ভাস্কর্য ইস্যুর পূর্বাপর প্রসঙ্গে
Advertisements

বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠিত হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ উত্তর সেক্যুলার জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্রের জয়জয়কারের কালে। তুরস্ক, মিশর, ইরানসহ উত্তর আফ্রিকার মুসলিম রাষ্ট্রগুলিতে এই সময়ে বিউপনিবেশায়নের প্রথম পর্যায় চলছিল। এই পর্যায়ে আধুনিক ভাষা ও সংস্কৃতিভিত্তিক সেক্যুলার জাতীয়তাবাদ এবং একদলীয় রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত অর্থনীতি ও সর্বাত্মকবাদী সমাজতন্ত্র বিউপনিবেশীয়মান রাষ্ট্রগুলিকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল।

১৯৪৭ উত্তর পাকিস্তানও এই কামালবাদী অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে গিয়েছিল। এই সার্বিক পরিস্থিতির আলোকেই পূর্ব বাংলা/পূর্ব পাকিস্তানের ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২’র ভাষা আন্দোলন এবং পরবর্তীকালে ষাট দশকের স্বাধিকার ও স্বায়ত্তশাসন থেকে ১৯৭১’র বাংলাদেশ স্বাধীনতা আন্দোলনকে দেখতে হবে।

এই সেক্যুলার জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র ও আনুষঙ্গিক বস্তুবাদ/নাস্তিক্যবাদ বাংলাদেশে আধুনিকতার এমন একটি রূপ প্রবর্তন করে যেখানে অন্তত নাগরিক এলিট মহলে জেন্ডার সাম্যের নামে নারী-পুরুষ অবাধ মেলামেশা, ভাস্কর্য শিল্পের নামে মূর্তি সংস্কৃতির নবায়ন এবং ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ধর্মউপেক্ষা ও ধর্মবিরোধীতার চর্চা শুরু হয়। একাত্তরের স্মৃতি চর্চাকে আশ্রয় করে দেশে একটি সেক্যুলার ভাস্কর্য সংস্কৃতির উদ্বোধন হয় এবং যা নাগরিক এলিট মহলে ক্রমশঃ বিস্তৃত হতে থাকে। কবি দাউদ হায়দার সত্তর দশকের প্রথমার্ধে রাসুল স.-কে অবমাননা করে কবিতা লিখে বস্তুবাদী/নাস্তিক্যবাদী আক্রমণের সূচনা করেন। এই ধারায় পরবর্তীকালে কবি শামসুর রাহমান, হুমায়ূন আজাদ, তসলিমা নাসরীন প্রমুখ উত্তরোত্তর নতুন নতুন মাত্রা সংযোগ করেন।

কিন্তু ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ আন্দোলনের নেতৃত্ব এক মহাসংকটের আবর্তে নিপতিত হয়েছিল। অর্থনৈতিক নৈরাজ্য, দুর্ভিক্ষে অনেক মানুষের মৃত্যু, প্রশাসনিক অদক্ষতা, দুর্নীতি, লুটপাট ও ব্যর্থতা বাংলাদেশ আন্দোলনের অনুঘটক চেতনা ও আদর্শগুলিকে জনমানুষের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে। সেক্যুলার জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র এবং বস্তুবাদ/নাস্তিক্যবাদ সমাজ ও রাষ্ট্রের এই মহাপতনের কার্যকারণ হিসেবে চিহ্নিত হতে থাকে।

হিজরী পঞ্চদশ শতাব্দীর সূচনায় মুসলিম বিশ্বের অন্যান্য দেশেও এইসব আদর্শগুলির বিরুদ্ধে এক জনজোয়ার লক্ষ করা যায়। বিশেষ করে ইরানে ১৯৭৯ সালে সংঘটিত ইসলামি বিপ্লব মুসলিম বিশ্বের চেতনাকাঠামোতে একটি বড় পরিবর্তনের সূচনা করে। পেট্রোডলার সমৃদ্ধ ওয়াহাবি মতাদর্শ অনুসারী সৌদী রাষ্ট্রের প্রভাব মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রে পড়তে শুরু করে। উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিমে পাকিস্তান রাষ্ট্রে সামরিক বাহিনীর পৃষ্ঠপোষকতায় ইসলামী শরিয়াভিত্তিক আইন ও প্রশাসনের প্রবর্তনা একটি নতুন পরিবেশের ইশারা হিসেবে আবির্ভূত হয়। এই সময়ে পার্শ্ববর্তী আফগানিস্তানে সোভিয়েত সামরিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এক সম্মিলিত মুসলিম জিহাদ পরিগঠিত হয় যা আধুনিক কালে জিহাদের এক পুনরুজ্জীবন ঘটায়। কামালবাদের উৎসভূমি আধুনিক তুরস্কেও ধীরে ধীরে একটি সংস্কারধর্মী ইসলামায়ন প্রক্রিয়ার সূচনা ঘটতে থাকে।
এসবের অভিঘাতে মুসলিম বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশেও আশি দশক থেকে একটি ক্রমবর্ধিষ্ণু সামাজিক ইসলামায়ন প্রক্রিয়া চলতে থাকে। কিন্তু এই প্রক্রিয়াটি সমাজের সেক্যুলার আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত একটি এলিট শ্রেণির মধ্যে এপর্যন্ত যথেষ্ট প্রবেশ করতে পারেনি। বরঞ্চ এই শ্রেণিটি পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রের মদদে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে সেক্যুলার আধুনিকতাকে তাদের আত্মপরিচয় ও চেতনা চর্চার মূলসূত্র হিশেবে অব্যাহত রেখেছে।

