ভালো কাজের ফাঁদে ফেলেই - ভালো কাজের ফাঁদে ফেলেই শয়তান সৎকর্মশীল ব্যক্তিদের বিপথে চালিত করতে চেষ্টা করে - সত্য ও নিরপেক্ষ সংবাদ
Advertisements

শয়তান বেশিরভাগ মুসলিমকে বলে না, “যাও, গিয়ে ভাঙচুর করো, প্রতিবেশীর বাসায় চুরি করো, অমুককে খুন করো।” তিন মাস থেকে বাসায় বসে আছি লকডাউনে। একবারও আমার এগুলো করার কথা মনে হয়নি। কারণ, শয়তান বেশিরভাগ সময় মুসলিমকে এইসব বুদ্ধি দেয় না। সে বেশিরভাগ মুসলিমকে কী কুবুদ্ধি দেয়, সেটা আমাদের বোঝা দরকার। না হলে আমরা তার আসল মিশন কী, তা ধরতে পারবো না। তখন বোকার মতো তার ফাঁদে পা দিয়ে শেষ হয়ে যাবো।

একজন মুসলিম যখন কোনও ভালো কাজ করার উদ্যোগ নেয়, শয়তান তখন তাকে এর থেকেও ভালো কাজের কথা মনে করিয়ে দেয়। যেমন, কেউ চিন্তা করছে সাদাকা দেওয়ার। শয়তান তাকে মনে করিয়ে দেবে, “শ্রেষ্ঠ মানুষ তারাই যারা ইসলাম শিক্ষা দেয়। তোমার উচিত ফিকহ, হাদিস, তাফসির এইসব পড়াশুনা করা এবং শিক্ষা দেওয়া।” —এভাবে সে তাকে সাদাকা থেকে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে এমন সব পথে নিয়ে যায়, যে পথে সাদাকার সমান কিছু আর অর্জন হয় না, বা অনেক সময় কিছুই অর্জন হয় না।

[সাদাকা এত বড় ব্যাপার যে, আল্লাহ ﷻ কুরআনে বহু সূরাহ’য়, বিশেষ করে সূরাহ বাকারাহ’য় পর-পর বিশটা আয়াতে বহুভাবে উদাহরণ দিয়ে, যুক্তি দিয়ে মুসলিমদেরকে বুঝিয়েছেন সাদাকা করলে কী বিরাট প্রতিদান পাওয়া যায়। এটা তিনি ﷻ নামাজ, রোজা, যাকাতের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতের বেলাতেও করেননি। তিনি ﷻ সেই আয়াতগুলোতে আমাদের দেখিয়েছেন যে, সাদাকা করে কীভাবে মানুষ সহজেই জান্নাত কিনে নিতে পারে; কীভাবে মানুষ তার বিরাট গুনাহর বোঝা নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে; কীভাবে সে এমন একটা কাজ করতে পারে, যার পুরস্কার হবে সীমাহীন। কিন্তু না। যেই না সাদাকা করার চিন্তা মাথায় আসে, শয়তান এসে সাথে সাথে আরেকটা আপাতদৃষ্টিতে বড় ইবাদত করার চিন্তা মাথায় ঢুকিয়ে দেয়।]

অনেক সময় কেউ যখন ভালো কাজ করে, শয়তান এসে তাকে বলে, তুমি অনেক ভালো। খুব অল্প মানুষই তোমার মতো এত ভালো কাজ করে। তুমি না থাকলে কী যে হতো। —এভাবে সে অন্তরে একধরনের সূক্ষ্ম অহংকার তৈরি করে। আর যেই মুসলিমের অন্তরে একবার অহংকার ঢুকে যায়, সে শেষ। তার ভালো কাজগুলো অহংকার প্রদর্শনের কারণে কিয়ামতের দিন সব ধুলা হয়ে হারিয়ে যায়।

অনেক সময় কেউ যখন একটা ভালো কাজ করে, শয়তান এসে তাকে বলে, নাহ, মানুষ তোমার ভালো কাজের ঠিকমতো কদর দিচ্ছে না। তোমার উচিত এই ভালো কাজগুলোকে জোরেশোরে প্রচার করা। —এভাবে সে অন্তরে একধরনের সূক্ষ্ম লোক-দেখানো উদ্দেশ্য ঢুকিয়ে দেয়। শুধুমাত্র আল্লাহকে খুশি করার জন্য তখন আর ভালো কাজটা করা হয় না। যার ফলাফল হয়— সেই ভালো কাজের জন্য আল্লাহর কাছ থেকে আর কোনও পুরস্কার পাওয়া হয় না। দুনিয়াতে তার সময়, সম্পদ, মেধা নষ্ট হয়। আখিরাতে গিয়ে ফলাফল শুন্য।

রমাদানে শয়তানের বিশেষ কিছু কৌশল আছে। যেমন, কেউ এক পারা করে কুরআন পড়ছে, আর তারপর সেই পারার অর্থ বুঝে নিচ্ছে। শয়তান এসে বলবে, “এভাবে তো বেশি পারা পড়া হচ্ছে না! অর্থ বুঝে সময় নষ্ট না করে বরং শুধুই তিলাওয়াত চালিয়ে যাও। তাহলে আরও বেশি পারা কুরআন পড়া হবে।” —কুরআন মানুষকে দেওয়ার আসল যে উদ্দেশ্য—কুরআন বোঝা এবং তা জীবনে বাস্তবায়ন করা—সেটা থেকে সে মানুষকে দূরে নিয়ে যাবে। ফলাফল হবে, কুরআন পড়েও সে আল্লাহ ﷻ তাকে কী বলেছেন, তার কিছুই বুঝবে না। ইসলাম সম্পর্কে তার ন্যূনতম মৌলিক জ্ঞান হবে না। আখিরাতে গিয়ে চরম অপমান।

