৬৪ জেলায় ই-পাসপোর্ট
Advertisements

এ যেন এক ঘুসের হাট বাজার। নগদ টাকা ঘুস ও দালাল ছাড়া জমা হয় না পাসপোর্টের আবেদন। ঘুস যেন ওপেন সিক্রেট। এ চিত্র কক্সবাজার আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের।

অভিযোগ আছে, পাসপোর্ট অফিসের কর্মচারী ও বহিরাগত দালাল সিন্ডিকেট মিলে ঘুসের হাটে পরিণত করেছে কক্সবাজার পাসপোর্ট অফিস। আর দালাল ছাড়া কোনো কাজই হয় না। পাসপোর্ট অফিসের চিহ্নিত কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে অর্ধশত দালালের সিন্ডিকেটে এমন দৌরাত্ম্য চলছে বছরের পর বছর।

পাসপোর্ট অফিস ঘুরে সেবাগ্রহীতাদের সঙ্গে কথা বলে অনুসন্ধানে জানা যায়, সরকারি নিয়ম মেনে পাসপোর্টের ফরম জমা দেওয়া যায় না কক্সবাজার পাসপোর্ট অফিসে। আর কোনো রকম জমা দিতে পারলেও সময়মতো পাসপোর্ট পাওয়া যায় না। শুধু দালালদের হাতে টাকা তুলে দিলেই পাসপোর্ট পাওয়া যায়। হোক না রোহিঙ্গা বা বাংলাদেশি। টাকায় মিলছেই পাসপোর্ট সেবা। এছাড়া কক্সবাজার জেলার সাধারণ মানুষ রোহিঙ্গাদের কারণে পাসপোর্ট পেতে না বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছে।

অভিযোগ আছে, কক্সবাজার আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের কর্মচারী-কর্মকর্তাদের যোগসাজশে অর্ধশত দালাল রোহিঙ্গা ও গ্রামের সহজ-সরল মানুষদের পাসপোর্ট বানানোর নামে প্রতিদিন হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। এসব দালালরা অবৈধ পন্থায় পাসপোর্ট বানিয়ে দিয়ে গাড়ি, বাড়ি ও জমি কিনে বনে গেছেন কোটিপতি। অনুসন্ধানে এমন চিত্র উঠে এসেছে। স্থানীয় এক দালাল জানান, দালালদের মাধ্যমে পাসপোর্টের আবেদন করলে আবেদন ফরমে বিশেষ কিছু চিহ্ন থাকে যেমন-স্টার, টিক, ডি, এফ, ও। পাসপোর্টের আবেদনগুলোতে ‘বিশেষ চিহ্ন’ আছে কিনা যাচাই করে পাসপোর্ট অফিসের কর্মচারীরা। এরপর ওই চিহ্নের পাশে আরেকটি ‘চিহ্ন’ ব্যবহার করে তারা। মূলত এই বিশেষ চিহ্নের মাধ্যমে পাসপোর্টের কাজ শুরু করেন তারা। এরপর দালালদের কাছ থেকে সপ্তাহে বা মাসে ঘুসের চাহিদামতো টাকা বুঝে নেন অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার শাখাওয়াত হোসাইন, অফিস সহায়ক মো. সাদ্দাম হোসাইন ও পরিচ্ছন্নতাকর্মী মো. খাদেমুল ইসলাম। আবার সেই ঘুসের টাকা থেকে একটি অংশ অফিস সহকারী থেকে শুরু করে সহকারী পরিচালক পর্যন্ত যায় বলেও জানিয়েছেন এই দালাল।

সাংকেতিক চিহ্নের বিষয়ে অপর এক দালাল জানান, আবেদনকারীদের ফরমে ওই ‘বিশেষ চিহ্ন’ থাকলে প্রতিটি পাসপোর্ট থেকে সরকারি নির্দিষ্ট ফির বাইরে অতিরিক্ত ৩ হাজার টাকা থেকে ৫ হাজার টাকা ও নাম বা বয়স সংশোধন করতে অফিসের কর্মচারী নেন ৫০ হাজার থেকে ৬০ হাজার টাকা। আর এখানেও বিশেষ চিহ্ন না থাকলে সহজে কার্যক্রম শুরু করে না তারা। হতে হয় নানা হয়রানি ও বিড়ম্বনার শিকার। পাসপোর্টও মেলে না যথা সময়ে। আবার অনেকে ঝামেলা এড়াতে বাধ্য হয়ে অফিসের কর্মচারী ও দালালের দারস্থ হন বলেও স্বীকার করেন এই দালাল। এতে করে ঘুসের হাটে পরিণত হয়েছে কক্সবাজার পাসপোর্ট।

