বাংলাদেশে ইকবালের প্রাসঙ্গিকতা
Advertisements

“Nations are born in the hearts of poets; they prosper and die in the hands of politicians.” — Allama Muhammad Iqbal [১]

১. উপমহাদেশ ও মুসলিম বিশ্বের প্রেক্ষিতে ইকবালের মনীষা

আল্লামা মুহাম্মদ ইকবাল ছিলেন একাধারে একজন প্রথম শ্রেণির কবি ও দার্শনিক। ফারসি ও উর্দু — দুটি প্রধান ভাষায় তিনি তার কাব্য সাধনা করেছেন। এ কারণে তিনি আধুনিক যুগে মুসলিম নবজাগরণের কবি ও দার্শনিক হিশেবে উপমহাদেশ, ইরান ও তুর্কী অঞ্চলে সমধিক পরিচিতি লাভ করেছেন। তার এই অবস্থান, সম্মান ও পরিচিতি অনন্য ও অদ্বিতীয়। এক্ষেত্রে তিনি মধ্যযুগের চিরন্তন মরমী সুফী কবি জালালউদ্দীন রুমীর আধুনিক কালের উত্তরসূরি।

এছাড়া তিনি ছিলেন একজন রাজনীতিবিদ এবং রাষ্ট্রচিন্তক। তিনি ব্রিটিশ উপনিবেশকালের শেষার্ধে স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে উপমহাদেশের মুসলিমদের জন্য একটি স্বতন্ত্র আত্মপরিচয় নির্মাণ করেছিলেন। এই স্বতন্ত্র আত্মপরিচয়ের ভিত্তিতে একটি স্বাধীন ও স্বতন্ত্র মুসলিম রাষ্ট্র নির্মাণের স্বপ্নদ্রষ্টাও তিনিই ছিলেন। এই স্বপ্নের বাস্তবায়ন হয়েছিল ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। ১৯৭১ এর বাংলাদেশ এই প্রক্রিয়ার একটি উপজাত অনুসিদ্ধান্ত।

আল্লামা ইকবালের সবচাইতে বড় অবদান হল তিনি আধুনিক শিক্ষিত মুসলিমদের সামনে ইসলামের এমন একটি বোঝাপড়া উপস্থাপন করেছেন যেখানে আল্লাহ ও তার খলিফা হিশেবে সৃষ্ট মানুষের সম্পর্ক একটি সুষমিত এবং ন্যায্য অবস্থান পেয়েছে। তিনি তার খুদী তত্ত্বের মধ্য দিয়ে আল্লাহর খলিফা মানুষকে তার স্রষ্টা আল্লাহর সঙ্গে একটি আত্মপ্রত্যয়ী এবং ক্রিয়ামুখী আন্তঃসম্পর্কে বয়ান করেছেন। এভাবে তাসাউফের আধ্যাত্মিক সকর্মক শক্তিকে তিনি আহরণ করেছেন। কিন্তু কর্মবিমুখ বৈরাগ্য, সন্ন্যাস ও ব্যক্তিপূজা পরিত্যাগ করেছেন। তিনি ইসলামের চিরায়ত ঐতিহ্য এবং এর বিচ্যুতি ও বিকৃতির মধ্যে বৈসাম্য বিদূরিত করেছেন। এ কারণে তিনি হলেন ইমাম গাজালী থেকে ইমাম তাইমিয়া ও শেখ আহমদ সিরহিন্দী হয়ে শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলবী পর্যন্ত ধ্রুপদী ইলমের যে প্রবহমান ধারা তার আধুনিক কালের যোগ্যতম উত্তরাধিকারী। তাকে পাঠ, অনুধাবন, অনুসরণ ও অনুশীলন যেকোন সমকালীন মুসলিমের জন্য অপরিহার্য।

২. ইকবাল, মুসলিম স্বাতন্ত্র্যচেতনা ও বাংলাদেশ

আল্লামা ইকবাল বিশ শতকের প্রথমার্ধে উপমহাদেশে মুসলিম স্বাতন্ত্র্যচেতনার ধারণা প্রদান করেন। তার এই মুসলিম স্বাতন্ত্র্যচেতনা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ কংগ্রেস ও অন্যান্য হিন্দুত্ববাদীদের মোকাবেলায় যে দ্বিজাতিতত্ত্ব ধারণা গ্রহণ করেছিলেন তার একটি দার্শনিক ভিত্তির যোগান দিতে পেরেছিল। ১৯৪০ সালে জিন্নাহর নেতৃত্বে মুসলিম লীগ দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে লাহোর/পাকিস্তান প্রস্তাব গ্রহণ করে। আল্লামা ইকবাল অবশ্য ইতিপূর্বেই ১৯৩৮ সালে ইন্তেকাল করেছিলেন।

বাংলার মুসলমানদের নেতা হিসাবে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক এই লাহোর প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন। অর্থাৎ বাঙালি মুসলিমদের যে অংশটি মুসলিম লীগ সমর্থক ছিল তাদের এই দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রতি সমর্থন ছিল। শেরে বাংলা অবশ্য লাহোর প্রস্তাবের স্বরূপ নিয়ে জিন্নাহর সঙ্গে মতভিন্নতার কারণে পরবর্তীকালে মুসলিম লীগে আর সক্রিয় ছিলেন না। কিন্তু খাজা নাজিমউদ্দীন, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম, মওলানা ভাসানী এবং শেখ মুজিবুর রহমান — এরা সকলেই নিজ নিজ অবস্থান থেকে দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রতি সমর্থন দিয়েছিলেন। তবে দ্বিজাতিতত্ত্বের বোঝাপড়া সবার এক রকম ছিল না। যেমন সোহরাওয়ার্দী এবং আবুল হাশিম দ্বিজাতিতত্ত্ব ফর্মুলার অধীনে যুক্তবাংলা গড়তে চেয়েছিলেন। জিন্নাহর তাতে সমর্থনও ছিল; কিন্তু কংগ্রেস হাই কমান্ডের বিরোধীতায় তা সম্ভব হয়নি। কেবল বাংলার পূর্বাংশ ও সিলেট নিয়ে ১৯৪৭ সালে পূর্ব বাংলা গঠিত হয়েছিল এবং তা পাকিস্তানে যোগ দিয়েছিল।

বাংলার মুসলিম নেতাদের দ্বিজাতিতত্ত্ব সম্পর্কে এই রকমের বিভিন্ন বোঝাপড়া থেকে এটা বোঝা যায় যে খোদ বাংলার মুসলমানদের মধ্যেই এই প্রশ্নে একটা অস্পষ্টতা ও দোদুল্যমানতা ছিল। এই অস্পষ্টতা ও দোদুল্যমানতা বাঙালি মুসলিমের সাধারণ আইডেনটিটি ক্রাইসিসেরই প্রতিফলন। বাঙালি মুসলমান বিভিন্ন ঐতিহাসিক কারণে উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের মুসলিমদের মত নিজেদের আত্মপরিচয়ের প্রশ্নে স্পষ্ট ও দ্বিধাহীন নয়। তাদের পরিচয় নির্ধারণে তারা তাদের বাঙালিত্ব ও মুসলমানত্ব নিয়ে বরাবরই দোদুল্যমান। কারো কাছে তাদের বাঙালিত্ব আগে আবার কারো কাছে তাদের মুসলমানত্ব আগে। এই বিভিন্নতার কারণে বাংলার মুসলমানের আত্মপরিচয় সংকট তৈরি হয়েছে এবং তা এক জাতিগত অনৈক্য ও বিভেদে পরিণত হয়েছে।

এই প্রেক্ষিতে ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তান যখন বিচ্ছিন্ন হয়ে বাংলাদেশের উত্থান হল তখন অনেকেই বলেছেন যে দ্বিজাতিতত্ত্ব ভুল ছিল এবং তা বাতিল হয়ে গেছে। তারা বলতে চাইলেন যে যেহেতু বাঙালি আইডেনটিটিকে সামনে রেখে বাংলাদেশ তৈরি হয়েছে সেহেতু দ্বিজাতিতত্ত্ব মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু আসলে কি তাই? বাঙালি আইডেনটিটি ভিত্তিক বাংলাদেশ তো একটি স্বাধীন ও স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে উঠেছে এবং এই স্বাধীন ও স্বতন্ত্র অস্তিত্ব বজায় রাখার প্রয়োজনে এদেশের বাঙালিরা তাদের মুসলমানত্বকেই কাজে লাগিয়ে যাচ্ছে।

এদিক থেকে বলা যায় বাংলাদেশে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তি যে মুসলিম স্বাতন্ত্র্যচেতনা তার প্রাসঙ্গিকতা একেবারে ফুরিয়ে যায়নি। দ্বিজাতিতত্ত্বের মূলকথা যে মুসলিম স্বাতন্ত্র্য তার মানে এই নয় যে উপমহাদেশে দুটি জাতি তাই শুধু দুটি রাষ্ট্রই থাকতে হবে — হিন্দুস্তান ও পাকিস্তান। দ্বিজাতিতত্ত্বের মৌল ধারণা মুসলিম স্বাতন্ত্র্যচেতনার মানে আবার এটাও নয় যে উপমহাদেশের মুসলিমরা একজাতি তাই তাদের শুধু একটি রাষ্ট্রই থাকতে হবে আর সেটা হল পাকিস্তান। আরব মুসলিমরা যেমন এক জাতি হওয়া সত্ত্বেও মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকায় বিভিন্ন রাষ্ট্র গড়ে উঠেছে তেমনিভাবে উপমহাদেশের মুসলিমরা এক জাতি হওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তান ও বাংলাদেশ দুটি রাষ্ট্র গড়ে উঠেছে। আবুল মনসুর আহমদ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ সৃষ্টির প্রেক্ষাপটে দ্বিজাতিতত্ত্বকে এভাবেই তা’বিল করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন বাংলাদেশ লাহোর প্রস্তাবের মূল স্পিরিটের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ।

এছাড়া হিন্দুস্তানেও উপমহাদেশের মুসলিমদের একটি বড় অংশ বাস করছে। আর হিন্দুস্তানে সাম্প্রতিককালে উগ্র হিন্দুত্ববাদের উত্থানে সেখানকার মুসলিমদের উপর যে অত্যাচার ও নিপীড়ন চলছে তা আল্লামা ইকবালের মুসলিম স্বাতন্ত্র্যচেতনাভিত্তিক স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের ধারণাকে বারবার সঠিক বলে প্রমাণ করছে।

৩. ইকবালের মুসলিম স্বাতন্ত্র্যচেতনা, সাম্প্রদায়িকতার বয়ান ও বাংলাদেশ

পূর্ব বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানেরা আল্লামা ইকবালের মুসলিম স্বাতন্ত্র্যচেতনাভিত্তিক দ্বিজাতিতত্ত্বকে উৎসাহের সঙ্গে সমর্থন করে পাকিস্তান রাষ্ট্রে যোগ দিয়েছিল। এর কারণ ছিল পূর্ব বাংলায় সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষক মুসলিমদের উপর সংখ্যালঘিষ্ঠ হিন্দু জমিদারদের শোষণ ও জুলুম। এই অত্যাচার ও জুলুম এই অঞ্চলের মুসলিমদের কাছে স্বাধীন ও স্বতন্ত্র আত্মপরিচয়ের ধারণাকে আকর্ষণীয় করে তুলেছিল।

কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পরেই পূর্ব বাংলায় ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন একটি বাঙালিত্ব নির্ভর প্রতিবাদী ও স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক বয়ানের সূচনা করে। ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র কায়েমের পরিবর্তে এমন একটি রাষ্ট্র কায়েম হয় যার নিয়ন্ত্রণে ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের সামন্ততন্ত্রের অবশেষ, ঔপনিবেশিক আমলাতন্ত্র ও সামরিকতন্ত্র। কমবেশি জাতিগত ও আঞ্চলিক অর্থনৈতিক বৈষম্য ছিল এই রাষ্ট্রের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। এই অবস্থার প্রেক্ষিতে পূর্ব বাংলায় ক্রমান্বয়ে একটি আঞ্চলিক অর্থনৈতিক বৈষম্য ও বঞ্চনার বয়ান জোরদার হতে শুরু করে। এই আঞ্চলিক সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য ও বঞ্চনার পাটাতনে দ্বিজাতিতত্ত্বের সমালোচক হিশেবে “সাম্প্রদায়িকতা”র ভারতীয় বয়ানটি পূর্ব বাংলায় অনুপ্রবেশের সুযোগ পেয়ে যায়।

এক্ষেত্রে এদেশের বামপন্থী ও বাঙালি জাতিবাদী বুদ্ধিজীবি, সংস্কৃতিকর্মী ও রাজনীতিবিদেরা একজোট হয়ে ভূমিকা রাখে। এই বয়ানের বিনির্মাণে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ থেকে শুরু করে আবদুল গাফফার চৌধুরী, আলতাফ মাহমুদ, হাসান হাফিজুর রহমান, শামসুর রাহমান, মুনীর চৌধুরী, জহির রায়হান, ওয়াহিদুল হক, সনজীদা খাতুন, আনিসুজ্জামান, মওলানা ভাসানী, শেখ মুজিবুর রহমান, সিরাজুল আলম খান প্রমুখ নিজ নিজ অবস্থান থেকে অংশগ্রহণ করেছেন।

বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগের দুই প্রধান রূপকার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং কাজী নজরুল ইসলাম অখন্ড ভারতীয় রাষ্ট্রচেতনার মধ্যে বাঙালি উৎকর্ষের প্রবক্তা ছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও এ দুজনকেই পূর্ব বাংলার এই নব স্বতন্ত্র বাঙালি আত্মপরিচয়ের প্রধানতম বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক আইকন হিশেবে আত্মীকরণ করা হয়েছে। এভাবে আল্লামা ইকবালের ইনসাফ ও আদল-ভিত্তিক উম্মাহচেতনা বা বিশ্বমুসলিম চেতনা থেকে বিযুক্ত হয়ে এক আঞ্চলিক/ভৌগোলিক সাংস্কৃতিক বাঙালি চেতনায় পূর্ব বাংলা নিজেকে অভিষিক্ত করেছে। এভাবে ইকবালের মুসলিম স্বাতন্ত্র্যচেতনাভিত্তিক দ্বিজাতিতত্ত্বের সমালোচনা ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ নাকচ করার এই প্রক্রিয়াটি যেমন ছিল একাধারে অর্গ্যানিক তেমনি ছিল অন্যদিকে ভারতীয় সাংস্কৃতিক অনুচরদের অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতার সম্মিলিত ফলাফল।

এই প্রক্রিয়ার একটি ঐতিহাসিক মাইলফলক হল ১৯৭১ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাংলাদেশ রাষ্টের অভ্যুদয়। কিন্তু বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের পরেও আল্লামা ইকবালের দ্বিজাতিতত্ত্ব সম্পূর্ণ অকার্যকর হয়ে যায়নি। এর কারণ হল ১৯৭১ পরবর্তী বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিবেশী বৃহৎ আধিপত্যবাদী ভারত রাষ্ট্র থেকে নিজের স্বাতন্ত্র্য ও সার্বভৌমত্ব সুরক্ষা করতে গিয়ে পুনরায় এর নাগরিকদের মুসলমানত্বকেই কাজে লাগাচ্ছে। এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগকে যেমন তার “বাঙালি জাতীয়তাবাদ”কে মুসলমানত্ব দিয়ে সম্পূরণ করে নিতে হচ্ছে/হবে তেমনি বিএনপিকেও তার ভৌগোলিক সীমানানির্ভর আধাখেঁচড়া “বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ”কে ফাইন টিউন করে নিতে হবে।

এদিক থেকে বলা যায় যে বাংলাদেশকে যত বেশি আত্মপ্রত্যয়ী এবং মর্যাদাশীল রাষ্ট্র হিশেবে গড়ে তোলা হবে তত বেশি এদেশকে আল্লামা ইকবালের ইনসাফ ও আদল-ভিত্তিক উম্মাহচেতনা বা বিশ্বমুসলিম চেতনায় ফিরে যেতে হবে। এভাবে বাংলাদেশ এই উপমহাদেশে একটি শক্তিমান ও আত্মনির্ভরশীল মুসলিম রাষ্ট্র হিশেবে বিকশিত হয়ে ভারত ও পাকিস্তান উভয় রাষ্ট্র থেকে একটি স্বকীয় সত্তা বজায় রেখে মুসলিম উম্মাহতে এর যোগ্য স্থান করে নিতে পারবে।

