উপনিবেশিক থেকে বিউপনিবেশিক ও গঠনবাদী পর্যায়ে উত্তরণের উদ্বোধন
Advertisements

১. বাংলা অঞ্চলে এবং বাংলা ভাষায় ইসলামের দার্শনিক প্রকাশ তেমন একটা হয়নি। আরবি ভাষায় ইসলামের আকর গ্রন্থগুলির বাংলা ভাষান্তর এবং প্রথানুগ ভাষ্যরচনা এখানে নেম অফ দ্য গেম। এক্ষেত্রেও যে খুব মৌলিক, মেধাবী ও নান্দনিক কাজ হয়েছে তা বলা যাবে না। কিন্তু ইসলামের প্রত্যয় ও ধারণাগুলির যুক্তিবুদ্ধিগত বিন্যাসের ক্ষেত্রে অপ্রতুলতা এবং দুর্বলতা নিঃসন্দেহে বেশি লক্ষ্যণীয়। এই ক্ষেত্রে আরবি ও ফারসি ভাষায় পারসিক জগতে যে উৎকর্ষ দেখা গেছে তা আরব বিশ্বেও অতটা দেখা যায় নি। ইমাম গাজালী কর্তৃক আফলাতুনী ও আরিস্তু ফালসাফার সুনির্দিষ্ট সমালোচনার পরে ইরানে ইবনে সিনার ফালসাফা, শিহাবউদ্দীন সুহরাওয়ার্দী ও মীর দামাদের ইশরাকী এবং ইবনে আরাবীর মারেফাতী চিন্তাকান্ডের সংশ্লেষ করে এক সমৃদ্ধ হিকমাতের উদ্ভব ঘটান মোল্লা সদরা।

ইউরোপের কন্টিনেন্টাল ফিলোসফিতে কান্ট বুদ্ধিবাদী ও অভিজ্ঞতাবাদী ধারার সংশ্লেষে যে অভিনব জর্মান ভাবাদর্শের সূত্রপাত করেছিলেন অনেকটা তেমনি মোল্লা সদরা ইরানী ও পারসিক বলয়ে এই হিকমাতে আলীয়ার প্রবর্তন করেন। এর অভিঘাত সাফাভিদ শিরাজ ও ইসফাহান থেকে মুঘল হিন্দুস্তানের অযোধ্যা ও লখনৌ হয়ে বাংলায় এসে পৌঁছেছিল। ফিরিঙ্গী মহলের দারসে নিযামীতে এই বিদ্যাকান্ডের চর্চা ও বিস্তার হয়েছিল। কিন্তু ইরান সরাসরি উপনিবেশিক শাসন পরিহার করতে পারলেও হিন্দুস্তান ও বাংলা তা পারে নি। ফলে এখানে উপনিবেশিক অভিজ্ঞতা যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিপর্যয় ডেকে আনে তা হিকমাতী চর্চায় ছেদ নিয়ে আসে। পরাভূত মুসলিম বিদ্বজ্জনেরা রক্ষণশীল হীনমন্যতায় ডুবে যায়। যুক্তিবুদ্ধি ভিত্তিক হিকমাতের চর্চা পরিত্যাগ করে কয়েকটি আকর কিতাবের পাঠ মুখস্থ করা ও পূর্বনির্ধারিত সীমার মধ্যে তার ভাষ্য রচনা ও পুনর্পাঠের মধ্যেই ঘুরপাক খেতে থাকে তারা।

