ইউক্রেন যুদ্ধ পরিণতিতে অর্থনৈতিক মহামন্দার দিকে আগাচ্ছে!
Advertisements

গ্লোবাল মহামন্দা ধেয়ে আসার হুশিয়ারি উচ্চারণ হতে শুরু হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ও বিনিয়োগ ব্যাঙ্ক সিটিগ্রুপ ইতোমধ্যেই সতর্কবার্তা জারি করেছে! কোভিডের অর্থনৈতিক বিপর্যয় দুনিয়া সামলে উঠা শেষ না করতেই বাইডেনের নেতৃত্বে পশ্চিমাওশক্তির সীমাহোন লোভের যুদ্ধ ইউক্রেন এই নয়া বিপর্যয়ের আগমনি ধ্বনির ইঙ্গিত দেয়া শুরু করেছে। ইউক্রেন যুদ্ধের পরিণতিতে কি গত ২০০৮ সালের মত আবার এক গ্লোবাল অর্থনৈতিক মহামন্দা? বিশ্বজুড়ে অর্থনীতি ভেঙ্গে পড়া? দুনিয়ায় ক্ষুধা-দারিদ্র্য আরো খারাপ ভাবে ছেয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটবে? এমনিতেই গত তিন বছর ধরে কোভিড ভাইরাসের প্রভাবে বিশ্বজুড়ে ছেয়ে বসা এক মুদ্রাস্ফীতি দুনিয়ার সবদেশকেই মারাত্মক অর্থনৈতিক চাপে ফেলেছে। অর্থাৎ গ্লোবাল অর্থনীতি ও বাণিজ্যে কোভিডের প্রভাব এখনও মারাত্মক। আমরা তা কাটিয়ে উঠতে পারি নাই। কোভিডের আক্রমণও শেষ হয় নাই। তাই সব মিলিয়ে এবার খোদ আমেরিকাতেই এ নিয়ে ব্যাপক জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়ে গেছে। ওয়াল স্ট্রিট পাড়া, গ্লোবাল পুঁজিবাজার, বিজনেস হাউজগুলো এ নিয়ে ভীত হয়ে পড়েছে। অর্থনীতি ও বাণিজ্যের জগত জুড়ে বাইডেনকে ফিরে তাই অভিযুক্ত করা শুরু করেছে – বিশেষত ইউক্রেন যুদ্ধে উস্কানি তোলার জন্য, অন্তহীন করে ফেলার জন্য। সব অভিযোগের গোড়া – কাটার মত যা সবাইকে বিঁধছে তা হল জ্বালানি তেল মুল্যবৃদ্ধি যা ১২০ ডলারের উপরে উঠেছে। এটাই সবাইকে এখন ভীত করে তুলেছে!