৪. ইকবালের মুসলিম স্বাতন্ত্র্যচেতনা এবং বাঙালি মুসলমানের দার্শনিক দারিদ্র্য

পূর্ব বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানেরা আল্লামা ইকবালের মুসলিম স্বাতন্ত্র্যচেতনাভিত্তিক দ্বিজাতিতত্ত্বকে উৎসাহের সঙ্গে সমর্থন করে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রে যোগ দিয়েছিল। এর প্রধান কারণ ছিল পূর্ব বাংলায় সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষক মুসলিমদের উপর সংখ্যালঘিষ্ঠ হিন্দু জমিদারদের শোষণ ও জুলুম। এই প্রধানত হিন্দু উচ্চবর্ণের অর্থনৈতিক অত্যাচার ও জুলুম এই অঞ্চলের বিপুল কৃষিজীবী বাঙালি মুসলিমদের কাছে আল্লামা ইকবালের স্বাধীন ও স্বতন্ত্র আত্মপরিচয়ের ধারণাকে আকর্ষণীয় করে তুলেছিল। এই স্বকীয় পরিচয় ভিত্তিক একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র কায়েমের পরিকল্পনার মধ্যে বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ নিম্নবর্গীয় মুসলিম কৃষকেরা একটি মুক্তির পথ খুঁজে পেয়েছিল।

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথা বাংলার প্রধানত মুসলিম কৃষকদেরকে একটি অমানবিক কৃষিপ্রজায় (সার্ফ) পরিণত করেছিল। কাজেই আল্লামা ইকবালের মুসলিম স্বাতন্ত্র্যচেতনাভিত্তিক দ্বিজাতিতত্ত্বকে বাঙালি মুসলমান প্রথমত স্বাগত জানিয়েছে একটি শ্রেণিগত অর্থনৈতিক স্বার্থের অবস্থান থেকে। এই প্রসঙ্গে বামপন্থী ও একাডেমিক উভয় ধারার বুদ্ধিজীবিদের ব্যাখ্যা ও ভাষ্যের মধ্যে আশ্চর্যজনক ঐক্য লক্ষ করা যায়। যেমন বদরুদ্দীন উমর তার ‘সাম্প্রদায়িকতা’ (১৯৬৬), ‘সংস্কৃতির সংকট’ (১৯৬৭), ‘সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা’ (১৯৬৮), ‘পূর্ববাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’ (১৯৭০), ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বাঙলাদেশের কৃষক’ (১৯৭২) প্রভৃতি বইয়ের মাধ্যমে এই প্রসঙ্গে যে বয়ানটি প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন সেখানে দ্বিজাতিতত্ত্বের এই মার্কসবাদী অর্থাৎ শ্রেণিবাদী অর্থনৈতিক আকর্ষণকেই উচ্চকিত করে তুলে ধরেছেন।

আবার একাডেমিক স্কলার তাজ উল-ইসলাম হাশমি-ও তার ‘Pakistan as a Peasant Utopia: The Communalization of Class Politics in East Bengal, 1920-1947’ (1992) গ্রন্থে বাঙালি মুসলমানের আল্লামা ইকবালের মুসলিম স্বাতন্ত্র্যচেতনাভিত্তিক দ্বিজাতিতত্ত্ব বোঝাপড়া নিয়ে মোটামুটি একইরকম ব্যাখ্যা ও ভাষ্য উপস্থাপন করেছেন। কাজেই দেখা যাচ্ছে যে এই প্রসঙ্গে বামপন্থী, জাতীয়তাবাদী ও একাডেমিক সব বয়ানই প্রায় একই ধরনের।

তাহলে লক্ষ করা যায় যে আল্লামা ইকবালের মুসলিম স্বাতন্ত্র্যচেতনাভিত্তিক দ্বিজাতিতত্ত্বের বোঝাপড়ায় বাঙালি মুসলমান তার শ্রেণিগত অর্থনৈতিক স্বার্থচিন্তা দ্বারাই মূলত প্রভাবিত হয়েছিল। অর্থাৎ তাদের জীবন জীবিকার উপরে আধিপত্য প্রতিষ্ঠাকারী বর্ণ হিন্দুর বিতাড়নের একটি সুযোগ হিশেবেই তারা দ্বিজাতিতত্ত্বকে দেখেছে। এ কারণে হিন্দু-মুসলিম বাইনারিতে তারা আল্লামা ইকবালের মুসলিম স্বাতন্ত্র্যচেতনাভিত্তিক দ্বিজাতিতত্ত্বকে বুঝেছিল; কিন্তু আল্লামা ইকবালের মুসলিম স্বাতন্ত্র্যচেতনার আসল আদর্শিক উৎকর্ষ যেখানে নিহিত অর্থাৎ তার জাতি, বর্ণ, নৃগোষ্ঠী, ভাষা, সংস্কৃতি ও ভৌগোলিক সীমানা নিরপেক্ষ যে উম্মাহচেতনা বা বিশ্বমুসলিম আন্তর্জাতিক চেতনা সেটি বাঙালি মুসলমানের বোঝাপড়ায় সম্যকভাবে ধরা পড়েনি।

অতএব একথা বলা যায় যে শায়েরে মাশরিক হিশেবে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে বিখ্যাত কবি ও দার্শনিক আল্লামা ইকবালের তৌহিদ-ভিত্তিক ভৌগোলিক অঞ্চল নিরপেক্ষ বিশ্বায়িত ওয়াতান-চেতনা বা দেশ ও বিশ্বসম্প্রদায়চেতনার প্রতি বাঙালি মুসলিম যতটা না আনুগত্য প্রদান করেছিল তার চাইতে তারা এই মহান আদর্শের একটি বৈষয়িক জীবিকা-নির্ভর স্বার্থ-তাড়িত আঞ্চলিক বোঝাপড়ায় উপনীত হয়েছিল।

আল্লামা ইকবালের এই উৎকৃষ্ট ইসলাম-অনুপ্রাণিত ও আদর্শ প্রস্তাবনাকে বাঙালি মুসলমান দার্শনিকভাবে গ্রহণ করতে পারেনি তাদের দার্শনিক দারিদ্র্যের কারণে। আর তাদের এই দার্শনিক দারিদ্র্যের কারণেই তারা যখন পঞ্চাশ দশকে হিন্দু জমিদারদের চলে যাওয়ার প্রেক্ষিতে তাদের প্রাথমিক স্বার্থ উদ্ধার হয়েছে বলে মনে করেছে তখন থেকেই ইকবালের মুসলিম স্বাতন্ত্র্যচেতনাভিত্তিক দ্বিজাতিতত্ত্বকে উপেক্ষা করে ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক/নৃতাত্ত্বিক ভিন্নতা এবং আঞ্চলিক অর্থনৈতিক বঞ্চনা ও বৈষম্যের বাঙালি জাতীয়তাবাদী বয়ানে আকর্ষিত হওয়া শুরু করেছে। এর অনিবার্য পরিণতিই ছিল ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন থেকে ১৯৭১-এর বাঙালি বিচ্ছিন্নতাবাদী/জাতীয়তাবাদী স্বাধীনতা আন্দোলন।

৫. ইকবালের সম্প্রদায়চেতনা, লাহোর প্রস্তাব ও দেওবন্দী আলেম সমাজ

মুসলিম লীগের বাঙালি মুসলিম নেতৃত্বের একাংশের মধ্যে লাহোর প্রস্তাবের পরবর্তীকালের বিবর্তিত রূপ অর্থাৎ প্রস্তাবিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের গঠন ও কাঠামো নিয়ে ভিন্নমত ছিল। এই ভিন্নমত বা সংশয় প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৪৭ সালে এই রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠার পূর্বেই। [২] কাজেই ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণে পাকিস্তান রাষ্ট্রের বোঝাপড়া নিয়ে বাঙালি মুসলিম এলিট ও সাধারণের এই ভিন্নমত ও দোদুল্যমানতা স্মরণে রাখাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। [৩]

১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ অবধি পাকিস্তানের যে বাস্তবতা অর্থাৎ যে সামন্তবাদী, ঔপনিবেশিক প্রশাসন ও সেনাবাহিনী এবং পাশ্চাত্য জ্ঞানকান্ড ভিত্তিক সিভিল সোসাইটি দ্বারা সেই পাকিস্তান পরিচালিত হয়েছে তার সমস্যা ও সংকটের দায় ও দায়িত্ব না আল্লামা ইকবালের না আল্লামা শাব্বির আহমদ উসমানীর। কামালবাদী উগ্র সেক্যুলার ও মডার্ন ক্ষমতাসীন এলিট পাকিস্তান রাষ্ট্রকে ইসলামিক রেটরিক্সের আড়ালে যে ইউরোকেন্দ্রিক, ভেস্টফ্যালিয়ান, প্রেটোরিয়ান, ক্লেপ্টোক্র্যাটিক অলিগার্কিতে পরিণত করেছিল সেই বিচ্যুত রাষ্ট্রটি ১৯৭১ সালে একটি পূর্বাঞ্চলিক গৃহযুদ্ধ ও এর অব্যবহিত পরে একটি আন্তঃরাষ্ট্রীয় প্রথাগত যুদ্ধে নিপতিত হয়ে বিভক্ত হয়েছিল। কিন্তু এর মাধ্যমে আল্লামা ইকবাল ও আল্লামা শাব্বির আহমদ উসমানীর মুসলিম স্বাতন্ত্র্যভিত্তিক দ্বিজাতিতত্ত্ব ভুল প্রমাণিত হয়নি। [৪]

একটি বাঙালি ভাষাগত, জাতিসত্তাগত ও সাংস্কৃতিক ভিন্নতার বয়ানকে একটি আঞ্চলিক অর্থনৈতিক বঞ্চনা ও বৈষম্যের অতিরঞ্জিত আখ্যান দ্বারা পরিপুষ্ট করে তুলে পাকিস্তানের পূর্বাংশকে এই পরিণতির দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছিল। এর ফলাফল হিশেবে একটি স্বাতন্ত্র্যবাদী স্বায়ত্বশাসনের রাজনৈতিক আন্দোলন পারস্পরিক বিভেদ, বিদ্বেষ, ঘৃণা, সহিংসতা ও সন্ত্রাসে পর্যবসিত হয়ে একটি আঞ্চলিক গৃহযুদ্ধের অবতারণা করেছিল। [৫] এই গৃহযুদ্ধ কালে পাকিস্তানের অস্তিত্বমূলক হুমকি হিশেবে উপমহাদেশের প্রতিবেশী যে রাষ্ট্রটি ১৯৪৭ সাল থেকে এর অঙ্গচ্ছেদের বদলা নিতে বদ্ধপরিকর ছিল তা এই পরিস্থিতির সম্পূর্ণ সদ্ব্যবহার করতে কোন কসুর করেনি।

ফলে কামালবাদী পাকিস্তানের পূর্বাংশকে ১৯৭১ সালে একটি করদ রাষ্ট্র বানিয়ে ফেলা সম্ভব হয়েছিল। উপমহাদেশ ও বিশ্বমুসলিম উম্মাহ – উভয় প্রেক্ষিতেই এটি উপমহাদেশীয় সম্মিলিত মুসলিম রাষ্ট্রের আদিপ্রকল্পের জন্য একটি মহা বিপর্যয় বা নাকবা। আর এই প্রেক্ষিতে আল্লামা ইকবালের সেই উক্তিটি প্রযোজ্য ও প্রাসঙ্গিক যেটিকে এই নিবন্ধের শুরুতেই উদ্ধৃত করা হয়েছে। তার এই উক্তিটি এত প্রফেটিক যে বিস্মিত না হয়ে উপায় থাকে না।

এই গবেষণামূলক নিবন্ধে আমরা পর্যালোচনা করছি যে ১৯৭১-এ বাংলাদেশ সৃষ্টির পর প্রায় পঞ্চাশ বছর অতিক্রান্ত হবার পরেও আজকের বাস্তবতায় আল্লামা ইকবালের উম্মাহচেতনাভিত্তিক উপমহাদেশের মুসলিম ঐক্য ও সংহতি কতটা প্রযোজ্য ও প্রাসঙ্গিক। এক্ষেত্রে আমরা যা আশার সঞ্চারী হিশেবে লক্ষ করি তা হল বাংলাদেশ রাষ্ট্র বর্তমান ভারত রাষ্ট্রের প্রভাবাধীন হওয়া সত্ত্বেও এখানে পশ্চিম বাংলা বা ভারতের সঙ্গে পুনরেকত্রীকরণের দাবী এখন অবধি অত্যন্ত ক্ষীণ ও দুর্বল। কাজেই আল্লামা ইকবালের মুসলিম স্বাতন্ত্র্যচেতনাভিত্তিক দ্বিজাতিতত্ত্ব একেবারে হারিয়ে যায়নি। আলহামদুলিল্লাহ।

অতএব বাংলাদেশেও আধুনিক শিক্ষিত মুসলিম মধ্যপন্ন্থীদের সঙ্গে ঐতিহ্যবাদী উলামাদের একটি বড় অংশ এবং সংস্কারবাদী ও আধুনিকতাবাদী ইসলামবাদীদের সমঝোতা, ঐক্য ও সংহতি গড়ে তোলা সম্ভব হলে বাংলাদেশও দক্ষিণ এশীয় প্রেক্ষাপটে একটি গুরুত্বপূর্ণ মুসলিম মার্কাজ হয়ে উঠতে পারবে। কিন্তু এক্ষেত্রে ২০১৩-এর শাপলা গণসমাবেশ-উত্তর বাংলাদেশে ভারতপন্থী আওয়ামী লীগের সঙ্গে এদেশের দেওবন্দী উলামাদের একাংশের গাঁটছড়া একটি প্রতিবন্ধক হয়ে দেখা দিয়েছে। এই বাস্তবতায় এদেশে আল্লামা শাব্বির আহমদ উসমানী প্রদর্শিত চিন্তা ও আদর্শ লালনকারী কওমি উলামাদের উত্থান ও আধুনিক শিক্ষিত মধ্যপন্থী এবং সংস্কারবাদী ও আধুনিকতাবাদী ইসলামবাদীদের সঙ্গে পারস্পরিক সহযোগিতা এখন সময়ের দাবী। এই লক্ষ্য পূরণ করা সম্ভব হলে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের যে মৌলিক রূপান্তর সম্ভব হতে পারে তা সমগ্র মুসলিম উম্মাহর জন্যও একটি সম্পদসদৃশ কাঠামো হিশেবে পরিগণিত হতে পারবে, ইনশাআল্লাহ।

৬. ইকবাল, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল এবং বাংলাদেশ

১৯৪৭ সালে উপমহাদেশে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান হয়। এই সময় উপমহাদেশ বিভক্ত হয়। যা “দেশভাগ” বলে পরিচিতি পেয়েছে। সাতচল্লিশের “দেশভাগ” কথাটার মধ্যে একধরনের আক্ষেপ আছে। অভিযোগ আছে, হেরে যাবার গ্লানি আছে, যন্ত্রণা আছে, দুঃখ আছে। কিন্তু সেটা নির্ভর করে যে আপনি কে তার উপরে। আপনি যদি ইকবালের মত মুসলিম স্বাতন্ত্র্যে বিশ্বাসী হন, উপমহাদেশের মুসলিম জনগোষ্ঠীর স্বাধিকারে প্রত্যয়ী হন, আধুনিক কালে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র নির্মাণের সম্ভাবনায় উজ্জীবিত হন তাহলে সাতচল্লিশ আপনার কাছে “দেশভাগ” নয়, সাতচল্লিশ আপনার কাছে “দেশঅর্জন” এবং “আজাদী”। গোলামীর শৃঙ্খল ভেঙে নতুন দেশ ও রাষ্ট্র গড়ার শুভ সূচনা। সাতচল্লিশ আপনার কাছে বর্ণবাদী জমিদারী ব্যবস্থার জুলুম থেকে মুক্তির বার্তা।

শত বছর ধরে হারানো জমির মালিকানা ফিরে পাবার আনন্দে আলহামদুলিল্লাহ বলার অবারিত সুযোগ। নিজের ধর্ম, জাতীয়তা ও ভাষা বৈচিত্র্য নিয়ে নিজের স্বপ্নরাষ্ট্রকে সমৃদ্ধভাবে গড়ে তোলার অফুরন্ত সম্ভাবনা। কাজেই সাতচল্লিশকে “দেশভাগ” না বলে সাতচল্লিশকে “দেশঅর্জন” বলতে পারার মধ্য দিয়ে ইতিহাসের এক নতুন প্যারাডাইম তৈরি হয়। আর ইকবালের মুসলিম স্বাতন্ত্র্যচেতনার আলোকে জিন্নাহ ছিলেন সেই দেশঅর্জনের জন্য পরিচালিত সফল আজাদী আন্দোলনের কেন্দ্রীয় ও প্রধান নেতা।

