জিয়াউর রহমানের আলোচিত-সমালোচিত-বিতর্কিত পাঁচটি বিষয়
Advertisements

১.
রাজনৈতিক নেতৃত্ব খুব গুরুত্বপূর্ণ। সংগঠন বা দল যেমন থাকতে হয় তেমনি ক্যারিশম্যাটিক ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্বও থাকতে হয়। এই নেতৃত্ব যে সবসময় সিভিল সমাজ থেকেই আসবে এমন কোন ধ্রুব সত্য নেই। এই নেতৃত্ব অনেকসময় সামরিক সমাজ থেকেও আসতে পারে। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন অনেকবারই হয়েছে। অনেকবারই সামরিক নেতৃত্ব সামরিক সমাজের গন্ডী অতিক্রম করে বৃহত্তর রাজনৈতিক সমাজের নেতৃত্বে বরিত হয়েছেন। এর উজ্জ্বল উদাহরণ হিশেবে রয়েছেন সালাহউদ্দীন আইয়ুবী, নেপোলিয়ন বোনাপার্ট, শার্ল দ্য গল কিংবা ডোয়াইট ডি আইজেনহাওয়ার।

আমাদের বাংলাদেশের বিগত পঞ্চাশ বছরের ইতিহাসেও এমন একজন বরেণ্য সামরিক নেতৃত্বের রাজনৈতিক নেতৃত্বে রূপান্তরিত হওয়া আমরা দেখতে পেয়েছি। মুক্তিযুদ্ধের সেনানায়ক থেকে সামরিক সমাজের প্রতিনিধিত্বশীল নেতৃত্ব হয়ে শেষ অবধি জাতীয় রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং রাষ্ট্রনায়ক হয়ে উঠেছিলেন তিনি। এবং অল্প সময়কালের মধ্যে তিনি উপমহাদেশীয় এবং মুসলিম বিশ্বের প্রেক্ষাপটে তার নেতৃত্বের বিভা বিচ্ছুরিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এটা তার অসাধারণ প্রতিভা, সৌভাগ্য, সততা, সাহস এবং কর্মোদ্যোগের ফলেই সম্ভব হয়েছিল।

২.
৭ নভেম্বর বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি পালাবদলের দিন। একাত্তর উত্তর বাংলাদেশে যখন রাজনীতিবিদেরা ব্যর্থ হয়ে পড়েছিলেন তখন ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সেনা অভ্যুত্থান ঘটে যায়। সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব পর্যায়ে চলতে থাকে এক অস্থির ও চাপা প্রতিযোগিতা।

এরই এক পর্যায়ে ৭ নভেম্বরে সেনাবাহিনীর বৃহত্তর অংশ তাদের পছন্দমাফিক নেতৃত্ব বাছাই করে নেয়। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের ক্র্যাকডাউনের অব্যবহিত পরে বীরোচিত কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে পরিচিতি পাওয়া জেনারেল জিয়াউর রহমান ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সেনানিবাসের নৈরাজ্য অবসানকল্পে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে চলে আসেন সিপাহী ও অফিসারদের যৌথ সমর্থনে। তার সততা, যোগ্যতা এবং সংকট-পরিস্থিতি মোকাবেলার দক্ষতা তার প্রতি সেনাবাহিনী, প্রশাসন ও সাধারণ জনতার আস্থা নিয়ে আসে।

তিনি এই আস্থাকে কাজে লাগিয়ে একটি পরিকল্পিত ভিশন ও মিশনের মাধ্যমে একজন সেনানায়ক থেকে একজন সফল ও জনপ্রিয় রাষ্ট্রনায়ক হয়ে ওঠেন। ব্যাপক সেচ-ভিত্তিক কৃষি উৎপাদন, কার্যকর ও গতিশীল মিশ্র অর্থনীতি, উন্নত আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি, বহুদলীয় গণতন্ত্র, স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি, বিদেশে মানবসম্পদ ও তৈরি পোশাক রপ্তানি ইত্যাদি প্রক্রিয়ার শক্তিমান সূচনা করেন। তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ খাদের কিনারা থেকে ফিরে আসে এবং উন্নয়ন সম্ভাবনার দিগন্ত উন্মোচিত হয়। এসব কারণে ৭ নভেম্বর বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি অমোচনীয় ও স্মরণীয় দিন।

৩.
জেনারেল জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রনায়ক হিসাবে একজন বিশ্বমানের ক্ষণজন্মা নেতা। প্রশ্নহীন সততা, দেশপ্রেম, অটল ধর্মীয় বিশ্বাস ও মূল্যবোধ, দুর্দান্ত সাহসিকতা, সংকটে অবিচল থেকে নেতৃত্ব দেবার অসামান্য দক্ষতা, অবিরত কর্মস্পৃহা ও কর্মোদ্যোগ, দল-মত নির্বিশেষে সবাইকে নিয়ে কাজ করতে পারার পূর্বদৃষ্টান্তহীন ক্ষমতা, কঠোর শৃঙ্খলাবোধ, অন্যদিকে সবরকমের উগ্রতাকে পরিহার করে উদারতা, আধুনিকতা ও প্রগতিকে বরণ করে নেয়ার প্রতিভা—এসব তাঁকে আমাদের অন্যান্য গড়পরতা নেতাদের পাশে একজন বিরল, ব্যতিক্রমী, বিশাল ও মহান ব্যক্তিত্বের আসনে আসীন করে তোলে।

