বাংলাদেশ সীমান্তে মিয়ানমারের ছোড়া মর্টারশেল বিস্ফোরণে নিহত ১
Advertisements

মিয়ানমার সীমান্তে অস্থিতিশীলতার বিষয়ে ঢাকায় অবস্থানরত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের ব্রিফ করেছে সরকার। ব্রিফিংয়ে সরকার কূটনীতিকদের জানিয়েছে, মিয়ানমার ইচ্ছাকৃতভাবেই সীমান্তে গোলাগুলি ও হামলার ঘটনা ঘটাচ্ছে। অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে তারা ফায়দা লুটতে চায় যেন রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে না হয়। তবে বাংলাদেশ কোনো রকম সংঘাতে জড়িয়ে মিয়ানমারকে ফায়দা লুটতে দেবে না বলে কূটনীতিকদের জানিয়ে দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া মিয়ানমারে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির জন্য কাউকে বাংলাদেশের মাটি ব্যবহার করতে দেয়া হবে না বলেও জানানো হয়েছে। গতকাল রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় আসিয়ানভুক্ত দেশের বাইরে অন্য সব দেশের রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনারদের নিয়ে এ ব্রিফিং আয়োজন করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ব্রিফিংয়ে আসিয়ানভুক্ত দেশ ছাড়া বিভিন্ন দেশের প্রায় ৩০ জন কূটনীতিক ও দূতাবাসের প্রতিনিধিরা অংশ নেন। এর আগে সোমবার আসিয়ানভুক্ত সাত দেশের মিশন প্রধানদের একই রকম ব্রিফ আয়োজন করা হয়।

গতকালের ব্রিফিংয়ে চীনের কোনো প্রতিনিধি অংশ নেননি বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে। ভারত এবং রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত না থাকলেও তাদের প্রতিনিধিরা ব্রিফিংয়ে অংশ নেন। ব্রিফিংয়ে মিয়ানমার সীমান্তে গোলাগুলি ও হতাহতের ঘটনা বন্ধে স্ব স্ব অবস্থান থেকে উদ্যোগ নিতে কূটনীতিকদের আহ্বান জানান ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্র সচিব অবসরপ্রাপ্ত রিয়ার অ্যাডমিরাল খুরশেদ আলম।

ব্রিফিংয়ে কূটনীতিকরা জানিয়েছে, তারা এই বার্তা নিজ দেশের সরকারের কাছে পৌঁছে দেবেন। ব্রিফিং শেষে ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্র সচিব সাংবাদিকদের বলেন, আমরা রোহিঙ্গাদের নিয়েছি পাঁচ বছর হয়ে গেল, মিয়ানমার একজন রোহিঙ্গাও আজ পর্যন্ত ফেরত নেয়নি, আমাদের প্রধানমন্ত্রীও বলেছেন যে, আমরা ধৈর্যের সঙ্গে কাজ করছি। আসলেই, আমরা ধৈর্যের সঙ্গে কাজ করছি। কিন্তু আমরা এমন কিছু করি নাই, যার জন্য মিয়ানমারের গোলা এসে আমাদের যে জনগণ, যারা আমাদের সীমান্তের ভেতরে আছে, তাদের জানমালের নিরাপত্তা ব্যাহত করবে এবং তারা গরু-বাছুর নিয়ে বাইরে যেতে পারবে না, তাদের ধানক্ষেতে যেতে পারবে না, তাদের ঘরবাড়িতে থাকতে পারবে না, এটা তো চলতে দেয়া যায় না।

এই কারণে আমরা কূটনীতিকদের কাছে বলেছি যে, আপনাদের সাহায্য আমরা চাই, যাতে করে মিয়ানমার এ অঞ্চলে একটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে ভবিষ্যতে ফায়দা লুটতে না পারে, যাতে এই রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে না হয়। বাংলাদেশ যে ‘চরম ধৈর্য’ ধরে পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছে, সে কথা কূটনীতিকদের কাছে তুলে ধরা হয়েছে বলে জানান ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্র সচিব। তিনি বলেন, আমরা কোনোভাবে চাই না এখানে জড়িত হতে, যাতে করে এখানে জড়িত হলে মিয়ানমার হয়তো সুযোগ পাবে, এই রোহিঙ্গাদের ফেরত না নেয়ার জন্য অজুহাত পাবে, সেই রকম কোনো অজুহাত আমরা মিয়ানমারকে এই মুহূর্তে দিতে চাচ্ছি না। কূটনীতিকদের প্রতিক্রিয়া কী ছিল, এ প্রশ্নে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মেরিটাইম বিষয়াবলী ইউনিটের এই সচিব বলেন, তাদের যে মতামত, তারা অ্যাপ্রিশিয়েট করেছে। আমরা যে চরম ধৈর্য দেখাচ্ছি এবং আমরা যেকোনো উস্কানিতে পা দিচ্ছি না, মিয়ানমারের কোনো উস্কানিতে পা দিচ্ছি না, এটাকে তারা অ্যাপ্রিশিয়েট করেছে। তারা বলেছে, তারা তাদের ক্যাপিটালে এই জিনিসগুলো জানাবে এবং যাতে করে ভবিষ্যতে যদি কোনো কিছু করণীয় থাকে, বিশেষ করে জাতিসংঘে যদি কোনো কিছু করণীয় থাকে, তারা আমাদেরকে সে বিষয়ে সহায়তার আশ্বাস প্রদান করেছে। মিয়ানমার ইচ্ছাকৃতভাবে এদিকে গোলা পাঠাচ্ছে কিনা, এমন প্রশ্নে নৌবাহিনীর শীর্ষ পর্যায়ের সাবেক এই কর্মকর্তা বলেন, সেটা আমাদের ধর্তব্যের বিষয় না।