ইউক্রেন যুদ্ধের আপডেটঃ
জুন মাস শেষ হয়ে এল। অর্থাৎ ইউক্রেন যুদ্ধ টানা মোট চার মাস পেরিয়ে গেল যার মধ্যে সবচেয়ে বড় এক পরিবর্তন এখন দেখা যাচ্ছে তা হল – আগে যেভাবে ……এই তো রাশিয়া হেরে যাচ্ছে কিংবা অবরোধে পড়ে রাশিয়ান অর্থনীতি এই ডুবে যাচ্ছে বলে অথবা সামরিকভাবে ইউক্রেন এই যুদ্ধে জিতেই যাচ্ছে – ইত্যাদি ধরনের পশ্চিমা নানা প্রপাগান্ডা রিপোর্ট যেটা চারদিকে ছেয়ে গিয়েছিল তাতে আজ ভাটা দেখা যাচ্ছে। একালে অনেক পশ্চিমা মনের সাফাই হল, নিজদেশের জন্য “কথিত দেশপ্রমের স্বার্থে মিথ্যা প্রপাগান্ডা’ জায়েজ আছে। আর এই সুত্র ধরে এর উপর আবার তবু শুরু থেকেই পশ্চিমে বিশেষত ইউরোপে; বিশেষ করে যুদ্ধের নিউজ রিপোর্ট আর ‘কথিত দেশপ্রেমী প্রপাগান্ডা’ যে এক জিনিস নয় এর কোন হুশজ্ঞান কারও আছে মনে হচ্ছিল না। এমনিতে কোনো দেশের মিডিয়ায় নিজ দেশের যুদ্ধের খবরে কিছু মাত্রায় প্রপাগান্ডা থাকে এটা হয়ত খুব অস্বাভাবিক নয় যদিও একালে গ্লোবাল বাণিজ্য ব্যবস্থার যুগে অন্তত পশ্চিমাদেশের মিডিয়াগুলোতে “নিজ দেশের মিডিয়া” বলে কোনো ধারণা কার্যকর থাকার কথা নয়। কারণ এত দিনে সবাই বুঝে গেছে যে – মিথ্যা প্রপাগান্ডায় দেশপ্রেম দেখাতেই হবে এটা কোনো কাজের কথা বা পদক্ষেপ নয়। আর সবচেয়ে বড় কথা মিথ্যা কথা আর জার্নালিজম এম হওয়ার কোন সুযোগ নাই। শেষবিচারে মিথ্যা বলে কোনো দেশের আসলেই কোন লাভ হয় না। কারণ কিছুই শেষে লুকানো থাকে না। তবু ইউরোপেই এবার বেশি দেখা যাচ্ছে লাগামছাড়া মিথ্যা প্রপাগান্ডা করতে। আর মিথ্যা হওয়াতেই সম্ভবত এই প্রপাগান্ডা চার মাসও টিকতে পারেনি। কারণ চার মাস ধরে কেউ যদি লাগাতার বলে চলে যে, আমরা খালি ‘জিততেই আছি’ অথচ বাস্তবতায় কোনো বদল, পরিবর্তন নাই – এতে এক পর্যায়ে সব প্রপাগান্ডাই মুখ থুবড়ে না পড়ার কোন কারণ নাই! তাই সবাই এখন প্রপাগান্ডা রেখে অন্তত চুপ হয়ে গেছে।

তবে এ’অবস্থার জন্য আরো কারণও আছে। একদিকে ইউক্রেন যুদ্ধ, এটা শুরু থেকে কখনই রাশিয়া-ইউক্রেন এদুই দেশের কোনো লোকাল যুদ্ধ মানে, এটা কোন বুদ্ধিতেই এ দুই দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ এমন কোন ধারণা দেয়া যায় নাই। বরং এটা সব অর্থেই সবদেশের উপরই একটা গ্লোবজুড়ে প্রভাব পড়া যুদ্ধ হিসেবে হাজির হয়েছে। আর এটা আগে বা শুরুতে এমনও ছিল না যে শুরুতে তে তা দুই দেশের কোন লোকাল যুদ্ধ ছিল আর পরে তা গ্লোবালভাবে সবার ওপরে প্রভাব নিয়ে হাজির হয়েছে তা-ও নয়। এই যুদ্ধ শুরু থেকেই গ্লোবাল প্রভাবের। আর বাইডেনই এমন একটা যুদ্ধ হোক – এমনটা হ্ওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর কোন পরোয়া ছিল না, এটাই চেয়েছেন।

যেমন- বাইডেনের হিসাব মতে, এটা তো সবসময়ই পরিস্কার থেকেছে যে যুদ্ধের প্রধান পক্ষাপক্ষ হোক সারা ইউরোপ আর আমেরিকা মিলে একসাথে; এভাবে সারা পশ্চিমজুড়ে এক নিজ পক্ষশক্তি খাড়া হোক। হয়েছেও তাই। আর তা না হয়ে অন্য কিছু হওয়ার সুযোগ ছিল না। প্রধানত ইউরোপের রাষ্ট্রগুলো সবাই এমনকি খোদ আমেরিকাও কম বা বেশি পরিমাণে (কোন রাষ্ট্র ৫০ শতাংশের বেশি) রাশিয়ান তেল অথবা গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল ছিল, তারা তা কিনে চলত। তাই এটা রাশিয়া-ইউক্রেনের মধ্যে সীমিত একটা যুদ্ধের ঘটনা যতটা না এর চেয়েও কয়েকগুণ বেশি প্রভাবশালী ঘটনা হল, রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ। বাংলা ভাষায় বললে যার সারার্থ হল – রাশিয়াকে ‘ভাতে-পানিতে মারার’ পশ্চিমাশক্তির পরিকল্পনা ও যুদ্ধ বললে যা বোঝাবে ঠিক তাই।