দ্বিতীয় বারের মত বঙ্গভঙ্গ-ও এই সময় সংঘটিত হয়। পূর্ব বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠী উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের মুসলিমদের সঙ্গে পাকিস্তান রাষ্ট্রে যোগ দেয়। কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর নেতৃত্বে মুসলিম লীগ এই পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিল। এই রাষ্ট্র যে রাজনৈতিক চেতনার আলোকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা দ্বিজাতিতত্ত্ব নামে পরিচিত।

এই দ্বিজাতিতত্ত্বের দার্শনিক প্রস্তাবনা করেছিলেন কবি ও দার্শনিক আল্লামা মুহাম্মদ ইকবাল তার মুসলিম স্বাতন্ত্র্যচেতনার মাধ্যমে। ১৯৩০ সালে এলাহাবাদ ভাষণে তিনি এই প্রস্তাব উপস্থাপন করেছিলেন। তিনি অবশ্য পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগেই ১৯৩৮ সালে মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু তার সাহিত্যিক ও দার্শনিক অবদানকে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুপ্রেরণা ও পথনির্দেশনা হিশেবে গণ্য করা হয়।

আল্লামা ইকবাল ফারসি ও উর্দু ভাষায় তার মূল রচনাগুলি লিখেছিলেন। ইংরেজী ভাষাতেও লেখা আছে তার কিছু গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতা ও চিঠি। কিন্তু তার সাহিত্য ও দর্শনের প্রতি পূর্ব বাংলার বাঙালি মুসলিম বিদ্বজ্জনেরা ১৯৪৭ এর পূর্বে ও অব্যবহিত পরে যথেষ্ট সমাদর দেখিয়েছেন। সেই সময়ে তার অনেক রচনার বাংলা অনুবাদ হয়েছিল। অনেক যোগ্য ও খ্যাতিমান বাঙালি মুসলিম সাহিত্যিক ও লেখক এই অনুবাদ কর্মে নিযুক্ত হয়েছিলেন। যেমন ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, গোলাম মোস্তফা, ফররুখ আহমদ, মনিরউদ্দীন ইউসুফ প্রমুখ।

কিন্তু আজকের বাংলাদেশে আল্লামা ইকবালের সাহিত্য ও চিন্তা কেন প্রান্তিক অবস্থানে চলে গেছে? এই প্রশ্নের উত্তর হল — ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় থেকে পূর্ব বাংলায় যে বাঙালিত্ব-ভিত্তিক সাহিত্য ও সংস্কৃতির জোয়ার চলেছে তারই ক্রমবর্ধিষ্ণু অভিঘাতে এটি ঘটেছে। সেই সঙ্গে যোগ করা যায় ১৯৬১ সালে পূর্ব বাংলায় রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনকে কেন্দ্র করে এই বাঙালিত্ব-ভিত্তিক চেতনার আরো প্রচার ও প্রসার-কে। এরই ফলশ্রুতিতে বিগত ষাটের দশকে আমরা দেখতে পাই বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণি একদিকে ৬ দফা কর্মসূচির আলোকে উদীয়মান আঞ্চলিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে সোচ্চার ও তৎপর; আবার অন্যদিকে এর সমান্তরালে বাঙালি শিক্ষিত নাগরিক মধ্যবিত্ত মননশীল ও সৃজনশীল শ্রেণি রবীন্দ্র-নজরুল জন্মজয়ন্তী ও পহেলা বৈশাখ পালন এবং সাধারণভাবে রবীন্দ্রসঙ্গীত চর্চায় ব্যাপক আগ্রহী হয়ে উঠছে। এই প্রেক্ষিতে ছায়ানটের ওয়াহিদুল হক ও সনজীদা খাতুনেরা পূর্ব বাংলার মধ্যবিত্ত বিদগ্ধ নাগরিক শ্রেণির সাহিত্য ও সংস্কৃতির একটি রবীন্দ্র-নজরুল-কেন্দ্রিক বলয় তৈরি করতে পেরেছিলেন।

এই কেবলি বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি ভিত্তিক বাঙালি মুসলিম মধ্যবিত্তের শিল্পরুচিস্নিগ্ধ মানস পরিমন্ডলে স্বতন্ত্র মিল্লাতী রাষ্ট্র ও উম্মাহচেতনার ধারক ও বাহক আল্লামা ইকবাল ক্রমাগত উপেক্ষিত হতে থাকলেন। একথা বললে ভুল হবে না যে পূর্ব বাংলা পাকিস্তান রাষ্ট্রের অংশ হওয়া সত্ত্বেও এখানে রবীন্দ্র-নজরুল যুগলবন্দী দিয়ে আল্লামা ইকবালকে ম্রিয়মান করে ফেলা হয়েছিল। পূর্ব বাংলার বাঙালিরা এভাবে পশ্চিম বঙ্গ থেকে রাজনৈতিকভাবে ভিন্ন হওয়া সত্ত্বেও সেখান থেকে রবীন্দ্র-নজরুল এই দুই আইকনকে আমদানী করে তাদের সাংস্কৃতিক চাহিদা মিটিয়েছে। এখানে লক্ষণীয় বিষয় হল এই যে আল্লামা ইকবালকে প্রতিস্থাপনে তারা পূর্ব বাংলার কোন সাংস্কৃতিক আইকনকে খুঁজে পায়নি কিংবা তৈরিও করতে পারেনি। তাদের সাংস্কৃতিক চৈতন্য গঠিতই হল পরদেশনির্ভরতা দিয়ে। এই পরদেশনির্ভর মানস ও সংস্কৃতি দিয়ে আর যাই হোক পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা অর্জন করা যায় না। বরঞ্চ পরনির্ভর সংস্কৃতি পরনির্ভর রাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতির জন্ম দেয়।

বাঙালি মুসলমানের এই সংকীর্ণ এবং আঞ্চলিক সাহিত্য ও সংস্কৃতি চেতনা এবং মানস থেকে ১৯৭১-উত্তর বাংলাদেশে আল্লামা ইকবাল সম্পূর্ণ বর্জিত হলেন। কারণ দ্বিজাতিতত্ত্ব-ভিত্তিক পাকিস্তান রাষ্ট্রের কাঠামো থেকে একটি গণহত্যামূলক স্বাধীনতা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ গঠিত হয়েছে। পূর্ব বাংলার বাঙালির উপরে পাকিস্তান রাষ্ট্রের এই অন্যায় বৈষম্য, বঞ্চনা, নিপীড়ন ও গণহত্যার দায় এই বাঙালি জাতিবাদীরা পাকিস্তানের স্বপ্নদ্রষ্টা হিশেবে আল্লামা ইকবালের উপরেও বর্তিয়েছে। কাজেই ১৯৭১-উত্তর বাংলাদেশে আমরা দেখতে পেলাম যে আমাদের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছাত্রাবাসের নাম থেকে আল্লামা ইকবালের নাম প্রত্যাহার করে নেয়া হল।

বাঙালি মুসলমান তার দার্শনিক দারিদ্র্যের কারণে নিজের আত্মপরিচয় নিয়ে সর্বদা দোদুল্যমান ও সংশয়গ্রস্ত। এই বাঙালি মুসলমান কি কখনো এই আত্মজিজ্ঞাসা করেছে যে আল্লামা ইকবালকে অপাংক্তেয় করে রাখায় তাদের কি ক্ষতিটা হচ্ছে? ১৯৭১ সালে বাংলা ভাষা, বাঙালি জাতিসত্তা, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের উপরে ভিত্তি করে গঠিত স্বতন্ত্র আত্মপরিচয়ভিত্তিক বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় হয়েছিল। কিন্তু একটি উগ্র বাঙালিত্ববাদী গোষ্ঠী এই সুযোগে বাঙালি মুসলমানের আত্মপরিচয় থেকে মুসলমানত্বকে বিসর্জন দিয়ে তাকে সম্মিলিত জাতীয়তার নামে কারো গোলাম করে রাখতে চায় কিনা — সেই ব্যাপারেও তো তাকে যথেষ্ট সতর্ক ও সচেতন থাকতে হবে। আর এই সতর্কতা ও সচেতনতা সৃষ্টির জন্য আল্লামা ইকবালের সাহিত্য ও দর্শন বাঙালি মুসলমানের জন্য এখনো অনেক প্রযোজ্য ও প্রাসঙ্গিক।

আল্লামা ইকবাল উপমহাদেশের প্রেক্ষিতে একটি স্বতন্ত্র মুসলিম আত্মপরিচয় এবং মিল্লাত ও উম্মাহচেতনা কুর’আন এবং সুন্নাহর আলোকে উপস্থাপন করেছিলেন। তা বাঙালি মুসলমানের জাতীয়, সাংস্কৃতিক এবং রাষ্ট্রিক স্বাতন্ত্র্য ও কর্তাসত্তা সুরক্ষায় প্রণোদনা যোগাতে পারে। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের তাগিদেই তাই আল্লামা ইকবালকে এখনো প্রয়োজন।

৭. ইকবাল, কলকাতামুখী পূর্ব বঙ্গীয় এলিট বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতি এবং বাংলাদেশ

পূর্ব বাংলার বাঙালি মুসলমান এক ধরনের দোদুল্যমান ও সংশয়গ্রস্ত আত্মপরিচয় নিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রে যোগ দিয়েছিল। এই দ্বিধা ও সংশয়ের উৎস ও সূত্র হল এ অঞ্চলের বাঙালি মুসলমানের দীর্ঘদিনের শিক্ষা, জ্ঞান ও সংস্কৃতিচেতনায় ইসলামের অগভীর ও উপরিতলীয় অবস্থান। ধর্মীয় শিক্ষা ও সাধারণ শিক্ষা — এই দুটি পরিমন্ডলেই এই অগভীর এবং ত্বকভেদে অক্ষম অপর্যাপ্ত ইসলামায়ন প্রক্রিয়া লক্ষ করা গেছে। ফলে এদেশে ইসলাম বাঙালি মুসলমানের ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক পরিমন্ডলেই সীমাবদ্ধ থেকেছে; ইসলামের চেতনা পূর্ব বাংলার মুসলমানের ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও মানস কাঠামোর ত্বকভেদ করে গভীরে প্রবেশ করতে পারেনি।

ফলে পূর্ব বাংলায় বিশ শতকের প্রথমার্ধ থেকে পঞ্চাশ ও ষাট দশক অবধি যে এলিট বাঙালি মুসলিম শ্রেণি গড়ে উঠছিল তার মানস ও চেতনা জগতে ইসলামের নিমজ্জন ছিল অগভীর ও উপরিতলীয়। বরঞ্চ তার মানস ও চেতনায় গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল ইংরেজী শিক্ষা সূত্রে পাশ্চাত্য ভাবধারা এবং সেইসঙ্গে কলকাতায় উদ্ভূত এবং বিকশিত বাঙালি হিন্দু “বাবু” বা “ভদ্রলোক”-এর ভাবধারা ও চেতনা। এর কারণ হল বাঙালি মুসলমানের শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যক্রমে এই দুই উৎসের একচ্ছত্র প্রাধান্য ও প্রভাব। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের উপজাত হিসাবে উনিশ শতকের শেষার্ধ থেকে কলকাতায় বাঙালি হিন্দু এলিটের মাধ্যমে যে আধুনিক “বাঙলার রেনেসাঁ” বা নবজাগরণ সাধিত হয়েছিল বিশ শতকের পূর্ব বাংলার বাঙালি মুসলিম এলিট শ্রেণি সেই কলকাতাকেন্দ্রিক নবজাগরণের ছায়াতলেই বিকশিত হচ্ছিল।

প্রশ্ন উঠতে পারে যে বাঙালি মুসলিম শ্রেণি যদি এই কলকাতাকেন্দ্রিক হিন্দু “বাংলার রেনেসাঁ”র অনুপ্রেরণাতেই গঠিত হচ্ছিল তবে তারা কেন অখন্ড ভারতের অধীনে অবিভক্ত বাংলা গড়ে তোলেনি? এর উত্তর হল ১৭৯৩ সালে সূচিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের অভিঘাতে পূর্ব বাংলার বৃহত্তর মুসলিম কৃষক সমাজ হিন্দু জমিদার শ্রেণির অধীনস্ত জমির মালিকানাবিহীন প্রজায় পরিণত হয়েছিল। কাজেই হিন্দু জমিদার রুপী এলিট শ্রেণির সঙ্গে তার একটি অর্থনৈতিক ও শ্রেণিগত বিরোধ দেখা দিয়েছিল। [৬] ফলে তার কাছে স্বতন্ত্র মুসলিম পরিচয় ভিত্তিক পাকিস্তানের ধারণা অত্যন্ত আকর্ষণীয় বলে মনে হয়েছিল। [৭]

কিন্তু তার এই স্বাতন্ত্র্যচেতনা তার উল্লিখিত পর্যাপ্ত ইসলামায়নের অভাবে কেবল অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিমন্ডলেই সীমাবদ্ধ ছিল। ফলে সে ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও চিন্তার ক্ষেত্রে কলকাতায় উদ্ভূত এলিট হিন্দু বাঙালির ঔপনিবেশিক এবং আধুনিক চেতনা ও ভাবধারায় আচ্ছন্ন ছিল। আর এটিই ছিল তার দোদুল্যমান ও দ্বিধাগ্রস্ত আত্মপরিচয়ের মূল কারণ।

এই প্রেক্ষিতে মিল্লাতী রাষ্ট্র ও উম্মাহচেতনার ধারক আল্লামা ইকবাল কলকাতা প্রভাবিত উদীয়মান বাঙালি মুসলিম এলিট শ্রেণির কাছে ক্রমাগত উপেক্ষিত হতে থাকলেন। বাঙালি মুসলিম তার বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতিকে আশ্রয় করে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে যে বাঙালি জাতীয়তাবাদী ও সাংস্কৃতিক জাগরণ ঘটাচ্ছিল সেখানে একধরনের উর্দু ভাষা বিরোধীতা ও ঘৃণা তৈরি হয়েছিল। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারীতে কয়েকজন বাঙালি মুসলিম নিহত হবার প্রেক্ষিতে পূর্ব বাংলায় এমন একটি আবেগী মিথিক পরিবেশ তৈরি হতে পেরেছিল।

এই প্রেক্ষাপটে ১৯৬১ সালে জন্মশতবার্ষিকীকে উপলক্ষ করে বাংলা ভাষায় বিশ্বমানের সাহিত্য ও সঙ্গীত স্রষ্টা পশ্চিম বঙ্গের বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পূর্ব বাংলার মঞ্চে প্রবল উত্থান ঘটে। রবীন্দ্রনাথ একজন উৎকৃষ্ট কবি ও সঙ্গীতকার এতে কোন সন্দেহ নেই; কিন্তু তার জাতীয় চেতনা ও আদর্শ অখন্ড ভারতের আওতায় অবিভক্ত বাংলার পক্ষে-ই অবস্থান নিয়েছিল; তিনি যেহেতু বাংলা ভাষায় লিখে একজন বিশ্বমানের শিল্পস্রষ্টা হতে পেরেছেন সেহেতু তার প্রতি বাঙালি মুসলমানের-ও আকর্ষণ থাকবে নিশ্চয়ই; কিন্তু তাই বলে তাকে পূর্ব বাংলার স্বাতন্ত্র্যকে ভিত্তি করে যে রাষ্ট্র গঠিত হয়েছে তার জাতীয় চেতনার প্রতিভূ মনে করা অযৌক্তিক। আর তাকে সম্মান জানাতে গিয়ে কেন মুসলিম স্বাতন্ত্র্যচেতনার প্রতীক আল্লামা ইকবালকে বিসর্জন দিতে হবে? কেন উর্দু ভাষাকে ঘৃণা করে উপমহাদেশের মুসলিম সাহিত্য ও সংস্কৃতির একটি উজ্জলতম ঐতিহ্য থেকে পূর্ব বাংলার বাঙালি মুসলমানকে বঞ্চিত রাখা হবে?

