হাকালুকি হাওরে - হাকালুকি হাওরে পরিযায়ী পাখির আগমন কমেছে - সত্য ও নিরপেক্ষ সংবাদ
Advertisements

শীত মৌসুম এলেই পরিযায়ী পাখির কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে ওঠে মৌলভীবাজারের হাকালুকি হাওর এলাকা। তবে কয়েক বছর ধরেই এখানে পরিযায়ী পাখির আগমন কমছে। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন), প্রকৃতি ও জীবন এবং বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের এক যৌথ শুমারিতে দেখা গেছে, এবার হাওরটিতে পরিযায়ী পাখি এসেছে আগের মৌসুমের তুলনায় প্রায় অর্ধেক। বাংলাদেশ বন বিভাগ এ সমীক্ষায় সহযোগিতা করেছে।

দুই দিনব্যাপী ওই শুমারিতে পর্যবেক্ষণ চালিয়ে ২৪ হাজার ৫৫১টি পরিযায়ী পাখির উপস্থিতি শনাক্ত করতে পেরেছেন গবেষকরা। এর আগে ২০২০ সালের শুমারিতে দেখা মিলেছিল ৪০ হাজার ১২৬টি পরিযায়ী পাখির। কমেছে আগত পাখির প্রজাতির সংখ্যাও। গত বছরের শুমারিতে ৫৩ প্রজাতির পাখির দেখা মিললেও এবার দেখা মিলেছে ৪৬ প্রজাতির। হাকালুকি হাওরের ৪৩টি বিলে এবারের পাখিশুমারি করা হয়েছে। গত বছর করা হয়েছিল ৪০টি বিলে। এর আগে ২০১৯ সালে হাকালুকিতে ৫১ প্রজাতির ৩৭ হাজার ৯৩১টি পাখির দেখা মিলেছিল। ২০১৭ সালের শুমারিতে শনাক্ত হয়েছিল ৫৮ হাজার ২৮১টি পরিযায়ী পাখি।

বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি পাখি বিশেষজ্ঞ ড. ইনাম আল হকের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত শুমারিতে অংশ নেন বার্ড ক্লাবের সহসভাপতি তারেক অণু, আইইউসিএনের মুখ্য গবেষক সীমান্ত দিপুসহ নয়জন গবেষক। দুই দলে ভাগ হয়ে তারা পাখি গণনা করেন।

শুমারি দলের সদস্য ও আইইউসিএনের মুখ্য গবেষক সীমান্ত দিপু জানান, যেভাবে পাখি কমেছে তার পেছনে অনেক কারণ আছে। এর জন্য চোরা শিকার যেমন দায়ী, তেমনি দায়ী পরিবেশের কথা চিন্তা না করে বাছবিচারহীন মৎস্য আহরণও। এছাড়া হাওর শুকিয়ে যাওয়াও এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছে।

তার মতে, হাওরে পরিযায়ী পাখির আগমন ধরে রাখতে সবার আগে প্রয়োজন চোরা শিকার বন্ধ করা। তিনি বলেন, চোরা শিকার বন্ধ করা না গেলে একদিন এখানে পাখি আসবে না। যেসব বিলে বিষটোপ দিয়ে পাখি শিকার হয়, সেসব বিলে এবার পাখিরা খুব কম এসেছে। স্থানীয় মানুষকে সচেতন হয়ে পাখি শিকার বন্ধ ও তাদের আবাসের দিকে খেয়াল রাখতে হবে। পাখি কমে গেলে মাছও কমে যাবে। যে হাওরে পাখি থাকে না, প্রাকৃতিক নিয়মেই সেখানে মাছও হবে না।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পাখি শিকার, পরিবেশ-প্রতিবেশগত সংকট, হাওরের খাল-বিল ভরাটের ফলে অন্যান্য জীববৈচিত্র্য যেমন টিকতে পারছে না, তেমনি খাদ্য সংকটে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে পরিযায়ী পাখিরাও। উদ্বিগ্ন পরিবেশবাদীরা বলছেন, এখনই ব্যবস্থা না নিলে হুমকিতে পড়বে এখানকার জীববৈচিত্র্য।

