এটা নিয়ে লিখবো না ভেবেছিলাম। তারও পরেও এই বিষয়ে লিখতে হলো, কারণ দরকারী যে পয়েন্টটা আলোচনায় আনার দরকার ছিল তা কোথাও দেখি নাই। ব্লেইম গেইমের বাইরে যৌনতার রাজনীতির আলাপটাই আমরা তুলতে পারি নাই। তাই ছোট করে নিজের নোট রাখার জন্য লিখতে গিয়ে দেখি, ২০১২ সালে ‘যৌন-রাজনীতির সমাজিক ব্যাকরণ’ নামে একটা বই ৭০ পৃষ্ঠার মতো লিখে ফেলে রেখেছি। ফলে পুরানা চিন্তার আলোকেই নতুন করে কথাগুলা সহজেই আবার বলার সুযোগ নিলাম।
একটা সময়ে আমাদের দেশের কালচারাল বামপন্থীদের মধ্যে যারা একটু বুদ্ধিজীবীতাগিরি করতে চেষ্টা করতো তারা, বিখ্যাত আমেরিকান নারীবাদী চিন্তক কেট মিলেটের (Kate Millett) ‘সেক্স ইজ পলিটিক্যাল’ মানে যৌনতা রাজনৈতিক -কথাটা খুব ব্যবহার করতো। যদিও মিলেটের বইটা পুরোপুরি পড়ে দেখেছে বলে তাদের লেখা-লেখি পড়ে মনে হয় নাই। কারণ তারা মিলেটকে একটা বাম ও শ্রেণী বিপ্লবী হিসেবে হাজির করেছেন অথচ মিলেটের এই কাজের যারা পরে ক্রিটিক করেছেন তারা বরং বলছেন, তিনি রেস/বর্ণ ও শ্রেণীর প্রশ্নটা এখানে গুরুত্ব দেন নাই। অথচ বামরা এখানে মিলেটকে বিশাল বিপ্লবী আকারে হাজির করেছে। অথচ বিষয়টা পুরাই উল্টা। আবশ্য কালচারাল বামদের একটা কমন স্বভাব হলো সব কিছুকে মার্কসবাদের (তাদের তৈরিকৃত মার্কস) চোখ দিয়ে দেখা।
যাক সেই কথা। খুব ছোট করে এখনকার আমাদের প্রেক্ষাপটে এই পুরানা বইটার সূত্র ধরে কিছু কথা বলেই শেষ করি।
কেট মিলেটের “Sexual Politics” বইটা উনার পিএইচডি থিসিসের লিখিত রুপ ( ছবিতে দিছি)। এটা প্রথম বই আকারে বের হয় ১৯৬৯ সালে (কোন কোন জায়গায় ১৯৭০ সালের কথা উল্লেখ আছে। আমি যে কপিটা পড়ছি এটা ২০১৬ সালে নতুন করে ভূমিকা লিখে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস থেকে আবার বের করা হয়েছে।) এটাকে একটা ক্লাসিক বই হিসেবে ধরা হয় নারী/যৌনতা/ক্ষমতার আলোচনার জগতে। এই বইটা বের হওয়ার সাথে সাথেই ব্যাপক আলোচিত হয়েছিল। পরেই টাইম ম্যাগাজিনে “The Politics of Sex” শিরোনামে একটা প্রচ্ছদ কাহিনীও করা হয়েছিল মিলেট ও এই বইটাকে নিয়ে( ছবিতে দিছি)।
ইংরেজি সাহিত্যের বিখ্যাত কিছু উপন্যাসকে বিশ্লেষণ করে মিলেট তার তাত্বিক কাঠামো গড়ে তুলেছেন। এই বইয়ের লম্বা আলোচনা এখানে করতে পারবো না। দরকারি কয়েকটা কথা শুধু বলি।
১.