এসব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন অমীমাংসিত রেখে বাঙালি মুসলমান তার জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় পরিচয়ের উন্মেষ ও বিকাশ ঘটাবার ফলে উপমহাদেশের মুসলিম ঐক্য ও সংহতি বিঘ্নিত হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় মুসলিম শক্তি দুর্বল হয়েছে। আজকে যে বাংলাদেশ তৈরি হয়েছে তা এখনো তার পরিচয় সংকট থেকে উত্তীর্ণ হতে পারেনি। এদেশের জনগোষ্ঠী এর প্রভাবে আজো বিভক্ত ও পরস্পর নির্মূল অভিযানে লিপ্ত। এর থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন স্বতন্ত্র ও স্বকীয় চেতনার আলোকে জাতীয় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক চেতনার বিচ্ছিন্নতার মোচন এবং পুনর্গঠন। বাংলাদেশের এই পুনর্গঠনে আল্লামা ইকবালের সাহিত্য ও দর্শন আমাদের জন্য নিশ্চিতভাবে উপকারী পথনির্দেশনা। এতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।

৮. ইকবাল এবং বাংলাদেশের স্বতন্ত্র ভাষা ও সাহিত্য প্রশ্ন

আল্লামা ইকবাল বাংলাদেশে কেন ও কিভাবে প্রাসঙ্গিক সে বিষয়ের আলোচনার সূত্রে এখানে অবতারণা করা যেতে পারে পূর্ব বাংলার সাধারণ প্রমিত ভাষা এবং বিশেষভাবে সাহিত্যের ভাষার প্রশ্নটি। লক্ষ করলে দেখা যাবে যে পূর্ব বাংলার প্রমিত ভাষা ও সাহিত্যের ভাষায় পশ্চিম বঙ্গের হিন্দু বাঙালি “বাবু” বা “ভদ্রলোক” শ্রেণির সংস্কৃত প্রভাবিত আধুনিক বাংলা ভাষার অনেক প্রভাব রয়েছে। পূর্ব বাংলার আঞ্চলিক শব্দ এবং এদেশে প্রচলিত আরবি, ফারসি, উর্দু ও তুর্কী শব্দ বিবর্জিত এই “প্রমিত” ভাষা আসলে একটি কৃত্রিম ভাষা। এই ভাষা তৈরি হয়েছিল কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গে ব্রিটিশ প্রাচ্যবাদীদের উদ্যোগে সংস্কৃত পন্ডিতদের মাধ্যমে। এরা প্রাক-আধুনিক বাঙালি মুসলিম সাহিত্যিকদের আরবী-ফারসি শব্দ প্রভাবিত বাংলা ভাষাকে “মিশ্র ভাষা” বলে বর্জনীয় মনে করলেও তাদের সৃষ্ট সংস্কৃত শব্দ প্রভাবিত বাংলা ভাষাকে মিশ্র ভাষা না বলে “প্রমিত ভাষা” মনে করেছেন। এখানেই নিহিত রয়েছে প্রমিত ও সাহিত্যের ভাষা প্রশ্নে ক্ষমতা ও রাজনৈতিক কর্তাসত্তার বোঝাপড়ার বিষয়টি।

পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, কাজী নজরুল, বিভূতিভূষণ, জীবনানন্দ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখের হাতে এই সংস্কৃত প্রভাবিত মিশ্র বাংলা ভাষাটি একটি শৈল্পিক উৎকর্ষ লাভ করেছে। পশ্চিম বঙ্গের এই সংস্কৃত প্রভাবিত মিশ্র বাংলা ভাষাকেই ভাষা আন্দোলন-উত্তর পূর্ব বাংলা তার প্রমিত ও সাহিত্যের ভাষা হিশেবে বরণ করে নিয়েছে।

জসীম উদ্দীন, আল মাহমুদ, আহমফ ছফা, হুমায়ুন আহমেদ ও সাম্প্রতিক কালের অনেক তরুণের হাতে পূর্ব বাংলা/বাংলাদেশের প্রমিত ও সাহিত্যের ভাষায় একটি আঞ্চলিক শব্দ ভিত্তিক বাচন ও লেখন রীতি বেশ প্রচলিত হয়েছে। এটিকে নিঃসন্দেহে এক কদম অগ্রগতি বলা যায়; কিন্তু এরপরেও পূর্ব বাংলা/বাংলাদেশের প্রমিত ভাষা ও সাহিত্য স্বকীয় ভাষাগত ও চেতনাগত বৈশিষ্ট্যে এখনো একটি উৎকৃষ্ট বিশ্বমানে পৌঁছাতে পারেনি। এর কারণ হল পূর্ব বাংলা বা বাংলাদেশের ভাষা ও সাহিত্য এখনো বাঙালি মুসলমানের ইসলাম-ভিত্তিক জীবনচর্যা ও চেতনার আলোকে পর্যাপ্ত পরিগঠিত হয়নি।

ভারতীয় আলেম মওলানা আবুল হাসান আলী নাদভীর পর্যবেক্ষণ এক্ষেত্রে অনেক প্রাসঙ্গিক। তিনি বাঙালি মুসলমানকে বাংলা ভাষার সাহিত্যিক নেতৃত্ব অর্জনে সচেষ্ট হতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। যেভাবে উত্তর ভারতের মুসলিমেরা উর্দু ভাষাকে ইসলামের সংস্কৃতি ও চেতনার আলোকে জারিত করে এই ভাষার নেতৃত্ব অর্জন করেছে, তেমনিভাবে বাংলা ভাষার সৃজনশীল ও মননশীল সাহিত্যকেও ইসলামের আদর্শ ও চেতনা দিয়ে রাঙিয়ে বাঙালি মুসলমানকে বাংলা ভাষার কর্তাসত্তা হয়ে ওঠার তাগিদ মওলানা নাদভী এদেশের মুসলিমদেরকে দিয়েছিলেন। আর এই বৃহৎ ও মহৎ কর্মে আল্লামা ইকবাল হতে পারেন একজন উজ্জ্বল অনুপ্রেরণা ও বাতিঘর।

এই লক্ষ্য নিয়ে মওলানা আকরম খাঁ, ইবরাহীম খাঁ, গোলাম মোস্তফা, আবদুল কাদির, আবুল মনসুর আহমদ, দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, ফররুখ আহমদ, মনিরউদ্দীন ইউসুফ, মওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীম, সৈয়দ আলী আহসান, সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন, সৈয়দ আলী আশরাফ, মুইনুদ্দীন আহমদ খান, আল মাহমু্‌দ, আবদুল মান্নান সৈয়দ, এবনে গোলাম সামাদ, মাহমুদুর রহমান, ফাহমিদ-উর-রহমান প্রমুখ অনুসৃত স্বাতন্ত্র্যবাদী বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে ঐতিহ্য হিশেবে বরণ করে নিতে হবে। এভাবে পূর্ব বাংলার/বাংলাদেশের ভাষা ও সাহিত্যকে মুসলিম আদর্শ ও চেতনার অসমাপ্ত পথপরিক্রমার সঙ্গে পুনঃসংযোগ সাধন করতে হবে। সমকালীন বৈশ্বিক মিল্লাত ও উম্মাহচেতনার সংশ্লেষে এই ধারাটিকে পুনর্গঠিত ও পরিপুষ্ট করতে হবে। তাহলে বাঙালি মুসলিম একটি বিশ্বমানের অস্তিত্বে নিজেকে উত্তীর্ণ করতে পারবে, ইনশাআল্লাহ!

৯. ইকবাল ও আনমারি শিমেলের যুগনামকরণ — “দ্য এজ অফ ইকবাল”

প্রখ্যাত জার্মান গবেষক ও লেখক আনমারি শিমেল তার বিদ্বজ্জন মহলে স্বীকৃত উপমহাদেশের মুসলিম বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাস নিয়ে লেখা ‘ইসলাম ইন দ্য ইন্ডিয়ান সাবকন্টিনেন্ট’ (১৯৮০) গ্রন্থে বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধকে “ইকবালের যুগ” বা “দ্য এজ অফ ইকবাল” বলে চিহ্নিত করেছেন।

অথচ তার মৃত্যুর ৩৩ বছর পরে ১৯৭১ সালে সংঘটিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিবাদের দায় তার উপরে চাপিয়ে তাকে বর্জন করেছে বাংলাদেশ রাষ্ট্র। ১৯৭১ সালে যে কামালবাদী পাকিস্তান রাষ্ট্রটি পূর্ব বাংলায় একটি রক্তক্ষয়ী সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছিল সেই সামন্ত, ঔপনিবেশিক, আমলাতান্ত্রিক ও সেনাতান্ত্রিক পাকিস্তানের দায় কি আল্লামা ইকবালের উপরে বর্তায়?

এইসব বিষয়ে স্থূল, বর্ণবাদী ও জাতিবাদী ঘৃণায় আক্রান্ত হলে একধরনের অন্ধত্ব ও মূঢ়তায় নিমজ্জিত হতে হয়। ফলে এক পক্ষপাতদুষ্ট ন্যায়বিচারহীন সিদ্ধান্তের অন্ধকারে ডুবে যেতে হয়। এই ধরনের আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত জাতিকে শুধু বঞ্চিত-ই করে না; বরঞ্চ জাতির জন্য চলমান বিভেদ ও বিভক্তির উৎস হয়ে ওঠে।

১০. বাংলা ভাষায় ইকবাল-চর্চার সেকাল ও একাল

ইকবাল সাহিত্য ও দর্শনের বাংলা অনুবাদ ও পর্যালোচনার প্রকাশকাল লক্ষ করলেই এটা পরিস্কার হয়ে যাবে যে ১৯৪৭ সালের দেশবিভাগ ও ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্যবর্তী সময়কালেই সর্বাধিক ইকবাল-চর্চা হয়েছে। আবার যদি প্রকাশস্থান খেয়াল করি তাহলে এই সিদ্ধান্তে আসা সহজ হয়ে যায় যে তৎকালীন পূর্ব বাংলাতেই বাংলা ভাষায় সর্বাধিক ইকবাল-চর্চা হয়েছে। এর কারণ অত্যন্ত সহজ; যেহেতু আল্লামা ইকবালের মিল্লাত ধারণা ও উম্মাহচেতনার একটি রূপরেখা হিশেবে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অভ্যূদয় হয়েছিল সেহেতু তৎকালীন পূর্ব বাংলা, যা “পূর্ব পাকিস্তান” অভিধা পেয়েছিল, সেখানে ইকবাল চর্চা রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে দ্রুত বিকাশ লাভ করেছিল।

আবার ১৯৭১ সালে যখন বিউপনিবেশিত হতে ব্যর্থ কামালবাদী পাকিস্তান রাষ্ট্রটি স্বায়ত্ত্বশাসন ও স্বাধিকারের প্রশ্নে পূর্ব বাংলার উপরে একটি রক্তক্ষয়ী গণহত্যা ও নারী ধর্ষণে অভিযুক্ত হয়ে পড়ে তখন একটি বাঙালি জাতিবাদী প্রতিহিংসা ও ঘৃণাবাদী প্রতিক্রিয়া ও আবেগের পরিবেশ তৈরি হয়। এই জিঘাংসা ও প্রতিশোধের আবেগ ও আবেশে বুদ্ধিবৃত্তিক ও সৃজনশীল পরিমন্ডলও প্রভাবিত হয়ে পড়ে। এরই ফলশ্রুতিতে ১৯৭১ সালে যে কলোনিয়াল সিভিল ও সামরিক আমলাতন্ত্র ও এলিটের অপকর্মের ফলে পাকিস্তান রাষ্ট্রটি ভেঙে পড়েছিল তার দায় আল্লামা ইকবালের উপরেও বর্তানো হয়েছে। কাজেই পূর্ব বাংলায় যে নতুন বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির রক্তাক্ত অভ্যূদয় হল সেই রাষ্ট্রটি আল্লামা ইকবালের প্রতি রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য প্রত্যাহার করে নিল। এরই ফলে বাংলাদেশে একাত্তর-পরবর্তী কালে ইকবাল-চর্চা স্তিমিত হয়ে পড়েছে। স্কুলের পাঠ্যবই, বেতার, টেলিভিশন, সংবাদপত্র, জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় সাহিত্য ও সংস্কৃতির বলয়ে তথা জনপরিসরে ইকবাল অনুপস্থিত, অপাংক্তেয় এবং অস্পৃশ্য অপর।

আল্লামা ইকবালের কাব্য ও দর্শন যখন বাংলা অনুবাদের মধ্য দিয়ে পূর্ব বাংলায় ক্রমাগত প্রচার ও প্রসার লাভ করছিল তখন ১৯৭১ সালের রাজনৈতিক সংকট এই ধারায় ছেদ ঘটায়। জাতিবাদী হিংসা ও ঘৃণার সার্বিক প্লাবনে পরিবেশ বিষিয়ে ওঠে। এই পরিবেশের গর্ভ থেকে যে বাংলাদেশের অভ্যূদয় হয় তা আরো কামালবাদী হয়ে ওঠে। অর্থাৎ প্রতিহিংসায় আরো উগ্র সেক্যুলার, জাতিবাদী, বাঙালিত্ববাদী এবং পাঞ্জাবি-বিহারী জাতিসত্তা ও উর্দু ভাষা বিদ্বেষী হয়ে ওঠে। অসাম্প্রদায়িকতার ছদ্মবেশে এই ধর্মবিদ্বেষী সংকীর্ণ ও কূপমন্ডুক পরিবেশে জ্বলন্ত আগুনে তপ্ত হাওয়া দিতে এগিয়ে আসেন অনেক সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবি।

১১. ইকবালের বিশ্বজনীন ইসলামিকতা, রবীন্দ্রনাথের ‘মানুষের ধর্ম’, কাজী নজরুলের হিন্দু-মুসলিম ঐক্যসাধনা এবং আগামী বাংলাদেশের নবগঠন

আল্লামা ইকবালের কাব্যে ও দর্শনে ইসলামের বিশ্বজনীন ও সর্বজনীন চেতনা ও রূপ বিধৃত হয়েছে। কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ তার দ্বিজাতিতত্ত্ব ও পাকিস্তান প্রকল্পে আল্লামা ইকবালের এই বিশ্বজনীন ও সর্বজনীন ইসলামের চেতনা দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন, একথা ঠিক। কিন্তু একথাও অনস্বীকার্য যে ১৯৪০ সালে ঘোষিত লাহোর প্রস্তাবের পরিবর্তিত সংস্করণের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে যে ঐকিক রাষ্ট্র পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা আল্লামা ইকবালের এই বিশ্বজনীন ও সর্বজনীন চেতনা থেকে কিছুটা বিচ্যুত হয়েছিল। অর্থাৎ যে পাকিস্তান রাষ্ট্রটি ১৯৪৭ সালে গঠিত হয়েছিল সেটিকে আদতে তৎকালীন উপমহাদেশের হিন্দু-মুসলিম সমস্যার প্রেক্ষিতে একটি স্থানীয় ধর্ম-সম্প্রদায়ভিত্তিক জাতিবাদী প্রতিক্রিয়া হিশেবেই দেখা দরকার।

এই পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনে ইসলামের বিশ্বজনীন ও সর্বজনীন চেতনার কিছু চিহ্ন ও প্রতীক স্থান পেয়েছিল, একথা ঠিক। কিন্তু বস্তুতঃ এই পাকিস্তান রূপকল্পে উপমহাদেশের উর্দুভাষায় দক্ষ উত্তর-পশ্চিম ও উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের আশরাফ মুসলিমদের সম্প্রদায়ভিত্তিক জাতিবাদী আকাঙ্খা ও নেতৃত্ব কায়েম হয়েছিল। [৮] পূর্ব বাংলার বিশাল আতরাফ মুসলিম জনগোষ্ঠী পাকিস্তান আন্দোলনে সমর্থন দিয়েছিল তাদের কৃষক চেতনার আলোকে। এই বাঙালি মুসলিম কৃষক ও প্রজা শ্রেণির উপরে হিন্দু জমিদার শ্রেণি দীর্ঘদিন ধরে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ভিত্তিতে শোষণ ও জুলুম চালিয়ে আসছিল। তাই এরা জমিদারি প্রথা অবসানে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ পাকিস্তান প্রকল্পের মধ্যে নিজেদের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির সম্ভাবনা দেখতে পেয়েছিল। [৯] মওলানা আকরম খাঁ (১৮৬৮-১৯৬৯), শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক (১৮৭৩-১৯৬২), হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী (১৮৯২-১৯৬৩) প্রমুখ বাঙালি মুসলিম ব্যক্তিত্ব এই কৃষক চেতনার কমবেশি ধারক ও বাহক হিশেবেই এদের নেতৃত্ব অর্জন করেছিলেন।