দুনিয়ার সবাই এখন এর আসল অর্থ বুঝে গেছে যে, এটা শুধু রাশিয়া-ইউক্রেনের মধ্যে সীমিত যুদ্ধ একেবারেই নয়। এটা মূলত বাইডেনের আমেরিকার (বগলে ইইউ-কে নিয়ে) পুতিনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। তাই ইইউ বা আমেরিকার যে কাউকে যদি জিজ্ঞাসা করা যায়, রাশিয়ার সাথে আপনাদের বিরোধের ক্ষেত্রটা কী? ইউক্রেনের যুদ্ধভূমির ক্ষেত্রে নাকি রাশিয়ার ওপর সর্বাত্মক, সবাই মিলে অর্থনৈতিক অবরোধ (ডলার বা ইউরো মুদ্রার অবরোধ) আরোপে? পশ্চিমা কোনো রাষ্ট্র এর সঠিক উত্তর দিতে পারবে না। যেমন – এটা কি “ইউক্রেনের এই যুদ্ধে” জিতার জন্য রাশিয়ার ওপর মুদ্রা অবরোধের যুদ্ধ? শুরুতে এমন দাবি প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা তারা করেছিল। কিন্তু এখন অন্য কাউকে বিশ্বাস করানোর আগে তারা নিজেরাই আর তা বিশ্বাস করে না। তাদের পশ্চিমাশক্তির লক্ষ্য এখন পরিষ্কার ও উদাম যে, তারা পুতিনের রাশিয়াকে নিজ রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক স্বার্থে ব্যবসায়-বাণিজ্য এমনকি কোনো স্ট্রাটেজিক স্বার্থ – এমন সব কিছু থেকে বঞ্চিত করাই পশ্চিমের লক্ষ্য। তারা রাশিয়াকে দেখতে চায় যেন সে ১৯৯১ সালের আগের মত এক সোভিয়েত ইউনিয়ন, যে রাষ্ট্রের সাথে দুনিয়ায় আইএমএফ-বিশ্ব ব্যাংকের সদস্যরাষ্ট্র যারা তাদের কারো সাথে বলার মত কোন বাণিজ্য সম্পর্ক ছিল না। এমনকি সেকালের সোভিয়েত ব্লকের বলে যেসব রাষ্ট্র ছিল যেমন – পোল্যান্ড বা রোমানিয়া এদের সাথেও সোভিয়েত ইউনিয়নের “বাণিজ্য-প্রধান” এমন কোন সম্পর্ক কখনও ছিল না। এসবের মূল কারণ – কোনো আন্তর্জাতিক মুদ্রা ব্যবস্থা ও এর সদস্যপদ নেয়া ছাড়া কোনো রাষ্ট্র আন্তঃরাষ্ট্রীয় বাণিজ্য করতে পারে না। আর ১৯৯১ সাল পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়ন বা কমিউনিস্ট ব্লকের কোনো রাষ্ট্রই আইএমএফ ধরনের কোনো আন্তর্জাতিক মুদ্রা ব্যবস্থার সদস্য ছিল না।

পরে সোভিয়েত ভেঙ্গে গেলে, ১৯৯২ সাল থেকে রাশিয়াসহ সব পুরানা কমিউনিস্ট ব্লকের রাষ্ট্রগুলো আইএমএফের সদস্য হয়ে যাওয়ার পরে এখন যেন বাইডেন চাইছেন পুতিনের রাশিয়ার সদস্যপদ শূন্য করে দেয়ার জন্য। পুতিনের রাশিয়া যেন সোভিয়েত ইউনিয়নের অবস্থায় ফিরে যাক! তাই যেন সে উদ্দেশ্যেই এখন (ডলার, ইউরো ইয়েন ইত্যাদি) অবরোধ আরোপ করা হয়েছে। মানে বাইডেন আসলে যেন চান রাশিয়া আগের মতই কার্যত আইএমএফের সদস্যপদ না থাক। কিন্তু ভাগাড়ে গরু বেশি না কম মরে পড়ে থাকবে তা শকুনের অভিশাপের ওপর নির্ভর করে না – এটাই সমস্যা!!!

