বাংলাদেশের রাজনৈতিক
Advertisements

আমাদের বুঝতে হবে সমাজের প্রধান সমস্যাটা কোথায়? আধুনিক রাষ্ট্রের সেকুলার কাঠামোর মধ্যে ইসলামের বিকাশ ও চর্চার ধরণ নিয়ে সংঘাত নতুন কোনো সমস্যা নয়। প্রতিটি মুসলিম দেশেই এ ধরনের পরিস্থিতি দেখা যায়। কিন্তু বাংলাদেশে ইসলামপন্থীরা সাংস্কৃতিক বয়ানে এখনও ‘অপর’ হিসেবে চিহ্নিত, এবং এখানকার সেকুলারিজম পশ্চিমা ধারণার মতো সব ধর্মকে একসঙ্গে ধারণ করার পরিবর্তে ইসলাম-বিরোধিতার রূপ নিয়েছে, যা ভারতীয় হিন্দুত্ববাদী বয়ানের প্রতিচ্ছবি। ফলে বাংলাদেশের তথাকথিত সেকুলারিজম মূলত ইসলাম-বিরোধিতার উপর দাঁড়িয়ে আছে।

অন্যদিকে, ইসলামী আন্দোলনের বিভিন্ন ধারার মধ্যে প্রতিযোগিতা থাকলেও মৌলিক বিষয়গুলোতে যে ঐক্যের প্রয়োজন, তার দৃষ্টান্ত বিরল। বরং কওমী জননী উপাধির মাধ্যমে ক্ষমতার সঙ্গে আপস করে ইসলামী সমাজের নির্ভরযোগ্যতা সংকটে পড়েছে। শাপলার ঘটনার পরিণতি আরও প্রকট হয়েছে, যার ফলে সমাজের নৈতিক ভিত্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

৫ জানুয়ারির পর বাংলাদেশে নতুন বাস্তবতা সৃষ্টি হয়েছে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম এখন ডানপন্থীদের করতে হবে, কারণ তথাকথিত প্রগতিশীল বামপন্থীদের শাহবাগী মডেল ফ্যাসিবাদ কায়েম করেছিল। এর ফলে বামপন্থী প্রতিশ্রুতিগুলো রাজনৈতিকভাবে মৃত হয়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধের আওয়ামী-বাম চেতনার বিরুদ্ধেই এখানে অভ্যুত্থান ঘটেছে। সুতরাং এটাকে ডানপন্থী অভ্যুত্থান বলা যেতে পারে। এখন তাদের চ্যালেঞ্জ হলো—একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও গণতান্ত্রিক শাসন কাঠামো বিকাশ করা।

বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতায় রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকতে হলে একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া প্রয়োজন, আবার ইসলামী জ্ঞানগত অবস্থানকে সমাজের মূলধারা করতে হলে যথাযথ বয়ানও তৈরি করতে হবে। কিন্তু ডানপন্থীদের হাতে ক্ষমতা, প্রতিষ্ঠান কিংবা কোনো সুপার পাওয়ারের সমর্থন নেই। তাদের নিজেদের প্রচেষ্টায় এ লড়াই চালাতে হবে। অন্যথায় শাহবাগী বয়ানের কাছে তারা পরাজিত হতে থাকবে।

একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো—ইসলামপন্থীদের ‘মব’ বা ‘উগ্র’ হিসেবে চিহ্নিত করে নাগরিক ডিসকোর্স থেকে দূরে রাখা। এভাবে আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক-বয়ান অটুট রাখা হয়, যেখানে অনেক লীগ-বিরোধীও অংশগ্রহণ করেন। ইসলামপন্থীদের ‘জঙ্গি’ বা ‘বিদেশি এজেন্ট’ প্রমাণের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকে। তাই প্রথম কাজ হবে শাহবাগী বয়ানের নাগরিক ধারণাকে ভাঙা। তারপর নিজের বিশ্বাসের স্বাধীনতা অর্জন এবং অন্যের অধিকারের পক্ষে এজেন্সি হিসেবে হাজির হওয়া। নাগরিক পরিসরে ইসলামপন্থীদের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে হবে, কোটাভিত্তিক সংখ্যালঘু গোষ্ঠী হিসেবে নয়, বরং মূলধারার নাগরিক শক্তি হিসেবে।

