তর্জাতিকভাবে এর স্বীকৃতি মেলে। সাইটেশন, ডিজিটাল অবজেক্ট আইডেন্টিফায়ারসহ (ডিওআই) বিভিন্ন ইনডেক্সে এর প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের অন্যান্য উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেসব পিএইচডি গবেষণা হচ্ছে, তার উল্লেখযোগ্যসংখ্যক অভিসন্দর্ভই আন্তর্জাতিক মানসম্মত জার্নালে প্রকাশিত হয় না।
এছাড়া চৌর্যবৃত্তির অভিযোগও রয়েছে অনেক গবেষকের বিরুদ্ধে। ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগ থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন ওই বিভাগেরই শিক্ষক আবুল কালাম লুত্ফুল কবির। যদিও ডিগ্রি পাওয়ার কয়েক বছর পর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থীর একটি প্রকাশিত গবেষণা অভিসন্দর্ভ থেকে ৯৮ শতাংশ হুবহু নকল করে নিজের অভিসন্দর্ভে ব্যবহার করার অভিযোগ ওঠে। এ বিষয়ে গঠিত তদন্ত কমিটি অভিযোগের প্রমাণও পেয়েছে।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামাল বলেন, বিজ্ঞান, প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিষয়ে উচ্চতর গবেষণায় আগ্রহীদের জন্য উন্নত বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় স্কলারশিপসহ নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। তাই এসব বিষয়ে আগ্রহী শিক্ষার্থীদের বেশির ভাগই গবেষণার জন্য বিদেশে পাড়ি জমান। এজন্য বিজ্ঞান-প্রকৌশলে আমরা পিএইচডি গবেষক অনেক কম পাই। অন্যদিকে উন্নত বিশ্বের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় কলা অনুষদের শিক্ষার্থীদের জন্য সুযোগ-সুবিধা তুলনামূলকভাবে অনেক কম। তাই এসব বিষয়ে গবেষক ও ডিগ্রির সংখ্যাও বেশি।
মান ও চৌর্যবৃত্তি বিষয়ে দুর্যোগ বিজ্ঞানের এ অধ্যাপক বলেন, এটা সত্য যে যেসব পিএইচডি গবেষণা হচ্ছে, তার খুব কমসংখ্যক অভিসন্দর্ভই আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হচ্ছে। এজন্য উচ্চশিক্ষায় জ্ঞান সৃষ্টির যে লক্ষ্য রয়েছে, আমরা সেটি অর্জন করতে পাচ্ছি না। আর গবেষণায় চৌর্যবৃত্তি ঠেকাতে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। দ্রুততম সময়ের মধ্যে সেটি চূড়ান্ত করা হবে।
সূত্রঃ বণিক বার্তা