গুমের কেসগুলোর বিষয়ে বাংলাদেশের বক্তব্য ‘অপর্যাপ্ত’ বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিল। বাংলাদেশের ৬৬টি স্পর্শকাতর গুমের ঘটনার কথা জানিয়ে কেস বাই কেস সরকারের বক্তব্য চেয়েছিল জেনেভাস্থ ওই কমিশন। বাংলাদেশ জবাব দিয়েছে স্বীকার করে কমিশন তাদের পর্যবেক্ষণে বলেছে, ৫ই ফেব্রুয়ারি ২০২২ বাংলাদেশ সরকার ৬৬ গুমের ঘটনার মামলা বিষয়ে যেসব তথ্যাদি প্রেরণ করেছে কেসগুলোর স্পষ্টতা প্রমাণে তা অপর্যাপ্ত বলেই মনে করে কমিশন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ওপর সিরিজ শুনানি শেষে দু’দিন আগে এডভান্স এডিটেড ভার্সন শীর্ষক ৩৬ পৃষ্ঠার রিপোর্ট প্রকাশ করেছে মানবাধিকার কাউন্সিল। ওয়ার্কিং গ্রুপ অন এনফোর্সড অর ইনভলন্টারি ডিজঅ্যাপিয়ারেন্সেস প্রকাশিত সেই রিভিউ রিপির্টের বাংলাদেশ চ্যাপ্টারে কয়েকটি কেসের আপডেটও দেয়া হয়েছে।
৬৬টি গুমের ঘটনার যে তালিকা জাতিসংঘ দিয়েছিল, তার বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেনসহ সরকারের নীতি- নির্ধারকরা জাতিসংঘকে জবাব পাঠানোর কথা জানিয়েছিলেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী অবশ্য এক অনুষ্ঠানে খেদোক্তি করে বলেছিলেন জাতিসংঘের গুম তালিকায় থাকা অনেক বাংলাদেশির সাগরে সলিল সামাধি হয়ে গেছে! তবে জাতিসংঘ যে রিভিউ রিপোর্ট প্রকাশ করেছে তাতে বলা হয়, কমিশনের ওয়ার্কিং গ্রুপ আর্জেন্ট কেস হিসেবে ইমাম মাহাদি হাসান নামের একজনের নিখোঁজ হওয়ার বিষয়ে সরকারের কাছে জানতে চেয়েছে। গত ৬ই নভেম্বর ২০২১-এ সাদা পোশাকে একদল ব্যক্তি তাকে অপহরণ করে নিয়ে গেছে। জাতিসংঘের ধারণা ফুলবাড়ীয়ার ওই ঘটনায় র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের কেউ সম্পৃক্ত থাকতে পারে। রিপোর্টে স্ট্যান্ডার্ড প্রসিডিউর হিসেবে আরেকটি ঘটনা তুলে ধরা হয়। তাতে বলা হয়, ওয়ার্কিং গ্রুপ মোহাম্মদ ওমর ফারুক নামের একজনের বিষয়েও সরকারের কাছে জানতে চেয়েছে। যাকে ৫ই ফেব্রুয়ারি ২০১৪ সালে তার আত্মীয়ের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তার করা হয়।
মোট ৮ জন সদস্য ছিলেন সেই অভিযানে। র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন এবং বাংলাদেশি পুলিশের গোয়েন্দা শাখার সদস্য বলে তারা পরিচয় দেন। তিনি চট্টগ্রামের বাসিন্দা। রিভিউ রিপোর্টে জাতিসংঘে টিম ১০ই জানুয়ারি ২০২২ থেকে ৫ই ফেব্রুয়ারি ২০২২ তারিখে তথ্য সরবরাহ করেছে জানিয়ে বলা হয়, যার ভিত্তিতে ওয়ার্কিং গ্রুপটি মোহাম্মদ মাহমুদ হাসান, মোহাম্মদ আলতাফ হাওলাদার, মোহাম্মদ হাসিনুর রহমান, মোহাম্মদ সিদ্দিকুর রহমান, মো. আব্দুল্লাহ-আল ফারুক, মো. আক্তার হোসাইন, শামীম উদ্দিন প্রধান এবং মোহাম্মদ রফিকুল ইসলামের মামলা খতিয়ে দেখছে। ৭ই ডিসেম্বর ২০২১-এ, ওয়ার্কিং গ্রুপ আদিলুর রহমান খান এবং নাসিরুদ্দিন এলানের বিরুদ্ধে চলমান বিচারিক কার্যক্রমের বিষয়ে জানতে চেয়েছে। রিপোর্টের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, বাংলাদেশ সরকার জাতিসংঘ কমিশনের সঙ্গে এনগেজ হয়েছে এটা প্রশংসনীয়। বিশেষ করে অনেকগুলো অসামান্য মামলার বিষয়ে তারা তথ্য দিয়েছে। বাংলাদেশি নিখোঁজ ব্যক্তি বা তাদের দেহাবশেষের সন্ধান শুরু করার জন্য সরকার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাও উল্লেখ করা হয় রিভিউ রিপোর্টে। তাদের অনুসন্ধান অব্যাহত রাখার বাধ্যবাধকতার বিষয়টি স্মরণ করা ছাড়াও নিখোঁজ ব্যক্তিদের আত্মীয়দের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ বন্ধের তাগিদ দেয়া হয়।
