মিডিয়া ও শাসনের কথকথা
Advertisements

চার্লস চ্যাপলিনের মডার্ন টাইমস (১৯৩৬) সিনেমার প্রথম দৃশ্যে দেখা যায় সাতসকালে গাদাগাদা সুজজ্জিত মানুষ শহরের পথে হুড়োহুড়ি করে ছুটে চলেছেন, কে কার আগে যাবেন তাই নিয়ে যেন পাল্লা দিচ্ছেন। আসলে কিন্তু এটা কোনো দৌড় পাল্লার দৃশ্য না, সকলেই নাকেমুখে ছুটেছেন বস্তুগত প্রয়োজনে, টাইমমতো অফিস বা কাজে পৌঁছানোর তাগিদে। পরের দৃশ্যটা আরও চমকপ্রদ: একদল ভেড়া ঠেলাঠেলি করে, এ ওকে গুতো দিয়ে সূড়ঙ্গপথে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে। এইটুকু দেখে নিয়ে, আপনি যদি সিনেমা বুঝে থাকেন, তো আপনার মনে প্রশ্ন জাগবে: চ্যাপলিন কি আধুনিক, কর্মপানে ছুটে-চলা, কর্তব্যপরায়ণ, টাইম-মানা মানুষজনকে ভেড়ার পালের সাথে তুলনা করলেন! হ্যাঁ, তাই। চ্যাপলিন তাই করেছেন। কারণ, এই মানুষগুলো সমাজের অমানবিকতা, অস্থিরতা, অসাম্য, অসঙ্গতি, অগণতন্ত্র ইত্যাদি নিয়ে কোনো রা করে না, কোনো প্রশ্ন করে না। তারা কেবলই উপরওয়ালার নির্দেশ মেনে চলে, ভীষণ অনুগত, প্রয়োজন মতো শেখানো বুলি আওড়ায়, স্লোগান দেয়, কাজকর্ম করে মালিকের প্রফিট বাড়ায়, খায়-দায়, আর আরামে ঘুমায়- ঠিক যেন আরামপ্রিয় ভেড়ার পালের মতো শরীরে লোম আর মাংস উৎপাদন করে চলেছে। কেবল দুটো ভালোমন্দ খাবার, জানমালের আপাত নিরাপত্তা মানে আইনের শাসন, সপ্তাহান্তে একটু আনন্দফুর্তির সুযোগ এবং পছন্দমতো পণ্য কিনতে পারলেই নিজেদেরকে সুখী ও কামিয়াব ভাবে। আর এইসব আনন্দে সূড়ঙ্গের সংকীর্ণ জীবনবোধ ও পরাধীনতার শেকলকেই স্বাধীন ফুলের মালা ভেবে গলায় পড়ে নেয়, কলুর বলদের মতো ভোর থেকে নিয়ম মেনে কর্মপানে ছুটতে থাকে। সমাজ যেন এক অবিরাম গড্ডলপ্রবাহ।

আর গড্ডল মানে যে ভেড়া এই কথাটা আমরা সকলেই জানি। যুগে যুগে শাসকেরাও জানে বলেই বোধহয় ‘সমাজ’ শব্দটির ভিতরেও ভেড়ার লোমশ শরীর ও কটূ গন্ধ ঢুকিয়ে দিয়েছেন। কেননা, আমাদের ব্যাকরণ বলে, সম অজ’র সমষ্টি হলো সমাজ; আর অভিধান বলে, অজ শব্দটির একটা অর্থ তো ভেড়াও হয় হে!

যে শিশু প্রতি মুহূর্তে এটা-ওটা করতে থাকে এবং তার জাগ্রত প্রতিটা ক্ষণ হাজারো প্রশ্নবাণে আমাদের জীবন জর্জরিত করে তোলে সেই শিশুই ক্রমশ শিখতে শিখতে বেড়ে ওঠে, এবং বড় হতে হতে তার এটা-ওটা করবার সৃষ্টিশীল বাসনা ও জানবার সীমাহীন জিজ্ঞাসা হারিয়ে যায়। কিন্তু, কেন এমন হয়? কেন সে অসাম্য, ক্ষুধা আর অমানবিকতায় ভরা এই দুনিয়াদরি নিয়ে কোনো প্রশ্ন করতে শেখে না? কেন সে সমাজের জন্য মানানসই নিয়ম-কানুন, আচার-প্রথা শিখে নিয়ে অজ বা গড্ডলপ্রবাহে গা ভাসিয়ে দেয়? অমিত সম্ভাবনাময় ও সৃজনশীল মানুষ্য সন্তানকে এ রকম অজ কিংবা গড্ডল বানাবার তরিকাই বা কি, তাদের শাসন করবার মেকানিজম কী?

মানুষকে ভেড়া বানিয়ে শাসন করবার তরিকা মোটামুটি দুইটি- অস্ত্র এবং শাস্ত্র। শাস্ত্র’র কথা শুনে চোখ কপালে তুলবেন না। শাস্ত্র কেবল ধর্ম, নীতি-নৈতিকতা, কিংবা নিরীহ আলোবিস্তারী জ্ঞানবিদ্যার ভান্ডার না- বিদ্যার আলো শাসনেরও নিশানা দেগে দেয়। অন্তত, সকল জ্ঞানকান্ডের বেশিরভাগ শাস্ত্রীয় জ্ঞান যে শাসকের আনুগত্য তৈরিতে ব্যয় হয় সেকথা নিশ্চিত। এ সকল শাস্ত্র এমনভাবেই সমাজের মানুষকে শিক্ষা দেয় যেন তারা ধর্মরাজের বিশ্বস্ত নতজানু প্রজা কিংবা আধুনিক রাষ্ট্রের বাধ্য-অনুগত সুনাগরিক হয়ে ওঠে। শাস্ত্র মানেও তাই, হরিচরণ বন্দোপাধ্যায় তার বঙ্গীয় শব্দকোষে লিখে রেখেছেন এইভাবে- শাসন যন্ত্র, যা দিয়ে শাসন করা হয়। অস্ত্রের বল সীমিত, তাতে শাসিতের সবটুকু আনুগত্য পাওয়া যায় না, অস্ত্রের বল ক্ষণস্থায়ী; আর শাস্ত্রের বল দীর্ঘস্থায়ী, কখনো চিরস্থায়ী। মানুষের মনের ওপর গভীরভাবে শাসন জারী করতে তাই বেশি বেশি লাগে শাস্ত্রের চর্চা- শাস্ত্রের অনুশাসন ও নজরদারি। এ কারণেই অস্ত্রশস্ত্র শব্দ দুটি একাকার হয়ে একসাথে উচ্চারিত হয়, কিন্তু কেন যে একসাথে উচ্চারণের অভ্যাস আমরা রপ্ত করে নিয়েছি তা হয়তো অনেকেই খেয়ালও করি না।