এর থেকে উত্তরণের প্রারম্ভে আধুনিকতাবাদীরা পাশ্চাত্য জ্ঞানকান্ডকে অনেক সময় আনক্রিটিকালি আবাহন করেছেন। আবার অক্ষরবাদী ডগম্যাটিস্টরা পাশ্চাত্য জ্ঞানকান্ডকে পুরোপুরি ডিনাই করতে চেয়েছেন। কেউ কেউ হয়তো এই দুই পজিশনের মাঝে দুই প্রান্তের কোন একটির কাছে বা দূরে অবস্থান নিয়েছেন। যেমন, মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ বিশ শতকে একটি আধুনিকতাবাদী ইসলামভাষ্য রচনা করেছিলেন। আহলে হাদীস অনুসারী হিশেবে তিনি ইসলামের ঐতিহ্যের শুদ্ধতা নিয়ে কনসার্ন ছিলেন ঠিকই; কিন্তু উপনিবেশ সূত্রে আগত আধুনিকতার সঙ্গে লিপ্ত হতে কুণ্ঠিত ছিলেন না। বিস্মিত হতে হয় যে, তার এই ভাষ্যরীতি আজ এদেশে তেমন কোনো প্রভাব বিস্তার করে না। রাজনীতিতে তার মুসলিম জাতীয়তাবাদ পাকিস্তান-উত্তর বাংলাদেশে আজ আর অনুসৃত হয় না; অথবা তা পরিবর্তিত রূপে চর্চিত হচ্ছে। অন্যদিকে তার ইসলাম ভাষ্যরীতি আজ বাংলাদেশের মাদরাসা, সেক্যুলার একাডেমিয়া কিংবা ইসলামতন্ত্রী রাজনৈতিক দলের কোনোটিতেই সেভাবে অনুসৃত হয় না।
ইসলামতন্ত্রী চিন্তক, লেখক ও অনুবাদক মওলানা মুহাম্মাদ আবদুর রহীম রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন বলে তার রচনাবলী অন্তত একটি দলীয় পরিসীমায় হলেও পঠিত হচ্ছে। তবে তিনি একপর্যায়ে তার দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় তার প্রচার ও প্রসারে কিছুটা হলেও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। অবশ্য তার পরবর্তী সমগ্রবাদী রাজনীতিবিদ ও লেখক গোলাম আজম, বুদ্ধিবৃত্তিক সংগঠক শাহ আবদুল হান্নান, সাংবাদিক আবুল আসাদ এবং ইতিহাসবিদ মোহাম্মদ আবদুল মান্নানের রচনাবলী অন্তত দলীয় পরিসরে হলেও যথেষ্ট পঠিত হয়ে আসছে।

আর একাডেমিয়াতে অবস্থান করে মুরশীদ-মুরীদ সূফি চর্চাকে দার্শনিক ও তাত্ত্বিক স্তরে উন্নীত করেছিলেন মুঈনুদ্দীন আহমদ খান। ইসলামের ইতিহাসের একাডেমিক গবেষণার পাশাপাশি তার এই ইরফান বা তাজকিয়া ও তাজরিবিয়া চর্চার মাধ্যমে তিনি এদেশে একটি স্বকীয় আখলাকি ইলমের প্যারাডাইম তৈরি করেছিলেন। তিনি পশ্চিমা বস্তুবাদী ও প্রাণবিনাশী আধুনিকতা, কেন্দ্রীভূত ক্ষমতাদর্পী রাজনীতি, পুঞ্জীভূত পুঁজি ইত্যাদির সমালোচক ছিলেন। আবার তার লেখালেখি ও জীবনচর্যা থেকে এটিও বোঝা যায় যে, তিনি সমগ্রবাদী “ইসলামী রাষ্ট্র” প্রকল্পেরও সমালোচক ছিলেন। কারণ কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা ব্যক্তির নৈতিক ও আখলাকি আত্মশুদ্ধির প্রতিবন্ধক—যাকে তিনি তার ভাষায় ব্যক্তির “বিবেকী” বিকাশের অন্তরায় বলে বিবেচনা করেছেন। মুঈনুদ্দীন আহমদ খানের নৈতিক ও বিবেকী ইসলামভাষ্য মাদরাসা, একাডেমিয়া ও পার্টি এই তিন কাঠামোর কোনোটিতেই প্রাতিষ্ঠানিকভাবে চর্চিত না হবার ফলে তার প্রচার ও প্রসার সীমিত হয়ে পড়েছে।

২. আমরা এই সুযোগে বাংলা ভাষায় ইসলাম প্রশ্নের মোকাবিলার বিভিন্ন কক্ষপথগুলিকে একটু বিস্তারিতভাবে এখানে জেনে নিতে পারি। বিংশ শতাব্দীতে যে কয়েকজন বাঙালি মুসলিম দর্শন চর্চার সূচনা করেছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন—মোহম্মদ বরকতুল্লাহ, আবুল হাশিম এবং দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ। তিনজনের বর্ণাঢ্য জীবন ও কর্ম তিন রকমের। বরকতুল্লাহ ছিলেন পেশায় প্রধানত একজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা। আবুল হাশিম ছিলেন মূলত একজন রাজনীতিবিদ। আর দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ ছিলেন একজন আজীবন শিক্ষাবিদ। কিন্তু পেশাগত জীবনের এই বৈচিত্র্য সত্ত্বেও এরা তিনজনই দর্শন ও ধর্মতত্ত্ব চর্চা করেছেন।

