এক.
গীর্জার সর্বাত্মক নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত হয়ে ইউরোপে স্বাধীন চিন্তার বিকাশ হয়েছিল। একপক্ষে, বিশেষ করে মহাদেশীয় ইউরোপে ফরাসি দার্শনিক দেকার্তের নেতৃত্বে যুক্তি ও বুদ্ধির প্রাধান্য থেকে যুক্তিবুদ্ধিবাদ গঠিত হয়েছিল। আর অন্যপক্ষে, বিশেষত ইংলন্ডে, ডেভিড হিউমের নেতৃত্বে ইন্দ্রিয়লব্ধ অভিজ্ঞতার উপরে ভিত্তি করে অভিজ্ঞতাবাদ বিকাশ লাভ করেছিল। ইউরোপের এনলাইটেনমেন্টের বরপুত্র জর্মন দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট উল্লেখিত দুই ধারার দর্শনের একটি সংশ্লেষ করে ইউরোপের দর্শনে একটি কোপারনিকান বিপ্লব সাধন করেন। অর্থাৎ জ্ঞানের উৎস হিশেবে ইন্দ্রিয়লব্ধ অভিজ্ঞতা যেমন সেখানে স্বীকৃতি পেল, তেমনি অভিজ্ঞতার উপরে যুক্তিবুদ্ধিজাত বিভিন্ন অন্তর্নিহিত বর্গের প্রক্রিয়াকরণও যথাযথ স্বীকৃতি পেল। ইন্দ্রিয়লব্ধ প্রতিভাসের উপরে যুক্তিবুদ্ধি নির্মিত বর্গের প্রলেপনের মাধ্যমে জ্ঞান উৎপাদন হয় এটা যেমন কান্ট দেখালেন; তেমনি তিনি প্রতিভাসের উৎস হিশেবে বস্তুজগতের অনুমানও অটুট রাখলেন; যা অধরা থেকে যায় বলে তিনি বললেন। এভাবে ইউরোপের ফালসাফা একটা পূর্ণাঙ্গ কাঠামোর ভেতরে এযাবত উত্থাপিত প্রধান প্রবণতাগুলিকে অঙ্গীভূত করে নিল। এটাই মহাদেশীয় দর্শনের কান্টিয়ান বিপ্লব; যেখান থেকে জর্মন ভাবাদর্শের সৃষ্টিশীল প্রবাহ তৈরি হয়ে পরবর্তী ইউরোপীয় চিন্তা পরিসরে একটা শক্তিমান চিন্তাঘরের নর্যাদা পেয়েছে।
কান্টের এই মহাসংস্লেষের পরে জর্মন ভাবাদর্শ হেগেল ও শোপেনহাওয়ারে এসে আবার দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যায়। হেগেল বলেন যে কান্টের যান্ত্রিক চিন্তাকাঠামোতে বস্তুজগত যেহেতু অধরাই থেকে যায়, তাই এর থাকা বা না থাকা আসলে অর্থহীন। হেগেল যেখানে বেশি গুরুত্ব দিলেন সেটা হল যুক্তিবুদ্ধিজাত বর্গসমূহের অনিত্যতায় কিংবা পরিবর্তনশীলতায় কিংবা ইতিহাসে এসবের প্রগতিশীল বিকাশে; যার মধ্যে সবকিছু এক চরম উৎকর্ষ লাভ করে পরমে বিলীন হবার দিকে ধাবমান। অর্থাৎ হেগেল যুক্তিবুদ্ধির ক্রমবিকাশকে ইতিহাসের প্রগতির মধ্যে নিয়ে গেলেন। তার গুরুত্বপূর্ণ শিষ্য কার্ল মার্কস এসে সেখানে বাস্তব উৎপাদন সম্বন্ধের নির্ধারক ভূমিকার কথা প্রস্তাব করে এর একটি রাজনৈতিক অর্থনীতি গঠন করলেন। মোট কথা হেগেল ও মার্কসে এসে জর্মন ভাবাদর্শ যুক্তিবুদ্ধির একটি ইতিহাস ও সমাজ বিকাশভিত্তিক চিন্তা ও চর্চায় পর্যবসিত হল।
অন্যদিকে শোপেনহাওয়ার ডুব দিলেন মানব মনের অতলে ক্রিয়াশীল আদিম অভীপ্সা বা ইচ্ছার দিকে। অর্থাৎ যুক্তিবুদ্ধির শৃঙ্খলার অবতলে মানব প্রবৃত্তির অযুক্তি, বিযুক্তি ও প্রতিযুক্তির ভুবনে। ইউরোপের আধুনিক ফালসাফায় যুক্তিবুদ্ধি ও অভিজ্ঞতার দুই উৎসের সঙ্গে যুক্ত হল প্রবৃত্তি ও বাসনার তৃতীয় উৎস। এই আবেগমথিত অভীপ্সাকে ব্যক্তি মানুষের অস্তিত্বের ভীতি ও কম্পন আকারে ব্যাখ্যা করে কীয়ের্কেগার্ড নাজাত খুঁজলেন খ্রিষ্টান গডের সান্নিধ্য সাধনায়। অন্যদিকে নীটশে বললেন গডকে হত্যা করা হয়েছে; তিনি মৃত, তিনি আর আসবেন না, এখন এই গডহীন জগতের অর্থহীনতা ও শূন্যতাকে ডীল করতে হবে শক্তিমান পরামানুষের আবেগমথিত শিল্প সৃজনচর্চার মাধ্যমে। শক্তিমান পরামানুষের জীবনকে মেষমানুষের ও উনমানুষের সামষ্টিক নিয়ম-নীতি-ধর্মের নিগড় থেকে বের করে আনতে হবে। ব্যক্তিক নিয়ম-নীতি-মূল্যবোধের উদ্ভাবন করতে হবে। এভাবে সৃষ্টি ও শক্তি মুখাপেক্ষী আবেগমথিত অভীপ্সার দিকে ধাবিত হওয়াই মানব উৎকর্ষের পথ ও পন্থা। নীটশের এই পথরেখা ধরে প্রবৃত্তির ভুবনকে আরো উন্মোচিত করতে এগিয়ে এলেন সিগমুন্ড ফ্রয়েড।
তাহলে আমরা দেখতে পাচ্ছি ইউরোপের মহাদেশীয় ফালসাফা যুক্তিবুদ্ধি, অভিজ্ঞতা ও প্রবৃত্তির ভুবনে জ্ঞান ও সত্য অনুসন্ধানে লিপ্ত হয়েছে। কিন্তু চিত্ত কিংবা হৃদয়ের পরিশুদ্ধির মাধ্যমে কিভাবে প্রেমময় সম্বন্ধ, তৃপ্তি, সুখ, আনন্দ, জ্ঞান ও সত্যের সরাসরি উপলব্ধি ও অনুধাবন হয় সেদিকে আধুনিক ইউরোপ খুব একটা যেতে চায়নি। প্রত্যাদেশ, ধ্যান, স্বজ্ঞা ও প্রজ্ঞার আলোকময় চর্চাকে উপেক্ষা করেছে। এইখানেই খুঁজে পাওয়া যায় ইউরোপের আধুনিক চিন্তা ও চর্চার সীমা ও সীমানা।
দুই.