অত্যাচারী শাসক যখন যৌনতাকে ব্যবহার করে তখন সে এটাকে একই সাথে কালচালার ও রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে।
২. মিলেট লিখেন,
“Sex is deep at the heart of our troubles . . . ,” (২২)
আমাদের সংকটের গোড়ার গভীরে রয়েছে যৌনতা। এবং তিনি এর পরে আরও লিখেন, যদি আমরা আমাদের নিপীড়নমূলক ব্যাবস্থাকে বিনাশ করতে না পারি, যদি আমরা যৌন রাজনীতির গভীরে দেখতে না পারি এবং ক্ষমতার রুগ্ন ও অত্যাচারী রুপটা বুঝতে না পারি, তাইলে আমাদের স্বাধীনতার প্রচেষ্টা কোন কাজে আসবে না। আমরা আবার সেই আগের অবস্থাতেই ফিরে যাবো। কোন কিছুই পরির্বতন হবে না।
৩. তিনি আরও লিখেন, “sexualization of power is the basis of oppression.” ক্ষমতার যৌনায়ন নির্যাতনের ভিত্তি তৈরি করে। তখন যৌনতাকে একটা ‘মোরাল’ ক্যাটাগরি আকারে হাজির করে রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রয়োগের একটা প্রক্রিয়া শুরু করা হয়। মানে যৌনতা এখানে ক্ষমতা প্রয়োগের একটা পাটাতন হিসেবে কাজ করে। আশা করি এই বিষয়টা বিস্তারিত ব্যাখ্যার দরকার নাই।
৪. যৌনতার যে ধারণা সমাজে প্রচলিত থাকে তা যৌনতার সমাজিক ধারণা। এটা যৌনতার যে স্বাভাব বা প্রকৃতি (ন্যাচারাল) সেই ধারণা না। তখন এর মধ্যে জেন্ডার রোল ও অন্য অনেক বিষয় হাজির হয়। মানে সামাজিক পরিসরে যৌনতার যে ধারণা তা যৌনতার ন্যাচারল যে ধরণ বা ধারণা তার সাথে মিল থাকে না। ফলে এই ধারণা যেহেতু প্রকৃত যৌনতার ধারণার থেকে বিচূত একটি ধারণা, ফলে এটাকে নারীর বিরুদ্ধে যেমন ব্যবহার করা যায়, সমাজের দুর্বল পুরুষের বিরুদ্ধেও ব্যবহার করা যায়। বা নারী চাইলে এটা পুরুষের বিরুদ্ধেও ব্যবহার করতে পারে। আমাদের দেশের তথাকথিত নারীবাদিদের আলোচনাতে যৌনতাকে ধরেই নেয়া যে, এটা পুরুষদের কাছে নির্যাতনের অস্ত্র। খোদ যৌনতাকেই নারীর প্রতি একটা নির্যাতনের হাতিয়ার যা পুরুষ প্রয়োগ করে -এটা তারা ধরেই নেয়।
তারা কখনও এটা ভাবেই দেখে না যে, যেই যৌনতার দ্বারা নারী বা পুরুষ বা দুর্বল অত্যাচারিত সেই খোদ যৌনতার ধারণায়ই ‘যৌনতা’ নাই। যে যৌনতাকে ব্যবহার করা হয় এই অত্যাচারের টুল হিসেবে তা যৌনতার বিষয়ে তৈরি করা একটা ধারণা মাত্র। যৌনতার ন্যাচারাল স্বভাব তাতে নাই। ফলে নারীবাদের যৌন স্বাধীনতার যে জিকির তাতে যৌনতাকে যৌনতনার ন্যাচারাল রুপে ফেরাবার বার্তা নাই বরং এটা পুরুষ/অন্যরা কেন টুল হিসেবে ব্যবাহার করছে- এটাই মূল প্রশ্ন হিসেবে থাকে। এটাকে সে দখল করতে চায়। ফলে কর্পোরেট মর্ডান কালচারাল ইডিওলজি তাকে আরও উস্কে দিয়ে, তার যৌনতাকে বাজারে হাজির করার প্রতিযোগিতায় তাকে সহজেই ঠেলে দেয়। যাক, নারীবাদের চিন্তার অনেক দরকারী দিকও যেমন আছে এটার ক্রিটিকও আছে। এখানে সেই আলাপ করবো না।