ইচ্ছা করে করুক বা যা কিছুই করুক, আমরা যেটা বলি যে, এটা এই অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করে ফেলবে। কাজেই মিয়ানমার সরকারকে এটা বুঝতে হবে, মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে বুঝতে হবে। মিয়ানমারের পরিস্থিতি তুলে ধরে ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্র সচিব বলেন, বাংলাদেশ পশ্চিমে, দক্ষিণে মিয়ানমার আর্মি, উত্তরে আরাকান আর্মি। তো, তাদের গোলা কোনোভাবেই বাংলাদেশে আসার তো কথা না, পশ্চিমে তো আসার কথা না। ভৌগোলিকভাবে এটা হয় না, যদি কেউ ইচ্ছাপূর্বক না করে। খুরশেদ আলম বলেন, ইচ্ছাপূর্বক আমাদেরকে এই কনফ্লিক্টে জড়ানোর যে প্রচেষ্টা, সেটা আমরা (ব্রিফিংয়ে) বলছি যে, আমরা এই প্রচেষ্টায় জড়িত হবো না। আমরা আপনাদেরকে এটা অবহিত করলাম, আপনারা যে অ্যাকশন নেয়া মনে করেন, যথাযথ মনে করবেন, সেটা আপনারা নেবেন। কূটনৈতিক পর্যায়ের পাশাপাশি সামরিক বাহিনীর মধ্যে উত্তেজনার বিষয়ে যোগাযোগ হয়েছে কিনা- এমন প্রশ্নে খুরশেদ আলম বলেন, আমরা সর্বস্তরেই মিয়ানমারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেছি। আমি শুধু এতটুকুই বলবো যে, সর্বস্তরেই আমরা যোগাযোগ রাখতেছি, যাতে করে মিয়ানমার বুঝতে পারে, যে এই রকম একটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করা তাদের জন্য যেমন বিপজ্জনক, বাংলাদেশ কোনোভাবেই এটা সঠিকভাবে গ্রহণ করবে না।

সীমান্তের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, ওদের ভেতরে তো গোলাগুলি হচ্ছেই, সেটা অন্য জিনিস। এদিকে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম সীমান্তসহ আশপাশের এলাকায় উদ্ভূত পরিস্থিতির জন্য মিয়ানমার এবার আরাকান আর্মির পাশাপাশি রাখাইনের সশস্ত্র সংগঠন আরসার ওপর দায় চাপিয়েছে। দেশটি বলেছে, বাংলাদেশের সঙ্গে বিদ্যমান ‘আন্তরিক সম্পর্ক’ নষ্ট করার স্বার্থে এই দুই পক্ষ মিলে সীমান্ত এলাকায় চলমান পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। সোমবার সকালে ইয়াঙ্গুনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মঞ্জুরুল করিম খান চৌধুরীর সঙ্গে আলোচনায় নিজেদের অবস্থান ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মিয়ানমারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কৌশলগত অধ্যয়ন ও প্রশিক্ষণ বিভাগের মহাপরিচালক জ ফিউ উইন এমনটা বলেছেন। সোমবার রাতে মিয়ানমারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাদের ফেসবুক পেজে এই বৈঠকের তথ্য প্রকাশ করেছে।

বাংলাদেশের সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায় মিয়ানমার সেনাবাহিনীর মর্টারশেল ও গোলাবর্ষণে হতাহতের ঘটনার মধ্যে নিজেদের জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে জাতিসংঘে চিঠি দিয়েছেন শূন্যরেখায় অবস্থানরত রোহিঙ্গা শরণার্থীরা। মিয়ানমার থেকে আসা গোলায় এক কিশোর নিহতের ঘটনার তিন দিনের মাথায় সোমবার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার তুমব্রু সীমান্তের কোণাপাড়া ক্যাম্পের বাসিন্দাদের পক্ষ থেকে এই চিঠি পাঠানো হয়েছে। শূন্যরেখার রোহিঙ্গা ক্যাম্প ব্যবস্থাপনা কমিটির সর্দার (মাঝি) দিল মোহাম্মদ স্বাক্ষরিত চিঠিটি মেইল যোগে জাতিসংঘের সদর দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। মাঝি দিল মোহাম্মদ বলেন, আমরা চিঠিতে জাতিসংঘকে জানিয়েছি, সামরিক জান্তা বাহিনী যেকোনো মুহূর্তে আমাদের ওপর আরও বড় আক্রমণ করতে পারে। এমন পরিস্থিতি বিবেচনায় জাতিসংঘকে শূন্যরেখার আশ্রিত রোহিঙ্গাদের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে বলে জানান দিল মোহাম্মদ।

সূত্রঃ মানবজমিন

Advertisements