তাদের পক্ষে যারা কাজ করছে তাদের সুরক্ষা নিশ্চিতেরও তাগিদ দেয় কমিশন। জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদ (ইউএনএইচআরসি)’র বিভিন্ন সেশনে বিশ্বের অর্ধশতাধিক দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি সাম্প্রতিক সময়ে পর্যালোচনা হয়েছে। পরিষদের গুম-সংক্রান্ত ওয়ার্কিং গ্রুপ ডব্লিউজিইআইডি (ওয়ার্কিং গ্রুপ অন এনফোর্সড অর ইনভলান্টারি ডিজঅ্যাপিয়ারেন্সেস) আগের রিপোর্টে বাংলাদেশ পরিস্থিতি তুলে ধরে। ইউএনএইচআরসি’র ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, ওয়ার্কিং গ্রুপ এ বছর তিন সেশনে অনুষ্ঠিত ঘরোয়া বৈঠকে বিভিন্ন দেশে সংঘটিত নতুন পুরনো গুমের ঘটনা এবং এ সংক্রান্ত প্রাপ্ত তথ্য পর্যালোচনা করে। এর বাইরে সাধারণ অন্যান্য অভিযোগও পর্যালোচনা করে। বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা ও গুম-খুনের শিকার ব্যক্তিদের স্বজনদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য এবং তাঁদের ও সরকারি প্রতিনিধিদের সঙ্গে সাক্ষাতের ভিত্তিতে ওই পর্যালোচনার কাজটি সম্পন্ন করে ওয়ার্কিং গ্রুপ। সরাসরি সাক্ষাতে ওয়ার্কিং গ্রুপ গুমের শিকার ব্যক্তিদের স্বজন ও সংশ্লিষ্ট অন্য প্রতিনিধিদের সঙ্গে গুম বিষয়ে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও সংগৃহীত তথ্যবিনিময় করেছে। পরে গ্রুপ লিখিতভাবে বিভিন্ন দেশের সরকারকে তাদের সিদ্ধান্তের কথা জানায়। ওয়ার্কিং গ্রুপের ১২৫তম অধিবেশন শেষে তৈরি করা প্রতিবেদনে বাংলাদেশের গুম পরিস্থিতি নিয়ে বক্তব্য তুলে ধরা হয়। গত ২০ থেকে ২৯শে সেপ্টেম্বর ওয়ার্কিং গ্রুপের ওই বৈঠক হয়। গত ৬ ডিসেম্বর এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন হালনাগাদ করে ওয়ার্কিং গ্রুপ।
হালনাগাদ প্রতিবেদনে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে বলা হয়, বাংলাদেশে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও ভিন্নমতাবলম্বীদের নিশানা করতে গুমকে অব্যাহতভাবে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার বিরুদ্ধে। গুমের এসব অভিযোগের বিষয়ে জাতিসংঘের কাছে বিশ্বাসযোগ্য তথ্য রয়েছে। গুমের শিকার হওয়া থেকে প্রত্যেক ব্যক্তির সুরক্ষাসংক্রান্ত ঘোষণার (ডিক্লারেশন অন দ্য প্রটেকশন অব অল পারসনস ফ্রম এনফোর্সড ডিজঅ্যাপিয়ারেন্স) লঙ্ঘন ও এ ঘোষণা বাস্তবায়নে বাংলাদেশে বাধা দেওয়ার অভিযোগ বিষয়ে বিভিন্ন সূত্র থেকে তথ্য পেয়েছে ওয়ার্কিং গ্রুপ। এ সাধারণ অভিযোগ অবশ্যই ২০১১ সালের ৪ঠা মে, ২০১৬ সালের ৯ই মার্চ, ২০১৭ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারি ও ২০১৯ সালের ২২শে মে বাংলাদেশ সরকারের কাছে পাঠানো অভিযোগগুলোর অতিরিক্ত হিসেবে উল্লেখ করা হয়। তখন পর্যন্ত এসব অভিযোগের কোনো জবাব পায়নি কমিশন।