রাশিয়া ইরান নয়ঃ
পশ্চিমাশক্তির রাশিয়াকে শুরু থেকে ইরান-ই মনে করে এসেছে – যা ছিল মারাত্মক ভুল। অন্যভাবে বললে, হয়তো এটা আসলে নিজেদের বড় করে দেখা [over-estimation] বা মেপে নিজেকে বেশি করে বলা। এটাকেই আমরা অনেকে ‘সাদা শ্রেষ্ঠত্ববাদ’-এর প্রকাশ বলব। যেমন ধরেন এক সাদা ককেশীয় বলল, আরে আমরা তো দুনিয়াকে গত পাঁচশ বছর ধরে অধীনস্ত করে শাসন করে চলেছি। আমাদের জ্ঞান-বুদ্ধি, চাতুরি বা শঠতার সাথে কি কেউ পারবে? তাই দুনিয়া আগামীতে চীনের নেতৃত্বে কেন, কারো নেতৃত্বেই যাবে না – গত পাঁচশ বছরের মত বরাবরই এটা আমাদের নেতৃত্বেই থেকে যাবে। তাই আমাদের আপাত লক্ষ্য রাশিয়াকে ভাত-পানিতে মারা; রাশিয়াকে ইউরোপে প্রভাবহীন করে কোণঠাসা ও বিতাড়িত করাই তাদের লক্ষ্য! ইউরোপের যেকোনো কর্নারে একেবারেই প্রভাবহীন করা, হাতে ভিক্ষাপাত্র ধরানো ও ফেলে রাখা। অনেকে অবশ্য প্রশ্ন করতে পারেন, রাশিয়া তো চীনের মত কোন হবু গ্লোবাল নেতা নয়! যদিও রাশিয়া স্বাধীন মর্যাদা নিয়ে দুনিয়ায় সামর্থ্য অনুসারে ব্যবসায়-বাণিজ্য করে চলতে চায়। পশ্চিমাশক্তির খায়েশ ছিল রাশিয়ার উপর অর্থনৈতিক-সামরিক সব রকমের চাপ সৃষ্টি করে তাকে কোণঠাসা, রিক্ত করে রাখা। আর এর সাথে তারা দেখতে চেয়েছিল রাশিয়ার এই কল্পিত দুস্থ দশা দেখে চীনের প্রতিক্রিয়া কী হয়! চীন কী রাশিয়াকেই বাঁচাতে ছুটে যায় ও বিপদে জড়ায়, নাকি রাশিয়াকেই ফেলে চলে যায়! যদিও যুদ্ধ শুরুর এক সপ্তাহের মধ্যে চীন পরিষ্কার করে নিজ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্রিফিংয়ে বলে দিয়েছিল – রাশিয়ার নিজ অর্থনৈতিক-সামরিক স্বার্থ যদিও চীনের স্বার্থ নয় তবু তারা আশা করে পশ্চিমের সাথে রাশিয়ার বিরোধে সব পক্ষই শান্তিপূর্ণ উপায়ে তা সমাধানের পথ বের করতে সফল হবে!’ তাহলে অবরোধ আরোপের বিচারে পশ্চিমাশক্তির রাশিয়াকে ইরান মনে করাকে মারাত্মক ভুল বলে কথা শুরু করলাম কেন?

কারণ, আমেরিকান অবরোধ এর আগে বহুবার ইরানের ওপর দেয়া হয়েছিল, যা এখনো আছে। প্রায় একইভাবে রাশিয়ার উপরও তাই দেয়া হয়েছিল যা এখন সর্বব্যাপী অবরোধে এমনকি ইইউও রাশিয়ার ওপর এখন ‘ইউরো অবরোধ’ দিয়ে রেখেছে। আর এখান থেকেই আসছে রাশিয়ার সাথে ইরানের তুলনা। তবে রাশিয়া ও ইরানের আরেক মিলের দিকও আছে তা হল – এ’দুই দেশই তাদের তেল-গ্যাস আর কোনো দেশ কিনুক আর না কিনুক, এরা উভয়ই চীনে ২৫ বছর ধরে লাগাতার জ্বালানি সরবরাহ করতে চীনের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়ে আছে। আর এটাই এদুই দেশকে আমেরিকান অবরোধের হাত থেকে, এদুই দেশের অর্থনীতিকে অন্তত কিছুটা স্থায়ী রিলিফ দিয়ে থাকে।