বাংলাদেশ সৌভাগ্যবান ও গর্বিত হতে পারে যে এমন নেতা আমাদের মাঝে জন্মেছিলেন। এই রাষ্ট্রের জন্মের মাহেন্দ্রক্ষণে তিনি ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে অমর হয়ে আছেন। এরপরে বাংলাদেশ যখন অভ্যন্তরীণ সংকটে নিদারুণভাবে বিপর্যস্ত তখন তিনি আবার ইতিহাসের বরপুত্র হয়ে কক্ষচ্যুত বাংলাদেশকে পুনরায় সঠিক কক্ষপথে স্থাপন করেছিলেন। বারবার তিনি ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্টে তাঁর অসামান্য দক্ষতা ও নিষ্ঠার পরিচয় দিয়েছেন। এবং এটা শুধু দেশের গন্ডীতেই সীমাবদ্ধ ছিলো না। ইরান-ইরাক যুদ্ধকে কেন্দ্র করে শিয়া-সুন্নী বিরোধকে যখন সাম্রাজ্যবাদী ও জায়নবাদী শক্তি উসকে দিয়েছিল তখন জিয়াউর রহমান মুসলিম উম্মাহর এই সংকট মোকাবেলায় যে কূটনৈতিক ভূমিকা নিয়েছিলেন তা বাংলাদেশের মত একটি উদীয়মান মুসলিম রাষ্ট্রের তরফ থেকে যে সম্ভব ছিল সেটা ভাবতে পারাটাও অত্যন্ত কঠিন ছিল। একারণে তাঁর সেই কৃতিত্ব ছিল সম্পূর্ণ অভূতপূর্ব।

কিন্তু হায়, দুর্ভাগ্য আমাদের, তাঁকে দেশীয় কুইসলিং ও আঞ্চলিক আধিপত্যবাদের যোগসাজসে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। সামরিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের দুর্লভ ভারসাম্যপূর্ণ সমাহার হয়েছিল যে জিয়াউর রহমানের মধ্যে তাঁকে হত্যার মাধ্যমে বাঙালি মুসলমান তার যোগ্য অরগ্যানিক নেতৃত্ব থেকে সেই সময় থেকে আজ অবধি বঞ্চিত হয়ে আছে।

এরপর থেকে শুরু হয়েছে জোড়াতালি আর গোঁজামিল দিয়ে চলার ধারা যা বিকার ও পচনের মধ্য দিয়ে আজকে সম্পূর্ণভাবে আঞ্চলিক আধিপত্যবাদের করায়ত্ত হয়ে গেছে।
আজকে প্রয়োজন জিয়াউর রহমানের মত আরেকজন দক্ষ ক্রাইসিস ম্যানেজার, নিষ্ঠাবান সংগঠক, সৎ ও ক্যারিশম্যাটিক নেতা যিনি আবার কক্ষচ্যুত বাংলাদেশকে সঠিক কক্ষপথে পুনঃস্থাপন করতে পারবেন।

৪.
সেনাবাহিনীর কিছু দেশপ্রেমিক অফিসার ও সৈনিকের জাঁবাজ সমর্থনকে মূলধন করে জেনারেল জিয়াউর রহমানের উত্থানের বিষয়টি ভাবলে আজকে অবাক হতে হয়। তিনি তাঁর অসামান্য নেতৃত্বের প্রতিভা প্রমাণ করতে পেরেছিলেন এই প্রাথমিক ও ক্ষুদ্র সামরিক উদ্যোগের সমর্থনে বৃহত্তর রাজনৈতিক ও সামাজিক যে সাইলেন্ট মেজরিটি ছিল সেটাকে জাগ্রত ও সংগঠিত করে।

কিন্তু এই একই সেনাবাহিনীর আরেকটি ক্ষমতালোভী ও সুবিধাবাদী অংশ প্রতিবেশী আধিপত্যবাদী শক্তির যোগসাজশে জিয়াউর রহমানকে আরো গুছিয়ে নেয়ার সময় ও সুযোগ দেয় নি। জিয়াউর রহমান এদেশের সাংবিধানিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও পররাষ্ট্রনৈতিক সংস্কারে বেশ কিছুটা সফল হয়েছিলেন। কিন্তু সাংস্কৃতিক, শিক্ষাগত ও বুদ্ধিবৃত্তিক পরিসরে অনেকদিন ধরে কলকাতা প্রভাবিত শিক্ষিত বাঙালি মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণী দ্বারা এদেশে যে রবীন্দ্র চেতনার চর্চা ও সার্বিকভাবে বাঙালিত্ববাদী উপরিকাঠামো মৌরসী পাট্টা হয়ে বিদ্যমান ছিল সেসব বিস্তৃত ক্ষেত্রে তিনি পর্যাপ্ত সংস্কার বা পরিবর্তন আনার সময় ও সুযোগ পান নি।