বরকতুল্লাহ মেজাজের দিক থেকে ছিলেন উদারনৈতিক ও আধুনিক। আবুল হাশিম ছিলেন আধুনিক এবং কিছুটা সাম্যবাদ-ঘেঁষা। আর দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ শুরু করেছিলেন আধুনিক-অজ্ঞেয়বাদী হয়ে; মাঝপথে বাম দিকেও কিছুটা ঝুঁকেছিলেন; কিন্তু শেষ পর্যন্ত থিতু হয়েছিলেন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দর্শন এবং ইসলামের এক অনবদ্য সমন্বয়ক হিশেবে।

প্রত্যেকের দর্শনে এবং বিশেষ করে জ্ঞানতত্ত্বে নিজস্বতা থাকলেও এদের প্রত্যেকেই ছিলেন কমবেশি অতীন্দ্রিয় স্বজ্ঞাবাদী। বুদ্ধিবাদ, অভিজ্ঞতাবাদ এবং বিচারবাদকে এরা সবাই যার যার মত করে সমীহ করলেও প্রত্যেকেই মনে করতেন যে সুনিশ্চিত সত্য অর্জন করা সম্ভব একমাত্র স্বজ্ঞার মাধ্যমেই। এটি কিন্তু এদের তিনজনের মাঝে একটি আশ্চর্য মিল এবং ঐক্য। যা অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক এবং উৎসাহজনক।
এই কারণে এরা তিনজনই দিনশেষে ইসলামের প্রত্যাদেশভিত্তিক ঐশী সত্যকে দার্শনিকভাবে উপলব্ধি করে তা মনেপ্রাণে মেনে নিয়েছেন। তা নিজেদের জীবনে যেমন চর্চা করেছেন, অন্যদেরকেও অনুশীলন করতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। এটি তারা সবাই করেছেন মূলত তাদের লেখালেখি ও বিভিন্ন কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে।

উপমহাদেশের আরেকটু আগের পর্বের কবি ও দার্শনিক ইকবালের চিন্তা ও সৃজনশীলতার সাপেক্ষে যদি উপরে উল্লেখিত তিনজনকে দেখতে চাই, তাহলে বলা যাবে যে বরকতুল্লাহ, হাশিম এবং আজরফ—এরা তিনজনই ইকবালের চিন্তাকেন্দ্র থেকে কমবেশি লিবারেল-বাম দিকে ঝুঁকেছিলেন। যদিও ইকবালের খুদি ও বেখুদি দর্শন এবং মুসলিম স্বাতন্ত্র্যচেতনার সঙ্গে এদের তিনজনেরই একটা অল্পবিস্তর নাড়ির বন্ধন টের পাওয়া যায়।

বাঙালি মুসলমান ইতিপূর্বে উনিশ শতকের সত্তর দশক থেকে একধরনের আধুনিক রেনেসাঁ বা নবজাগরণের ছোঁয়া পেয়েছিল। কিন্তু সেটা ছিল মূলত কলকাতা ভিত্তিক। এর ভাষা, আঙ্গিক ও প্রকরণে কলকাতার বাঙালি হিন্দু রেনেসাঁর প্রভূত প্রভাব ছিল। এছাড়া এই আংশিক ও সীমিত রেনেসাঁয় পূর্ব বাংলা বা ঢাকার অংশগ্রহণ প্রায় ছিল না বললেই চলে। এরপরে অবশ্য ১৯২৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ কর্তৃক “বুদ্ধির মুক্তি” নামক একটি আন্দোলন হয়েছিল। একে অন্নদাশঙ্কর রায় বাংলার দ্বিতীয় রেনেসাঁ বলে চিহ্নিত করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, আবুল হুসেন, কাজী মোতাহার হোসেন এবং অন্যান্যদের মধ্যে কাজী আবদুল ওদুদ, আবুল ফজল ও মোতাহের হোসেন চৌধুরী এতে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ‘শিখা’ পত্রিকা ছিল এদের মুখপত্র।

অন্যদিকে বাঙালি মুসলিম এই তিন দার্শনিকের পরবর্তী প্রজন্ম থেকে দুটি বিপরীতমুখী ধারার উৎপত্তি হয়েছিল বলা যায়। পরবর্তী প্রজন্মের প্রথম ধারাটি ছিল কলকাতায় গড়ে ওঠা ‘পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটি’ এবং ঢাকায় গড়ে ওঠা ‘পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ’-কে আবর্তন করে। দুটিই গড়ে উঠেছিল চল্লিশের দশকে আজাদী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ইকবালের চিন্তার অনুপ্রেরণায়। প্রজন্মের এই ধারায় যোগ দিয়েছিলেন আবুল কালাম শামসুদ্দীন, মুজিবুর রহমান খাঁ, আবুল মনসুর আহমদ, হাবিবউল্লাহ বাহার, আবদুর রাজ্জাক, ফররুখ আহমদ, সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন, সৈয়দ আলী আহসান, সৈয়দ আলী আশরাফ, শাহেদ আলী প্রমুখ। পরবর্তীকালে কাজী দীন মুহম্মদ ও হাসান জামানও এদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন।