কারণ, এই মানুষগুলো সমাজের অমানবিকতা, অস্থিরতা, অসাম্য, অসঙ্গতি, অগণতন্ত্র ইত্যাদি নিয়ে কোনো রা করে না, কোনো প্রশ্ন করে না। তারা কেবলই উপরওয়ালার নির্দেশ মেনে চলে, ভীষণ অনুগত, প্রয়োজন মতো শেখানো বুলি আওড়ায়, স্লোগান দেয়, কাজকর্ম করে মালিকের প্রফিট বাড়ায়, খায়-দায়, আর আরামে ঘুমায়- ঠিক যেন আরামপ্রিয় ভেড়ার পালের মতো শরীরে লোম আর মাংস উৎপাদন করে চলেছে। কেবল দুটো ভালোমন্দ খাবার, জানমালের আপাত নিরাপত্তা মানে আইনের শাসন, সপ্তাহান্তে একটু আনন্দফুর্তির সুযোগ এবং পছন্দমতো পণ্য কিনতে পারলেই নিজেদেরকে সুখী ও কামিয়াব ভাবে।

প্রাচীন কাল থেকে আধুনিক কাল পর্যন্ত বারবার অস্ত্রের রূপবদল হয়েছে, তার ধ্বংসের ক্ষমতা ক্রমশ বেড়েছে। বল্লম-তলোয়ারের জায়গায় এসেছে অটমেটিক রাইফেল-বন্দুক-বোমা। গণবিধ্বংসী নাপাম বোমা, এটম বোমা- যা দিয়ে মুহূর্তেই লক্ষ লক্ষ মানুষকে বাস্তুভিটাসহ ধুলোয় মিলিয়ে দেয়া যায়। এসেছে সুপারসনিক জঙ্গীবিমান, নির্ভুল লক্ষ্যভেদী মিজাইল। এসেছে জীবানু অস্ত্র, যা গোপনে শরীরে প্রবেশ করে প্রাণঘাতী রোগবালাইয়ের প্রাদুর্ভাব ঘটিয়ে বিনাশ করে; কিংবা ড্রোণ নামের সেই আশ্চর্য মনুষ্যবিহীন যুদ্ধযান, রিমোট কনট্রোল হাতে যুক্তরাষ্ট্রে বসেই যে অস্ত্র দিয়ে পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তের চেনা-অচেনা শত্র মুহূর্তেই খতম করা যায়। শাস্ত্রেরও রূপবদল হয়েছে। রূপকথা, লোকগাথা, পুঁথি কিংবা ধর্মোপদেশের কাল বহু পিছনে ফেলে আধুনিক শিল্পবিপ্লব কালের মূদ্রণ সংবাদপত্র ও গল্প-উপন্যাস পাঠক-পাঠিকাদেরও অতিক্রম করে আমরা এসে পড়েছি অহর্নিশ বহুবর্ণিল মিডিয়া প্রবাহের যুগে- দেখনদারির কালে, মিডিয়া-সংস্কৃতির এই কালে। এখন স্মার্ট টেলিভিশন, স্মার্ট টেলিফোন, আর স্মার্ট ঝকঝকে মানুষজনের স্মার্ট জীবন যাপনের কাল। এখন সর্বক্ষণ হাজারটা স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেল ২৪ ঘণ্টা সম্প্রচার করছে প্রায়-বাস্তব করে তোলা ভিডিও ইমেজ ও কথা। এখন মানুষের হাতে হাতে মোবাইল ফোন, আর সেই ফোন-ক্যামেরায় তোলা সেলফি সাথে সাথেই অনলাইলে আপডেট হয়ে যাচ্ছে- দেখা এবং দেখানোর বাসনায়। এখন মুহূর্তেই ইন্টারনেটে ডিজিটাল বার্তা ছড়িয়ে পড়ছে, দূরদেশের মানুষ নিকটবর্তী হচ্ছে- ওয়েবক্যামে বসে কেউ ছায়া-সঙ্গীর সাথে মুখোমুখি কথা বলছে। যদিও, সেই ছায়া-মানবদের মুখ ও মুখোশের চেহারা অবিরাম বদলে বদলে যাচ্ছে- ডিজিটাল ফরম্যাটের সুবাদে একই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান হাজার নামে হাজার রূপে হাজারটা প্লাটফর্মে নিজেদেরকে হাজির করতে পারছে। এইসব অবিরাম বার্তাপ্রবাহে সমাজ দেহমন আবেগে, আতঙ্কে, ভয়ে, ত্রাসে, আশ্বাসে, স্বপ্নে, ঘৃণায় আলোড়িত হচ্ছে। আর এই সুযোগে অনলাইনে, মোবাইল ফোনে ও অন্যান্য কানেকশানের সূত্র ধরে ব্যক্তিগত গোপনীয়তার সকল অন্দর লোপাট হয়ে যাচ্ছে রাষ্ট্র ও কর্পোরেশানের গোপন গোয়েন্দা যন্ত্রের অদৃশ্য আড়িপাতা তারে। একটু বাদেই আমাদের যাপিত বর্তমানের শাসনপ্রণালী ও শাস্ত্রকথায় ঢুকবো, তার আগে একনজর পিছনের রাস্তার চিহ্নগুলো দেখে আসি।