তবে এক্ষেত্রে সবচাইতে অর্গ্যানিক নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী (১৮৮০-১৯৭৬), আবুল মনসুর আহমদ (১৮৯৮-১৯৭৯), আবুল হাশিম (১৯০৫-১৯৭৪) ও শেখ মুজিবুর রহমান (১৯২০-১৯৭৫)। [১০] শেখ মুজিবুর রহমান এমন এক অনন্য ব্যক্তিত্ব যিনি একাধারে পাকিস্তান আন্দোলনে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রশিক্ষিত করেছেন [১১] এবং পরবর্তীকালে বাংলাদেশ আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে পরিণত হয়েছেন। এজন্য তিনি ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি পেয়েছিলেন।

কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহকে পাকিস্তান কায়েমের লড়াইয়ে একাধারে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদ ও কংগ্রেস নেতৃত্বের মোকাবেলা করতে হয়েছিল। এই ত্রিমুখী লড়াইয়ের প্রেক্ষাপটে তিনি উপমহাদেশের মুসলিমদের আঞ্চলিক ও শ্রেণিগত বিভেদকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত প্রচ্ছন্ন করে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৪৮ সালের শেষের দিকে পূর্ব বাংলায় উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা করা প্রশ্নে যে বিরোধ দেখা দেয় তার মধ্য দিয়ে পাকিস্তান প্রকল্পের বোঝাপড়ায় উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল ও পূর্ব বাংলার মুসলিমদের ভিন্নতা উন্মুক্ত হয়ে পড়ে। এই বিরোধটি কেবলমাত্র জাতিগত বিরোধ ছিল না। এটি সেইসঙ্গে ছিল আশরাফ ও আতরাফ মুসলিমদের মধ্যকার একটি শ্রেণিগত বিরোধ।

এই বিরোধ যারা প্রকাশ করেছিলেন তারা মূলত বাঙালি মুসলিম শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রতিনিধি হলেও এদের উৎসস্থল ছিল পূর্ব বাংলার বৃহত্তর কৃষক সমাজের গভীরে নিহিত। [১২] মনে রাখতে হবে এই কৃষক শ্রেণি পাকিস্তানে যোগ দিয়েছিল জমিদারী প্রথার অবসানের মধ্য দিয়ে তাদের সার্বিক মুক্তির আকাঙ্খায়। কাজেই তারা এমন এক পাকিস্তান চেয়েছিল যেখানে জমিদারী প্রথা বিলুপ্ত হবে এবং তাদের পরবর্তী প্রজন্ম শিক্ষা দীক্ষা অর্জন করে সমাজ ও রাষ্ট্রে সমানভাবে অংশগ্রহণ করতে পারবে। এজন্যে তাদের নিজস্ব মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়াটা তাদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়েছিল।

আর এখানেই তৎকালীন পাকিস্তান রাষ্ট্রের কর্ণধারেরা সবচাইতে ভুল কাজটি করে বসলেন। আল্লামা ইকবালের বিশ্বজনীন ও সর্বজনীন ইসলামের চেতনা থেকে বিচ্যুতি আরেক কদম অগ্রসর হল। আশরাফ শ্রেণির আঞ্চলিক কৃষ্টি ও দৃষ্টির আলোকে উর্দুকে চাপিয়ে দেয়ার প্রচেষ্টা বাঙালি মুসলিম কৃষক শ্রেণি থেকে উঠতি নাগরিক মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত কয়েক বছরের মধ্যেই এক বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখাতে বাধ্য করল। এই বিরূপ প্রতিক্রিয়া কোন সাময়িক এবং ঐকিক বিষয় ছিল না। এই প্রতিক্রিয়ার মধ্যে নিহিত ছিল তাদের বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি ভিত্তিক সম্প্রদায়নিরপেক্ষ জাতিবাদী চেতনা ও আকাঙ্খা — যা পরবর্তী দুই দশক ধরে ক্রমাগত বিকশিত হয়েছে। [১৩]

এই বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি ভিত্তিক সম্প্রদায়নিরপেক্ষ জাতিবাদী চেতনার জাগরণের প্রেক্ষিতে পূর্ব বাংলায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ক্রমাগত অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে উঠতে থাকলেন। তার সাহিত্য ও সঙ্গীত উঠতি শিক্ষিত নাগরিক মধ্যবিত্ত শ্রেণির কাছে অনুসরণীয় ও জনপ্রিয় হয়ে উঠতে লাগল।

ইসলামের বিশ্বজনীন ও সর্বজনীন আদর্শের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। কিন্তু বস্তুতঃ পাকিস্তান রাষ্ট্র এর উপনিবেশিক কাঠামো অব্যাহত রেখে অগ্রসর হতে থাকে; সেইসাথে জমিদারী প্রথা উঠে গেলেও সামন্ত প্রভুদের আধিপত্য নিঃশেষ হয়ে যায়নি; সিভিল প্রশাসন, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও বহির্দেশীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল উপনিবেশিক আইন-কানুন ও পদ্ধতির আওতাধীন। এ কারণে পূর্ব বাংলায় উদ্ভূত এই ভাষাগত, সাংস্কৃতিক ও জাতিগত সমস্যার কোন ইনসাফ বা আদল ভিত্তিক সমাধান করা হয়নি; উপরন্তু এই সমস্যার সঙ্গে পরবর্তী দুই দশকে যুক্ত হয় আঞ্চলিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য ও বঞ্চনার একটি ক্রমবর্ধিষ্ণু বয়ান।

এই সবকিছু মিলিয়ে পূর্ব বাংলায় দেখা দেয় একটি স্বায়ত্বশাসন ও স্বাধিকার ভিত্তিক পূর্ণাঙ্গ জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবী ও আন্দোলন। এই আন্দোলনের বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক চেতনার যোগান দেবার জন্য রবীন্দ্রনাথ হয়ে ওঠেন এর প্রবক্তাদের কাছে প্রধান প্রণোদক আইকন বা প্রতিভূ। [১৪] উর্দু ভাষায় দক্ষ পাঞ্জাবি ও ভারতের উত্তর অঞ্চল থেকে হিজরত করা উর্দুভাষী মোহাজের বিহারী মুসলিম — বাস্তব পাকিস্তানে আধিপত্য বিস্তারকারী এই দুই জাতিসত্তার বিরুদ্ধে বাংলাভাষী পূর্ব বাংলার অধিবাসীদের এই সংগ্রাম পরিণত হয় একটি বাঙালি জাতিবাদী আন্দোলনে। আর এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য ও সঙ্গীত এই আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের জন্য একটি শক্তিশালী হাতিয়ারে পরিণত হয়। [১৫]

পাকিস্তানের আশরাফ মুসলিম নেতৃত্ব যতই এই বাঙালি জাতিবাদী আন্দোলনকে ভারতের ষড়যন্ত্র ও হিন্দুদের প্রভাবপুষ্ট বলে প্রচার করতে চেয়েছে ততই এই আন্দোলন আরো বেশি জোরদার হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রেও এই কথা সত্য; যখন রবীন্দ্রনাথের হিন্দু ও ভারতীয় পরিচয় তুলে ধরে তার প্রভাব ও জনপ্রিয়তাকে মোকাবেলা করার চেষ্টা করা হয়েছে তখনই তিনি এই বাঙালি জাতিবাদী আন্দোলনকারীদের কাছে আরো বেশি বরণীয় ও স্মরণীয় হয়ে উঠেছেন। এই প্রেক্ষিতেই ১৯৬১ সালে পূর্ব বাংলায় রাষ্ট্রীয় প্রতিবন্ধকতাকে উপেক্ষা করে বেসরকারীভাবে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী ব্যাপকভাবে উদযাপিত হয়েছিল। [১৬]

কিন্তু এই ধারা ১৯৭১-পূর্ব কালে একটি ইতিবাচক ভূমিকা পালন করলেও ১৯৭১-পরবর্তীকালে রবীন্দ্র অনুরাগীদের মধ্যে এক ধরণের উগ্র বাঙালি জাতিবাদী সাম্প্রদায়িকতার বিকাশ ঘটিয়েছে বলে লক্ষ করা যায়। এর প্রভাবে উর্দু ভাষা, উর্দুভাষী বিহারী ও সামগ্রিকভাবে পশ্চিম পাকিস্তানী জাতিসত্তাগুলি, বিশেষ করে পাঞ্জাবিদের প্রতি, একধরণের বিদ্বেষ ও ঘৃণার উদ্রেক হতে দেখা যায়। এই বিদ্বেষ ও ঘৃণা এতই সঞ্চারী যে এর প্রভাবে এরা এমনকি এদেশের নাগরিকদের মুসলমানত্ব ও অনেক ইসলামিকেট চিহ্ন ও প্রতীকের প্রতিও অবজ্ঞা, উপেক্ষা ও প্রতিহিংসা প্রদর্শন করে।

এরই প্রভাবে আল্লামা ইকবালের বিশ্বজনীন ও সর্বজনীন ইসলাম-ভাষ্য থেকে পূর্ব বাংলার বাংলাভাষীরা মুখ ফিরিয়ে নিতে থাকে। এমনকি রবীন্দ্রনাথের উপনিষদ ও বাউল চেতনা আশ্রয়ী যে বিশ্বজনীন ও সর্বজনীন “মানুষের ধর্ম” বা সম্প্রদায় ও জাতিনিরপেক্ষ মহামানব চেতনা, তা যতটা না এই বাঙালি জাতিবাদীরা আত্মস্থ করতে পেরেছে, তার চাইতে তারা রবীন্দ্রনাথকে পাকিস্তানী চেতনার একটি প্রতিচেতনা হিশেবে বেশি চর্চা করেছে।

একইভাবে এই উগ্র বাঙালি জাতিবাদী ও সাম্প্রদায়িকেরা কাজী নজরুল ইসলামের হিন্দু-মুসলিম যৌথ ঐতিহ্য ও ঐক্য সাধনাকে যতটা না অনুশীলন করেছে, তার চাইতে বেশি অনুশীলন করেছে নজরুলকে সামনে রেখে পাকিস্তানবাদ বর্জনের নামে পশ্চিম বঙ্গের বাঙালি হিন্দু রচিত সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি অতিভক্তি; এবং উর্দু ও ফারসি ভাষা ও এসব ভাষার সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি একধরনের বিদ্বেষ ও ঘৃণা।

এভাবে পূর্ব বাংলার বাঙালি একাধারে উপমহাদেশের তিন তিনজন মহাপুরুষের বিশ্বজনীন ও সর্বজনীন চেতনা ও আদর্শের প্রতি ইনসাফ ও আদল করতে ব্যর্থ হয়েছে; এবং তাদের উচ্চতর আদর্শ ও চেতনা থেকে বিচ্যুত হয়ে একধরনের অদ্ভূত, স্থূল, সংকীর্ণ, কূপমন্ডুক, আত্মকেন্দ্রিক, একভাষী ও উর্ধ্বে মাঝারিমানের প্রজাতিতে পরিণত হয়েছে। এই কারণে এদের মধ্যে বিশ্বমানের বা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বৃহত্তর ও উচ্চতর উৎকর্ষ ও অর্জনের কোন নজির অত্যন্ত দুর্লভ।

এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে আগামী বাংলাদেশকে বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিকভাবে পুনর্গঠিত ও নবগঠিত করা এখন সময়ের দাবী ও প্রয়োজন।

১২. ইকবালের বিশ্বজনীন ও সর্বজনীন ইসলামিকতা এবং বাঙালি মুসলমানের বিপ্রতীপ স্বদেশচেতনা

আমরা এখানে দেখতে চাইব যে — বাঙালি মুসলমানের পাকিস্তান রাষ্ট্রকল্পনায় শুরু থেকেই কী ভিন্নতা ছিল? এবং সেইসাথে বাঙালি মুসলমানের স্বদেশচেতনা কোন ভিন্ন শিক্ষাগত, ভাষাগত, সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও ধর্মবিষয়ক আদর্শ ও রূপকল্প দ্বারা পরিগঠিত হয়েছিল? অর্থাৎ কী কারণে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পরেই পূর্ব বাংলায় ধর্মভিত্তিক পাকিস্তান রাষ্ট্রকল্পনা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছিল?

এইসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে প্রথমেই আমাদেরকে পর্যালোচনা করতে হবে বাঙালি মুসলমানের তৎকালীন উঠতি মধ্যবিত্ত শ্রেণির উন্মেষ ও বিকাশকে। এদের আধুনিক শিক্ষা, ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, বুদ্ধিবৃত্তি ও ধর্মবোধের আদর্শ ও প্রেরণার মেট্রিক্স বা উৎসভূমি হিশেবে উনিশ শতকের কলকাতায় উন্মেষিত ও বিকশিত বাংলার রেনেসাঁকে বিশ্লেষণ করতে হবে। বিশ শতকের প্রথমার্ধে পূর্ব বাংলার মধ্য কৃষক শ্রেণি থেকে উদীয়মান এই আধুনিক মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রমিত ও লিখিত ভাষা, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, বুদ্ধিবৃত্তি ও ধর্মবোধ – এর সবই উপনিবেশিক কাঠামোর অধীনে পরিগঠিত হয়েছিল; আর তা হয়েছিল উনিশ শতকের কলকাতায় হিন্দু বাঙালি বাবু ভদ্রলোক শ্রেণি কর্তৃক উন্মেষিত ও বিকশিত বাংলার রেনেসাঁর আলোকে।

উপনিবেশিক কাঠামোর অধীনে ইংরেজী ভাষা শিক্ষা সূত্রে বাঙালি মুসলিম শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি ইউরোপীয় এনলাইটেনমেন্টের ছিটেফোঁটার সঙ্গে পরিচিত হতে পেরেছিল একথা ঠিক। কিন্তু তার চাইতেও বড় সত্য হল বাঙালি মুসলমানের চেতনাজগতের যাবতীয় ইউরোপীয় ও অ-ইউরোপীয় উপাদান ও অনুষঙ্গ সেখানে প্রবেশ করেছিল তার চাইতে অপেক্ষাকৃত অগ্রসর হিন্দু বাঙালি বাবু ভদ্রলোকের মধ্যস্থতায়। আধুনিক শিক্ষিত বাঙালি মুসলমানের চৈতন্যের আয়নায় প্রতিফলিত হত উনিশ শতক থেকে বিকাশমান কলকাতার বাঙালি হিন্দুর মনোজগতের প্রতিচ্ছায়া। আর এখানেই নিহিত রয়েছে আধুনিক শিক্ষিত বাঙালি মুসলমানের যাবতীয় মনোজাগতিক নির্ভরতা ও পরাধীনতার রহস্য।

এই আধুনিক শিক্ষিত বাঙালি মুসলমান পূর্ব বঙ্গের অধিবাসী হলেও, পূর্ব বঙ্গীয় আঞ্চলিক ভাষায় কথা বললেও, ধর্মীয় পরিমন্ডলে ইসলামের অনুসারী হলেও এর মানসজগতে রাজত্ব করতেন বিদ্যাসাগর, মধুসূদন, বঙ্কিমচন্দ্র, হেমচন্দ্র, নবীনচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, প্রমথ চৌধুরী, শরৎচন্দ্র, বিভূতিভূষণ, জীবনানন্দ, বুদ্ধদেব বসু প্রমুখ। এদের রচনার ভাষা, চিন্তা ও কল্পনার রঙে রঞ্জিত ছিল বাঙালি মুসলিম আধুনিক শিক্ষিত মধ্যবিত্তের চেতনা ও মন।

আধুনিক শিক্ষিত মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণির একাংশ স্যার সৈয়দ আহমদ প্রবর্তিত আলীগড় শিক্ষা আন্দোলনের চেতনা ও আদর্শের তাজদীদি রূপে উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। এরা আল্লামা ইকবাল ও কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর অনুপ্রেরণায় পাকিস্তান রূপকল্পে অংশীদার হলেও এটি ছিল আসলে তৎকালীন পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে একটি সাময়িক ও ব্যতিক্রমী সিদ্ধান্ত।