তবু ইরান ও রাশিয়ার মধ্যে প্রধান ফারাক হল – সারা ইইউ রাশিয়ান তেল-গ্যাসের ক্রেতা হিসাবে খুবই নির্ভরশীল। ব্যাপারটা কেবল রাশিয়ার ঠেকা তা নয়; ক্রেতারও স্বার্থের ঠেকা কম বড় না। যদিও জো বাইডেনের পাল্লায় পড়ে তার মনরক্ষার্থে ইইউ বহু চেষ্টা এখন করে গেলেও তাতে সফল হতে পারে নাই। যেমন, সর্বশেষ রয়টার্সের খবর হল – ‘জার্মানি হঠাৎ করে বিশাল গ্যাস সঙ্কটের মুখোমুখি, রাশিয়া এক চলতি জুন মাসের ব্যবধানে ৬০ শতাংশ গ্যাস সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে [Germany is facing a sudden acceleration of its gas crisis. A 60% drop in Russian supplies since early June threatens to plunge Europe’s biggest economy into severe economic shock. ]।’ আসলে এটাকেই বলছিলাম রাশিয়ার পরিস্থিতি ইরানের চেয়ে আলাদা। কীভাবে? পণ্য কেনাবেচা না হলে রাশিয়ার বেলায় এর ক্ষয়ক্ষতি একপক্ষীয় নয় বরং বিক্রেতা (রাশিয়া) ও ক্রেতা (যেমন ইইউ রাষ্ট্রগুলো) উভয়েই তাতে অসুবিধায় পড়ে এখানে। আর এখানেই সুবিধায় রাশিয়া আছে। যেমনটা ইরানের বেলায় নাই। ইরানের বেলায় জ্বালানি বিক্রি না হলে এতে বিক্রেতা ইরানের ক্ষতিটাই সবার চেয়ে বেশি।

কেন ইউরোপে রাশিয়া সুবিধাজনক অবস্থায়? মূল কারণ- পূর্ব-ইউরোপ বলে বা কমিউনিস্ট ব্লকের দেশগুলোর নেতা বলে রাশিয়া দীর্ঘদিন বাকি-দুনিয়া থেকে বাণিজ্যবিচ্ছিন্ন ছিল, মানে নিজ ব্লকের বাইরের অন্য কোনো রাষ্ট্রের সাথে বাণিজ্যিকভাবে কোন পণ্য লেনদেনের সম্পর্কে সে ছিল না ১৯৯১ সালের আগ পর্যন্ত। আর তাতে রাশিয়ান তেল-গ্যাস বাদে বাকি পুরো ইউরোপের মাটির নিচের সব তেল-গ্যাস ব্যবহার করে পশ্চিম-ইউরোপে তা শেষ করে ফেলা হয়েছিল। ফলে বর্তমান ইইউ রাষ্ট্রগুলো সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর সবাই তেল-গ্যাস প্রশ্নে সবাই একই রাশিয়ার তেল-গ্যাসের উপর সকলেই কমবেশি পরিমাণ নির্ভরশীল হয়ে পড়ে আছে সেই থেকে। যেখানে গ্যাস একদিকে তুলনামূলক ক্লিন এনার্জির উৎস। অন্যদিকে, ইউরোপ মানেই বছরের ছয় মাসের বেশি যেখানে ঘরগরম রাখতে জালানি না পুড়ালে ওসব দেশ বসবাসের অযোগ্য। ফলে ওই জীবনযাত্রা প্রচুর জ্বালানি খরচনির্ভর। এ কারণে, সেই থেকে একালে ইউরোপের কোন রাষ্ট্র রাশিয়ার তেল-গ্যাস কিনবে না এটা বললেই তাতে রাশিয়ার একটি বিকল্প জোগাড় করে ফেলাটা সহজ নয়। এজন্য তারা অনেকবারই বাইডেনকে বুঝিয়েছিল ও সিদ্ধান্তে এসেছিল যে, ২০২৭ সালের আগে তারা রাশিয়ার বিকল্প উৎসের কাছে যাবে না কারণ পাবে না। কিন্তু বাইডেনের চাপের মুখে ফিরে তারা অনেকেই অপারগতার কথা বাস্তব হলেও তা উচ্চারণ করতে চায়নি। আবার হাঙ্গেরি বা ইতালির মত কিছুদেশ খোলাখুলি চেঁচিয়ে বলে দিয়েছিল যে, রাশিয়ান গ্যাস ছাড়া তাদের অর্থনীতি চলবে না, তাই তারা কিনতেই থাকবে। অথবা গোপনে অসরকারিভাবে নগদ রুবল দিয়ে রাশিয়ান তেল-গ্যাস কিনে চলছে।