এতোদিনের এই পৃথিবীতে, সভ্য মানুষের কয়েক হাজার বছরের ইতিহাসে কিন্তু তিন-চারশো বছর আগেও আধুনিক রাষ্ট্র ছিল না, ছাপানো বইপত্র ছিল না, সংবাদপত্রও ছিল না। মানবাধিকার, ভোটাধিকার, প্রজাতন্ত্র কিংবা গণতন্ত্রও ছিল না, আজকের মতো জাতীয় ও জাতীয়তাবাদী নাগরিক পরিচয়ও ছিল না। তখন ছিল রাজা-মহারাজাদের একক সার্বভৌমত্বের কাল। তারই নির্দেশে যেকারো প্রাণ যেত যেকোনো মুহূর্তে, বাঘে-মহিষে একঘাটে জল খেত। তিনিই ছিলেন আইন, তিনিই কানুন, এ জগতের তিনিই সূর্য, তিনিই চন্দ্র। নিজের রাজত্বে নিজেদেরকে তারা ভাবতেন ঈশ্বর/আল্লাহর প্রতিনিধি শাহানশাহ, ধর্মাবতার কিংবা ঈশ্বরপ্রতিম সর্বেশ্বর। সর্বোস্তরের মানুষও তাদের ইহজাগতিক-পরজাগতিক ভালো-মন্দ সকল কিছুকেই বিচার করতো ধর্মীয় জ্ঞান ও বিশ্বাস দিয়েই। এইতো সেদিন বৃটিশ আমলেও, আমাদের দেশের চাষীরা বিশ্বাস করতেন জমিদারের ধর্ম হলো, ঈশ্বর/আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে প্রজাদেরকে আপন সন্তানের মতো প্রতিপালন করা- যাহার নাম প্রজাপালন ধর্ম, রাজধর্ম। তাই, এই ধর্ম পালনে ব্যর্থ, দূরাচার প্রজাপীড়ক দুষ্টু জমিদারের বিরুদ্ধে তারা যখন বিদ্রোহ করতো, তাও করতো ধর্মের নামেই। আর আশ্রয়দাতা হিসেবে প্রজাবৎসল নতুন জমিদার খুঁজে নিতো অনুগত সন্তানের মতো। নবাবদের মসনদ ভেঙ্গে বৃটিশ বেনিয়ারা যখন এই দেশকে উপনিবেশ বানিয়ে ফেললো, তখনও তাদের তাই কিছুই যায় আসেনি। তারা শুধু এইটুকু চেয়েছে যেন বৃটিশ বেনিয়াও রাজধর্ম মেনে প্রজাপালন করে, একটু প্রজাবৎসল হয়। ফলত, এই একেশ্বরী নিরংকুশ ক্ষমতার অবসান হতো না কখনো, ধর্মের কল বাতাসে নড়তো’ ধর্মশাস্ত্র, ধর্মীয় আদাব-লেহাজের নীতিশাস্ত্র তাদের নিরংকুশ শাসনের বৈধতা তৈরি করতো। সনাতন মানুষের জন্য মনুর বিধান, রামায়ন, অমৃতসমান মহাভারতকথা, কিংবা খৃস্ট্রীয় ধর্মের বিশেষত ক্যাথলিক চার্চ, ম্যাস কনগ্রিগেশান, ব্যাপটিজম ইত্যাদি, ইসলামের খিলাফতের ধারণা, কাজীর বিচার ইত্যাদি রাজা-মহারাজার ক্ষমতাকে নিরংকুশ করে তুলতো, প্রজাসাধারণ ভেড়ার পালের মতো ধর্মাবতার রাজার অনুগত দাসানুদাস হয়ে থাকতো, কখনো একটু বেগরবাই করলেই তো কল্লা যেত, এমনই ছিল ধর্মশাস্ত্রের বিধান ও শাসন।

কিন্তু বিভিন্ন দেশের উপনিবেশগুলো থেকে বর্বর শোষণের মাধ্যমে উপার্জিত সম্পদ- যে শোষণকে বর্তমানের উদারবাদী অর্থনীতি প্রিমিটিভ এ্যকিউমুলেশান বলে এড়িয়ে যেতে চাইলেও কোনোকালেই এই আদিম বর্বরতা ত্যাগ করতে পারেনি; এবং অনেকটা সেই সম্পদের জোরেই, ইউরোপে জ্ঞান ও বিজ্ঞানের বিকাশ, সেইসাথে সমাজের প্রতিষ্ঠানগুলোতে যুক্তিবাদিতার চর্চা পুরনো ধর্ম ও ধর্মরাজের কর্তৃত্ব ও শাসনতন্ত্রে ফাটল ধরিয়ে দিল। আবিষ্কার হলো বিদ্যুতশক্তি, মূদ্রণযন্ত্র, আরও হরেক রকমের কল ও কারখানা। রেললাইন বসলো, টেলিগ্রাফ আর টেলিফোনও হলো। শিল্পবিপ্লব শুরু হলো, দাস-শ্রমিক ও প্রজার বদলে মানুষ হয়ে উঠলো ‘ফ্রি’ লেবার। এ হলো আধুনিকতার যুগ, পুঁজিতন্ত্রের যুগ। জনসাধারণের জন্য আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা চালু হলো। সংবাদপত্র, সাময়িকি, উপন্যাস ও নানা কাহিনী প্রকাশিত হতে থাকলো। দেখা দিল এক নতুন সমাজ, গণমানুষের সমাজ- আলোকিত সমাজ, যুক্তিবাদের সমাজ, যে সমাজে মানুষ নিজেই নিজের ভাগ্যনিয়ন্তা কর্তা ভাবতে চায়। ইমানুয়েল কান্ট তার হোয়াট ইজ এনলাইটেনমেন্ট (১৭৮৪) নামের ছোট্ট কিন্তু অত্যন্ত প্রভাবশালী প্রবন্ধে পূর্বের ধর্মশাসিত যুগকে দেখলেন ’সেল্ফ-ইমপোজড ইমম্যাচিওরিটি’ হিসেবে। আর এই ‘ইমম্যাচিওরিটি’ থেকে উত্তরণের পথ হলো কেবলই ‘র‌্যাশনালিজমের’ চর্চা। ফরাসী বিপ্লব সাম্য, মুক্তি আর স্বাধীনতার আশা জাগিয়ে তুলল দেশে দেশে। এই যুগ রাজার তন্ত্র ও ধর্মশাস্ত্রের শাসন হটিয়ে কায়েম করলো প্রজার তন্ত্র ও যুক্তিবাদিতার শাসন। আমরা পেলাম আধুনিক রাষ্ট্র, গণতন্ত্র, আইনের শাসন, আর প্রজা ও দাসের বদলে শাসিত হবার মতো ‘জনগণ’। নতুন কায়দা-কানুনের বশে মানুষ মুক্তি, স্বাধীনতা, সাম্য, ন্যায়বিচার, উন্নয়ন, প্রগতির স্বপ্নে বিভোর হলো। এগুলোই নতুন যুগের শাস্ত্রবচন যার ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে পুঁজিবাদ পুরনো ধর্মরাজ ও ধর্মরাজ্য হটিয়ে আধুনিক মানুষ শাসনের বৈচিত্রময় অভিযাত্রা শুরু করলো।


ধর্মীয় শাসনের যুগেও মানুষ অর্থসম্পদ উপার্জন ও সঞ্চয় করতো। তবে সে যুগে মানুষই সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায়ে রাখতে পারতো। কিন্তু পুঁজির যুগের বৈশিষ্ট্য হলো, সম্পদই মানুষের জীবন নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে।