কিন্তু রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে মতভেদ দেখা দেয় চল্লিশ দশকের শেষে। বিশেষ করে পঞ্চাশ দশকের সূচনায়। এর ফলে উত্তরপ্রজন্মের দ্বিতীয় ধারাটি গড়ে ওঠে। যারা বাঙালি মুসলমানের ইসলামকেন্দ্রিক বুদ্ধিবৃত্তি ও জ্ঞানকান্ডকে ক্রমশ ইউরোকেন্দ্রিক এবং ইন্দোকেন্দ্রিক করে তোলে। এই উত্তরপ্রজন্মের শুরুতে আমরা দেখতে পাই আবদুল হক, আবদুর রাজ্জাক, শওকত ওসমান, মুনীর চৌধুরী, আহমদ শরীফ, সরদার ফজলুল করিম, আবদুল গাফফার চৌধুরী, হাসান হাফিজুর রহমান, শামসুর রাহমান, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, বদরুদ্দীন উমর, আনিসুজ্জামান, মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান শেলী, সৈয়দ শামসুল হক, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী প্রমুখ। একাত্তর উত্তর কালে এই ধারাটিতে আরো যুক্ত হন আহমদ ছফা, সৈয়দ আবুল মকসুদ, হুমায়ুন আজাদ, ফরহাদ মজহার, হুমায়ূন আহমেদ, আকবর আলী খান, গোলাম মুরশিদ, আফসান চৌধুরী, তসলিমা নাসরীন, মুহম্মদ জাফর ইকবাল, সলিমুল্লাহ খান প্রমুখ।

আবার অন্যদিকে আশি দশক ও বিশেষ করে নব্বই দশক থেকে ইসলামকেন্দ্রিক জ্ঞানকান্ডের একটি পুনরাবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। একাত্তর পরবর্তী কালে নিস্তেজিত এই ধারাটিতে আবার জোয়ার নিয়ে এসেছেন কয়েকজন মেধাবী প্রবীণ ও নবীন মনীষা। যেমন এবনে গোলাম সামাদ, মুঈনুদ্দীন আহমদ খান, আবদুল করিম, মুহাম্মদ মোহর আলী, আল মাহমুদ, মাহমুদুর রহমান, মোহাম্মদ আবদুল মান্নান, ফাহমিদ-উর-রহমান প্রমুখ।

এই ধারাটিতে মওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদীর চিন্তা ও আন্দোলনের অনুসারী হিশেবে আরেকটি প্রশাখা এসে যুক্ত হয়েছে। এই প্রশাখাটির জ্ঞানতাত্ত্বিক বিনির্মাণে বিপুল অবদান রেখেছেন মওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীম, গোলাম আজম, শাহ আবদুল হান্নান, আবুল আসাদ, মোহাম্মদ আবদুল মান্নান প্রমুখ। ইকবালের দর্শন ও সাহিত্যের সাপেক্ষে যদি এই প্রশাখাটিকে দেখা হয় তাহলে এটা বলা যায় যে এটি ইকবালের অবস্থান থেকে আরো কিছুটা ডানমুখী। আর সে কারণে এই প্রশাখাটির সঙ্গেই ইউরোকেন্দ্রিক এবং ইন্দোকেন্দ্রিক ধারাটির সম্মুখ সংঘর্ষ বা হেড-অন-কলিশন সংঘটিত হচ্ছে।

অন্যদিকে ক্রমবর্ধিষ্ণূ-ঐতিহ্যবাদী উলামারা এদেশে মূলত এক অরাজনৈতিক/বিরাজনৈতিক, সম্প্রদায়ভিত্তিক ও সামাজিক ইসলামের চর্চা করে আসছেন। মক্তব, মাদরাসা ও মসজিদভিত্তিক এই কওমি ধারাটি বিভিন্ন পারিবারিক ও সামাজিক ধর্মীয় আচারের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে জনপরিসরে ভূমিকা পালন করে থাকে। ওয়াজ মাহফিলের মাধ্যমেও একধরনের ওরাল ধর্মীয় গণশিক্ষা ও দীক্ষা কার্যক্রমে এদের ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। তবে এদের মধ্যেও ইদানীং একধরনের অগোছালো দলীয় রাজনৈতিক কর্মকান্ডের প্রবণতা লক্ষণীয়। যা তাদেরকে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা সংস্থাগুলির নিবিড় নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণের টার্গেটে পরিণত করছে।

