মিনিকেট, নাজিরশাইল নামের ধান না থাকলে
Advertisements

বাংলাদেশের বাজারগুলো সয়লাব হয়ে আছে মিনিকেট, নাজিরশাইল কিংবা মোটা চালে কিন্তু বাস্তবতা হলো এসব নামের কোন ধানের আবাদ যেমন দেশের কোথাও হয় না তেমনি এগুলো কেউ আমদানিও করে না।

বরং কৃষি বিজ্ঞানীরা বলছেন দেশের ধানের মাঠ আর বাজার সয়লাব থাকে ব্রি ধানে, কিন্তু বাজারে ব্রি চাল নামে কোন চালের অস্তিত্বই নেই।

আবার দেশে এখন বিপুল পরিমাণ হাইব্রিড ধান উৎপাদিত হলেও বাজারে হাইব্রিড ধানের চাল বা হাইব্রিড চাল বলে কিছু পাওয়া যায় না।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউটের ফলিত গবেষণা বিভাগের প্রধান ড. মোঃ হুমায়ুন কবীর বলছেন, ইন্সটিটিউটের উদ্ভাবিত ব্রি ২৮ ধানকেই মিলগুলো নিজেদের ইচ্ছে মতো কেটে, মিক্স ও ওভারপলিশ করে নানা নামে বাজারে আনছে।

“আমাদের এতো হাইব্রিড ধান উৎপাদন হয় অথচ সেগুলো তো আমরা বাজারে দেখি না। আবার বাজারে যেগুলো ভুরি ভুরি দেখছি সেগুলো তো মাঠে হচ্ছে না,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

অর্থাৎ বাংলাদেশে এখন যে বিপুল পরিমাণ হাইব্রিড ধান উৎপাদন হচ্ছে সেগুলোই রাইস মিলগুলোতে নিয়ে মেশিনে কেটে ছেঁটে নানা আকার দিয়ে মিনিকেটসহ নানা নামে বাজারে দেয়া হচ্ছে।

এর ফলে চালগুলো ব্রান্ডিং হচ্ছে এক নামে অথচ এর ধানগুলোর নামই মানুষ জানতে পারছে না।

আর এ ক্ষেত্রে যে ধানটি বেশি ব্যবহৃত হয়ে সেটি হলো ধান গবেষণা ইন্সটিটিউটের প্রিমিয়াম কোয়ালিটি ধান- ব্রি ২৮।

ধান গবেষণা ইন্সটিটিউটের কৃষি অর্থনীতি বিভাগের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোঃ আব্দুর রউফ সরকার বলছেন প্রডাকশন ও ব্রান্ডিং দুটি আলাদা হয়ে গেছে কোন কোন ধানের ক্ষেত্রে আর সেটিই কিছু চালের নামকরণের ক্ষেত্রে বিপত্তি তৈরি করেছে।

“ধান থেকে চাল হওয়ার পর সেটি ব্রান্ডিংয়ের ক্ষেত্রে কোন নীতিমালা নেই। সে কারণে অনেকে নিজের ইচ্ছে মতো চালের নামকরণ করেছে এবং কিছু নাম সেভাবেই প্রচলন হয়ে গেছে,” বলছিলেন তিনি।


মিনিকেট, নাজির শাইল, কাজললতা চাল আছে কিন্তু ধান নেই

দেশে মূলত ধান তিন ধরণের- আউশ, আমন ও বোরো। আর ধানের অর্ধেকেরও বেশি হলো বোরো জাতের, যেগুলোর পরিচিত ব্রি হিসেবে।

কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ বলছে এ ব্রি ধানের দুটি জাত থেকেই বেশি ধান পাওয়া যায়।

অথচ বাজারে ব্রি নামে কোন চাল নেই।

ঢাকার মিরপুরের রোকেয়া সুলতানার ৫ সদস্যের পরিবারের জন্য নিয়মিত মিনিকেট চাল কেনেন।