জ্ঞানবিজ্ঞান শাস্ত্রগুলোর ঐতিহাসিক রূপান্তর নিয়ে কাজ করে পৃথিবীময় সাড়াজাগানো ফরাসী দার্শনিক মিশেল ফুকো নিজেকে কান্টের ছাত্র বলতেন। প্রায় ২০০ বছর পরে ১৯৭০’র দশকে তিনি কান্টের সমালোচনা করে একই শিরোনামে একখানা প্রবন্ধ লিখেছিলেন। তিনি অবশ্য কান্টের মতো যুক্তিবাদের মধ্যে মুক্তির আলো খুঁজে পাননি। তিনি বরং সতেরো শতক থেকে ধর্মের বদলে আধুনিক যুক্তিবাদের ভিত্তিতে জগৎ বিচারের এই রূপান্তরকে দেখেছেন শাসকতার ক্ষেত্রে এপিস্টেমিক ব্রেক বা জ্ঞানের রূপান্তর হিসেবে। এই রূপান্তর মানুষের মুক্তির আশ্বাস পূরণ করেনি, ‘ইমম্যাচিওরিটি’ বা নাবালকত্ব থেকে উত্তরণের স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেছে। মানুষ বরং নতুনভাবে অনুশাসনবদ্ধ হয়েছে। যেমন, ইতোপূর্বে রাজামহারাজারা শাস্তিদানের উদ্দেশ্যে কারাগারকে কেবলই অন্ধকূপ হিসেবে ব্যবহার করতো। জীবনের অপচয় ছিল ভয়াবহ। কিন্তু যুক্তিবাদের এ যুগে জীবনকে মূল্যবান ভাবা শুরু হলো- ফলে তাকে দক্ষ করে তুলবার সকল আয়োজন রাষ্ট্র করতে থাকে, কোনো মহৎ উদেশ্যে নয় অর্থনৈতিক স্বার্থে। কারণ, যুক্তিবাদ শ্রমের অপচয় রোধ করে দক্ষতা বাড়িয়ে পুঁজির বিকাশও গতিশীল করতে চায়। এযুগে শাস্তির পাশাপাশি তাই বিভিন্ন প্রশিক্ষণ, শিক্ষা ও রুটিন জীবনে অভ্যস্ত করা হয় কয়েদীদের- যেন তারা আবার সমাজে ফিরে এসে উৎপাদনশীল শ্রমিক হয়ে উঠতে পারে, অর্থনীতির চাকাকে বেগবান করতে পারে। এ কারণেই, দেশে দেশে কারাগারের নাম বদলিয়ে রাখা হতে থাকে- সংশোধনাগার। আর, কারাগারের এই মডেলে ধীরে ধীরে রাষ্ট্রের অন্য সকল প্রতিষ্ঠানও রূপান্তরিত হতে থাকে। কারাগারে যেমন সার্বক্ষণিক নজরদারি থাকে, এ সকল প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেও সমাজের সর্বত্র সার্বক্ষণিক নজরদারি চালু হয়ে যায়। আর, নজরদারীর অধীন অনুশাসনবদ্ধ মানুষের আনুগত্যেই পুঁজির অধিকতর বিকাশের পথ খুলে যায় বহুভাবে। আধুনিকতা আর যুক্তিবাদের ম্যূল্যবোধ ও জীবন অন্য সকল প্রকারের জীবন ও মূল্যচেতনার ওপর দখল কায়েম করতে চেয়েছে। গুটিকয়েক মানুষ আর প্রতিষ্ঠানের হাতে পৃথিবীর তাবৎ সম্পদ কুক্ষিগত হয়ে পড়েছে। ফলত, পৃথিবী এই যুক্তিবাদী আধুনিকতার যুগেই দুই দুইবার বিশ^যুদ্ধ দেখেছে। এই যুক্তি আর বিজ্ঞানের যুগেই দেশে দেশে স্বনির্ভর কৃষিব্যবস্থা পরনির্ভর হয়েছে। অধিকতর উৎপাদনের যুক্তিতে লক্ষ লক্ষ একর জমি কোম্পানির কাছে লিজ দেয়া হয়েছে। আর, ক্ষুদ্র কৃষকেরা উদ্বাস্তু হয়ে শহরে এসে কারখানার শ্রমিক হয়েছে। ১৯৩০’র দশকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঠিক আগে পৃথিবীজুড়ে দেখা দিয়েছে অথনৈতিক মহামন্দা।

ঠিক এই সময়েই চ্যাপলিন মডার্ন টাইমস সিনেমাটি বানিয়েছিলেন। অমিত সম্ভাবনাময় মানুষকে অনুশাসনের সূড়ঙ্গের সংকীর্ণতায় আটকে ফেলার যে অবিরাম প্রচেষ্টা আধুনিক শিল্পসমাজ চালু করেছে তার সমালোচনা করতেই তিনি পূর্বোল্লেখিত দৃশ্য দুটি পাশাপাশি রেখেছিলেন, আর পুরো সিনেমাজুড়ে দেখিয়েছিলেন শিল্পকারখানায় শ্রমিক হয়ে ওঠা বিপুল সংখ্যক অসহায় মানুষের নিষ্ঠুর দারিদ্র। এইরকম শিল্পসমাজের জন্য দরকার অনুগত কর্মীবাহিনী। আধুনিক সমাজ এইরকম পণ্যলোভাতুর, প্রশ্নহীন, ভেড়াতুল্য অনুগত মানুষ তৈরি করে এবং শাসনের পক্ষে জনসম্মতি উৎপাদন করে ধর্মশাস্ত্র দিয়ে নয়। বরং সেকুলার মডার্ন রাষ্ট্রের সহায়তায় পুঁজিবাদ আগের ধর্মগুলোকেই শাসন করে নতুন রূপে সাজায় এবং নিজে নতুন ধর্মব্যবস্থা হয়ে ওঠে। অবাকই লাগে যে, চ্যাপলিনের সেই সময়ে অর্থাৎ ত্রিশের দশকেই এ-সংক্রান্ত দুইখানা বিশেষ উল্লেখযোগ্য পুস্তক লেখা হয়েছিল। ম্যাক্স ওয়েবার লেখেন, দ্য প্রটেট্যান্ট এথিক্স এন্ড দ্য স্পিরিট অব ক্যাপিটালিজম- যেখানে তিনি দেখান ইহজাগতিক কর্তব্য পালনের যে প্রটেস্ট্যান্ট নৈতিকতাকে ধর্মীয় কর্তব্য হিসেবে গণ্য করা হয় তাই পুঁজিবাদের বিকাশে প্রধান ভূমিকা রেখেছে। এই নৈতিকতায় বিত্তবৈভব অর্জনের প্রচেষ্টাকে ভোগবিলাসের পথ প্রশস্ত করবার উপায় নয় বরং ধর্মীয় কর্তব্য হিসেবে গণ্য করা হয়। আর, ওয়াল্টার বেঞ্জামিন লেখেন ক্যাপিটালিজম এ্যজ রিলিজিওন বইটি- তার প্রধান দাবি, ধর্মের নৈতিকতা অবলম্বন করে পুঁজিবাদ গড়ে উঠেছে বললে কমই বলা হয়, বরং পুঁজিবাদ নিজেই সবচেয়ে শক্তিশালী ধর্মীয় কাল্ট হিসেবে সক্রিয় হয়েছে।


সর্বোস্তরের মানুষও তাদের ইহজাগতিক-পরজাগতিক ভালো-মন্দ সকল কিছুকেই বিচার করতো ধর্মীয় জ্ঞান ও বিশ্বাস দিয়েই। এইতো সেদিন বৃটিশ আমলেও, আমাদের দেশের চাষীরা বিশ্বাস করতেন জমিদারের ধর্ম হলো, ঈশ্বর/আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে প্রজাদেরকে আপন সন্তানের মতো প্রতিপালন করা- যাহার নাম প্রজাপালন ধর্ম, রাজধর্ম। তাই, এই ধর্ম পালনে ব্যর্থ, দূরাচার প্রজাপীড়ক দুষ্টু জমিদারের বিরুদ্ধে তারা যখন বিদ্রোহ করতো, তাও করতো ধর্মের নামেই।