তবে উলামাদের এই পরিমন্ডলেও একটি ইলমী অবদানের স্রোত ফল্গুধারার মত প্রবহমান। তাদের পূর্বসূরী যেমন কেরামত আলী জৌনপুরী, মুহাম্মদ আকরম খাঁ, মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, শামসুল হক ফরিদপুরী, মুফতী মুহাম্মদ ফয়জুল্লাহ, আমীমুল ইহসান প্রমুখের প্রদর্শিত পথ অনুসরণ করে সমসাময়িক কালে কাজী মুতাসিম বিল্লাহ, মুহীউদ্দীন খান, আবদুছ ছালাম চাটগামী, আবু সাঈদ মুহাম্মাদ ওমর আলী, ফরীদ উদ্দীন মাসউদ, আবদুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদী, আবুল ফাতাহ মুহাম্মদ ইয়াহইয়া, আবু তাহের মিসবাহ, ইসহাক ফরিদী, খন্দকার আবদুল্লাহ জাহাঙ্গীর, উবায়দুর রহমান খান নদভী, মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন, আবদুল মালেক, শরীফ মুহাম্মদ, মুহিব খান, মুসা আল হাফিজ প্রমুখ (এটি একটি প্রাথমিক তালিকা যা আপাতত দেয়া হয়েছে; পরে আরো সুনির্বাচিত তালিকা দেয়া হবে) এক গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞানগত ও সাহিত্যিক ভূমিকা রেখে যাচ্ছেন।

৩. আধুনিক, উপনিবেশিক, সেক্যুলার লিবারেল, জাতিবাদী এবং কমিউনিস্ট অভিঘাতের মোকাবিলায় ইসলামের দার্শনিক অভিব্যক্তি ক্রমাগত ব্যাকফুটে গিয়ে বিউপনিবেশিক ঐতিহ্যবাদী, বিরাজনৈতিক এবং সংস্কারবাদী, অক্ষরবাদী ও সমগ্রবাদী রাজনৈতিক ভাষ্যের নানাবিধ রূপে প্রকাশিত হচ্ছে। আশ্চর্যের ব্যাপার হল এই যে, এই পরস্পর বিচ্ছিন্ন ও অলিপ্ত অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য উলামা কিংবা ইসলামিস্টরা কিন্তু এগিয়ে আসতে সক্ষম হন নি। বরঞ্চ এর থেকে উদ্ধারে যারা সক্রিয় হয়েছেন তারা সেক্যুলার লিবারেল কিংবা কমিউনিস্ট ঘরানায় বিলং করেছেন। যেমন, বিশ শতকের বিশের দশকে ঢাকায় ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজে’র ব্যানারে এগিয়ে এসেছিলেন কাজী আবদুল ওদুদ। তিনি ইসলামের তুরাস থেকে মু’তাজিলা চিন্তা পদ্ধতিকে আশ্রয় করে বাংলা ভাষায় ইসলামের একটা যুক্তিবুদ্ধিভিত্তিক দার্শনিক ভাষ্য রচনা করেছিলেন। কিন্তু তার এই নবব্যাখ্যায় অনেক বেশি রামমোহন রায়ের ব্রাহ্ম একেশ্বরবাদের ছাপ ছিল; এবং এর ধারাবাহিকতায় রাবীন্দ্রিক শান্তিনিকেতনী প্রভাব স্পষ্ট হবার ফলে ওদুদের এই ভাষ্য গ্রহণযোগ্য হয় নি। এছাড়া তিনি ছিলেন আধুনিক কট্টর সেক্যুলার তুরস্কের কামালবাদের একজন অতিউৎসাহী গ্রাহক—যা এই বাংলায় গ্রহণযোগ্যতা পায় নি। অন্যদিকে কাজী নজরুল ইসলাম এই প্রবণতাটিকে এত ন্যায্যতা ও ভারসাম্যের সঙ্গে ধারণ করেছিলেন যে তিনি ইসলামিকতা, বিউপনিবেশিকতা এবং অসাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদি প্রত্যয় ও বর্গের এক দারুণ সুষমা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। যা তাকে আজকের বিভাজিত বাংলার সীমান্তের দুই পারেই গ্রহণযোগ্য করে তুলেছে।