ফরহাদ মজহার এবং সলিমুল্লাহ খান দুজনই মূলত ইউরোপের মহাদেশীয় ফালসাফার সন্তান। তবে দুজনই ফকির লালনের দেহাত্মিক সহজ মানুষের ভাবচর্চার মধ্যে নিজনিজ দার্শনিক প্রাধিকারের প্রতিচ্ছায়া আবিস্কার করতে চান। মার্কসবাদকে কেন্দ্রে রেখে মজহার হাইডেগারিয়ান ফেনোমেনোলজি দিয়ে নির্গমন করেন লালন ফকিরের বর্তমান মানুষ গুরুর ভাবচর্চায়। তিনি ইসলাম প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে খানিকটা অগ্রসর হন ঠিকই; কিন্তু সেখানে কেবল ইসলাম মুগ্ধতাই ছড়ান; সুনির্দিষ্ট ও বিস্তারিত দার্শনিক ইসলামভাষ্য ও পর্যালোচনার যে প্রতিশ্রুতি তিনি দেন তা এখনো অপূর্ণই থেকে গেছে। এক্ষেত্রে কবি-দার্শনিক ইকবালের মত ইসলামে ধর্মীয় চিন্তার পুনর্গঠনের কোনো রূপরেখা আমরা পাইনি। কিংবা ইসলামবিদ্যা বিশারদ ফজলুর রহমানের মত কোর’আনের প্রেক্ষিতভিত্তিক ভাষ্য আমরা সেখানে দেখতে পাই না। কিংবা সাইয়েদ হোসেইন নসরের মত ইবনে সিনা, ইবনে আরাবি ও শিহাবউদ্দীন সুহরাওয়ার্দীকে সংশ্লেষিত করে সম্পাদিত মোল্লা সদরার হেকমতি ঐতিহ্যের আলোকে এক চিরায়ত/সনাতন/পেরেনিয়াল সুফি ইসলামভাষ্য আকার দিতে দেখি না আমরা। কিংবা ত্বহা আবদুর রহমানের মত ইসলামের পরিসরে আস্থা ও আমল ভিত্তিক যুক্তির ক্রমোন্নত কয়েকটি স্তরের স্বীকৃতিও আমরা দেখি না সেখানে; যেখানে প্রত্যাদেশের প্রযত্নে যুক্তির যে উন্নত স্তর তাকেই সর্বোচ্চ নৈতিক ও আধুনিক মর্যাদা ও মহিমা দেয়া হয়েছে।
অন্যদিকে সলিমুল্লাহ খানও মার্কসবাদকে তার ভাববিশ্বের ভরকেন্দ্র হিশেবে নিয়েছেন; এরপরে ফ্রয়েডিয়ান মনোসমীক্ষণে প্রবেশ করেছেন; ফ্রয়েডের শিষ্য জাক লাকার ভাষাতাত্ত্বিক মনোসমীক্ষণে উপনীত হয়ে তার ইমেজিনারি, সিম্বলিক ও রিয়াল অর্ডারের সমরূপ খুঁজেছেন লালন ফকিরের সাকার, আকার ও নিরাকার/একাকারের মধ্যে। ইসলাম প্রশ্নে তিনিও অনেক শ্রদ্ধাশীল ও সমীহশীল; কিন্তু মজহারের তুলনায় এইক্ষেত্রে তিনি অনেক বেশি নিস্পৃহ; ইসলাম নিয়ে তার বিশেষ কোনো উচ্চাভিলাষ আছে বলে মনে হয় না। তিনিও ফরহাদের মতই শেষ অব্দি একজন মার্কসবাদীই থেকে যান; তবে তার মার্কসবাদকে তিনি ফ্রানতস ফানোর উত্তরউপনিবেশিক তত্ত্ব এবং জাক লাকার ভাষাতাত্ত্বিক মনোসমীক্ষণ দিয়ে বুনে আরো সমৃদ্ধ করতে চান। স্লাভয় জিজেকও অনেকটা একই পথে চললেও, সলিমুল্লাহ জিজেকের মত অতটা আত্মসমর্পণ করেন না; রাজনৈতিক প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের ব্যর্থতা, অকার্যকারিতা ও বন্ধ্যাদশা নিয়ে হাস্যরসময় নির্লিপ্ততায় মাতেন না।