এই সিদ্ধান্তের নেপথ্যে ছিল উঠতি বাঙালি মুসলিম মধ্য কৃষকের হিন্দু জমিদারী প্রথার নিগড় থেকে মুক্তির আকাঙ্খা। এই আকাঙ্খার ভেতরে আধুনিক শিক্ষিত বাঙালি মুসলিম শ্রেণিও তার শ্রেণিস্বার্থ চরিতার্থ করার সম্ভাবনা দেখতে পেয়েছিল। কিন্তু এই বস্তুগত আর্থ-সামাজিক স্বার্থচিন্তা বাঙালি মুসলিমকে পাকিস্তান কল্পনায় উদ্বুদ্ধ করলেও তার মনোজগতে হিন্দু বাঙালি বাবু ভদ্রলোকের চেতনা ও আদর্শের প্রভাব অব্যাহতই থেকে গিয়েছিল। কাজেই মুসলিম লীগের সক্রিয় উদ্যোগে যখন জমিদারী প্রথা বিলুপ্ত হল এবং বাঙালি মুসলিম মধ্য কৃষক ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির আর্থ-সামাজিক বিকাশের দ্বার উন্মোচিত হল তখন তার জীবনে পাকিস্তানের প্রাসঙ্গিকতা যেন অনেকটা হ্রাস পেল। তার মনোজগতে কলকাতার বাঙালি হিন্দু বাবু ভদ্রলোক স্থাপিত চেতনা ও আদর্শের আলোকে সে তার জীবন ও জগতকে দেখতে ও বুঝতে অভ্যস্ত হল। এরই পরিণতিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অল্প কয়েক মাসের মধ্যেই রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে পূর্ব বাংলায় পাকিস্তান কল্পনার অন্তর্গত বিভ্রান্তি ও বৈপরীত্যের আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল। এরই একটি মাইলফলক হিশেবে দেখা যায় ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারীর পূর্বাপর ঘটনাবলীকে।

আধুনিক শিক্ষিত বাঙালি মুসলিম তার চেতনালোক ও মনোজগত গঠন করেছে বাংলার রেনেসাঁর সূতিকাগার কলকাতার আদলে। ইংরেজ প্রাচ্যবাদীদের ধাত্রীত্বে বাঙালি বর্ণ হিন্দু পন্ডিতদের হাতে সূচিত এই উপনিবেশিত আধুনিকতা, মনন ও সৃজনশীলতার গর্ভেই জন্ম নিয়েছিল বাঙালি মুসলিম মধ্যবিত্তের মনোলোক ও কল্পনালোক। এক্ষেত্রে কলকাতাই ছিল তাদের সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক কেবলা। দেওবন্দ, আলীগড় কিংবা লাহোর নয়।

এমনকি উনিশ শতকে বাংলার নিম্নবর্গীয় গ্রামীন কৃষক শ্রেণির মধ্যে তিতুমীর এবং হাজী শরীয়তউল্লাহ প্রমুখের নেতৃত্বে যে তৃণমৌলিক ইসলামিকতার সংস্কার আন্দোলন ও সংশ্লিষ্ট কৃষক চৈতন্যের উদ্বোধন হয়েছিল তার শিক্ষা, চিন্তা ও কল্পনাকেও এই আধুনিক শিক্ষিত উদীয়মান বাঙালি মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণি তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক কেবলা হিশেবে গ্রহণ করেনি।

তারা এমনকি উপমহাদেশের ঐতিহ্যবাদী উলামাদের পরিমন্ডলের বাইরে থেকে উদ্ভূত মওলানা মওদূদীর জাতীয়তাবাদ-উত্তর ইসলামিকতা নির্ভর সমগ্রবাদী রাষ্ট্রকল্পনার প্রতিও সেই সময়ে তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো আগ্রহ দেখায়নি।

দেওবন্দ, লখনৌ, আলীগড় এবং লাহোর ভিত্তিক এইসব উপমহাদেশীয় মুসলিম ও ইসলামিকতার আদর্শ ও অনুসরণীয় নকশাকে আংশিক বা সম্পূর্ণ বর্জন করে তারা মূলত কলকাতাকেই তাদের কেবলা হিশেবে গ্রহণ করেছে। এর সবচাইতে বড় কারণ হল কলকাতা আদর্শটি যতই আত্মস্বাতন্ত্র্য বিনাশী হোক না কেন আফটার অল এর প্রকাশ তো বাংলা ভাষাতেই হয়েছে; যা বহু ভাষা আয়ত্ত করতে অপারঙ্গম এই উঠতি আধুনিক শিক্ষিত বাঙালি মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য আত্মস্থ করা অপেক্ষাকৃত সহজতর ছিল।

উপরের এইসব পর্যালোচনা থেকে যে শিক্ষাটি সিদ্ধান্ত হিশেবে টানা যেতে পারে তা হল বাঙালি মুসলিমকে যদি একটি স্থায়ী ও আত্মনির্ভর স্বদেশচেতনা ও রাষ্ট্রকল্পনায় উপনীত হতে হয় তাহলে তাকে ঢাকা কেন্দ্রিক একটি বিশ্বমানের ইসলামিকতা নির্ভর জীবন দর্শন, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ধর্মবোধ পরিগঠন করতে হবে। এটি এদেশের মানুষের নিজস্ব ও অর্গ্যানিক বাংলা ভাষাতেই প্রকাশিত হতে হবে; তবে তার নেপথ্যে থাকতে পারে আরবি, ফারসি, উর্দু ও ইংরেজীসহ বহুভাষা বাহিত জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার একটি সমৃদ্ধ ভাবুকতা ও সক্রিয়তা।

১৩. ইকবাল এবং আধুনিক মুসলিম বাংলা সাহিত্য ও ভাবনা

কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬)-এর আবির্ভাবে আধুনিক মুসলিম বাংলা সাহিত্যে ও ভাবনায় নবযুগের অবতারণা হয়েছিল। তিনি কেবল বিষয়বস্তুর মুসলিম প্রসঙ্গ ও অনুষঙ্গে সীমাবদ্ধ থাকলেন না। তার কবিতা ও গানের ভাষা, রীতি, আঙ্গিক, প্রকরণ, শৈলী, ভাব ও ভাবনায় মুসলিম চারিত্র জারিত করে দিলেন। আর এটাই আধুনিক বাংলা সাহিত্যে কাজী নজরুল ইসলামের অন্যতম মহৎ কীর্তি। তিনি আধুনিক যুগে বাংলা ভাষাকে আবার সুলতানী যুগ থেকে অনুসৃত আরবি, ফারসি ও উর্দু ভাষার প্রভাবাধীন করে তুললেন। এভাবে বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিক বাংলা ভাষার পুনঃসংযোগ করলেন। এটি বাংলা সাহিত্য ও ভাবনায় যে রীতিমত একটি মহাবিপ্লব এতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।

কাজী নজরুল অবশ্য ব্রিটিশ উপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে হিন্দু-মুসলিম সম্মিলিত ঐক্য ও সমন্বয়ের প্রবক্তা ও অনুসারী ছিলেন। এদিক থেকে আল্লামা ইকবালের আধুনিক ইসলামিকতা নির্ভর স্বতন্ত্র বিশ্বসম্প্রদায় ও বিশ্বপরিসর চেতনা থেকে তিনি পৃথক ছিলেন বলা যায়। কিন্তু তাদের উভয়ের চেতনায় একধরনের বিশ্বজনীন ও সর্বজনীন মানবিকতা ভিত্তিক ঐক্য ও সাদৃশ্য ছিল, একথাও বলা যেতে পারে।

১৪. ইকবাল এবং পূর্ব বাংলার রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন

আল্লামা ইকবাল আধুনিক কালে ইসলামের সক্রিয়তামুখী ও সামগ্রিক একটি ভাষ্য প্রদান করেছিলেন। এটি করতে গিয়ে তিনি পাশ্চাত্য সভ্যতার কয়েকটি মৌলিক ত্রুটি ও দুর্বলতা উন্মোচিত করেছিলেন। আমরা জানি জার্মান শ্রেষ্ঠ কবি গ্যেটে তার একটি রচনায় পাশ্চাত্য চেতনার অসম্পূর্ণতা পূরণের আকাঙ্খায় প্রাচ্য থেকে কোন একটি সমাধানসূত্র অনুসন্ধান করেছিলেন। ইকবালের কাব্য ও দর্শনে যে “পায়ামে মাশরিক” বা প্রাচ্য বার্তা প্রকাশিত হয়েছে সেখানে জার্মান প্রাচ্য বিশারদ আনমারি শিমেল কবি গ্যেটের সেই প্রত্যাশার তৃপ্তিকল্প দেখতে পেয়েছেন। এ কারণে ইকবাল যেমন একদিকে “আল্লামা” অর্থাৎ ইসলামিকতার মহাজ্ঞানী শিক্ষক অভিধা পেয়েছেন, তেমনি তিনি একাধারে “শায়েরে মাশরিক” বা প্রাচ্যের কবি উপাধিও পেয়েছেন।

আল্লামা ইকবালের বৈশ্বিক সম্প্রদায় ও দেশ-চেতনা একটি সুডৌল কাব্যিক ও দার্শনিক প্রত্যয় ও রূপকল্প। এটি কোন চটজলদি, ফরমায়েশি কিংবা মেঠো রাজনৈতিক বা আর্থ-সামাজিক প্রস্তাবনা নয়। এই প্রত্যয়টি ইসলামিকতার বিশ্বজনীন ভাষ্যের উপরে ভিত্তি করে যে বিশ্বসম্প্রদায় ও বিশ্বদেশচেতনা উপস্থাপন করে সেটি বর্ণ, ভাষা, নৃসত্তা, জাতিসত্তা প্রভৃতি সীমান্ত অতিক্রমী একটি বিশ্বমানবিক ধারণা ও প্রত্যয়। কাজেই আল্লামা ইকবালের এই বিমূর্ত ও দার্শনিক প্রত্যয় ও চিন্তাকল্প যারা বাস্তবায়ন করতে চেয়েছিলেন তাদের যোগ্যতা ও দক্ষতা সম্পর্কেও সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর প্রত্যাশা সমানুপাতিক হবে সেটাই স্বাভাবিক। তার চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে যারা বাস্তব রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক বিনির্মাণে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন তাদের কাছে একারণেই অনেক দূরদর্শীতা, সহনশীলতা, ধৈর্য ও উদারতা কাম্য ছিল।

কিন্তু আমরা বাস্তবে কী দেখলাম? আমরা দেখলাম আদর্শের প্রতি আনুগত্য ও অঙ্গীকারের নামে সামষ্টিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার পরিবর্তে অনেক ক্ষেত্রেই একক, স্বৈরাচারী ও স্বেচ্ছাচারী আচরণ ও উদ্ধত কর্মকান্ড। নেতৃত্বের জাতীয় পর্যায় থেকে প্রাদেশিক পর্যায় পর্যন্ত এই প্রবণতা প্রধান হয়ে উঠলে নেতৃত্ব ও সাধারণের মধ্যে দূরত্ব, বিরাগ, বিভ্রান্তি থেকে শেষমেষ ঘৃণা ও শত্রুতাই উৎপন্ন হতে পারে। এবং তা-ই হয়েছিল। আর সেই প্রেক্ষিতে বলা যায় আল্লামা ইকবাল কত দূরদর্শী ও ভবিষ্যদর্শী ছিলেন যে তিনি অনেক আগেই বলে গিয়েছিলেন যে কবিদের হৃদয়ে জাতিসত্তার জন্ম হয়, আর তার মৃত্যু হয় রাজনীতিবিদদের হাতে।

ইতিহাসের চলমান এই বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক বয়ানের দস্তুর মেনে এখানে খুঁটিনাটি তথ্য ও অনুপুঙ্খ দিয়ে পাঠককে ভারাক্রান্ত করতে চাই না। অর্থাৎ এই ইতিহাস প্রধানত ঘটনাপঞ্জীর কালানুক্রমিক বিন্যাস নয়; নয় সময়ের ক্যানভাসে তাথ্যিক অনুপুঙ্খের সংকলন বা গ্রন্থনা। এই ইতিহাস মূলত ঘটনাপঞ্জীর নেপথ্যে কার্যরত নিয়ামক বুদ্ধিবৃত্তিক এবং সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ববৃন্দের প্রাসঙ্গিক প্রত্যয় কাঠামোর বহুমুখী বয়ানের সমাহার। যদিও এখানে কোনো একটি সুনির্দিষ্ট বয়ানের কমবেশি সময়ানুক্রমিক অগ্রগতির সঙ্গে বাকী সহায়ক ও প্রতিদ্বন্দ্বী বয়ানগুলিকে গ্রন্থিত করা হয়েছে। তাই বলে এটিকে পক্ষপাতমূলক বলা যাবে না; সর্বোচ্চ হয়তো লেখকের প্রাধিকার বলা যেতে পারে।

তো, এই আলোকে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পরেই পূর্ব বাংলায় সংঘটিত রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট, কারণ ও ফলাফলের বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক বয়ান তৈরি করা সম্ভব। একদিকে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা যারা করতে চেয়েছিলেন তারা যেমন প্রাদেশিক বিভিন্নতা ও বৈচিত্র্যকে না বুঝে গোয়ার্তুমি করেছিলেন; অন্যদিকে যারা উর্দুর পাশাপাশি বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবী আদায় করেছিলেন, তাদের একাংশ পরবর্তীকালে বাড়াবাড়ি করে এই বাংলা ভাষার প্রতি অতিআনুগত্য দেখিয়ে একধরনের উর্দু ও অবাঙালি মুসলিম বিদ্বেষ ও ঘৃণার চর্চা করেছেন। অর্থাৎ দুটি পক্ষই একধরনের ঘৃণাবাদী জাতিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার তলদেশে নিমজ্জিত হয়েছিলেন। তারা তাদের দার্শনিক দারিদ্র্যের কারণে এই দুর্ভাগ্যজনক পরিণতিতে উপনীত হয়েছিলেন। তারা উভয়েই বর্ণ হিন্দুর সাম্প্রদায়িকতার প্রতিবাদে ও প্রতিরোধে পাকিস্তান রাষ্ট্রকল্পনায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন, একথা ঠিক। কিন্তু ঘটনাচক্রের পরিহাসে তারা নিজেরাই পরস্পরের প্রতি উগ্র জাতিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতায় আক্রান্ত হয়ে পড়লেন।

এই প্রেক্ষিতেই আমরা দেখতে পেলাম পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলনের প্রতিবেদনমূলক ইতিহাস রচয়িতা বদরুদ্দীন উমর (জন্ম ১৯৩১) তার বিভিন্ন গবেষণামূলক গ্রন্থাদির মাধ্যমে এক বাঙালি জাতিবাদী বয়ান খাড়া করলেন। যদিও তার বয়ানে জাতিবাদের সম্পূরক হিশেবে একটি বামপন্থী শ্রেণিবাদী বয়ানও কমবেশি লক্ষ করা যায়। তিনি পাকিস্তানের পঞ্চাশ ও ষাট দশকের বাস্তব রাজনৈতিক, আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের বিশ্লেষণ করে একটি নয়া “সাম্প্রদায়িকতা” ও “সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা”র বয়ান হাজির করলেন। এভাবে যে পাকিস্তান বর্ণ হিন্দুর সাম্প্রদায়িকতার একটি সম্ভাব্য সমাধান হিশেবে কায়েম হয়েছিল, বদরুদ্দীন উমরের বয়ানে সেই খোদ পাকিস্তান-ই একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র বলে প্রতিপাদিত হল। এখানে তার একটি বই থেকে এই প্রাসঙ্গিক উদ্ধৃতিটি দিচ্ছি যেখানে তিনি ভাষা আন্দোলনকে বাঙালি মুসলিমের “স্বদেশ প্রত্যাবর্তন” বলে আখ্যায়িত করেছেন:

“১৯৪৭ সাল থেকে ভাষা ও সংস্কৃতির সংগ্রাম তাই অনেকাংশে তাদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনেরই সংগ্রাম। … …বাঙালী পরিচয়ে সে আর লজ্জিত হল না। যে চিত্ত ছিল পরবাসী, সে চিত্ত সচেষ্ট হল স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে। প্রতিকূল শক্তি এবং সংস্কার এ পরিবর্তনকে প্রতিহত করা সত্ত্বেও ঘরে ফেরার এ সংগ্রাম রইল অব্যাহত এবং তা জয় করে চলল একের পর এক ভূমি — স্বীকৃত হল রাষ্ট্রভাষা বাংলা, বাংলা সাহিত্যের হাজার বছরের ঐতিহ্য; স্বীকৃত হল রবীন্দ্রনাথ এবং পয়লা বৈশাখ। এ স্বীকৃতির …সত্যিকার ক্ষেত্র হল পূর্ব পাকিস্তানী মুসলমান মধ্যবিত্তের বিস্তীর্ণ মানসলোক। এদেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের বর্তমান পর্যায়কে তাই মোটামুটিভাবে বলা চলে মুসলমান বাঙালি মধ্যবিত্তের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন।” [১৭]