“মিনিকেট চালই সাধারণত কিনি আমি। দামটাও আমি এফোর্ড করতে পারি। তবে এ চাল কোন ধান থেকে হয় তা আমি আসলে জানি না,” বলছিলেন তিনি।

রোকেয়া সুলতানার মতো অনেক ক্রেতার জন্য দেশজুড়ে বাজার গুলোতে আসে হরেক রকমের মিনিকেট চাল।

আবার সাভারের ইশরাত জাহান বলছেন, তাদের পরিবারে নাজিরশাইল চালটাই বেশি নেয়া হয়।

অথচ নাজিরশাইল নামেও কোন ধান নেই। মূলত ব্রি ২৯ ধানটি ছাঁটাই করে ও অতিমাত্রায় পলিশ করে নাজিরশাইল নাম দিয়ে বাজারে ছাড়া হয়।

ডঃ হুমায়ুন কবীর বলছেন নাজিরশাইলের কোন অস্তিত্ব নেই। তবে নাইজার শাইল ধান আছে, কিন্তু সেটা আবার বাজারের যে পরিমাণ নাজিরশাইল চাল পাওয়া যায় সে পরিমাণ ধান হয় না।

অর্থাৎ মিনিকেট কিংবা নাজিরশাইলের মতো নাইজার শাইল নামে যা পাওয়া যায় তারও একটি বড় অংশ আসলে মোটা ধান কেটে ও পলিশ করে তৈরি করা।

কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ যশোর কার্যালয়ের উপপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস বলছেন মিনিকেট নামটির সূত্রপাত হয়েছে ভারত থেকে আসা ধান থেকে।

মূলত ভারত থেকে একটি ধান আসতো আগে মিনি বা ছোট প্যাকেটে করে সেগুলো কৃষকদের দেয়া হতো।

সেই ধানকেই পরে কেটে যে চাল হতো তারই নাম মিলগুলো মিনিকেট উল্লেখ করতে শুরু করে। বিশেষ করে কুষ্টিয়া ও নওগাঁয় এর ব্যাপক প্রচলন হয়ে পরে তা ব্যক্তির নামেও বাজারজাত হতে শুরু করে।

বাসমতি, রোহিঙ্গা, মাধবী, কালো জিরা

বাংলাদেশের বাজারে বাসমতি চালেরও বেশ জনপ্রিয়তা আছে অথচ যে ধান থেকে এটি হয় তার নাম বাংলা মতি আর বিজ্ঞানীদের কাছে এর পরিচিত হলো ব্রি ধান ৫০ হিসেবে।

বাজারের সবচেয়ে সরু এই চালটি যশোর অঞ্চলে ভালো বাংলা মতি ধান ভালো হয় তবে দেশে এখনো বাসমতি নামের কোন ধান নেই।

মধ্যম আকারের সরু চাল পাজাম আসলে ব্রি ধান ৪৯ কেটে ছেঁটে তৈরি করা হয়।

এ ধানটি থেকে বের হওয়া চাল মেশিনের সাহায্যে নতুন আকার দেয়ার তিনটি নামে বাজারে আসে। এগুলো হলো নাজির, পাজাম ও ৪৯।

আবার উনত্রিশ নামে একটা চাল কিছু এলাকায় জনপ্রিয় যেটা আসলে ব্রি ধান ২৯ নয় বরং সমগোত্রীয় একটা চাল যা মিল মালিকরা উনত্রিশ নামে বাজারজাত করছে।

অন্যদিকে ভিয়েতনাম থেকে আসা একটি ধানের জাত হবিগঞ্জ এলাকায় অনেকে আবাদ করেন। আর বিদেশ থেকে আসা জাতের ধান থেকে হয় বলে এর নাম ‘রোহিঙ্গা’ দিয়ে বাজারজাত করা হচ্ছে।

আবার ময়মনসিংহ অঞ্চলের অনেক জায়গা মাধবী চাল বেশ বিক্রি হয় যেটি মূলত ভারতীয় একটি জাত। কিন্তু কেন এর নাম মাধবী হলো তা জানা নেই বিজ্ঞানীদেরও।