এই ধর্মীয় কাল্টের প্রধান ইডিওলজিক্যাল এ্যাপারেটাস বা মতাদর্শিক অঙ্গ ম্যাস মিডিয়া। এ কারণে পুঁজিবাদের প্রধান পাটাতন আধুনিক রাষ্ট্রে ম্যাস মিডিয়া চতুর্থ স্তম্ভ গণ্য হয়। ব্যবসাবাণিজ্য ও শিল্প উৎপাদনের মাধ্যমে পুঁজির অবাধ বিকাশের জন্য সুষ্ঠু রাষ্ট্র পরিচালনা এবং সুশাসনের ওপর নজরদারির দায়িত্ব ম্যাস মিডিয়ার ওপরে বর্তায়। এবং ম্যাস মিডিয়ার ‘ওয়াচডগ’ ভূমিকার মাধ্যমে সে দায়িত্ব পালিত হবে বলে সকলে প্রত্যাশা করে।

মিডিয়া বললেই এখনও আমাদের মাথায় ঘুরপাক খায় সংবাদপত্র, রেডিও, চলচ্চিত্র এবং টেলিভিশনের নাম। এগুলোকে আমরা ম্যাস মিডিয়া বা ‘গণমাধ্যম’ বলি, যদিও এগুলোকে গণমানুষের মাধ্যম বলা চলে না কিছুতেই। বস্তুত, ‘গণমাধ্যম’ বলার ভিতরে এমন একটা সূ² ভাঁজ আছে যে আমাদের মনে বিভ্রম জাগে, এগুলো হলো জনগণের মাধ্যম, এতে সমাজের সকল সদস্যের সমান অংশিদারিত্ব ও অংশগ্রহণ থাকে। এই বিভ্রমের ফলে মিডিয়া একটা গণতান্ত্রিক চেহারা পায়, এবং এদের বিশেষ স্বার্থগত অবস্থান ও কাজকর্ম আড়াল হয়ে যায়। যদিও, শ্রেণীবিভাজিত সমাজের উঁচু তলার কিছু মানুষের বিশেষ রাজনৈতিক, বাণিজ্যিক ও মতাদর্শিক স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য বৃহত্তর জনগণের মাঝে বার্তা ছড়িয়ে দিতেই এধরনের মিডিয়ার বেশিরভাগ কর্মকান্ড পরিচালিত। তাই এসব মিডিয়ার দর্পণে সবার চেহারা সমানভাবে ফুটে ওঠে না। কারো চেহারা উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়, কারো চেহারা বাঁকাচোড়া দেখায়, আর বৃহদাংশ মানুষের চেহারা এক্কেবারেই দেখা যায় না। তথাপি, সেই অদৃশ্য জনমানুষের সামনে অনুসরণ ও অনুকরণীয় ‘রোল মডেল’ বা ডেমি গড হিসেবে সিনেমা, টিভি, ক্রিকেট, ফুটবল ইত্যাদি ক্ষেত্রে নতুন নতুন তারকাশ্রেণী তৈরি হতে থাকে এই মিডিয়াগুলোতেই। এগুলোকে কর্পোরেট মিডিয়া বলাই শ্রেয়। গত দুই দশকে বাংলাদেশে গণমাধ্যম হিসেবে স্বীকৃত সংবাদপত্র-রেডিও-টেলিভিশনের সবগুলোরই জন্ম হয়েছে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের পেট থেকে, যাদের প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য অধিকতর মুনাফা অর্জন এবং একটা ভোগবাদী জনসমাজ তৈরি।

অবাক হবেন না, মিডিয়ার গায়ে উপসর্গ হিসেবে লেপ্টে থাকা এই ‘ম্যাস’ প্রত্যয়টি এসেছে খৃস্টীয় ধর্মতত্ত থেকেই। ম্যাস শব্দের একটা অর্থ- ঐশ্বরিক সেবা! উইকিপিডিয়াতে সার্চ দিলেই দেখতে পাবেন লেখা আছে- খ্রিস্টানদের জীবনে ম্যাস একেবারে কেন্দ্রীয় ও সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ চর্চা। মূলত, সাধারণ অর্থে, চার্চ থেকে যেসব কাজকর্ম করা হয় তার সবগুলোকেই ম্যাস বলা হয়। যুগে যুগে চার্চের ম্যাস যেমন কতিপয় মানুষের শাসনকে বৈধতা দিয়েছে, রাজামহারাজাদের নিরংকুশ ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে কাজ করেছে, সেরকমই আধুনিক এই যুগে ম্যাস মিডিয়া কতিপয় মানুষের ক্ষমতা ও মুনাফা বৃদ্ধিতেই কাজ করেছে। মিডিয়া অধ্যয়নে এককালের বাইবেল হিসেবে খ্যাত ওয়ান ডাইমেনশনাল ম্যান (১৯৬৭) পুস্তকে হার্বাট মার্কুজে দেখিয়েছেন, মিডিয়া এই কাজ করে মানুষের মনে সম্মোহনী ধারণা (হিপনোটিক ডেফিনিশান) পাকাপোক্ত করার মাধ্যমে। ধর্ম, অধর্ম, ভালো, মন্দ, সাফল্য, প্রেম, বিরহ, শুভ, অশুভ, সন্ত্রাস, সুন্দরী, সুপুরুষ ইত্যাদি সকল ধারণাই আমাদের মনে বদ্ধমূল করে দেয় মিডিয়া- একেবারে ধর্মশাস্ত্রগুলোর মতোই।