পূর্ব-পাকিস্তান সাংস্কৃতিক চেতনার অগ্রনায়ক আবুল মনসুর আহমদও রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন; তিনিও বাংলা ভাষার সপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন; কিন্তু তার কাছে বাংলা ভাষার যে আদলটি আদর্শ ছিল তা হল মধ্যযুগের মুসলিম সাহিত্যিকদের হাতে গড়া আরবি-ফারসি ও আঞ্চলিক শব্দ সমৃদ্ধ বাংলা ভাষা। এছাড়া তিনি লাহোর প্রস্তাবের মূল স্পিরিটের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ ছিলেন; কাজেই তিনি ভাষা আন্দোলন ও পরবর্তী ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের অভ্যূদয়কেও এই লাহোর প্রস্তাবের আলোকেই আত্মস্থ করতে পেরেছিলেন। তিনি বাংলাদেশ আন্দোলন, ১৯৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং ১৯৭১-উত্তর বাংলাদেশ রাষ্ট্রে ভারতীয় প্রভাব ও আধিপত্যকে একারণেই বরাবর সমালোচনা করতে পেরেছেন।

বাঙালি মুসলমানের বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক কোন রূপকল্পটি বর্তমান বাংলাদেশ রাষ্টের স্বতন্ত্র, স্বাধীন ও সার্বভৌম অস্তিত্বের জন্য সবচাইতে উপযুক্ত? এক্ষেত্রে আবুল মনসুর আহমদ ও তার সমমনাদের আমরা একটি প্যারাডাইম এবং বদরুদ্দীন উমর ও তার সমমনাদের একটি বিপ্রতীপ প্যারাডাইম হিশেবে বিবেচনা করতে পারি।

১৫. ইকবাল এবং একুশে ফেব্রুয়ারি-উত্তর পূর্ব বাংলার সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক নবজাগরণের প্রেক্ষিত

ইকবালের মুসলিম স্বাতন্ত্র্যচেতনার ক্রমহ্রাস বুঝতে হলে বাঙালি মুসলমানের বুদ্ধিবৃত্তিক, সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক রেনেসাঁ বা নবজাগরণের বেশ কয়েকটি ভিন্ন ভিন্ন পর্যায় ও ধারাকে বুঝতে হবে। উনিশ শতকের শেষ থেকে বিশ শতকের বিভিন্ন পর্যায়ে এসবের উন্মেষ ও বিকাশ হয়েছিল। এর মধ্যে বিশ দশকের ‘বুদ্ধির মুক্তি’ আন্দোলন ছিল র‍্যাডিক্যাল যুক্তিবাদী, উদারনৈতিক ও আধুনিক ধারার। অন্যদিকে চল্লিশ দশকের প্রথম দিকের ‘পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটি’ এবং ‘পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ’ ছিল মূলত মুসলিম স্বাতন্ত্র্যবাদী ধারার। আর চল্লিশ দশকের শেষ দিকের ‘তমদ্দুন মজলিশ’ ছিল একাধারে ইসলামমনস্ক এবং কিছুটা সমাজতন্ত্র প্রভাবিত।

কিন্তু ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির মধ্য দিয়ে পূর্ব বাংলায় যে সাহিত্য, সংস্কৃতি ও বুদ্ধিবৃত্তি এদেশের শিক্ষিত ও নাগরিক মধ্যবিত্ত শ্রেণির নেতৃত্বে ব্যাপক জনসাধারণকে প্রভাবিত করেছিল তা হল বাংলা ভাষা, জাতিসত্তা ও সংস্কৃতি ভিত্তিক এক সর্বাত্মক চেতনা। এই চেতনাকে এর প্রবক্তারা ইসলামিকতার প্রভাবমুক্ত রাখতে চেয়েছেন; তারা একে বলেছেন “অসাম্প্রদায়িক” এবং “আধুনিক”। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যূদয়ের পরে এই চেতনার “ধর্মনিরপেক্ষ”, ‘ইহজাগতিক’ ও ‘সমাজতান্ত্রিক’ ব্যাখ্যাও তারা দিতে চেয়েছেন; যদিও তা জনসাধারণের ব্যাপক সমর্থন পায়নি।

১৬. রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল পড়া বাঙালি মুসলমানের জন্য ইকবাল কেন প্রয়োজন

১৯০৫ সালে প্রথম বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হয়েছিল। কবি ইকবাল তখন একজন তরুণ শিক্ষার্থী। উচ্চ শিক্ষার্থে ইউরোপে গেছেন। প্রথমে ইংল্যান্ড এবং পরে জর্মানী। ১৯০৬ সালে ঢাকায় মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। কবি ইকবাল ১৯০৮ সালে উপমহাদেশে ফিরে আসেন। তার কাব্যচিন্তায় পরিবর্তন দেখা দেয়। ১৯১১ সালে প্রথম বঙ্গভঙ্গ রদ হয়ে যায়। এই সময় কবি ইকবাল কর্তৃক আতীয়া ফয়েজীকে লেখা এক চিঠির সূত্রে আমরা জানতে পারি যে এই বঙ্গভঙ্গ রদ হয়ে যাওয়া তিনি পছন্দ করেননি। তিনি এই প্রসঙ্গে ব্যঙ্গ করে লেখেন:

“মুন্দমিল জখমে দিলে বঙ্গাল আখির হোগয়া

য়ো যো থি প্যাহলে তামিজে কাফির ও মোমিন গয়ী

তাজশাহী আজ কল্কেত্তে সে দেহলি আ গয়ে

মিল গয়ী বাবু কো জুত্তী, অওর পাগড়ী ছিন গয়ী।” [১৮]

অনুবাদ:

বাংলার হৃদয়ের আঘাত যেন ক্ষতচিহ্ন হয়ে শেষ হল

কাফির ও মোমিনে ভেদকারী শিষ্টাচার যেন মিটে গেল

রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লীতে সরে আসলো

বাঙালি বাবুর কপালে জুতা জুটল, আর তার পাগড়ীও ছিনে নিল। [১৯]

এই ব্যঙ্গ কবিতা থেকে অনুমান করা যায় যে কবি ইকবাল বঙ্গভঙ্গ রদ হবার নেপথ্যে কার্যকর বাংলার হিন্দু, মুসলিম ও ব্রিটিশদের ত্রিমাত্রিক নোংরা রাজনীতি সম্পর্কে বেশ ভালোই ওয়াকেফহাল ছিলেন। স্বতন্ত্র মুসলিম আত্মপরিচয় বজায় রেখে একদিকে হিন্দু আধিপত্য ও অন্যদিকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন মোকাবেলার বিষয়টি তার কাছে এই সময় থেকেই পরিস্কার ছিল।

কবি ও দার্শনিক ইকবাল লিখতেন ফারসি, উর্দু ও ইংরেজী ভাষায়। এই কারণে তার রচনা বাংলাভাষীদের কাছে খুব বেশি প্রবেশ করতে পারেনি। বাংলা ভাষায় লেখার কারণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলামের রচনা বাংলাভাষীদের কাছে বেশি সমাদৃত হতে পেরেছিল। রবীন্দ্র কাব্যে বাঙালি পেয়েছিল গীতিকাব্যের আঙ্গিকে হিন্দু ব্রাহ্ম ঐতিহ্য থেকে ঔপনিষদিক ঈশ্বর বন্দনা, সোনার বাংলার নদ-নদী-নৌকা ও প্রকৃতিলগ্ন মানুষের চিত্রকল্প সমৃদ্ধ অপূর্ব কাব্যশিল্প। সেখানে বাংলার যে সৌন্দর্য পরিস্ফুটিত হয়েছে তা প্রাচীন ভারতের তপোবন থেকে অনেক সহস্রাব্দ ব্যাপী ইতিহাস পেরিয়ে আধুনিক অখন্ড ভারতে দীপ্যমান রয়েছে। এর সঙ্গে তিনি যোগ করেছিলেন বাউল সহজিয়া ও মরমিয়া জীবনচর্যা। এই সব কিছু মিলিয়ে রবীন্দ্রনাথ এক মানুষের ধর্ম প্রস্তাব করেছিলেন এবং এই চেতনাকে বিশ্বজনীন করে তুলতে চেয়েছিলেন। কলকাতা কেন্দ্রিক বাঙালি হিন্দু এলিট শ্রেণির কাছে এই রবীন্দ্র জীবন ও সৌন্দর্য চেতনা আদরণীয় হয়ে উঠেছিল। এই এলিট শ্রেণিতে বাঙালি মুসলমানের যে যৎসামান্য প্রতিনিধিরা ছিলেন তাদের কাছেও রবীন্দ্রনাথ স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে উঠেছিলেন।

বিশ শতকের বিশের দশকে কাজী নজরুল ইসলাম যে কাব্যধারার সূচনা করলেন তা রবীন্দ্রনাথের মত এত এলিটিস্ট ছিল না। তিনি ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের যে অগ্নিবীণা বাজালেন তা হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে বৃহত্তর বাঙালি সমাজে প্রবেশাধিকার পেয়েছিল। অল্পশিক্ষিত শ্রেণির কাছেও তা পৌঁছুতে পেরেছিল। আবার নজরুল যেহেতু আরবি-ফারসি-উর্দু ভাষা থেকে প্রচুর শব্দ ব্যবহার করে তার কবিতার শরীর সাজিয়েছিলেন তাই তিনি বাংলা ভাষাকে প্রাক-ঔপনিবেশিক সুলতানী ও মুঘল যুগের সাহিত্য-ভাষার ঐতিহ্যে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। এর ফলে নজরুলের ভাষা ও সাহিত্য সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি মুসলমানের প্রতিনিধি হয়ে উঠেছিল। এক্ষেত্রে কাজী নজরুল বাঙালি মুসলমান সমাজের কাছ থেকে বিশেষ সমীহ অর্জন করেছিলেন।

অর্থাৎ বাংলা সাহিত্যে একাধারে রবীন্দ্রনাথ ও কাজী নজরুলের উপস্থিতি এমন এক কাব্য বৈভব সৃষ্টি করেছিল যে সেখানে কবি ইকবালের ভিন্ন ভাষায় রচিত কবিতার সম্ভাবনা-পরিসর কমই ছিল বলা যায়। কিন্তু এর পরেও কবি ইকবালের কবিতা বাংলাভাষীদের মধ্যে বিশেষ করে বাংলাভাষী মুসলমানদের মধ্যে প্রবেশাধিকার পেয়েছিল।

কেন পেয়েছিল? এর কারণ হল কবি ইকবাল তার কবিতায় সাধারণভাবে মুসলিম উম্মাহর এবং বিশেষভাবে উপমহাদেশের মুসলিমদের অবক্ষয়, পতন ও তা থেকে উত্তরণের সম্ভাবনার এমন এক চিত্রকল্প এঁকেছিলেন যা বাংলাভাষী অন্য কোন কবির পক্ষে সম্ভব হয়নি। কাজী নজরুল ইসলাম তার কবিতার ভাষা ও বিষয়ে বিভিন্ন মুসলিম ভাষা ও ঐতিহ্য থেকে আহরণ করে বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করতে পারলেও তিনি তার কাব্যে চিরায়ত ইসলামের কোনো আধুনিক অথচ গ্রহণযোগ্য ভাষ্য বিনির্মাণ করেননি। নজরুলের কবিতায় রয়েছে দ্রোহের অস্থিরতা ও উচ্ছলতা, কিন্তু সেখানে পরম বিশ্বাসের নিশ্চয়তা ও স্থিরতা নেই। ইকবালের কবিতা ও দর্শনে তা আছে। কুর’আন ও সুন্নাহর চিরায়ত সত্যকে তিনি তার স্থান-কাল-পাত্র অনুযায়ী রূপায়িত করেছেন, উপস্থাপিত করেছেন। এই কারণে বাঙালি মুসলিম কাব্যরসিকেরা ইকবালের ভাষার দেয়াল টপকে তাকে আপন করে নিতে চেয়েছে। যারা মূল ভাষায় একাজ করতে পেরেছে তাদের রসাস্বাদন তো সেই মাত্রায় হয়েছে; আর যারা অনুবাদের মাধ্যমে করেছে তারাও কমবেশি ইকবাল চেতনা ও সৌন্দর্যকে স্পর্শ করেছে।

১৭. মুসলিম স্বাতন্ত্র্যচেতনা, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে কামালবাদের বিবর্তন

পাকিস্তান রাষ্ট্রের নেতৃত্বে যে মুসলিম লীগ অধিষ্ঠিত হয়েছিল তার ইসলামিকতা ছিল এক বিশেষ ধরনের ইসলামিকতা। পাশ্চাত্য আধুনিক যুক্তিনির্ভর শিক্ষা ও জ্ঞানকান্ড এদের মনোজগত ও বিশ্ববোধ তৈরি করেছিল। সেখানে এরা ইসলামকেও একটা জায়গা দিত বটে; কিন্তু তা ছিল অনেকটা প্রান্তিক বা সম্পূরক স্থান সংকুলানের মত। ইসলাম এদের বিশ্ববোধ ও কর্মপদ্ধতির কেন্দ্রবিন্দু ছিল না। ঔপনিবেশিক কাঠামোর উত্তরাধিকার এদের উপরে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করত। যে কারণে এই নতুন রাষ্ট্রের সেনাবাহিনীসহ নিরাপত্তা বাহিনীগুলো, জনপ্রশাসন, শিক্ষাব্যবস্থা, সংবাদপত্র ও রেডিও-সিনেমা সহ গণমাধ্যম প্রভৃতি মৌলিক প্রতিষ্ঠানসমূহে ব্যাপক ঔপনিবেশিক কাঠামোর ধারাবাহিকতা অব্যাহত ছিল।

একথা ঠিক যে পাকিস্তানের প্রথম দিকের সিভিল শাসকেরা ও পরবর্তীকালের সামরিক শাসকেরা অন্তত তুরস্কের কামালবাদীদের মত উগ্র ইসলামবিদ্বেষীতে পরিণত হননি। যেমন এখানে আজান ও মাদরাসা নিষিদ্ধ হয়নি কিংবা হিজাব ও দাড়ির উপরে নিয়ন্ত্রণ আরোপ হয়নি। হরফ, ভাষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও কৃষ্টি-সংস্কৃতির খুল্লামখুল্লা ইউরোপীয়করণ বা পশ্চিমাকরণ হয়নি। কিন্তু একথাও ঠিক যে এখানে ছদ্ম ইসলামিকতার আবরণে এলিট শ্রেণি ব্যাপক, জনবিচ্ছিন্ন ও বিসদৃশ এবং উগ্র আধুনিকতার চর্চা ও চর্যা করেছে। যে কারণে আখলাকী দিক থেকে কিংবা এথিকাল বিবেচনায় এই এলিট শ্রেণির মধ্যে ব্যাপক অবক্ষয়, দুর্নীতি ও অধঃপতন ঘটেছে।

এর সার্বিক ফলাফল হয়েছে এই যে জাহেলিয়াত ও জুলুম এই কথিত আধুনিকতাবাদী সেক্যুলার শ্রেণিগুলির মাধ্যমেই সমাজে বিরাজ করেছে। সমাজকে বিভাজিত করে ফেলেছে উপরিতলের এই জনবিচ্ছিন্ন অথচ ক্ষমতাশালী অংশগুলি। আমজনতার দারিদ্র্য ও শোষিত জীবনের বিপরীতে সমাজের এই উঁচুতলার এলিট শ্রেণির পাশ্চাত্য অনুকরণপ্রবণ ও ভোগবিলাসী উগ্র সেক্যুলার আধুনিকতা বড় অদ্ভূত ও উদ্ভট মনে হয়, জাতীয় সংহতি ও রাষ্ট্রীয় অখন্ডতার নিরিখে। এভাবে উত্তর-ঔপনিবেশিক পাকিস্তানে ইংরেজী এবং/অথবা উর্দু ভাষী বাদামী সাহেব ও বিবিদের আধিপত্য বজায় ছিল। যা দূর থেকে দরিদ্র ও নিষ্পেষিত আমজনতা দেখেছে এবং যার সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে না পেরে নতুন রাষ্ট্র ও এর এলিট শ্রেণি থেকে ক্রমাগত বিচ্ছিন্ন হয়ে এর প্রতি বিতৃষ্ণ হয়েছে।