আধুনিক বাংলা মুসলমানি ভাষা ও সাহিত্যের প্রধান প্রবক্তা, ভাষ্যকার ও প্রমোটার হিশেবে যিনি সক্রিয় হয়ে উঠেছিলেন তিনি হলেন আবুল মনসুর আহমদ। তিনি লিখেছেন: “বাঙালি মুসলমানের সাহিত্যের প্রাণ হবে মুসলমানের প্রাণ এবং সে সাহিত্যের ভাষাও হবে মুসলমানের মুখের ভাষা। … আজকার তথাকথিত জাতীয় সাহিত্যে বাংলার মেজরিটি মুসলমানের জবানই যে শুধু বাদ পড়েছে, তা নয়, তার মুখের ভাষাও সে সাহিত্যে অপাংক্তেয় হয়েছে। মুসলমানের আল্লা-খোদা, রোজা-নামাজ, হজ্জ-জাকাত, এবাদত-বন্দেগি, ওজু-গোসল, খানা-পানি সমস্তই বাংলা সাহিত্যের দিকপাল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তাদের কাছে বিদেশী ভাষা। এ জুলুমবাজীর মধ্যে কোনো জাতির সাহিত্য গড়ে উঠতে পারে না।” [সরদার ফজলুল করিম (সম্পাদনা), পাকিস্তান আন্দোলন ও মুসলিম সাহিত্য।]

আবুল হাশিম অন্যদিকে মওলানা আজাদ সুবহানীর রব্বানী দর্শনের অনুসারী ছিলেন। রব্বানী দর্শন থেকে আবুল হাশিমের চিন্তার বিচ্যুতি ঘটেনি। মওলানা আজাদ সুবহানীর পরামর্শে তিনি রাজনীতি করতেন। রাজনৈতিক নেতা হিসাবে তিনি সমাদৃত ছিলেন। রাজনীতি করতে গিয়েই তিনি দর্শন চর্চার প্রয়োজন অনুভব করেন। মওলানা ভাসানী ইসলাম ভাষ্যের দিক থেকে আবুল হাশিমের নিকটবর্তী ছিলেন; কারণ তিনিও আজাদ সুবহানীর অনুসারী ছিলেন। কিন্তু রাজনীতির পদ্ধতিগত দিক দিয়ে এদের দুজনের মধ্যে ভিন্নতাও ছিল। মওলানা ভাসানী হুকুমাতে রব্বানিয়া কিংবা রবুবিয়াত প্রতিষ্ঠাকল্পে গণঅভ্যুত্থানের গণরাজনীতি সক্রিয়ভাবে অনুশীলন করতেন; অন্যদিকে আবুল হাশিম ছিলেন প্রধানত তাত্ত্বিক, প্রথম জীবনে সক্রিয় রাজনীতি করলেও শেষ জীবনে তিনি খুব বেশি সক্রিয় ছিলেন না।

দর্শনের মৌলিক বিষয় জ্ঞানতত্ত্ব, অধিবিদ্যা এবং মূল্যবিদ্যায় আবুল হাশিমের তাৎপর্যপূর্ণ অবদান আছে। তিনি মনে করতেন বুদ্ধি অথবা অভিজ্ঞতার সাহায্যে পূর্ণ জ্ঞান অর্জন করা যায় না। বিশুদ্ধ জ্ঞানের জন্য তিনি স্বজ্ঞাবাদের আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। জ্ঞানের প্রাথমিক উৎস হিসাবে আবুল হাশিম অভিজ্ঞতাকে স্বীকার করতেন। কিন্তু চূড়ান্ত পর্যায়ে তিনি ইন্দ্রিয় সংবেদনমূলক জ্ঞানকে বর্জন করতেন। তিনি বুদ্ধি এবং স্বজ্ঞার সংমিশ্রণ করেছেন। স্বজ্ঞাকে বুদ্ধির উপর স্থান দিয়েছেন। আবুল হাশিমের জ্ঞানতত্ত্বের সঙ্গে ইমাম গাজালির জ্ঞানতত্ত্বের মিল পাওয়া যায়। গাজালির মতে, অতীন্দ্রিয় সত্তার জ্ঞান হচ্ছে উচ্চস্তরের জ্ঞান। আবুল হাশিমও অতীন্দ্রিয় সত্তার জ্ঞানকে উচ্চস্তরের মর্যাদা দিতেন। তিনি কুরআনের জ্ঞানকে সর্বোচ্চ জ্ঞান বলে জানতেন এবং মানতেন। তবে মানুষের ইচ্ছাশক্তির গুরুত্ব তিনি অস্বীকার করেছেন।