ধর্মীয় শাসনের যুগেও মানুষ অর্থসম্পদ উপার্জন ও সঞ্চয় করতো। তবে সে যুগে মানুষই সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায়ে রাখতে পারতো। কিন্তু পুঁজির যুগের বৈশিষ্ট্য হলো, সম্পদই মানুষের জীবন নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে। আর যেহেতু পুঁজি ক্রমবর্ধনশীল- সকল উপায়ে সে কেবল বাড়তেই থাকে। পণ্যের যে সারপ্লাস ভ্যালু পুঁজি হয়ে ওঠে তা আসে বস্তুত শ্রমিকের ঘাম থেকে। তাই কার্ল মার্কস পুঁজিকে বলেন ‘মৃত শ্রম’। পুঁজির শাসন সেহেতু জীবিতের দুনিয়ায় মৃতের শাসন, মানে ভুতের শাসন হয়ে ওঠে। আর এই মরা ভুত যেহেতু ক্রমবর্ধনশীল, সেহেতু শিশুকালের লীলাক্ষেত্র আধুনিক রাষ্ট্রকে পাটাতন হিসেবে ব্যবহার করলেও ক্রমে বড় হতে হতে ভয়ানক অতিকায় দৈত্যের আকার ধারণ করে এবং রাষ্ট্রের সীমানা অতিক্রম করে যায় নিজেরই বিকাশের স্বার্থে। আর এইভাবে সে তরল হয়ে প্লাবিত করতে থাকে সবকিছু- দৌড়াতে থাকে এক স্টকমার্কেট থেকে আরেক স্টকমার্কেটে, এক খাত থেকে আরেক খাতে, এক দেশ থেকে আরেক দেশে। আর, ডিপ স্টেট হয়ে আধুনিক স্টেটের খোলনলচে বদলে দেয়। বিস্ময়কর নয় যে, বর্তমানে হাতে গোনা কয়েকটা বহুজতিক কর্পোরেশনের মোট আয় তৃতীয় বিশ্বের সকল দেশের জাতীয় আয়ের চেয়েও বেশি। আগের দিনে যেহেতু বৃদহাকারের স্থায়ী ও স্থানীয় কলকারখানায় ভর করে এই ভুত বিকশিত হয়েছে, তাই সুশাসন, নির্দিষ্ট পরিচয়ের মানুষ, এবং সংহত রাষ্ট্রের প্রয়োজন হয়েছে। কিন্তু গত শতকের শেষ দুই দশক থেকেই দেখা যাচ্ছে, রাষ্ট্রের আইনকানুন ভাঙতেই পুঁজি বেশি তৎপর। লিবারালাইজেশানের তোড়ে রাষ্ট্রের সংহতি ও সার্বভৌমত্ব খান খান হয়ে যাচ্ছে। পুঁজির স্বার্থেই আইনের শাসন নয়, কার্ল সিমিট বর্ণিত ‘স্টেট অব একসেপশান’ বা বিশেষ পরিস্থিতিই শাসনের ভাষা হয়ে উঠছে- যখন সংবিধান বলবৎ থাকলেও বিশেষ বিশেষ আইন করে তার কার্যকারিতা রদ করে রাখা হয়। অর্থাৎ আইনের মাধ্যমে আইনের শাসন রদ করেই আজকালকার শাসকেরা শাসন করছেন। হিটলার যেমন অসংখ্য শমন জারীর মাধ্যমে আইনের শাসন রদ করে দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছিলেন, এখন তেমনই এক পরিস্থিতি- সন্ত্রাস দমন এবং জননিরাপত্তার নামে নতুন নতুন আইন হচ্ছে দেশে দেশে, আর মানুষের সকল নিরাপত্তা উবে যাচ্ছে, গণতন্ত্র অনির্দিষ্টকালের জন্য নির্বাসনে চলে যাচ্ছে।

পুঁজির অবাধ ও খিপ্র গতির জন্য দরকার হয়েছিল ডিজিটাল ফরম্যাটে সঞ্চরণকারী ইন্টারনেট ও স্যাটেলাইট প্রযুক্তির- যা কেবল বর্তমানের পুঁজিকেই অনুমাননির্ভর (স্পেকুলেটিভ) ও আগ্রাসী করেনি, ব্যক্তিক ও জাতীয় পরিচয়, মিডিয়ার ফর্ম ও ব্যবহারের ধরণ, জাতীয় সীমানা সবকিছুতেই তারল্য ঢেলে বদলে দিতে শুরু করেছে। এ অর্থনীতির কালে পুঁজির বিকাশে আপনি কেবল কারখানায় গিয়েই শ্রম দেন না। আপনার অবসরটুকুও সে হরণ করে। ক্লিক ক্লিক করে যে ওয়েবসাইটগুলোতে আপনি অনায়াসে ঢুকে যাচ্ছেন তারই সুবাদে অন্য কারো প্রফিট বাড়তে থাকছে। যে গুগল মেইল ও সার্চ ইঞ্জিন আপনি ব্যবহার করে এতো এতো কাজ করছেন, যে ফেসবুকে আপনি বন্ধুদের খোঁজখবর নিতে বারবার লগইন করছেন, সমাজের অন্যসকল কিছু থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে জীবনের প্রধান অঙ্গ করে তুলেছেন, তারই সুবাদে কোম্পানিগুলো কেবল বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের ব্যবসাই করে নিচ্ছে না, আপনার ব্যক্তিগত গোপনীয়তাটুকুও বিক্রি করে দিচ্ছে অন্যান্য কোম্পানি ও রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কাছে।

যেহেতু, কর্পোরেট-মিলিটারি-ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্সই প্রধান শাসনকর্তা, আমরা তাই এখন বাস করছি মূলত যুুদ্ধ অর্থনীতির কালে, যার প্রধান শাস্ত্রবচন – জননিরাপত্তা ও ভয়। আর এই জননিরাপত্তা ও ভয়-আতঙ্কের ডিসকোর্সের চাষাবাদ মিডিয়াতেই ঘটে। মিডিয়াও তরল হয়ে ওঠে। নির্দিষ্ট সীমানায় সে আর আটকে থাকতে পারে না, ডিজিটাল ফরম্যাটে আর ইন্টারনেটে ভর করে সকল রকমের মিডিয়া একই প্লাটফর্মে জড়ো হয়, আবার ইন্টারনেটের বিভিন্ন প্লাটফর্ম ব্যবহার করে গড়িয়ে গড়িয়ে বহুরূপে তা আমাদের অন্দরমহলে হাজির হয়। এ সময়ে মিডিয়ার প্রধান কাজ আপনার মনে বিভিন্ন ভয় উৎপাদন ও নিরাপত্তাহীনতার বোধ তৈরি করে মাদক বিরোধী, সন্ত্রাসবিরোধী ইত্যাদি যুদ্ধের চাকা সচল রাখা। কিন্তু আমরা লক্ষ্য করলে অবাক হবো, ইউরোপের যেসব দেশ মাদক সংক্রান্ত আইন রদ করে মাদকবিরোধী যুদ্ধ থামিয়ে দিয়েছে সেসব দেশে মাদকের ব্যবহারও কমে গেছে। একইভাবে দেখা যাবে, মার্কিন দেশে ২০০১ সালে টুইন টাওয়ারে হামলা পরবর্তী সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধমেশিন চালু হবার আগে দেশে দেশে এতো মুসলমান জঙ্গী ছিল না, কেবল এই যুদ্ধ চালু হবার পরেই জঙ্গী উৎপাদন হাজার গুণে বেড়ে গেছে। এখন তো যেকোনো মুসলমানই সম্ভাব্য সন্ত্রাসী হিসেবে গণ্য হয় সকল জনপরিসরে। অন্যদিকে পর্নোতারকা সানি লিওল মেইনস্ট্রিম হয়ে ওঠে। এমনকি সাফল্যের পুরস্কার হিসেবে পর্নোতারকা নারীর সাথে কর্পোরেট এক্সিকিউটিভদের রাত্রিযাপনের সুযোগ দেয়া হয়- আমাদের দেশের মিডিয়াও তা প্রচার করে! জর্জ বুশ ও বিন লাদেন যখন পৃথিবীর মানচিত্র সাজায় তখন আমাদের বুকের ভেতর সানি লিওন এবং পিঠের ওপর বুশ-লাদেনের তান্ডবনৃত্য অবিরাম হয়ে উঠেছে। সন্ত্রাসী ও সন্ত্রাস দমনকারী একই ভাষায় কথা বলছে। সময়টা পর্নোগ্রাফির, সময়টা যুদ্ধ ও সন্ত্রাসের। নিশ্চিতভাবেই মডার্নিটির নীতি-নৈতিকতা এবং র‌্যাশনাল হিউম্যান বিইঙয়ের দিন শেষ। এই সময় মূলত সানি লিওন, জর্জ বুশ এবং বিন লাদেনের। ফলে এই সময়ে এসে সমাজ শাসনের গ্রামারও বদলে গেছে। বিশেষ পরিস্থিতি যুগের জননিরাপত্তা ও ভয়ের ডিসকোর্সের এ এক অশেষ অবদান!