একজন মুসলিম যখন নামাজ পড়তে দাঁড়ায়, তখন শয়তান এসে তাকে মনে করিয়ে দেয় অমুক কাজ, তমুক ফেইসবুক পোস্ট, অমুক খবর, তমুক রান্নার চিন্তা ইত্যাদি। মানুষ তখন নামাজে মনোযোগ না দিয়ে দুনিয়ার সব হাবিজাবি চিন্তায় ডুবে যায়। নামাজ হয়ে যায় যোগব্যায়াম। কুরআনে আল্লাহ কঠিনভাবে বলেছেন যে, নামাজে একাগ্রতার সাথে দাঁড়াতে। কিন্তু শয়তানের ফাঁদে পড়ে নামাজ হয়ে যায় অর্থহীন উঠবস। কুরআনে কোথাও বলা নেই যে, যারা নামাজ পড়বে তারা সফল হবে। বরং বলা হয়েছে, যারা একাগ্রতা এবং আল্লাহর ভয় নিয়ে নামাজ পড়বে, তারাই সফল হবে।

মানুষ সফল তখনি হয়, যখন সে একাগ্রতার সাথে কোনও একটা কাজ সম্পূর্ণভাবে করে। তাই শয়তান চেষ্টা করে মানুষের একাগ্রতাকে নষ্ট করে দিতে। তাকে এক কাজ থেকে আরেক কাজে, এক দিক থেকে আরেক দিকে নিয়ে যেতে। যেমন, একজন মুসলিম যখন অর্থ বুঝে কুরআন পুরোটা পড়ে শেষ করার জন্য একাগ্রতার সাথে চেষ্টা করতে থাকে, তখন কয়েকদিন যেতে না যেতেই কেউ এসে বুদ্ধি দেয় যে, তার উচিত আরবিতে কুরআন পড়া, কারণ আরবিতে কুরআন না পড়লে আসলে কুরআন ঠিকভাবে বোঝা হয় না। ব্যাস, সে তখন কুরআন অর্থ পড়া বাদ দিয়ে শুরু করে আরবি শেখা। তারপর কয়েকদিন যেতে না যেতেই তাকে কেউ বুদ্ধি দেয় যে, তার কুরআন তিলাওয়াত শুদ্ধ হচ্ছে না এবং তার উচিত আগে তাজউইদ ঠিক করা। তখন সে আরবি শেখা বাদ দিয়ে তাজউইদ শিখতে লেগে যায়। —এভাবে সে এক জিনিস শেখার মাঝখান থেকে আরেক জিনিস শিখতে লেগে যায় এবং শেষ পর্যন্ত গিয়ে কোনও কিছুই ঠিকভাবে শেখা হয় না।

শয়তান অনেক সময় মুসলিমদেরকে এমন সব লক্ষ্য অর্জনের ফাঁদে ফেলে দেয়, যা তাকে উলটো ইসলামের পথ থেকে হারিয়ে ফেলে। যেমন, কেউ একজন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ঠিকমতো পড়ার জন্য চেষ্টা করছে। তখন শয়তান এসে তাকে এক আবেগঘন ঘটনা শোনাবে যে, অমুক বিখ্যাত ইমাম রাতভর জেগে তাহাজ্জুদ পড়তেন। আহা কী মধুর তাহাজ্জুদের স্বাদ। —তখন সেই বিখ্যাত ইমামের ঘটনায় অনুপ্রাণিত হয়ে তার মতো হওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে রাত জেগে সে তাহাজ্জুদ পড়বে, কিন্তু ওদিকে প্রায়ই আর ফজরের সময় উঠতে পারবে না। বেশি রাত জেগে দিনের বেলা ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত থাকবে। একসময় তার জীবনে ক্লান্তি, একঘেয়েমি এসে ভর করবে। ফরজ কাজগুলো সে তখন ছেড়ে দিতে থাকবে। —এভাবে অবাস্তব লক্ষ্য অর্জনের ফাঁদে ফেলে শয়তান সফল হবে উলটো তাকে পাপের সাগরে ডুবিয়ে দিতে।

(ঝাঁঝালো জযবাধারি অপরিপক্ব মানসিকতার মুসলিমরা ধেয়ে আসবেন যে, এখানে তাহাজ্জুদের নামাজকে ছোট করা হয়েছে। নিজের সন্মান বজায় রাখুন, দূরে থাকুন।)

সুতরাং মনে রাখবেন, শয়তান শুধু আমাদেরকে পাপ কাজের বুদ্ধি দেয় না। সে অনেক সময় আরও বেশি ভালো কাজেরও বুদ্ধি দেয়। যেই ভালো কাজ করার চেষ্টা করতে গিয়ে আপনি হারিয়ে যাবেন। এখন যেই ভালো কাজটা একাগ্রতার সাথে করছিলেন, সেটা করা বন্ধ করে দেবেন। তাই কোন ভালো কাজটা করবেন, সেটার গুরুত্ব আসলেই কতখানি —তা ভালো করে যাচাই করুন। তারপর সেই কাজে একাগ্রতার সাথে লেগে থাকুন। যথেষ্ট অর্জন না হওয়া পর্যন্ত অন্য যত কাজের বুদ্ধি নিজের মনে উদয় হচ্ছে এবং অন্যের কাছ থেকে আসছে, তার কিছুই পাত্তা দেবেন না। অনেক বড় ঝুঁকি আছে যে, সেগুলো সব শয়তানের চেষ্টা আপনাকে লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করার।

[শায়খ আকরাম নদয়ির লেকচার থেকে নিয়ে বাঙালিদের জন্য প্রাসঙ্গিক করতে কিছু উদাহরণ পরিবর্তন করে লেখা]

Advertisements