স্বজ্ঞাকে আশ্রয় করে আবুল হাশিম বিশ্বাসে উপনীত হতে চাইতেন। ইসলাম ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্যই তিনি স্বজ্ঞার উপর গুরুত্ব আরোপ করতেন। অধিবিদ্যার বিষয়গুলো নিয়ে তার বিশ্লেষণে দেখা যায় যে তিনি যুক্তি দিয়ে বিশ্বাস প্রতিষ্ঠা করতে চাইতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, আল্লাহ মহাবিশ্বের স্রষ্টা। মানুষ আল্লাহর প্রতিনিধি। মানুষ আল্লাহর কাছ থেকে আসে এবং মৃত্যুর পর পরিশেষে আল্লাহর কাছেই ফিরে যায়।

আবুল হাশিমের রাজনীতির উদ্দেশ্য ছিল অধিক সংখ্যক মানুষের সুখ। কিন্তু তার কাছে গণতন্ত্র পছন্দনীয় ছিল না। গণতন্ত্রকে তিনি নাসিকা গণনার পদ্ধতি বলে মনে করতেন। আবুল হাশিম পুঁজিবাদের পর্যালোচনা করেছেন। কিন্তু আবুল হাশিম যে বৃহৎ বঙ্গের স্বপ্ন দেখেছিলেন তা পুঁজিবাদকে অস্বীকার করে নি। পুঁজিবাদ এবং সমাজতন্ত্রের পর্যালোচনা করে আবুল হাশিম ইসলামি রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে উৎকৃষ্ট বলে ঘোষণা করেছিলেন। তিনি ইসলামি রাষ্ট্রে আল্লাহর মালিকানার ভিত্তিতে কালিমার জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। সার্বভৌমত্ব বলতে তিনি আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে বুঝিয়েছেন। আবুল হাশিম মর্মত ইসলাম ধর্মের অনুসারী ছিলেন। ইসলামের চার খলিফা নির্বাচনের পদ্ধতিকে তিনি নেতা নির্বাচনের সঠিক পদ্ধতি বলে বিবেচনা করতেন।

আবুল হাশিমের দর্শন পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, তা ছিল অংশত ভবিষ্যৎমুখী এবং অংশত অতীতমুখী। তিনি পাকিস্তান রাষ্ট্রের একটি ইসলামকেন্দ্রিক দার্শনিক ভিত্তি তৈরি করতে চেয়েছিলেন। তার এই দার্শনিক চেষ্টা বাস্তবতার মুখ দেখে নি। কারণ পাকিস্তান ছিল বাঙালি মুসলমানের কাছে জমিদারি থেকে মুক্তির লক্ষ্যে তৈরি একটি রাষ্ট্র। এছাড়া ইসলামকে ঘিরে যে স্বপ্ন ও আবেগ ছিল তা তাদের কাছে স্থায়ী হয়নি। ফলে পাকিস্তান রাষ্ট্রও টেকেনি। কিন্তু আবুল হাশিমের দর্শন ছিল বিশ্বাসে সমর্পিত। ধর্ম তার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ধর্মকে তিনি যুক্তি দিয়ে বিচার বিশ্লেষণের সাহায্যে প্রতিপন্ন করতে চেয়েছেন। আবুল হাশিমের জ্ঞানতত্ত্ব, অধিবিদ্যা এবং মূল্যবিদ্যা আলোচনা করলে দেখা যায় যে, তিনি এক ধর্মাশ্রিত চিন্তা-চেতনার প্রবক্তা। অতএব আবুল হাশিমকে একজন ধর্মকেন্দ্রিক ভাববাদী দার্শনিক বলা যায়। ধর্মবিশ্বাস থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে তিনি কোন স্বাধীন মত প্রতিষ্ঠা করতে চান নি। প্রচলিত ধর্মবিশ্বাসকে যুক্তির সাহায্যে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে তিনি ইসলাম ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপাদন করতে চেয়েছেন।

৪. আজাদী উত্তর পাকিস্তানে বাহান্নোর ভাষা আন্দোলন পরবর্তীকালে ঢাকায় যে বাঙালি জাতিবাদ গড়ে ওঠে তার অনুষঙ্গ হিশেবে এক আধুনিক সেক্যুলার লিবারেল ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক এঙ্গেল থেকে ইসলাম ভাষ্য রচিত হয়েছিল এক ঝাঁক বুদ্ধিজীবীর কলমে। এদের মধ্যে আছেন আবদুল হক, আহমদ শরীফ, সরদার ফজলুল করিম, বদরুদ্দীন উমর, আনিসুজ্জামান, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, হুমায়ূন আজাদ প্রমুখ। এরা যে লিবারেল সেক্যুলার এবং কমিউনিস্ট পরিভাষায় ইসলামের ভাষ্য রচনা করেছেন তা অনেক ক্ষেত্রেই স্থূল ও সূক্ষ্ম ইসলামোফোবিয়া উৎপাদন করেছে। ফলে এই পর্যায়েও ইসলামের হিকমাতী ঐতিহ্য অনুসৃত না হয়ে কঠোরভাবে লংঘিত হয়েছে। তাই এই পর্যায়ে এসেও ইসলামের দার্শনিক পরিভাষার অভিব্যক্তি ও বিকাশ হতে পারে নি।

