জাতীয় অধ্যাপক ও জ্ঞানতাপস আবদুর রাজ্জাক পাকিস্তান আন্দোলনে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নাজির আহমদের সঙ্গে ‘পাকিস্তান’ নামক একটি পত্রিকা বের করতেন। তার দুই বিখ্যাত ছাত্র আহমদ ছফা এবং সরদার ফজলুল করিমের সঙ্গে তার কথোপোকথন থেকে জানা যায় যে তিনি ভারতকে একটা সাম্রাজ্য হিশেবে দেখতেন। অর্থাৎ ভারতকে তিনি একটি অখন্ড জাতি বা রাষ্ট্র হিশেবে দেখতেন না। তিনি ভারতকে দেখতেন বিভিন্ন ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্ম ও জাতিসত্তার একটি বলপূর্বক গঠিত জাতিপুঞ্জ ও প্রদেশপুঞ্জ আকারে। যেখানে উত্তর ভারতীয়/হিন্দুস্তানী, বর্ণহিন্দু, ব্রাহ্মণ, ইংরেজীশিক্ষিত এলিট এবং পুঁজিপতিদের একটা আধিপত্য বা হেজেমনি আছে। এই হেজেমনির ধারক ও বাহক হিশেবে তিনি কংগ্রেসকে দেখতেন।
এজন্য তিনি সবসময় বলতেন যে ভারত যেহেতু একটা সাম্রাজ্য সেহেতু এটা দীর্ঘস্থায়ী হবে না। একদিন না একদিন এটা ভেঙে যেতে বাধ্য। কাজেই ভারত সাম্রাজ্য থেকে পাকিস্তানের বেরিয়ে যাওয়া যেমন একটা যৌক্তিক ঘটনা তেমনি এই ভারত সাম্রাজ্য ভেঙে গিয়ে সেখান থেকে আরো প্রদেশের বিচ্ছিন্ন ও স্বাধীন হওয়াটাও কেবল সময়ের ব্যাপার বলে তিনি মনে করতেন। কিন্তু তার জীবদ্দশায় তার এই ভবিষ্যতবাণী সত্য হয়নি। ইন ফ্যাক্ট আজ একুশ শতকে এসেও তা কার্যকরী হয়নি।
তবে তার জীবদ্দশায় তিনি যে পাকিস্তান আন্দোলনে সক্রিয় হয়েছিলেন তা ভেঙে দুই ভাগ হয়ে গিয়েছিল। আর এই পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার বুদ্ধিবৃত্তিক প্রেক্ষাপট যারা তৈরি করেছিলেন তাদের মধ্যে তাকে একজন প্রধানতম বলে মনে করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব শিক্ষক ও ছাত্র বাংলাদেশ আন্দোলনের বুদ্ধিবৃত্তিক দিকনির্দেশনা দিয়েছেন তাদের উপরে অধ্যাপক রাজ্জাকের একটা বড় প্রভাব ছিল। অর্থনীতিবিদ ড. নূরুল ইসলাম, রেহমান সোবহান প্রমুখের মাধ্যমে পাকিস্তানের যে দুই অর্থনীতির তত্ত্ব প্রচারিত হয়েছিল সেখানে অধ্যাপক রাজ্জাকের অনুপ্রেরণা ছিল বলে মনে করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মাধ্যমে আওয়ামী লীগে যে ছয় দফা কর্মসূচি গৃহীত হয়েছিল সেটি এই চিন্তার ফসল বলেই অনেকে মনে করেন।
তাহলে দেখা যাচ্ছে অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের চল্লিশ দশকের পাকিস্তান ভাবনা ষাটের দশকে এসে পরিবর্তিত হয়েছে। অর্থাৎ তিনি পাকিস্তানে যে শক্তিশালী ফেডারেল রাষ্ট্র গড়ে উঠেছিল তাকে সমর্থন দেয়া থেকে সরে এসে একধরনের শিথিল কনফেডারেশনের প্রতি ঝুঁকে পড়েছিলেন। আর ১৯৭১ সালে এর পরিণতিতে যখন পূর্ণ স্বাধীন বাংলাদেশ তৈরি হয়েছে সেই ঘটনাচক্রীয় পরিণতির সঙ্গেও তিনি খাপ খাইয়ে নিয়েছিলেন।