এযুগে ভায়োলেন্স আর পুরাতন জ্ঞানের ‘নাশকতা’ হিসেবে না, নতুন পোলিটিক্যাল ল্যাঙ্গুয়েজ হিসেবে হাজির হয়েছে। এযুগে চেতনার অনুভবের চেয়ে, চেতনার এক্সিবিশান ভ্যালু বেশি মূল্যবান হয়ে উঠেছে। আর এই জোরেই, আফগানিস্তান বা ইরাক থেকে মার্কিনি মিডিয়া যেমন রক্তপাতহীন নিপাট যুদ্ধের খবর পরিবেশন করে, আমাদের মিডিয়াগুলোও সেরকমভাবেই ঢাকা থেকে হেফাজত খেদানোর গল্প পরিবেশন করেছে। আহত বা নিহত কোনো হেফাজত কর্মী/এতিম মাদ্রাসা ছাত্রকে নিয়ে কোনো হিউমান্যাইজড স্টোরি কোনো মিডিয়াতে দেখা যায়নি।


স্টেট অব একসেপশান বা বিশেষ পরিস্থিতির ডাকেই বাংলাদেশে এখন বৈশ্বিক যুদ্ধ অর্থনীতির লক্ষণগুলো ফুটে উঠতে দেখা যাচ্ছে। এদেশ এখন গণতান্ত্রিক নয়, অর্থনৈতিকভাবে মালয়েশিয়া হতে চায়। এই তো সেদিন, ৩০শে এপ্রিল, মার্কিন সিনেটের কংগ্রেস কমিটির সামনে, প্রফেসর আলী রীয়াজ, সাক্ষ্য দিতে শুরু করেছেন এইভাবে: “গত দেড় বছরে বাংলাদেশের রাজনীতি খুবই বিক্ষুব্ধ সময় পার করেছে। এই সময়কাল চিহ্নিত হয়ে আছে দুইবার কয়েক মাসব্যাপী ভীষণ সহিংসতা (২০১৩’র শেষদিক থেকে ২০১৫ প্রথম কয়েকমাস পর্যন্ত), ২০১৫’র শুরুতে অত্যন্ত ক্রটিপূর্ণ জাতীয় নির্বাচন, সরকারের বিপুল বলপ্রয়োগমূলক পদক্ষেপ, এবং ভয়ানক কারচুপিপূর্ণ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের (২৮ এপ্রিল ২০১৫) ঘটনা দিয়ে। এইসব ঘটনা দেশটির রাজনৈতিক গতিপথ, বিশেষত গণতন্ত্রের ভবিষ্যত নিয়ে, গুরুতর জিজ্ঞাসা তৈরি করেছে।” তিনি আরও বলেছেন, “গত তিন বছরে বেশ কিছু অস্বস্থিকর প্রবণতা দেখা দিয়েছে, যা মানুষের জীবন নিরাপত্তাহীন করে তুলেছে এবং দেশটির মানবাধিকার পরিস্থিতির ভীষণ দুর্দশার চিত্র তুলে ধরছে। দুইটা প্রবণতা বিশেষ মনোযোগের দাবিদার: বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং গুমের ঘটনা।” এইসাথে পেট্রলবোমা, মিডিয়ার অধীনতা, গোয়েন্দা নজরদারি ইত্যাদি প্রবণতার উল্লেখ করে রীয়াজ মন্তব্য করেছেন, “সহিংসতা বহুদিন থেকেই বাংলাদেশে রাজনীতির অঙ্গ। কিন্তু, গত দেড় বছরে রাজনৈতিক সহিংসতার প্রকৃতি ও পরিধির গুরুতর অবণতি ঘটেছে। এমনকি দেখা যাচ্ছে, রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতাহীন মানুষজনও আক্রমণের শিকার হচ্ছে।” তিনি তাই দাবি করেছেন, “সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, বিশেষত ২০১৪ সালের শুরু থেকে, এইসব ঘটনা ও প্রবণতা জনসমাবেশ, চলাচল এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতার গণতান্ত্রিক পরিবেশ বিপুলভাবে সঙ্কুচিত করেছে। সহিংসতা এবং ভীতিই মূলত রাজনৈতিক ভাষা হয়ে উঠেছে।”
যদিও, তথ্যমন্ত্রণালয়ের ৫৬১নং তথ্যবিবরণীর বরাত দিয়ে রাইজিংবিডি.কম জানাচ্ছে, দেশে এখন বেসরকারি টেলিভিশনের সংখ্যা ২৬টি; দৈনিক, সাপ্তাহিক ও মাসিক পত্রপত্রিকার সংখ্যা ১২০০’রও বেশি। বেসরকারি এফএম রেডিও ১১টি, এবং অনুমোদিত কমিউনিটি রেডিও ৩২টি, যার মধ্যে ১৪টিতে সম্প্রচার চলছে। এবং তথ্যমন্ত্রণালয় মনে করে, বাংলাদেশের মিডিয়া এখন সর্বোচ্চ স্বাধীনতা ভোগ করছে। সেইসথে, অনলাইন প্লাটফর্ম হিসেবে ওয়েবসাইট, ব্লগ, সোস্যাল মিডিয়া প্লাটফর্ম তো বেশুমার। আর, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) প্রকাশিত সর্বশেষ পরিসংখ্যানে বলা হচ্ছে: চলতি বছরের [২০১৫] মার্চ পর্যন্ত দেশে মুঠোফোনের গ্রাহকের সংখ্যা ১২ কোটি ৩৬ লাখ ৯০ হাজার; এবং, মার্চ পর্যন্ত ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪ কোটি ৪৬ লাখ ২৫ হাজার। অথচ, মিডিয়ার এই ভরভরন্ত যুগেও আইনের শাসন কয়েম করা যায়নি।

