করোনার ধাক্কা সামলে ওঠার আগেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে নতুন করে সংকটের মুখে পড়ে দেশের তৈরি পোশাক খাত। সংকটের মধ্যেও ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় ছিলেন গার্মেন্টস মালিকরা। কিন্তু কিছুতেই যেন সংকট কাটিয়ে উঠতে পারছে না দেশের অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখা এই খাতটি। কমেই চলেছে ক্রয়াদেশ।
গত বছরের তুলনায় এ বছর ক্রয়াদেশ কমেছে অন্তত ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ। অর্ডার না থাকায় এবং আর্থিক সংকটের কারণে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ছোট অনেক কারখানা। বেকার হয়ে পড়ছেন শ্রমিকরা। ইউক্রেনে যুদ্ধের প্রভাবেই নতুন কার্যাদেশ কমছে বলে দাবি পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র। বলা হচ্ছে, করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলা করে তৈরি পোশাকশিল্প ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে নতুন করে সংকটে পড়েছে খাতটি।
বড় প্রতিষ্ঠানগুলো অর্ডার পেলেও মাঝারি বা ছোট আকারের প্রতিষ্ঠানগুলো অর্ডার পাচ্ছে না একদমই। ফলে এ ধরনের কারখানাগুলোকে ভুগতে হচ্ছে বেশি। কোনো কোনো কারখানা উৎপাদন সক্ষমতার অর্ধেক অর্ডারও পাচ্ছে না। লোকসানি ও রুগ্ণ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হচ্ছে অনেক কারখানা। পরিস্থিতি কবে নাগাদ ভালো হবে সেটিও নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না কেউ। এমন পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হলে পোশাকশিল্পের ঝুঁকি আরও বাড়বে বলে এমনটাই মনে করছেন শিল্প মালিকরা।
সংশ্লিষ্টদের দাবি, চলতি বছর প্রায় ৩০০ কারখানা বন্ধ হয়েছে। চাকরি হারিয়েছেন ২৫ থেকে ৩০ হাজার শ্রমিক। বন্ধের পথে আরও বেশ কয়েকটি কারখানা। বাংলাদেশ শিল্প পুলিশের তথ্যমতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ অর্থাৎ প্রথম তিন মাসে দেশের মোট ৯৭টি কারখানা বন্ধ হয়েছে। এগুলো বন্ধ হওয়ার কারণে ২০ হাজার ২৭৬ শ্রমিক চাকরি হারিয়ে বেকার হয়ে পড়েছেন। বন্ধ হওয়া কারখানাগুলোর মধ্যে বিজিএমইএ’র সদস্যভুক্ত ১৭টি কারখানায় ছয় হাজার ৬৪৭ শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন। বিকেএমইএ’র সাত কারখানায় এক হাজার ৪৮৬ জন, বিটিএমইএ’র তিন কারখানায় দুই হাজার ৮৭ জন, বেপজা’র দুই কারখানায় দুই হাজার ৪৫ জন শ্রমিক বেকার হয়েছেন।
ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের প্রভাবে গত বছরও সারা দেশে ৫১০টি শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে যায়। এর মধ্যে আশুলিয়া এলাকায় ৯৬টি, গাজীপুরে ১৫৭টি, চট্টগ্রামে ৮০টি, নারায়ণগঞ্জে ২০টি, ময়মনসিংহে ছয়টি এবং খুলনায় বন্ধ হয় ১৫১টি কারখানা। ক্রয়াদেশ না পাওয়া ছাড়াও শ্রমিক অসন্তোষের কারণেও অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। রোজার ঈদের আগে ও পরে সাভার, আশুলিয়া, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ এবং চট্টগ্রাম সহ বেশ কয়েকটি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এসব কারখানায় বেতন না পাওয়ায় আন্দোলনও করে শ্রমিকরা।
তবে শ্রমিক অসন্তোষ নেই দাবি করে পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সহ-সভাপতি শহিদউল্লাহ আজিম বলেন, গত বছর যেসব বায়ার যেখানে মিলিয়ন মিলিয়ন অর্ডার করেছেন, এ বছর সেখানে কোনো অর্ডারই নেই। ক্রয়াদেশ কমেছে ৩০-৩৫ থেকে শতাংশ। এ অবস্থায় পোশাক খাত সংকটের মুখে পড়েছে। অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কোনো শ্রমিক অসন্তোষ নেই। তিনি বলেন, ইউরোপ-আমেরিকা থেকে অর্ডার কম আসায় আমরা নতুন বাজার ধরার চেষ্টা করছি। কোরিয়া, জাপান, ভারতসহ বিভিন্ন দেশে বিকল্প বাজার খুঁজছি। সেটাও সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। কিন্তু পোশাক খাত এক ধরনের অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস বায়িং হাউস এসোসিয়েশনের (বিজিবিএ) সভাপতি কাজী ইফতেখার হোসেন বলেন, বর্তমানে বিক্রি কমেছে প্রায় ২৫ শতাংশ। এটা পোশাক খাতের জন্য বড় ইফেক্ট। আর এখান থেকে উত্তরণও যে খুব তাড়াতাড়ি ঘটবে তার কোনো আভাস পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ পুরো পৃথিবীই এই অবস্থার কারণে টালমাটাল অবস্থার মধ্যে পড়েছে। তিনি বলেন, আমাদের বাজার যেহেতু ইউরোপ এবং আমেরিকা, কিন্তু সেখানকার বাজারেই আমরা সবচেয়ে বেশি অর্ডার হারাচ্ছি। এটা আমাদের জন্য বড় ধরনের ক্ষতি। তবে ইউরোপ-আমেরিকার বাজার বড় করার সুযোগ রয়েছে। সেখানে আমরা সেভাবে বাজার সৃষ্টির জন্য কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছি না।