নাক কান গলা ইনস্টিটিউটে
Advertisements

হাসপাতালে কিছু কর্মীর শুধু জীবনবৃত্তান্ত জমা দিয়ে, আবার কর্মী সরবরাহ না করেই বছরের পর বছর দুই শতাধিক কর্মীর কোটি কোটি টাকা বেতন তুলে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে কয়েকটি আউটসোর্সিং (কর্মী সরবরাহকারী) প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। এই প্রক্রিয়ায় বেতনের নামে প্রায় ২০ কোটি টাকা পরিশোধ করার অভিযোগ রয়েছে কয়েকটি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধেও।

স্বাস্থ্য নিরীক্ষা অধিদপ্তর ১৩টি সরকারি হাসপাতালের হিসাব নিরীক্ষা করে শুধু আউটসোর্সিং খাতে গত অর্থবছরে ৪৫ কোটি টাকার বেশি অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য পেয়েছে। এর সঙ্গে রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং হাসপাতালের কিছু কর্মকর্তা জড়িত বলে জানা গেছে। নিরীক্ষা আপত্তি বিষয়ে ৩০ জানুয়ারি ও ২ ফেব্রুয়ারি চিঠি দিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে জানানো হয়। মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর তা পর্যালোচনা করে হাসপাতালগুলোর পরিচালকদের কাছে জবাব চেয়ে চিঠি দিয়েছে। তবে কোনো হাসপাতাল চিঠির এখনো জবাব দেয়নি। স্বাস্থ্য নিরীক্ষা অধিদপ্তর ২০২০-২১ অর্থবছরের নিরীক্ষায় অর্থোপেডিক হাসপাতালে আউটসোর্সিং কর্মী নিয়োগে অনিয়মের ফলে সরকারের ১ কোটি ৪৮ লাখ ৭ হাজার ৫০৪ টাকা ক্ষতির অভিযোগ তুলেছে। প্রায় একই ধরনের অনিয়ম পাওয়া গেছে রাজধানীর নাক, কাল, গলা ইনস্টিটিউটের বিরুদ্ধে। এখানেও আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে ৬০ কর্মী নিয়োগ দেখানো হয়েছে। এই জালিয়াতির মাধ্যমে গালফ সিকিউরিটি সার্ভিসেস নামের একটি প্রতিষ্ঠান ৩৮ লাখ ৫১ হাজার ৪৪২ টাকা তুলে নিয়েছে। কিন্তু কোনো কর্মী নিয়োগ হয়নি বলে নিরীক্ষা আপত্তিতে বলা হয়েছে।

আটটি হাসপাতালের বিরুদ্ধে আউটসোর্সিং প্রক্রিয়ায় সেবাগ্রহণ নীতিমালা ভঙ্গের প্রমাণ পেয়েছে স্বাস্থ্য নিরীক্ষা অধিদপ্তর। হাসপাতালগুলোর মধ্যে জাতীয় নাক, কান, গলা ইনস্টিটিউটও রয়েছে। নীতিমালা অনুযায়ী, আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে সাধারণত নিরাপত্তা ও পাহারা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, বাগান পরিচর্যা, পরিবহণ সেবা; ইলেকট্রিক্যাল, মেকানিক্যাল ও কাঠের কাজ; রান্না ও ডাইনিং, হোস্টেল, মেসরুম, ক্লাব, স্পোর্টস ও কমন রুম; হাউস কিপিং, কেয়ার টেকিং ও হাসপাতাল সেবা; লিফট মেইনটেন্যান্স, পাম্প জেনারেটর, মেশিন ও প্রজেক্টর অপারেটিং, এয়ার কন্ডিশন যন্ত্র স্থাপন ও মেইনটেন্যান্স, ডাক বিতরণ, স্যানিটারি ও প্লাম্বিং কাজে লোক নিয়োগ করা যায়। আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে কর্মীর বেতন-ভাতা তার নিজের নামে খোলা ব্যাংক হিসাবে জমা দিতে হবে।

কিন্তু এই হাসপাতালগুলোর বিল, ভাউচার, দরপত্র নথি, চুক্তিপত্রসহ অন্যান্য নথি যাচাই করে নিরীক্ষায় দেখা গেছে, কর্মীদের ২৮ কোটি ১৮ লাখ ৯৬ হাজার ৩৯১ টাকার বেতন সরাসরি কর্মী সরবরাহকারীকে পরিশোধ করা হয়েছে। নিরীক্ষা প্রতিবেদনে এর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা আবশ্যক। এসব হাসপাতালে কর্মী সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো হলো গালফ সার্ভিসেস, ভিক্টর ওয়ান সিকিউরিটি সার্ভিস, সাইফুল ইসলাম ট্রেড লিংক, পাথমার্ক অ্যাসোসিয়েটস, ধলেশ্বরী সিকিউরিটি অ্যান্ড ফিলিং সার্ভিস, টি ফোর এস ইন্টারন্যাশনাল ও রাটফা ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল।