আর এই ফোঁকর গলেই পুনরায় বাঙালিত্ববাদী রাজনৈতিক শক্তির পুনরুত্থান ঘটেছে নব্বই দশকের মাঝামাঝি থেকে। একবিংশ শতকে নাইন-ইলেভেন উত্তর গ্লোবাল ওয়ার অন টেররের ইসলামোফোবিয়ার প্রেক্ষিতে মার্কিন-ভারত অক্ষশক্তি এই বাঙালিত্ববাদী শিক্ষাগত, সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক হেজেমনিকে পুনরায় রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রিক হেজেমনিতে পরিণত করেছে।

৫.
জিয়াউর রহমান যখন ১৯৭৮ সালে বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তখন তার পেছনে ছিল ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের বীরত্ব, ১৯৭১-এ স্বাধীনতা ঘোষনার কিংবদন্তী এবং ১৯৭৫-এ ঘটনাচক্রে সিপাহী-জনতা কর্তৃক তাদের মধ্যমণি হয়ে ওঠার শ্বাসরুদ্ধকর কাহিনী। এসব বীরত্বপূর্ণ সাফল্য তাকে একটি নতুন রাজনীতির অধিনায়ক হবার জন্য আগে থেকেই প্রস্তুত করে রেখেছিল।

জিয়াউর রহমান দুই দুইবার জাতির চরম ক্রান্তিলগ্নে দুর্দান্ত সাহসের সঙ্গে তা মোকাবেলায় জানবাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। এমন উদাহরণ আর কার আছে? তিনি ক্ষমতার চূড়ায় আরোহণ করেও প্রশ্নহীন সততা অবলম্বন করে অল্পে তুষ্ট জীবন ধারণের উজ্জ্বল উদাহরণ রেখে গেছেন। এই তল্লাটে আর কেউ কি এমন আছে? শুধুমাত্র এই দুটি বিরলতম বৈশিষ্ট্যের জন্য জিয়াউর রহমান এদেশের ইতিহাসে চির অম্লান হয়ে থাকবেন। বাকীগুলো না হয় আর নাইবা বললাম।

বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পরিগঠনে তিনি যে ভিত্তিকাঠামো নির্মাণ করেছিলেন সেটাকেই অদল-বদল করে এই রাষ্ট্র এখনো টিকে আছে। কিন্তু তিনি যদি আরো সময় পেতেন তাহলে তিনি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পরিগঠনকে যে আরো উত্তুঙ্গ পর্যায়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হতেন এতে কোনো সন্দেহ নেই।

রাষ্ট্রের পরিগঠন মিডিওকার নেতৃত্ব দিয়ে হয় না। পরিগঠিত হয়ে যাবার পরে হয়তো কেবল রক্ষণাবেক্ষণ তারা করতে পারে। নয়তো এদের হাতে আধা পরিগঠিত রাষ্ট্র অবক্ষয় এবং বিনষ্টির দিকে ধাবিত হয়।

জিয়াউর রহমান জনগণের সৈনিক ছিলেন। সেখান থেকে তিনি জনগণের রাষ্ট্রনায়ক হতে পেরেছিলেন। বিএনপি গঠন করে জনগণের রাজনীতিরও সূচনা করেছিলেন। কিন্তু তার অকাল মৃত্যুর কারণে বিএনপির পরবর্তী মিডিওকার নেতৃত্ব জনগণের রাজনীতি ও বিশেষ করে জনগণের সংস্কৃতি বিনির্মাণে ব্যর্থ হয়েছে। বাঙালি মুসলমানের জাতিসত্তা, পরিচিতি, জাতীয় চেতনা, জাতীয় সঙ্গীত, রবীন্দ্রনাথ, কলকাতার ভাষা, সাহিত্য, মিডিয়া ও সংস্কৃতির মোকাবেলা ও মোলাকাতে বিএনপি এমন কি করেছে যা আওয়ামী লীগ থেকে পৃথক? খুব বেশি হলে সে পার্থক্য পরিমাণগত কিন্তু গুণগত নয়। সেজন্য জিয়াউর রহমান যত বেশি অবিতর্কিত ও গ্রহণযোগ্য বিএনপি ঠিক ততটা নয়।

৬.
মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গণের সেনানায়ক এবং পরবর্তীকালে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের রাষ্ট্রনায়ক জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের বিগত পঞ্চাশ বছরের বিনির্মাণ কালের যে ইতিহাস—সেখানে তিনি অন্যতম প্রধান বরপুত্র। তার দেখানো পথ থেকে পরবর্তী বাংলাদেশ পুনর্গঠনের আসন্ন নেতৃবৃন্দের অনেক কিছু শেখার আছে।

Advertisements