গবেষকদের ভাষ্যমতে, বাংলাদেশে জলজ উদ্ভিদ প্রজাতির অর্ধেকেরও বেশি হাকালুকি হাওরে জন্মে। সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রায় দুই লাখ মানুষ জীবন ও জীবিকার জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এ হাওরের ওপর নির্ভরশীল। হাওরে ১৫০ প্রজাতির মিঠা পানির মাছের মধ্যে বর্তমানে ১১২ প্রজাতি টিকে আছে। ৫২৬ প্রজাতির উদ্ভিদের মধ্যে ১২০ প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ ও সরীসৃপ এখন বিলুপ্তপ্রায়। এখানে প্রতি বছর শীতকালে প্রায় ২০০ বিরল প্রজাতির পরিযায়ী পাখি আসত। সে সংখ্যাটা কমতে কমতে এবার নেমে এসেছে প্রায় এক-পঞ্চমাংশে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) মৌলভীবাজারের সভাপতি আ স ম সালেহ সোহেল বলেন, পাখির আবাসস্থল ধ্বংস, ক্রমাগত পাখি শিকার, হাওর-বিলে মানুষের অত্যধিক চাপ বাড়ার কারণে পাখিরা এখান থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। প্রতি বছর শিকারিদের হাতে কী পরিমাণ পরিযায়ী পাখি মারা যায়, সে তথ্যও কারো কাছে নেই। অবৈধভাবে পাখি বিক্রি ও শিকারের ফলে একদিকে পরিবেশ ভারসাম্য হারাচ্ছে, অন্যদিকে ঝুঁকি বাড়ছে জনস্বাস্থ্যে। আগে শীতের শুরুতেই হাওরগুলো পরিযায়ী পাখির কলকাকলিতে মুখর হয়ে উঠত। কিন্তু এখন শীতের শেষদিকে পাখিরা আসে আবার খুব কম সময় তারা এখানে থাকে। কারণ খাবার না পেয়ে দ্রুত আবার চলে যায়। অন্যদিকে শুমারিতে যা-ই আসুক পাখির সংখ্যা কিন্তু দিনদিন কমছে। এটাই সত্য ও বাস্তবতা।

এদিকে নানা উদ্যোগ নেয়া সত্ত্বেও হাওরাঞ্চলে পরিযায়ী পাখি শিকার বন্ধ করা যাচ্ছে না। স্থানীয়রা জানায়, হাওরাঞ্চলে পাখি শিকার সাধারণ ঘটনা। শুধু পরিযায়ী নয়, শিকারিদের হাতে মারা পড়ছে স্থানীয় প্রজাতির পাখিরাও। বিষটোপ, শিকারের জাল ছাড়াও চোরা শিকারিরা নানা কৌশলে এসব পাখি শিকার করে থাকে। অনেক সময় তাদের কেউ কেউ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আটক হলেও বেরিয়ে এসে তারা আবারো ফিরে যায় পাখি শিকারে। এসব পাখির মাংস যায় বিভিন্ন হোটেলসহ বিত্তশালীদের ঘরে। পাশাপাশি জেলার বিভিন্ন বাজারেও মাঝেমধ্যেই প্রকাশ্যে বিক্রি হয় ফাঁদে আটকা পড়া পরিযায়ী পাখি।

অনুসন্ধানে জানা যায়, হাওরে পাখি শিকার সবচেয়ে বেশি হয় রাতের বেলায়। এর সঙ্গে স্থানীয়দের একাংশ জড়িত। পাখি শিকারকে তারা মৌসুমি ব্যবসা হিসেবে নিয়েছে। স্থানীয় মৎস্যজীবীদের কেউ কেউ রাতের আঁধারে মাছ ধরার সঙ্গে সঙ্গে পাখি শিকারও করছে। রাতে পাখি শিকার করে ভোরে তারা বস্তা বা মাছের ঝুড়িতে করে শিকারকৃত পাখি পৌঁছে দিচ্ছে ক্রেতার কাছে। অনেক সময় ক্রেতারাই হাওরপাড় থেকে এসব শিকারকৃত পাখি সংগ্রহ করে নিয়ে যায়।

চোরা শিকারিদের বিষটোপের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন স্থানীয় হাঁস-মুরগির খামারিরাও। গত ১৯ ফেব্রুয়ারি বড়লেখা উপজেলার তালিমপুর ইউনিয়নে হাকালুকি হাওরের পোয়ালা বিলে পাখি শিকারিদের দেয়া বিষটোপে এক খামারির ২৫০ হাঁসের মৃত্যু হয়েছে। আগেও এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে।

সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ) রেজাউল করিম চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, পাখি শিকারের ব্যাপারে আমরা সচেতন আছি। শিকারের তথ্য পেলেই অভিযান পরিচালনা করছি।

সূত্রঃ বণিক বার্তা

Advertisements