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম জানান, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে কারখানাগুলোতে পর্যাপ্ত কার্যাদেশ নেই। এ কারণে অনেক কারখানা ক্ষতির মুখে পড়ে বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন। তবে শ্রমিক অসন্তোষও রয়েছে বলে তার দাবি। জানান, শ্রমিক অসন্তোষের কারণে রোজার ঈদের পর দু’টি কারখানা বন্ধ হয়েছে। আরও কয়েকটি কারখানা বন্ধ হওয়ার পথে।
পোশাক খাত বর্তমানে নানা চাপের কারণে নাজুক অবস্থা দাবি করে বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান জানিয়েছেন, এ অবস্থায় পোশাক শিল্পের ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে সরকারের অব্যাহত সহায়তার কোনো বিকল্প নেই। তিনি বলেন, আমাদের পোশাক শিল্প নানা কারণে চাপে। মূল্যস্ফীতি বেড়েছে, সে তুলনায় পণ্যের দাম বাড়েনি। করোনায় সরকার বিভিন্ন প্রণোদনা দিয়েছিল। রপ্তানির ক্ষেত্রে যেসব প্রণোদনা আছে, তা আরও বাড়ানো দরকার।
ওদিকে, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে দেশের তৈরি পোশাকপণ্য রপ্তানি যুক্তরাজ্য, কানাডা এবং ইউরোপের বাজারে বেড়েছে। তবে কমেছে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে। ইপিবি’র ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিলের তথ্যমতে, প্রথম ১০ মাসের তৈরি পোশাক রপ্তানি আয় গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৯.০৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধিসহ ৩৮.৫৭ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। গত ১০ মাসে তৈরি পোশাকপণ্য যুক্তরাজ্যের বাজারে রপ্তানি বেড়েছে ১০.৮৮ শতাংশ, কানাডার বাজারে বেড়েছে ১৬.০৯ শতাংশ এবং ইউরোপের বাজারে বেড়েছে ৮.৫৮ শতাংশ। অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে কমেছে ৭.১৩ শতাংশ পণ্য।
এ সময়ে ইইউ’তে বাংলাদেশের রপ্তানি ২০২১-২২ অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৮.৫৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ইইউ অঞ্চলের প্রধান বাজারগুলোর মধ্যে জার্মানিতে রপ্তানি উল্লিখিত সময়ে পূর্ববর্তী বছরের একই সময়ের তুলনায় ৭.৩৩ শতাংশ কমে ৫.৫৩ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। ফ্রান্স এবং স্পেনে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি ছিল যথাক্রমে ২.৪০ বিলিয়ন ডলার ও ২.৯৫ বিলিয়ন ডলার এবং প্রবৃদ্ধি ছিল যথাক্রমে ২২.২১ শতাংশ এবং ১৬.৬৯ শতাংশ। ইতালিতে ৪২.৪০ শতাংশ ইতিবাচক প্রবৃদ্ধির প্রবণতা দেখিয়েছে এবং ১.৮৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। অন্যদিকে বুলগেরিয়া এবং পোল্যান্ডে বাংলাদেশের রপ্তানি বছরওয়ারিভাবে যথাক্রমে ৪৬.৪৩ শতাংশ এবং ১৭.৫৯ শতাংশ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি দেখিয়েছে।
হতাশাব্যঞ্জক প্রবণতা অনুসরণ করে ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রপ্তানিতে ৭.১৩ শতাংশ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়েছে এবং ৬.৯৪ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। অপরদিকে যুক্তরাজ্য এবং কানাডায়, উভয় বাজারে রপ্তানিতে যথাক্রমে ১০.৮৮ শতাংশ এবং ১৬.০৯ শতাংশ ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল মাসে অপ্রচলিত বাজারে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি ৩০.৮০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ৭ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। অপ্রচলিত বাজারগুলোর মধ্যে জাপান, অস্ট্রেলিয়া, ভারত এবং দক্ষিণ কোরিয়ার মতো প্রধান বাজারগুলোতে বাংলাদেশের রপ্তানি ছিল যথাক্রমে ১.৩২ বিলিয়ন, ৯৬১.৩০ মিলিয়ন, ৮৮৯.০৬ মিলিয়ন এবং ৪৭৭.৮১ মিলিয়ন ডলার।
সূত্রঃ মানবজমিন