এই কপট ইসলামিকতার আবরণে আচ্ছাদিত পাশ্চাত্য অনুকরণপ্রবণ আধুনিক শাসক শ্রেণি ১৯৫২ সালে রাষ্ট্র-ভাষা প্রশ্নে অসংবেদনশীল হয়ে পড়েছিল পূর্ব পাকিস্তানে। এছাড়া পাঞ্জাবি ও বিহারী উর্দুভাষী এক শ্রেণির হাতে ক্ষমতা ও সম্পদ পুঞ্জীভূত হতে থাকলে পূর্ব পাকিস্তানে আঞ্চলিক অর্থনৈতিক বৈষম্য ও বঞ্চনা বোধ বাড়তে থাকে। এভাবে এখানে ভাষা, জাতিসত্তা ও কৃষ্টিভিত্তিক জাতীয়তাবাদ গড়ে ওঠে যা অনেকটা সেক্যুলার আকার ধারণ করে। এছাড়া আর্থ-সামাজিক শোষণ-বঞ্চনার প্রতিবিধানে স্বাধিকার ও স্বায়ত্তশাসনের যে দাবী ওঠে তা উদার গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের পরিভাষা গ্রহণ করে।

মুসলিম লীগ পাকিস্তান গড়েছিল ইসলামের আধুনিকতাবাদী ভাষ্যের ভিত্তিতে। আর পূর্ব পাকিস্তানে ভাষিক, জাতিসত্তাগত এবং আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক বঞ্চনা ও শোষণ নিবারণে এক সার্বিক আন্দোলন গড়ে উঠল। তা থেকে শেষ অব্দি বাংলাদেশের উন্মেষের পরে যে চেতনা ও কর্মপদ্ধতি উন্মোচিত হল তা হল সেক্যুলারিজম — সেখানে ইসলামকে আগের চাইতে আরো ব্যক্তিক পরিসরে ঠেলে দেয়ার আকাঙ্খা জেগে উঠল। মুসলিম স্বাতন্ত্র্যচেতনা হ্রাস পেয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদ শক্তিমান হয়ে উঠল। অর্থনৈতিক সাম্যের আকাঙ্খা থেকে সমাজতন্ত্রের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল এই চেতনা। শীতল যুদ্ধের আন্তর্জাতিক পরিবেশে সমাজতন্ত্রের প্রবল আকর্ষণ ও সম্ভাবনা ছিল এর জন্য সহায়ক।

এই চেতনা চতুষ্টয়ের দুটি অর্থাৎ বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও উদার গণতন্ত্র যতটা অর্গ্যানিক ও অথেনটিক — বাংলাদেশ আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে — বাকী দুটি অর্থাৎ সেক্যুলারিজম ও সমাজতন্ত্র অতটা অর্গ্যানিক ও অথেনটিক নয়। শেষোক্ত এই দুই চেতনার ধ্বনি প্রতিধ্বনি একাত্তর-পূর্ব বাংলাদেশ আন্দোলনে খুব বেশি শোনা যায়নি। কিন্তু একাত্তরে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরে এই চেতনা দুটি সংবিধানে যুক্ত হয়েছিল। এক্ষেত্রে ভারতীয় নেহরুভিয়ান মূলনীতি ইন্দিরা গান্ধীর তত্ত্বাবধানে এদেশে আমদানী ও প্রযুক্ত হয়েছিল।

তাহলে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে সাতচল্লিশে ইসলামের একধরনের আধুনিকতাবাদী ভাষ্যের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন এলিট শ্রেণি ঔপনিবেশিক প্রভাবে একধরনের কোমল কামালবাদী জীবনচর্যা করেছে। অর্থাৎ ইসলামিকতার ছদ্মাবরণে একধরনের পশ্চিমা অনুকরণপ্রবণ জনবিচ্ছিন্ন উগ্র আধুনিক জীবন যাপন করেছে। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে যে বাংলা ভাষা ভিত্তিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলন গড়ে উঠেছিল এবং যার পরিণতিতে একাত্তরে রক্তাক্ত অধ্যায়ের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেই বাংলাদেশ ইসলাম প্রশ্নে আধুনিকতাবাদী ভাষ্যকে অতিক্রম করে সেক্যুলারিজম বেছে নিয়েছে। কোমল কামালবাদ থেকে কঠোর কামালবাদের দিকে এগিয়েছে। ইসলামকে আরো বেশি ব্যক্তিক পরিসরে ঠেলে দিতে চেয়েছে।

১৮. ইকবালের মুসলিম স্বাতন্ত্র্যচেতনা, পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ এবং ভবিষ্যত সম্ভাবনা

ইকবালের মুসলিম স্বাতন্ত্র্যচেতনার আলোকে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের ১৯৪৭ পরবর্তী বাস্তবতাকে বুঝতে হলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে যে উত্তর-ঔপনিবেশিক মুসলিম বিশ্ব ব্যবস্থা কায়েম হয়েছিল সেটিকে বুঝতে হবে। মনে রাখতে হবে যে উসমানী খেলাফত তার আগেই ১৯২৪ সালে বিলুপ্ত হয়েছে। মুসলিম বিশ্বে নতুন কোনো খেলাফত তখনো তৈরি হয়নি। ইউরোপীয় উপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তি সমূহের পরিকল্পনায় আরব ও মুসলিম বিশ্বে তখন অনেকগুলি জাতি-রাষ্ট্র কৃত্রিমভাবে তৈরি করা হয়েছে। এসব দেশ থেকে ইউরোপীয় উপনিবেশবাদী শক্তিগুলো তাদের সরাসরি শাসনের অবসান ঘটালেও সেখানে তারা তাদের আদর্শের অনুসারী একটি জাতীয়তাবাদী সেক্যুলার এলিট শ্রেণির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছিল। ফলে তুরস্ক, ইরান, মিশর, সিরিয়া, ইরাক ইত্যাদি সদ্য-গঠিত জাতি-রাষ্ট্রের শহুরে এলিট শ্রেণির মধ্যে ইউরোপীয় আধুনিকতার আদলে সবকিছু গড়ে নেবার এক অত্যুৎসাহী প্রচেষ্টা লক্ষ করা যায়।

ইসলামিকতা থেকে যথাসম্ভব দূরে থেকে ক্ষমতাসীন এলিট শ্রেণির এই আধুনিকতা কোথাও কোথাও উগ্র অনুকরণপ্রবণ পশ্চিমীকরণে (Westernization) পরিণত হয়েছিল। মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্বে আধুনিক সেক্যুলার তুর্কী জাতীয়তাবাদী তুরস্ক রিপাবলিক এবং রেজা শাহ পহলভীর নেতৃত্বে শাহতান্ত্রিক ইরান ছিল এই প্রবণতার সবচাইতে দৃষ্টিগ্রাহ্য উদাহরণ। তবে অনেকটা একই রকমের প্রবণতা মিশেল আফলাকের বাথ পার্টি প্রবর্তিত আধুনিক সেক্যুলার আরব জাতীয়তাবাদী সিরিয়া ও ইরাকেও বিভিন্ন পর্যায়ে প্রভাব বিস্তার করেছিল। মিশরে পরবর্তীকালে গামাল আবদেল নাসের ও লিবিয়াতে মুয়াম্মার গাদ্দাফির উত্থান কমবেশি এই প্রবণতার অভিযোজিত ও স্থানীয়কৃত রূপ।

সার্বিকভাবে মুসলিম বিশ্বে উত্তর-উপনিবেশিক কালের এই পশ্চিমা অনুকরণপ্রবণ জাতি-রাষ্ট্র ভিত্তিক জাতীয়তাবাদী আধুনিক সেক্যুলার চেতনা ও কর্মকান্ডকে বিউপনিবেশিক বিদ্যার (Decolonial Thought) সমকালীন বিশেষজ্ঞ সালমান সায়্যিদ কামালবাদ বলে তত্ত্বায়ন করেছেন। ১৯৪৭ পরবর্তী উত্তর-উপনিবেশিক পাকিস্তান রাষ্ট্রও এই কামালবাদী কাঠামোতেই উপনীত হয়েছিল। অর্থাৎ ব্রিটিশ প্রত্যাহারের পরবর্তীকালে সামন্ত শ্রেণির অবশিষ্টাংশের সঙ্গে পশ্চিমায়িত বেসামরিক ও সামরিক আমলা, কোন্দলপ্রবণ রাজনীতিবিদ, মনোপলিস্ট পুঁজিপতি এবং চাটুকার বুদ্ধিজীবি শ্রেণি মিলে একটি ভোগবিলাসী পাওয়ার এলিট ক্ষমতায়িত হয়েছিল।

এরা পাকিস্তান আদর্শের প্রতি কেবল লিপ সার্ভিসই দিয়েছিল। এরা পশ্চিমা উদার গণতন্ত্রের ওয়েস্টমিন্সটার স্টাইল অনুকরণ করতে চাইলেও অত্যন্ত পরিহাসের বিষয় হল এই যে এরা শেষপর্যন্ত প্রায়শই সিভিল কিংবা মিলিটারি ডিক্টেটরশীপে পরিণত হয়েছে। অর্থাৎ বাস্তব পাকিস্তানের সমস্যা ছিল বিউপনিবেশিত হতে না পারার সমস্যা। পাকিস্তান হল আদর্শ ও বাস্তবতার বৈপরীত্য ও বিরোধের সমস্যা। ইসলামিকতার রেটরিক থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে সামগ্রিক ইসলামায়ন না হতে পারার সমস্যা।

১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে পূর্ব বাংলায় রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলন শিখরে পৌঁছিছিল। যা ক্রমবিকশিত হয়ে একটি বাঙালি জাতীয়তাবাদী সেক্যুলার আধুনিক চেতনায় পর্যবসিত হয়েছিল। উত্তর-উপনিবেশিক বাস্তব পাকিস্তান রাষ্ট্র ছিল একটি কামালবাদী প্রপঞ্চ। উত্তর-উপনিবেশিক মুসলিম বিশ্বের এই কামালবাদী কাঠামোর অধীনেই বাংলা ভাষা আন্দোলনের উন্মেষ ও বিকাশকে দেখতে হবে। এর মাধ্যমে পাকিস্তানের প্রতি ছুঁড়ে দেয়া আধুনিক সেক্যুলার বাঙালি জাতীয়তাবাদী চ্যালেঞ্জকেও পর্যালোচনা করতে হবে। পাকিস্তান যেমন ইসলামের একটি রাষ্ট্রকল্প হিশেবে কল্পিত হলেও বাস্তবে ছিল একটি উপনিবেশিত, পশ্চিমায়িত, আধুনিক, সেক্যুলার আমলাতান্ত্রিক, সিভিল-মিলিটারি এলিটের স্বৈরতন্ত্র, তেমনি বাংলাদেশও একটি বাংলা ভাষা, বাঙালি জাতিসত্তা ও সংস্কৃতিভিত্তিক জাতীয়তাবাদী, গণতান্ত্রিক, সেক্যুলার ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়তে গিয়ে, ১৯৭১ সালে এত রক্ত মূল্য দেবার পরেও, ১৯৭৫ সাল নাগাদ মুখ থুবড়ে পড়া একটি “বেহাত বিপ্লব” বা বিচ্যুত রাষ্ট্র।

এর কারণ কী? পাকিস্তান ও বাংলাদেশ উভয়েরই কমবেশি মূল সমস্যা হল এই কামালবাদ। কামালবাদী বাস্তব পাকিস্তানের মত বাস্তব বাংলাদেশও তার উপনিবেশিত, পশ্চিমা কাঠামোর অনুকরণপ্রবণ বেসামরিক-সামরিক আমলাতন্ত্র, শোষক জোতদার, লুটেরা রাজনীতিবিদ ও পুঁজিপতি এবং দলদাস বুদ্ধিজীবি মিলে গঠিত একটি অদ্ভূত পাওয়ার এলিটের হাতে স্বপ্নভঙ্গের ট্রাজেডিতে পরিণত হয়েছে।

১৯৭৯ সালের ইরানী ইসলামী বিপ্লব, একুশ শতকের সূচনা থেকে বদিউজ্জামান সায়ীদ নূরসী, নাজমুদ্দীন এরবাকান প্রমুখের প্রেরণা নিয়ে রিসেপ তাইয়্যেব এরদোয়ানের নেতৃত্বে আধুনিক তুরস্কের ইসলামিকতার দিকে প্রত্যাবর্তন প্রভৃতি মুসলিম বিশ্বে একটি প্রতি-কামালবাদী উত্থানের সম্ভাবনা জাগ্রত করেছে। এসব মুসলিম বিশ্বে ইসলামিকতার একটি নতুন প্যারাডাইম হাজির করেছে। পাকিস্তান ও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পুনর্গঠনে হয়তো মুসলিম বিশ্বের উদীয়মান এই নতুন দিকনির্দেশনা থেকে প্রেরণা নিয়ে প্রয়োজনীয় তত্ত্বায়ন ও কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে।

রেফারেন্স:

[১] Muhammad Iqbal, Stray Reflections (1910): The Private Notebook of Muhammad Iqbal, Edited by Dr. Javid Iqbal, Revised and annotated by Khurram Ali Shafique, Iqbal Academy Pakistan, Lahore, 1961, 94. Poets and Politicians, p. 112, This reflection was first published in ‘New Era’, Lucknow, 1917.

[২] Mohammad Shah, Lahore Resolution, Banglapaedia, en.banglapedia.org/index.php?title=Lahore_Resolution, Accessed on May 14, 2020

[৩] Harun-or-Rashid, The Foreshadowing of Bangladesh: Bengal Muslim League and Muslim Politics 1906-1947, The University Press Ltd, 2010

[৪] Salman Sayyid, Recalling the Caliphate: Decolonisation and World Order, C. Hurst & Co., London, 2014, p. 126

[৫] Richard Sisson & Leo E. Rose, War and Secession: Pakistan, India, and the Creation of Bangladesh, University of California Press, Berkeley, 1990, p. 1

[৬] বদরুদ্দীন উমর, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বাঙলাদেশের কৃষক, মওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, ১৯৭২, পৃষ্ঠা ১২২ — ১৩৩।

[৭] Taj ul-Islam Hashmi, Pakistan as a Peasant Utopia: The Communalization of Class Politics in East Bengal 1920 — 1947, Westview Press, 1992, p. 219 — 262.

[৮] Willem Van Schendel, A History of Bangladesh, Cambridge University Press, Cambridge, 2009

[৯] Taj ul-Islam Hashmi, Pakistan As A Peasant Utopia: The Communalization Of Class Politics In East Bengal, 1920-1947, Westview Press, 1st edition, 1992, Routledge, New York, 2019

[১০] Joya Chatterji, Bengal Divided, Cambridge University Press, Cambridge, 1994

[১১] শেখ মুজিবুর রহমান, অসমাপ্ত আত্মজীবনী, দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ঢাকা, ২০১২

[১২] বদরুদ্দীন উমর, পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি, ১ম খন্ড, প্রথম প্রকাশ, ১৯৭০, সুবর্ণ সংস্করণ, ২০১২

[১৩] Willem Van Schendel, A History of Bangladesh, Cambridge University Press, Cambridge, 2009

[১৪] Anisuzzaman, Claiming and Disclaiming a Cultural Icon: Tagore in East Pakistan and Bangladesh, Rabindranath Tagore: Reclaiming a Cultural Icon, Eds. Kathleen M. O’Connell and Joseph T. O’Connell, Visva-Bharati, Kolkata, 2009, 377-389

[১৫] সৈয়দ আবুল মকসুদ, পূর্ববঙ্গে রবীন্দ্রনাথ, মওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, ২০০৭

[১৬] Anisuzzaman, Claiming and Disclaiming a Cultural Icon: Tagore in East Pakistan and Bangladesh, Rabindranath Tagore: Reclaiming a Cultural Icon, Eds. Kathleen M. O’Connell and Joseph T. O’Connell, Visva-Bharati, Kolkata, 2009, 377-389

[১৭] বদরুদ্দীন উমর, সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা, প্যাপিরাস, কলকাতা, ১৯৬০, পৃষ্ঠা ১১

[১৮] Atiya Begum, Iqbal, Edited and Annotated by Rauf Parekh, Oxford, 2011

[১৯] বাংলা অনুবাদ: মনোয়ার শামসী সাখাওয়াত

Advertisements