আর এখন এমন অবস্থায় খোদ রাশিয়াই এবার গ্যাস বিক্রি বা সরবরাহ কমিয়ে দেয়ার কথা জানিয়েছে। অর্থাৎ ইউরোপ ইচ্ছা বা পছন্দমত রাশিয়ার উপর (ইউরো) অবরোধ করার বদলে উল্টা রাশিয়া নিজ রুবল মুদ্রার শর্তপূরণ হলেই কেবল গ্যাস বেচবে তা তো বটেই, আবার রুবল দিলেও অনেক ক্ষেত্রে রাশিয়া উল্টা কোন কোন ইউরোপীয় রাষ্ট্রকে পাল্টা চাপ দিবে বিপদে ফেলতে – গ্যাস সরবরাহ-ই করবে না। আর এ সূত্রেই বিপদে পড়েছে জার্মানি। রয়টার্সের রিপোর্টটা তা নিয়েই।

অনেকের মনে হতে পারে, রাশিয়া গ্যাস বেচবে না? নিজে একথা বলার সামর্থ্য পেল কী করে? হ্যাঁ, রাশিয়ার সেই সামর্থ্য এখন হয়েছে। আমেরিকান মিডিয়া ব্লুমবার্গের উদ্ধৃতি, আর এনিয়ে বিবিসি এক লম্বা রিপোর্ট করেছে দেখেন গত ২২ মে – “রুবল: ভ্লাদিমির পুতিনের যেসব কৌশলে রাশিয়ার মুদ্রার নাটকীয় উত্থান”।

প্রথম কথা- রাশিয়ান অর্থনীতি এখন আমেরিকা ও ইইউ’র অবরোধের ঠেলায় কোণঠাসা হয়ে পড়বে বলে পশ্চিমাশক্তির মিডিয়া – প্রধান ও সোশ্যাল মিডিয়া দুটোতেই যে হইচই আতঙ্ক তুলে ফেলেছিল তা এখন উল্টে গেছে। বিবিসির এই রিপোর্ট বিস্তারিতভাবে রাশিয়া কী কী পদক্ষেপ নেয়ার কারণে তার রুবল এখন চাঙ্গা হয়ে গেছে এর বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছে। এছাড়া আমেরিকান স্থানীয় ভোক্তা-শ্রোতার মিডিয়া সিএনবিসি [CNBC] আরেক দিক থেকে বিস্তারিত রিপোর্ট করে [Russia’s ruble hit its strongest level in 7 years despite massive sanctions. Here’s why] জানিয়েছিল – গত মার্চ ২০২২ যেখানে এক মার্কিন ডলার কিনতে রাশিয়ার ১৩৯ রুবল লাগত; তা এখন ৫২ রুবলে নেমে গিয়ে রুবলকে শক্তিশালী করেছে। অর্থাৎ উল্টা এটা নেমে ৫২ রুবলে ডলার হয়ে যায়। কিন্তু এটা বেশি নিচে নেমে যাওয়া দর মনে করে রাশিয়ান কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কারণ এতে রাশিয়া রফতানি বাজারে বেশি রাশিয়ান পণ্য হারাবে মনে করে এতে এ্কটা ভারসাম্য আনতে তা এখন একটু বাড়িয়ে ৬২ রুবল / ডলার এই রেটের আশপাশে মূল্যস্থির ধরে রাখার মেকানিজম বের করার চেষ্টা করছে রাশিয়া।