২০০১ সালের ৯/১১ উত্তর বৈশ্বিক ইসলামোফোবিয়ার প্রবল উত্থানের পরিবেশে যে ‘ওয়ার অন টেরর’ প্রকল্প চলছে তারই একটি স্থানীয় রূপকল্প হিশাবে এদেশে ১/১১-তে একটি রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পালাবদল ঘটানো হয়। এই পালাবদলের সুস্পষ্ট আত্মপ্রকাশ ঘটে ২০১৩ সালে শাহবাগ আন্দোলনের উত্থানের মধ্য দিয়ে। এর ফলে এদেশে লো প্রোফাইলে টিকে থাকা সেক্যুলার জাতীয়তাবাদী, বস্তুবাদী/নাস্তিক্যবাদী শক্তিগুলি হাই প্রোফাইলে চলে আসার সুযোগ পায়।

অবশ্য শাহবাগ আন্দোলনের প্রতিক্রিয়ায় হেফাজতে ইসলামের বিপুল অভ্যূত্থান ক্ষমতাসীন গণতন্ত্র-বিধ্বংসী শক্তিকেও এমন একটি ফর্মুলায় আসতে বাধ্য করেছে যেখানে এই এলিটিস্ট সেক্যুলার চেতনা জনপ্রিয় ইসলামী মূল্যবোধের সঙ্গে বোঝাপড়া করে চলে। প্রায়শই বিভিন্ন ইস্যুতে এই বোঝাপড়াকে উভয় পক্ষকেই আপডেট করে নিতে হয়। একটি কালেক্টিভ বার্গেইনিংয়ের মধ্য দিয়ে উভয় পক্ষ তার সর্বোচ্চ দাবি আদায় করে নিতে চায়। এক্ষেত্রে পারস্পরিক দেয়া-নেয়ার একটা সম্পর্কও গড়ে উঠেছে। আমরা দেখেছি উগ্র ইসলামবিদ্বেষী ব্লগার লেখকদের প্রতি পৃষ্ঠপোষণা কমে গেছে; তাদের অনেককে বিদেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে কওমি মাদরাসার দাওরায় হাদিসকে মাস্টার্সের সমমর্যাদা দেয়া হয়েছে। শাপলা চত্ত্বরে ক্র্যাকডাউনের পরে রুজু করা মামলাগুলি আপাতত স্থগিত আছে। শোকরানা মাহফিলের মাধ্যমে কওমি উলামাদের একাংশ বর্তমান শাসক বর্গের সঙ্গে একধরনের সহাবস্থানে উপনীত হয়েছে।

এই যখন এই দুই মহলের বর্তমান সম্পর্ক ও অবস্থান তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে তার সম্মানে ভাস্কর্য স্থাপনকে কেন্দ্র করে এই দুই মহলের এই দেয়া-নেয়ার সম্পর্কে নতুন করে টানাপোড়েন দেখা দিয়েছে। এটি এমন একটি মৌলিক চেতনাগত বিষয় যে দুই পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি মধ্যবিন্দু খুঁজে পেতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। কওমী মহলের জন্য এটি হল শিরকের মত একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যেখানে তাদের পক্ষে আপস করা খুব কঠিন, এমনকি অসম্ভব। অন্যদিকে এদেশের ক্ষমতাসীন শক্তি অনেক সেক্যুলার অনুষঙ্গে ছাড় দিয়েছে ঠিকই কিন্তু তাদের আইকনোগ্রাফির কেন্দ্রবিন্দু বঙ্গবন্ধুর প্রশ্নে তারা কতটা ছাড় দিতে পারবে তা নিশ্চিত করে বলা কঠিন। এখানে তাদেরও প্রেস্টিজ জড়িত। তাদের ক্ষমতার মূল উৎস হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ইমেজ ও প্রেস্টিজ। কাজেই তার ইমেজের প্রজেকশন তাদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। এখন দেখার বিষয় তারা এই ইমেজ প্রজেকশন করতে গিয়ে ভাস্কর্য ছাড়া অন্য কোনো সর্বজনগ্রাহ্য মাধ্যম বেছে নিতে পারে কিনা। অন্যথায় তাদের সঙ্গে কওমি মহলের এতদিনকার যে বোঝাপড়া তাদের অনেকটা নিশ্চিন্ত রেখেছে সেটা ভেঙে পড়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।

তবে আমার মনে হয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার দূরদর্শী স্বার্থচিন্তা থেকেই এর একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান বের করে নেবেন। এই ইস্যুকে ক্যাশ করার সুযোগ তিনি দেবেন বলে মনে হয় না। তার ট্র্যাক রেকর্ড অন্তত তা বলে না।

Advertisements