চকরিয়ার হারবাং ইউনিয়ন থেকে পাসপোর্ট করতে আসা ভুক্তভোগী আরিফুল ইসলাম জানান, কোনো দালাল ছাড়া সরকারের নির্দিষ্ট ফি আদায় করে ই-পাসপোর্টের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজ সংযুক্তি করে আবেদন জমা দিতে গেলে আবেদন ফরমে ভুল এবং কয়েকটি কাগজ লাগবে বলে ফেরত দেন অফিসের এক কর্মচারী। পরে পাসপোর্ট অফিসের বাইরে তাদের নির্দিষ্ট দালালকে অতিরিক্ত ৩ হাজার টাকা দেওয়ার পর আবেদন ফরমে একটি সাংকেতিক চিহ্ন দিয়ে পাঠানো হলে সব ঠিক আছে বলে জমা নেন একই কর্মকর্তা।

টেকনাফ জালিয়া পাড়ার নুরুল ইসলাম নামের এক ভুক্তভোগী জানান, অনলাইনে আবেদন করে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে পাসপোর্ট অফিসে জমা দিলে তারা ফেরত দিয়ে কোর্ট বিল্ডিং একটি অফিসে গিয়ে সংশোধন করে আসতে বলেন। সেখানে গেলে তিনি ৩ হাজার টাকা ঘুস নিয়ে ফোন করে দেন অফিসের এক কর্মচারীকে। ওই কর্মচারী বরাবর গেলে তিনি নিমিষেই কাজ করে দেন।

দীর্ঘ অনুসন্ধানে কক্সবাজার পাসপোর্ট অফিসে টাকার বিনিময়ে রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট করার তালিকায় রয়েছে, রামু রশিদনগর ইউনিয়ন ৭নং ওয়ার্ডের হরিতলা এলাকার মোহাম্মদ সিকান্দারের ছেলে মোহাম্মদ হাসান তারেক, টেকনাফের মোহাম্মদ ইসমাইল, ঈদগাঁহ ইসলামপুর ইউনিয়ন ৬নং ওয়ার্ডের উত্তর নাপিতখালী এলাকার মৃত আব্দুল কাদেরের ছেলে আব্দুল মালেক, সদর উপজেলা চৌফলদণ্ডি ইউনিয়ন ৭নং ওয়ার্ডের সংখ্যালঘু পাড়ার বশির আহমদের ছেলে মোহাম্মদ রুবেল, কক্সবাজার পৌরসভার ১০নং ওয়ার্ডের দক্ষিণ বাহারছড়া এলাকার মো. সৈয়দ আলমের ছেলে মো. রুবেল, ঈদগাঁহ ইসলামাবাদ ইউনিয়ন ৮নং ওয়ার্ডের আউলিয়াবাদ তেঁতুলতলী এলাকার মৃত জালাল আহমদের ছেলে তৈয়ব জালাল।

এছাড়াও রয়েছে ঈদগাঁহ উপজেলার ঈদগাঁহ ইউনিয়ন ২নং ওয়ার্ড উত্তর মাইজ পাড়ার আলতাজ আহমদের ছেলে মো. জানে আলম, কক্সবাজার কোর্ট বিল্ডিং মসজিদ মার্কেট দ্বিতীয় তলার আব্দুস সালাম, কক্সবাজার কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ মার্কেটের রুহুল আমিন প্রকাশ পেট মোটা আমিন, একই মার্কেটের কম্পিউটার দোকানের মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম, পেকুয়া রাজাখালী ইউনিয়নের মো. রাজু, চকরিয়া ডুলহাজারা ইউনিয়ন রংমহল এলাকার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান, সদর চৌফলদণ্ডি ইউনিয়ন ৭নং ওয়ার্ডের নুরুল আজিমের ছেলে আমান উল্লাহ প্রকাশ মোটা আমানসহ অর্ধশতাধিক দালাল।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর শাখাওয়াত হোসাইন, অফিস সহায়ক মো. সাদ্দাম হোসাইন ও পরিচ্ছন্নতাকর্মী মো. খাদেমুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে ফোনে সংযোগ পাওয়া যায়নি।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে কক্সবাজার আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক মানিক চন্দ্র দেবনাথের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি পাসপোর্ট অফিসের সব অনিয়ম শোনার পরে এ প্রতিবেদককে, তিনি ফোনে কোনো বক্তব্য দেবেন না বলে সাফ জানিয়ে দেন।

Advertisements