তার মানে হল অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের বোঝাপড়ায় পাকিস্তানের লাহোর প্রস্তাবের ব্যাখ্যা ও ভাষ্য একবিন্দুতে স্থির ছিল না। তা সময়ের পরিক্রমায় পরিবর্তিত হয়েছে, যা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান থেকে শুরু করে অন্যান্য বাঙালি জাতিবাদী শিক্ষক, বুদ্ধিজীবি ও ছাত্রদের প্রভাবিত করেছে।
ছফার একাত্তর কালীন এবং পরবর্তী ভাবনা ও কর্মকান্ডের এই ভারসাম্য তাকে এখনো বাঙালি জাতিবাদী বুদ্ধিজীবিদের মধ্যে সবচাইতে গ্রহণীয় করে রেখেছে। তার নির্লোভ, সাহসী বুদ্ধিজীবিতা এবং এই ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান তাকে বাঙালি জাতিবাদী মহলে একটা মিথ বানিয়ে রেখেছে।
তার চিন্তার পরিবর্তনের এক পর্যায়ে ১৯৭১ সালে যখন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারত এই প্রক্রিয়ায় নিয়ামক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে তখন কিন্তু তিনি এই ব্যাপারে কোনো দ্বিধা বা আপত্তি প্রকাশ করেন নি। অথচ তিনি একাত্তরের আগেও যেমন তেমনি একাত্তরের পরেও ভারতকে একটা কৃত্রিম সাম্রাজ্য হিশেবেই তুলে ধরতেন; এবং তার এই বিশ্বাস আমৃত্যু অটুট ছিল যে ভারতের ভেঙে যাওয়া কেবল সময়ের ব্যাপার। অথচ এই ভারতের দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি সম্মানজনক ডক্টরেট ডিগ্রীও গ্রহণ করেছিলেন।
তার ছাত্র আহমদ ছফার মধ্যেও বাংলাদেশের জাতি ও রাষ্ট্র গঠনে ভারত প্রশ্নে একটা দ্বিমুখী মনোভাব দেখা যায়। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের ভূমিকার প্রতি অনুসমর্থনের স্রোতে যেমন সওয়ার হয়েছেন, তেমনি আবার যখন ভারত বিভিন্ন সময়ে স্বাধীন বাংলাদেশের উপরে আর্থ-রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আধিপত্য দেখিয়েছে, ছফা তার প্রতিবাদে আবার সোচ্চার হয়েছেন। ছফার একাত্তর কালীন এবং পরবর্তী ভাবনা ও কর্মকান্ডের এই ভারসাম্য তাকে এখনো বাঙালি জাতিবাদী বুদ্ধিজীবিদের মধ্যে সবচাইতে গ্রহণীয় করে রেখেছে। তার নির্লোভ, সাহসী বুদ্ধিজীবিতা এবং এই ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান তাকে বাঙালি জাতিবাদী মহলে একটা মিথ বানিয়ে রেখেছে।
কিন্তু প্রশ্ন জাগে অদ্যাপক রাজ্জাক ও তার অনুসারীরা কি ২০১৩-উত্তর বাংলাদেশে আজ ভারতীয় বাতাবরণে বাঙালি জাতিবাদের যে পচন ও বিকার তা কখনো অনুমান করতে পেরেছিলেন? তাদের ভাবনার ভেতরে যে আশাবাদী জাগ্রত বাংলাদেশের চিত্রকল্প দেখতে পাওয়া গিয়েছিল তা যদি পরিগঠন করতে হয় তাহলে ব্যাপক পুনর্চিন্তা ও পুনর্গঠন কর্মযজ্ঞ লাগবে—এতে কোনো সন্দেহ নেই।