একটি বাস্তবতা মানতে হবে—বাংলাদেশ সেকুলার কাঠামোর মধ্যে পরিচালিত হয়, এটি শরিয়াভিত্তিক রাষ্ট্র নয়। ফলে মেজরিটির অবস্থান থেকে ধর্মকে চাপিয়ে দিলে স্বাভাবিকভাবেই প্রতিক্রিয়া আসবে। এখানে ইসলামপন্থীদের প্রতি অন্যায় হলে প্রতিবাদ হয় না, কিন্তু সেকুলারদের সাংস্কৃতিক স্বাধীনতায় সামান্য হস্তক্ষেপ হলেও বিরাট আন্দোলন শুরু হয়। কারণ, রাজনৈতিক-অর্থনীতিতে ইসলামপন্থীরা গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং ২-৫% সাংস্কৃতিক আধুনিকতাবাদীরা ম্যাটার করে। ফলে লড়াই দুই স্তরে—একদিকে তাদের সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করা, অন্যদিকে ইসলামী মূল্যবোধকে মূলধারা করার চেষ্টা করা, তবে তা গায়ের জোরে নয়, বরং নান্দনিকতা দিয়ে।

“তৌহিদী জনতা” শব্দগুচ্ছ কীভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে তা নিয়ে চিন্তা করা দরকার। তৌহিদ শুধুমাত্র ইসলামী বিশ্বাসের মূল অংশ নয়, বরং আব্রাহামিক ধর্মগুলোর কেন্দ্রীয় বিশ্বাস। যারা এক গায়েবে বিশ্বাস করেন, তারা সবাই তৌহিদী। কিন্তু ক্ষমতার কাঠামো এটি ‘মব’ বা ‘উগ্র’ আখ্যা দিয়ে সেকুলার-জাতীয়তাবাদী বয়ানকে টিকিয়ে রাখে। এতে অনেক মডারেট ও ইসলামপন্থী শাহবাগী অবস্থান নিতে বাধ্য হন, যেন তারা জঙ্গি প্রমাণ না হন। ফলে সেকুলার-জাতীয়তাবাদী বয়ানই সমাজে মূলধারা হয়ে থাকে।

বাংলাদেশে ইসলামের একটি সর্বজনীন মূল্যবোধ তৈরি করা সম্ভব হয়নি। এখানকার ধর্মীয় চর্চায় নামাজ, ওয়াজ, সুদ, ঘুষ ও মিথ্যা পাশাপাশি চলে। নারীদের বিশাল অংশ ইসলামের প্রচারকদের পছন্দ করেন না। সামাজিকভাবে ইসলামপন্থীদের প্রভাব বাড়াতে হলে শুধুমাত্র আবেগের রাজনীতি করলে হবে না। দলীয় রাজনীতির ফাঁদে না পড়ে একটি স্বতন্ত্র ও শক্তিশালী ইসলামী বয়ান তৈরি করতে হবে।

সুতরাং, বাংলাদেশে কোনো মতাদর্শগত বলয় এককভাবে ক্ষমতায় আসতে পারবে না। এখানে ভিন্নমতকে শ্রদ্ধা করার সংস্কৃতি তৈরি হয়নি। তথাকথিত প্রগতিশীলরাই সবচেয়ে বেশি প্রতিক্রিয়াশীল। তারা নিজেদের সাংস্কৃতিক স্বাধীনতার জন্য ইসলামের বিপরীতে অবস্থান নেয়।

ক্ষমতায় আসতে হবে তাদের, যারা সব মতাদর্শকে ধারণ করে একটি মূল্যবোধভিত্তিক রাজনীতি গড়ে তুলবে। আদর্শিক সংগ্রাম চলবে, তবে রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে সার্বজনীন ন্যায়বোধ ও ধর্মীয় মূল্যবোধের উপর। ইসলামের নীতিগুলোকে এমনভাবে উপস্থাপন করতে হবে, যাতে তা সকল নাগরিকের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। এ জন্য আলেমদের পাশাপাশি ইসলামি চিন্তাবিদ ও সেকুলার থিওলজিয়ানদের প্রয়োজন, যারা এমন একটি দার্শনিক বয়ান গড়ে তুলবেন, যা স্বাধীনতার ভিত্তিতে হলেও সবার কাছে আকর্ষণীয় হবে।

জাতীয় ঐক্যের জন্য প্রয়োজন একটি কমন বয়ান, যা সভ্যতাগত এবং আধ্যাত্মিকভাবে শক্তিশালী। এটি তৈরি করতে না পারলে সমাজে চিরস্থায়ী মতবিরোধ চলতেই থাকবে। এটি শুধু বলা নয়, বাস্তবে প্রয়োগ করাই সবচেয়ে কঠিন কাজ। কিন্তু এটি করতেই হবে, সাময়িক উত্তেজনামূলক আন্দোলন দিয়ে কিছুই পরিবর্তন হবে না।

Advertisements