তাতে বলা হয়েছে, প্রকৃতপক্ষে আউটসোর্সিং কর্মচারী নিয়োগ না হওয়া সত্ত্বেও কর্মী নিয়োগ দেখিয়ে জালিয়াতির মাধ্যমে সরবরাহকারীকে বেতনভাতা পরিশোধ করায় সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ৩৮ লাখ ৫১ হাজার ৪৪২ টাকা। ২০২০-২০২১ অর্থবছরে আউটসোর্সিং প্রক্রিয়ায় সেবা গ্রহণ নীতিমালা-২০১৮-এর শর্ত লঙ্ঘনপূর্বক আউটসোর্সিং কর্মীদের বেতনভাতা বাবদ অনিয়মিতভাবে ২ কোটি ১ লাখ ৪৪ হাজার ৭৭৯ টাকা পরিশোধ করা হয় বলে স্বাস্থ্য অডিট অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে উঠে আসে। প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত দুই অর্থবছরে এ পদ্ধতিতে সেখানে ১১১ জনের নিয়োগ হয়। ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ৬০ জনকে নিয়োগ দেখিয়ে বেতন বাবদ পরিশোধ করা হয় ৩৮ লাখ ৫১ হাজার ৪৪২ টাকা। অডিট অধিদপ্তরের নিরীক্ষায় তা ধরা পড়ে, এ তিন মাসে ৬০ জনের কোনো নিয়োগ হয়নি। জানুয়ারিতে তাদের নিয়োগ দেখানো হলেও প্রকৃতপক্ষে তাদের নিয়োগ দেওয়া হয় ২০২১ সালের এপ্রিলে। অথচ গালফ সিকিউরিটিজ সার্ভিসেস লিমিটেড নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে জালিয়াতির মাধ্যমে বেতন বাবদ ৩৮ লাখ ৫১ হাজার ৪৪২ টাকা পরিশোধ করা হয়।

স্বাস্থ্য অডিট অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ২৭টি আপত্তি যাচাই-বাছাই করে অধিদপ্তরের কোয়ালিটি কন্ট্রোল (কিউসি) কমিটি একটি আপত্তি বাতিল করে। বাকি ২৬টির মধ্যে ১৯টিকে গুরুতর আর্থিক অনিয়ম (এসএফআই) হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ নিরীক্ষা আপত্তির বিষয়ে চার সপ্তাহের মধ্যে জবাব দিতে গত ১৬ জানুয়ারি ইনস্টিটিউটের পরিচালককে চিঠি দিয়েছে স্বাস্থ্য অডিট অধিদপ্তর। এরপর ৩১ জানুয়ারি আরেক চিঠিতে দুই সপ্তাহের মধ্যে জবাব দিতে বলেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সময় পেরিয়ে গেলেও জবাব দেওয়া হয়নি।

স্বাস্থ্য অডিট অধিদপ্তরের উপপরিচালক ও নিরীক্ষা দলের প্রধান মীর মুহ. নাছির উদ্দিন বলেন, ‘অডিটের আপত্তিগুলোর বিষয়ে আমরা জবাব চেয়েছিলাম। কিন্তু তারা কোনো জবাব দেয়নি। এখন নিয়ম অনুযায়ী এজি অফিস আপত্তিগুলো নিষ্পত্তি করবে।’

অভিযোগের বিষয়ে জাতীয় নাক, কান, গলা ইনস্টিটিউটের গালফ সিকিউরিটিজ সার্ভিসেস লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এবিএস খান স্বপন বলেন, অধিদপ্তরের নিরীক্ষা রিপোর্ট প্রস্তুতকারীদের অনৈতিক সুবিধা না দেওয়ায় হাসপাতালের পরিচালক ও আমার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মিথ্যা রিপোর্ট দিয়েছে, যা আমি ইতোমধ্যে অধিদপ্তরে শরণাপন্ন হয়ে আনীত অভিযোগগুলোর বিষয়ে অবগত করেছি।

বিগত দিনে এ কোম্পানির বিরুদ্ধে অনিয়মের বিষয়ে একাধিক মামলা রয়েছে বলে জানা গেছে। এসব অনিয়মের সঙ্গে ইনস্টিটিউটের পরিচালক মো. আবু হানিফ ও প্রধান সহকারী মো. শরীফুল ইসলামের সম্পৃক্ততা রয়েছে। পরিচালকের ঘনিষ্ঠ হিসাবে পরিচিত শরীফুল ইসলাম ছিলেন হাসপাতালটির ক্যাশিয়ার। তাকে নিয়োগবিধি উপেক্ষা করে সংশ্লিষ্ট পদোন্নতি কমিটির (ডিপিসি) অনুমোদন ছাড়াই প্রধান সহকারী পদে পদোন্নতি দেওয়া হয় বলে অভিযোগ উঠেছে। এ বিষয়ে শরীফুল ইসলাম জানান, প্রশাসনিক নিয়ম অনুযায়ীই তার পদোন্নতি হয়েছে। আর হাসপাতালে অনিয়মের সঙ্গে নিজের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করে তিনি বলেন, এসব বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। আপনি পরিচালক স্যারের সঙ্গে কথা বলেন।

এ বিষয়ে জাতীয় নাক, কান, গলা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. আবু হানিফের সঙ্গে তার অফিসে বক্তব্য নিতে গেলে তিনি অসুস্থতার অজুহাত দেখিয়ে দ্রুত অফিস ত্যাগ করেন। এভাবে ১৬ থেকে ২৪ জুন পর্যন্ত একাধিকবার যাওয়ার পর তাকে আর অফিসে পাওয়া যায়নি। তার ফোনে খুদেবার্তা ও হোয়াটসঅ্যাপে প্রশ্ন পাঠিয়েও সদুত্তর পাওয়া যায়নি।

Advertisements