অর্থাৎ রাশিয়ান কেন্দ্রীয় ব্যাংক সঠিক নীতি-পলিসি প্রণয়নে সক্ষম ও সফল যে, অন্য দেশকে আগে রাশিয়ান রুবল কিনে পরে ওই রুবলে মূল্য পরিশোধ করার শর্তেই রাশিয়ান তেল-গ্যাস কিনতে ক্রেতাকে বাধ্য করতে পেরেছে তারা। এটাই রুবলকে এখন এক চাঙ্গা চাহিদা সম্পন্ন মুদ্রা, এটা খুবই দরকারি মুদ্রা হিসেবে বাজারে হাজির করেছে। আর এখানেই ইউরোপের জ্বালানি চাহিদায় রাশিয়ার বিকল্প নেই – এর সুবিধা তুলে নিতে পারাতেই এটা রুবলকে শক্তিশালী মুদ্রা করে দিয়েছে। আর এখান থেকেই রাশিয়া ইরান থেকে আলাদা হয়ে আপাতত নিজ ভাগ্য খুলে বসেছে।

অথচ, যুদ্ধের শুরুতে আমেরিকার নেতৃত্বে ইউরোপ – এভাবে সারা পশ্চিমাশক্তির অনুমান-কল্পনা ছিল এটাই যেন রাশিয়ার উপর (অনেকটা যেমন ইরানের বেলায় তার অর্থনীতিতে করা হয়েছিল) আমেরিকান ডলার অবরোধ আরোপ করে ইরানের মতই রাশিয়ান অর্থনীতিকেও ক্ষতিগ্রস্ত বা সঙ্কুচিত করার পথে সহজেই ঠেলে তা সফল করবে। কিন্তু এক কথায় বললে, বাইডেনের এখনকার প্রশাসন ও নির্বাচন-পূর্ব নির্বাচন পরিচালনা টিম আসলে প্রয়োজনীয় হোমওয়ার্কই করেনি। যেগুলোর বিষয়ে শক্ত ও নির্মোহ পর্যালোচনা করে হ্যাঁ বা না সিদ্ধান্ত নেয়া দরকার ছিল সেসব ক্ষেত্রে তারা আবেগে সিদ্ধান্ত নিয়েছে; যেমন বিজয়ী হয়ে গেলে কী হবে সেই কল্পনা করে সেই সুখা-বেগে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইউরোপে রাশিয়ান তেল-গ্যাসের বিকল্প আছে কি না এর যাচাইও তারা আবেগ দিয়ে করেছিল বলেই রুবল আপাতত সারভাইভ করে গেল মনে হচ্ছে…!

শুধু তাই তা, এতে সব মিলিয়ে এখন খোদ আমেরিকাতেই একটি অংশের মনে আমেরিকার যুদ্ধে হেরে যাওয়ার বাঁশি বেজে উঠছে। তারা বাইডেনের সমালোচনার দিকগুলো তুলে আনা শুরু করেছে। হংকং থেকে প্রকাশিত এশিয়ান টাইমস ওয়েবপত্রিকা এ নিয়ে এক কঠোর সমালোচক হয়ে উঠেছে [Neocon think-tanks are driving Biden’s Ukraine policy]। সেখানে তারা আরো এক রিপোর্ট লিখেছে, বাইডেন প্রশাসনকে ঘিরে থাকা ৩৬ এক্সপার্ট এক কোটারি গ্রুপের রেফারেন্স দিয়ে বলছে এরা সম্মিলিতভাবে এক চিঠিতে লিখেছে, ‘আমেরিকা ও ইউরোপকে অবশ্যই ইউক্রেনকে রাশিয়ার সাথে কোনো যুদ্ধবিরতির চুক্তি ঘটানো থেকে ফেরাতে হবে যা ইউক্রেনের যুদ্ধলক্ষ্য পূরণের চেয়ে খাটো এবং যা পরিণতিতে লাখ লাখ ইউক্রেনীয়কে রাশিয়ার অধীনস্থ করবে।’

The letter says, in part:
“The United States and Europe must avoid the urge to encourage Kiev to negotiate a ceasefire that falls short of Ukraine’s goals and could consign millions of Ukrainians to Russian control.”