তাইলে আমাদের এখন দেখতে হবে এই যে সমাজে যৌনতার যে ধারণার প্রচলন করা হয় তার সাথে বিশ্বাসের একটা বড় সম্পর্ক থাকে। খোদ যৌনতার যে প্রাকৃতিক চরিত্র তা নিয়ে কেউ কোন কথা বলে না। কথা বলে সমাজে যে মোরাল কোড আমরা তৈরি করেছি তার নিরিখে যৌনতার জাসটিফিকেশন হলেই যেন সমস্যা মিটে যায়! সেইখানে সমস্যা তৈরি করা গেলে আপনি যত বড় ফিগারই হোন আপনাকে সাইজ করে দেয়া কোন ব্যাপার না। ফলে সাধারণ, মানুষের একটা আগ্রহ থাকে অন্যের যৌনতা বিশেষ করে একটু সেলিব্রেটি হলে তার যৌনতাকে সে জানতে চায়। জাজ করতে চায়। সেলিব্রেটিদের ঘিরে যৌনতার যে রহস্য তা তাদের বাজার হ্রস-বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এটা সেলিব্রেটিরা জানেন। ফলে মানুষের আগ্রহের উস্কে দেয়ার জন্য যতটা যৌনতা দরকার সব সময় তা প্রডিউস করেন। কিন্তু মানুষ তাতে সন্তুষ্ট না। সে তখন গোপন সূত্রে আরও পরিস্কার কিছু পেতে চায়।
এই ক্ষেত্রে সমাজের যৌনতার বিষয়ে আমজনতার যে — ‘মোরাল ইমোশন’ আছে এটাকে প্রচন্ড ক্ষমতাশালী খুব সহজেই কাজে লাগাতে পারে। আবার অন্যদিকে আপনি যখন একটা মোরাল গাইড আকারে সমাজে ফাংশন করেন কিন্তু আপনার যৌনতার চর্চার বিষয়টা আপনি সমাজের যে মোরাল ইমোশন সেই অনুযায়ী চর্চা করেন না। কিন্তু অন্যকে এটা করতে বলেন ২৪ ঘন্টা। ফলে তখন ঘটনাটা কিন্তু কৌতুককর হয়ে যায়। এই যে অনুশাসেনর কথা আপনি বলেন, এটার বিরুদ্ধে ফ্যাসিবাদের কালচারাল ফোর্সরা সব সময় সংগ্রাম করে আসছে। কিন্তু রাজনৈতিক ভাবে আপনি শত্রুর হিসেবে সিলেক্ট হওয়ার কারণে এখন আপনাকে তারা নিতে পারছে না। যদিও আপনিও তাদের মতো সোসাল কোডের বাইরের যৌনতার চর্চা করেন। আপনিও ব্যক্তিগত গোপনীয়তার স্বাধীনতা চান। কিন্তু তার পরেও আপনাকে তারা মিত্র মনে করে না। কিন্তু কালচারালি আপনিও তাদের মতোই। তাদের মিত্র। সব দিক থেকেই আপনি আসলে তাদেরই মতো ফ্যানাটিক। ড্রেস ও প্রকাশের ধরণ ভিন্ন কিন্তু তাদের মতো আপনারও কোন এসেন্স নাই। পুরাটাই পারফর্ম। নিচে এটা আবারও ছোট করে বলছি।
যে কোন ধরণের যৌন স্বাধীনতাতে অপ্রেশনের সুযোগ থাকে। মানে, একই সাথে যৌনতার স্বাধীনতা ও নির্যাতনমুক্ত জীবন ও সমাজ সম্ভব না ( এটা নারীবাদে ক্রিটিকে অনেক আলোচিত, এই বিষয়ে সাবা মাহমুদের লেখা-লেখি দেখুন)। মিলেটও এই ধারণার ক্রিটিক করেছেন। এখন দেখা যাচ্ছে, যে লিবারেলরা প্রগতীবাদিরা যৌনতার স্বাধীন ও প্রাইভেট অধিকার চান, সব রকম পুলিশিং থেকে মুক্ত থেকে যৌনতার ব্যাপারে নিজের চয়েজের ও অধিকারই একমাত্র চূড়ান্ত হিসেবে গন্য হবে -এমনটা চান কিন্তু সমাজ/রাষ্ট্রের মোরাল ট্রেন্ডের কারণে তা করতে পারেন না তারা যখন দেখলেন, এমন একজন যিনি নিজের মতো করে নিজের যৌনতার চর্চা করছেন। আবার একই সাথে সমাজের বিপুল মানুষের মোরাল ইমোশন ( যার বিরুদ্ধে শাহবাগীরা সংগ্রাম করে) তৈরির পিছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন তখন যে অবস্থার তৈরি হয় তা, খুবই কৌতুক করা মনে হলেও এটা খুবই স্বাভাবিক। হুজুর ফাংশন করে যৌনতার ন্যাচারাল কোডে (অন্তত নিজের জন্য এটা তার কাছে স্বাভাবিক) কিন্তু আপহোল্ড করেন সোশাল ও শরিয়তী কোড। সেটা আবার সে হাদিস দিয়ে জাস্টিফাইও করতে চেষ্টা করেন। মর্ডান মানুষ/সাবজেক্ট কিভাবে ডিভাইন অর্ডারকে পারসনালাইজ করেন এটা তার একটা ভাল উদাহরণ।