এর বাইরে বাজারে কালো জিরা, চাষি, স্বর্ণা ও মোটা চাল পাওয়া গেলে এসব নামে ধান নেই।

এর মধ্যে আবার ব্রি ধান ৩৪ থেকে পাওয়া চালই দুটি ভিন্ন আকারে কালোজিরা ও চাষি নাম দিয়ে বাজারজাত করছেন মিল মালিকরা।

আর মোটা নামে যে চাল বাজারে আছে সেটি আসলে ব্রি ধান ১১। এটি মূলত নিম্ন আয়ের মানুষেরা বেশি কেনেন দাম কম হওয়ার কারণে।

ধান কেটে ছেঁটে নতুন আকার দেয়ায় পুষ্টির হেরফের হয় কি?

গবেষকরা বলছেন যে ধানের পুষ্টিমানের নাটকীয় পরিবর্তন হয় মেশিন কাটাকাটি আর পলিশ করার কারণে।

আব্দুর রউফ সরকার যুক্তরাষ্ট্রের একটি সরকারি সংস্থার সাথে যৌথভাবে এ নিয়ে গবেষণাও করেছেন।

বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, “ওভার পলিশ ও বেশি ছাঁটাইয়ের কারণে জিংকের পরিমাণ অনেক কমে যায় এর প্রমাণ আমরা পেয়েছি। এছাড়া কিছু কিছু ধানের পুষ্টি উপাদান নাটকীয় কমে যায় এবং কোন কোন চালে শুধু শর্করাই থাকে”।

মূলত ধান থেকে বের হওয়া চাল সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ পর্যন্ত ছাঁটাই করলে পুষ্টিমানের ক্ষতি হয় না কিন্তু মিস্টার সরকার বলছেন বাংলাদেশে ছাটাই করা হয় ২৫ শতাংশেরও বেশি।

কিভাবে ছাঁটাই হয় ধান

নওগাঁর একজন মিল মালিক বলছেন, তারা কৃষকের কাছ থেকে ধান নিয়ে সেটি একবারেই অটোমেটিক ড্রায়ার মিলে দেন।

এগুলো তাপে সেদ্ধ হয়ে কালার সর্টার যন্ত্রের মধ্য দিকে ঝকঝকে চাল হিসেবে বের হয়ে আসে।

পরে পানি মিশেয়ে আরও তাপ দিয়ে চালের উপরের আবরণ তুলে ফেলা হয়। এরপর আবার মেশিনে পলিশ করা হয়।

এভাবে চালের প্রকৃত রংসহ উপরিভাগের আস্তরণ ও ময়লা সরিয়ে ঝকঝকে চাল বের হয়ে বাজারে যায় মিনিকেট, নাজিরশাইল কিংবা কাজললতা নামে।

তবে এই মিল মালিক তার নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করেছেন।

চালের উৎস আর ধানের জাত চেনার চেষ্টা

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, যে চালের উৎস জানতে অন্তত বিশটি জেলায় সমীক্ষার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে গত জুনে।

মূলত চালের উপরিভাগের আবরণে প্রোটিন, ভিটামিন ও মিনারেল যাতে ছাঁটাই করে না ফেলা দেয়া হয় সেটি নিশ্চিত করতেই এ উদ্যোগ নেয়া হয়।

বাজারের চালে এসব উপাদান না থাকলে ভিটামিন বি-২ সহ যেসব খাদ্য ক্যালরির পাওয়ার কথা তাও পাবেন না ভোক্তারা।

এ উদ্যোগটি সফলতা পেলে একটি নীতিমালা তৈরি হতে পারে বলে আশা করছেন ধান গবেষণা ইন্সটিউটের ফলিত গবেষণার প্রধান ডঃ হুমায়ুন কবীর।

সূত্রঃ বিবিসি

Advertisements