আর এই চিঠিকে কেন্দ্র করে ওয়াশিংটন পোস্ট ১৭ জুন প্রতিক্রিয়ায় আরেক রচনা ছাপিয়েছে। সেখানে প্রথম বাক্যেই বলা হয়েছে, ‘আমেরিকা ও এর সহযোগী দেশগুলো ইউক্রেনে এই দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়া শুরু করেছে বলে জানিয়ে কর্মকর্তারা বলছেন, বাইডেন প্রশাসন রাশিয়ান বিজয় যাতে না ঘটতে পারে তা থেকে রাশিয়াকে বঞ্চিত করতে চেয়ে কিয়েভে (ইউক্রেনে) সামরিক ব্যয় বিশাল বৃদ্ধির পরিকল্পনা করছে অথচ এতে যুদ্ধ বাড়িয়ে তোলাতে অস্থিতিশীলতা কয়েকগুণ বেড়ে যাবে যার সোজা ফল হবে দুনিয়াতে তীব্র ক্ষুধার সঙ্কট ও গ্লোবাল অর্থনীতির সঙ্কট জটিলতর করবে”।

“The United States and its allies are making preparations for a prolonged conflict in Ukraine, officials said, as the Biden administration attempts to deny Russia victory by surging military aid to Kyiv while scrambling to ease the war’s destabilizing effects on world hunger and the global economy.”

এভাবে সবগুলো খবরকে উদ্ধৃতি করে আরেক থিঙ্কট্যাঙ্ক কর্তা ইভো দালদার [Ivo Daalder] লিখছেন, ‘আমেরিকান প্রশাসন উভয় সঙ্কটে পড়েছে- হয় ইউক্রেনে চলমান ব্যাপক রক্তপাতের পথ হলেও তাই ধরে বসে থেকে এর ভয়ঙ্কর রকম সব গ্লোবাল পরিণতি আপন করতে হবে আর নয়তো ইউক্রেনকে সমর্থন বন্ধ করে মস্কোকে বিজয়ী হতে সহায়তা করতে হবে। এ পরিস্থিতি সত্ত্বেও বাইডেন প্রশাসন দায়িত্বজ্ঞানশূন্য আচরণ করছে, ব্যর্থ পলিসি আঁকড়ে থেকে চলছে। অন্তত সৎ নাগরিকের উচিত হবে এ নিয়ে প্রশ্ন তোলা।’

“Ivo Daalder, a former U.S. ambassador to NATO who now heads the Chicago Council on Global Affairs, said the battlefield impasse leaves the United States with a stark choice: either continue to help Ukraine sustain a potentially bloody status quo, with the devastating global consequences that entails; or halt support and permit Moscow to prevail.”

আমেরিকান বিভিন্ন থিঙ্কট্যাঙ্কের কর্তারা এ নিয়ে অস্থির হয়ে উঠেছেন। কারণ ইতোমধ্যে নিউইয়র্ক ফেডারেল রিজার্ভ বোর্ড অব গভর্নরের চেয়ারম্যান জেরোমে পাওয়েল [Jerome Powell ] আমেরিকান সিনেটের এক শুনানিতে সাক্ষ্য দিয়ে জবাব দিচ্ছিলেন যে, গ্লোবাল রিসেশন[recession] বা মহামন্দা এখন ২০০৭-৮ সালের মতো আসন্ন কি না এ প্রসঙ্গে। তিনি জবাবে তা আসন্ন নয়, তা বলতে পারেননি। অর্থাৎ এর সম্ভাবনা নাকচ করেননি [Powell says recession ‘a possibility’ but not likely]।

আর এরপর থেকেই ব্যবসায় পুঁজিবাজার বা অর্থনীতির তৎপরতার কেন্দ্রগুলোতে আশঙ্কা ছড়িয়ে পড়ে। তারা বাইডেনের থেকে নিজেদের দূরত্ব তৈরি করে ও অবিবেচক বলে তাঁর সমালোচনা করেছে, বিশেষত ইউক্রেন যুদ্ধ উসকে তোলার জন্য ও তা জোরদার করতে শুরু করেছে বলে!

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com

Advertisements