এটা কিন্তু বিপুল মানুষের জীবনে ঘটছে প্রতিনিয়ত। কিন্তু সেটা যেহেতু রাজনৈতিকভাবে দরকারি না তাই সেটার রাজনৈতিক ব্যবহার আমরা দেখছি না। আমি সব রকম মোরাল বাটপারির বিরুদ্ধে। বরং এথিক্যাল অর্ডার ফলো করার পক্ষে। ফলে যৌনতা যে রাজনৈতিক এটা এই কেইসেও প্রমাণিত হলো। আপনি রাজনৈতিকভাবে যেই মতাদর্শকে ধারণ করবেন, যেটাকে প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করবেন আপনাকে সেই ধরণের যৌনতারই চর্চা করতে হবে নিজের জীবনে। না হলে আপনার রাজনীতির কোন মানে থাকবে না। অন্যদিকে যৌনতা একটা গিভেন মানে আগে থেকেই হাজির একটা বিষয়। এটা ন্যাচারের মধ্যে অন্যসব বিষয়ের মতো আমরা নিজের শরীরের মধ্যে পাই। ফলে এর একটা স্বাধীন প্রকৃতি আছে। এর একটা নিজের মতো স্বভাব আছে। সেটা কি? এটা অনেকটা আত্মজ্ঞানের সন্ধানের সাথে সম্পর্কিত।
সেটা বুঝতে চেষ্টা করার মধ্যদিয়ে মানুষের যৌনতা পশুর যৌনতা থেকে আলাদা হয়ে যায়। আমাদের প্রগতিশীল বলেন, ধর্মশীল বলেন, ভদ্র বলেন, অভদ্র বলেন, শিক্ষিত বলেন, মূর্খ বলেন বেশির ভাগই মানুষকেই আমরা পশুর যৌনতাতেই আটকে থাকতে দেখি। মানুষের এই আত্মজ্ঞান যেহেতু খুব সহজ না, ফলে ধর্ম ও আইনের অনুশাসনে যৌনতাকে চর্চার কিছু নীতি দেয়া হয়েছে। এইসব নীতিকে কেন্দ্র করে মানুষ নিজের মোরাল ঠিক করে নিয়ে জীবন পার করতে থাকে। নিজের মধ্যে স্বাভাবিক ভাবে যে যৌনতা, তার স্বভাব আবিস্কার করা হয় না।
ফুকোর বার্থ অব সেক্সুয়ালিটির আলোচনা এখানে বাদ রাখছি। অনেকে আবার মনে করেন বহুগামিতার মধ্যে দিয়ে এটা আবিস্কার করা সম্ভব। কিন্তু বিষয়টা একগামিতা বা বহুগামিতার মতো সরল না। যে নিজের স্বভাব জানে না তার একগামিতা বা বহুগামিতা কোন কিছুতেই যৌনতার প্রকৃতি জানা হয় না। আমরা চার পাশের মানুষকে সমাজের মোরাল কোডে জাজ করি। অন্যের কাছ থেকে খাঁটি নৈতিক আচরণ আশা করি। নিজে এটা অর্জন করার যে সংগ্রাম তা করি না। এমনকি ধর্মের নীতিকে নিজের সুবিধা মতো বদলে নেই। সেকুলারদের মতো যৌনতাকেও সেকুলার করে ফেলি নিজের সুবিধার জন্য। কেউ করে এটা প্রগতীর নামে কেউ করে খোদ ধর্মের খোলসেই।
অন্যদিকে যৌনতার রাজনীতি পর্নোগ্রাফিক সময়ের খুব স্বাভাবিক প্রবণতা। মায়ের যৌনতার ইতিহাস পাঠ করে ছেলে এবং সেটা যখন জাতীয় ঘটনাতে পরিণত হয় তখন সমাজের মধ্যে রিয়েল পলিটিক্স চর্চার আর কোন স্পেস থাকে না। যা ফ্যাসিবাদের জন্য খুবই কাজে দেয়।
যৌনতার জন্ম আসলে ক্ষমতার জন্মের সাথে সম্পৃক্ত। ফলে যৌনতাকে অনুশাসন হিসেবে যখন থেকে আবিস্কার করা হয়েছে এটার ইতিহাস আসলে মানুষের শাসনতন্ত্র শুরু হওয়ার ইতিহাসের সাথেই সম্পর্কিত।