তাই বলবো, এযুগে ভায়োলেন্স আর পুরাতন জ্ঞানের ‘নাশকতা’ হিসেবে না, নতুন পোলিটিক্যাল ল্যাঙ্গুয়েজ হিসেবে হাজির হয়েছে। এযুগে চেতনার অনুভবের চেয়ে, চেতনার এক্সিবিশান ভ্যালু বেশি মূল্যবান হয়ে উঠেছে। আর এই জোরেই, আফগানিস্তান বা ইরাক থেকে মার্কিনি মিডিয়া যেমন রক্তপাতহীন নিপাট যুদ্ধের খবর পরিবেশন করে, আমাদের মিডিয়াগুলোও সেরকমভাবেই ঢাকা থেকে হেফাজত খেদানোর গল্প পরিবেশন করেছে। আহত বা নিহত কোনো হেফাজত কর্মী/এতিম মাদ্রাসা ছাত্রকে নিয়ে কোনো হিউমান্যাইজড স্টোরি কোনো মিডিয়াতে দেখা যায়নি। এর কারণ কি এই নয় যে দাড়ি-টুপিসমেত এই মানুষগুলোকে ইতোমধ্যেই বিপুলভাবে ডি-হিউম্যানাইজ করা হয়েছে, হচ্ছে প্রতিদিন; তাদের রক্ত আর মানুষের রক্ত বলে আমরা চিনতে পারিনি। পত্রিকার রিপোর্টগুলো পড়ে কি এরকম মনে হয় না যে একপাল অনাকাক্সিক্ষত জন্তু ঢাকা শহরে ঢুকে আমাদের প্রিয় তিলোত্তমা নগরীর গায়ে নোঙরা নখে আঁচড় কেটে চলেছিল। আর, আমাদের সুশৃঙ্খল বাহিনী তাদেরকে খেদিয়ে নগর দুয়ারের বাইরে ছুঁড়ে দিয়ে শহরটিকে আবর্জনামুক্ত করেছে। আমাদের জীবনে স্বস্তি ফিরে এসেছে। গণজাগরণ মঞ্চের বেলায় এরকম ঘটনা ঘটলেও কি আমরা একইরকম স্বস্তি বোধ করতাম? ইন্টারেস্টিংলি, মিডিয়ার এই হেফাজত পরিবেশনা আমাদের কাছে অস্বাভাবিক ঠেকেনি। মনে হয়েছে, এরকম করেই তো তাদের বিদায় এবং শায়েস্তা করা দরকার। এইরূপ ‘মনে হওয়া’ কিন্তু স্বাভাবিক ছিল না। যেকোনো মৃত্যুই মৃত্যু। কিন্তু বহু বছর ধরে সেকুলার মিডিয়া, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক চর্চা আমাদের মনকে এমনভাবে দীক্ষিত করেছে যে তাদের মৃত্যু আমাদের মনে একটুও আঁচড় কাটেনি। এই মৃত্যুগুলো নিয়ে আমরা আনন্দিতই হয়েছি। আর যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লা ও কামরুজ্জামানের ফাঁসির ঘটনা তো জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছিল। ফাঁসি কার্যকরের সময়ও এমনভাবে নির্ধারিত ছিল যে টেলিভিশনগুলো ‘প্রাইমটাইম’ নিউজে তা ধরাতে পেরেছিল। কাজকর্ম শেষে সন্ধ্যার অবকাশে সপরিবারে মিডিয়ার সার্বক্ষণিক সরাসরি সম্প্রচারে আমরা সে উৎসবে অংশগ্রহণেরও সুযোগ পেয়েছিলাম। অথচ, ‘আমাদের’ মৃত্যু নিয়ে মিডিয়ায় কাভারেজের পরিমাণ ও গুণগত মান ছিল একেবারেই ভিন্নতর।

এই সময়ে কয়েকজন লেখক-ব্লগার খুন হয়েছেন- এক্সট্রিমিস্টদের হাতে বলেই সবার অনুমান। এই মৃত্যু কয়টি নিয়ে মিডিয়া কাভারেজের পরিমাণ ও দৃষ্ঠিকোণের সাথে তুলনা করলেই আমার বক্তব্য বুঝা যাবে। মিডিয়া কাভারেজের পরিমান ও দৃষ্ঠিকোণের এরকম পার্থক্য দিয়েই আফগানিস্তানে, ইরাকে, সিরিয়ায়, মিশরে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের বিস্তার হয়েছিল- পৃথিবীময় যুদ্ধের পক্ষে জনমত গড়ে উঠেছিল। টুইন টাওয়ারে ৩,০০০ মৃত্যুর আগে, মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় ইরাকে ৫ লাখ শিশু মারা গিয়েছিল- সেই শিশুদের নিয়ে আন্তর্জাতিক মিডিয়া কোনো রিপোর্টই করেনি, আমাদের দেশের মিডিয়াও না, কেউ কথাও বলেনি। অথচ, টুইন টাওয়ারের মৃতদের নিয়ে এতো কথা বলা হয়েছে, যা আর কখনো বলা হয়নি, হয়তো হবেও না। সেহেতু, কোনো কোনো মৃত্যু আমাদের কাছে মুল্যবান, আর বেশিরভাগ মৃত্যু ভীষণ মূল্যহীন। মুল্যবান মৃত্যুগুলো নিয়ে আমরা হরদম অসংখ্য কথা বলি। কিন্তু, যে মৃত্যুগুলোকে আমরা মূল্যহীন ভেবে রিপোর্ট করিনি, কথা বলিনি, যাদের মূল্যহীন জীবনকে আরও মূল্যহীন করে তুলেছি কথা না বলে- সেগুলো নিয়ে কথা বললে হয়তো আমাদের মূল্যবান মৃত্যুগুলোর মুখোমুখি হতে হতো না! কিন্তু বিশেষ পরিস্থিতির যুগে তা কতোটুকু সম্ভব! পুরনো দিনের আইনের শাসনটুকু চাইতেও আজ ভয়। বিপুলভাবে ভয় মহারাজের সেবা দিয়েও তো দেখি মিডিয়ার স্বাধীনতা হুমকিগ্রস্ত হয়ে থাকে বিশেষ পরিস্থিতির যুগে- রিপোটার্স উইদাউট বর্ডার প্রকাশিত ২০১৪ সালের ইনডেক্স অনুযায়ী, প্রেসের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৬! তবু, মিডিয়ার ফাঁকফোঁকর খুঁজে আমাদের কথা বলেই যেতে হবে- নইলে ভয়ের শাসন গলা চেপে ধরবে।

১ আলী রীয়াজ, (2015) Congressional Testimony

BANGLADESH’S FRACTURE: POLITICAL AND RELIGIOUS EXTREMISM. http://docs.house.gov/meetings/FA/FA05/20150430/103406/HHRG-114-FA05-Wstate-RiazA-20150430.pdf

২ রাইজিংবিডি.কম, ২৬ ফেব্রুয়ারী ২০১৫। http://www.risingbd.com/printnews.php?nssl=95118

৩ প্রথম আলো ২৭ এপ্রিল, ২০১৫। http://www.prothom-alo.com/economy/article/513403/মার্চে-মুঠোফোন-গ্রাহক-বেড়েছে-১০-লাখ

Advertisements