একাত্তরের পূর্বাপর ষাট ও সত্তর দশক ছিল বাঙালি জাতিবাদী ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক বয়ানের রমরমা কাল। সিনিয়রদের মধ্যে আবুল ফজল, আবদুল হক, সুফিয়া কামাল, আহমদ শরীফ, সরদার ফজলুল করিম, বদরুদ্দীন উমর, নীলিমা ইব্রাহীম, আনিসুজ্জামান, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী প্রমুখেরা প্রবল প্রতাপের সঙ্গে এই যুগচরিত্র নির্মাণে অবদান রেখেছেন। আর জুনিয়র আরেকটি প্রজন্মে আমরা দেখেছি হুমায়ুন আজাদ, মুনতাসীর মামুন, শাহরিয়ার কবির, গোলাম মুরশীদ, আফসান চৌধুরী, তসলিমা নাসরীন ও আরো অনেক মুখের অভিষেক। এদের অনেকের ক্রিয়াকলাপে একধরনের উগ্র বাঙালি জাতিবাদ, আধুনিকতাবাদ এবং ইসলামোফোবিয়া পরিস্ফুট হয়েছে।

রাজনৈতিকভাবে মধ্যসত্তুরে একটা বাকশালী বিপর্যয়ে নিপতিত হলে বাঙালি জাতিবাদের পাশাপাশি একটা বাংলাদেশী জাতিবাদের অভ্যূদয় হয়। আবুল মনসুর আহমদ, সৈয়দ আলী আহসান, খন্দকার আবদুল হামিদ, এবনে গোলাম সামাদ, মওদূদ আহমদ, এমাজউদ্দীন আহমদ, তালুকদার মনিরুজ্জামান, মাহবুবউল্লাহ, আবদুল হাই সিকদার, ফাহমিদ-উর-রহমান প্রমুখেরা এই পূর্ব বাংলার ভৌগোলিক সীমানাভিত্তিক বাংলাদেশ রাষ্ট্রকেন্দ্রিক জাতিবাদের এক নতুন সংজ্ঞায় উপনীত হন। মুক্তিযোদ্ধা সেনানায়ক ও রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এই নতুন বাংলাদেশি জাতিবাদের প্রতীক পুরুষ হয়ে ওঠেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নির্মম হত্যাকান্ড একটি শোকগাঁথায় পরিণত হয়ে বাঙালি জাতিবাদের মধ্যসত্তুরের বিপর্যয়কে অতিক্রম করে পুনরায় একটা হাজার বছরের অপূর্ণ সোনার বাংলার স্বপ্ন আকারে জাতীয় মনস্তত্ত্বে আবেদনময়ী ভূমিকা পালন করতে থাকে। ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ নামক এই পুনরুজ্জীবিত মতাদর্শিক বয়ানের উপরে ভিত্তি করেই একবিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকে প্রতিবেশী আঞ্চলিক শক্তির সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে একটি পূর্ণাঙ্গ ফ্যাসিবাদ এদেশে কায়েম হয়েছে। এই একচেটিয়া সাংস্কৃতিক রাজনীতির ক্রিটিক হিশেবে কোনো বয়ান এখনো সমাজে জনগৃহীত হতে পারে নি।

আহমদ ছফার লেখালেখি ও কর্মকান্ডে বাঙালি জাতিবাদের একটি জাতীয় সমাজতান্ত্রিক এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক ও ভারসাম্যপূর্ণ রূপ ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তিনি এভাবে “মুক্তিযুদ্ধের চেতনা” নামক চতু:স্তম্ভের একটি ন্যায়ানুগ রূপ সংশ্লেষের চেষ্টা করেছেন। যা ইসলামের প্রতি একধরনের শ্রদ্ধাপূর্ণ সহনশীলতা ও সহাবস্থান গ্রহণ করেছিল। বাঙালি জাতিবাদের এই সদর্থক ও সংবেদনশীল ভাষ্য তাকে তরুণ সেক্যুলার মহলে ব্যাপক আদরণীয় করে তুলেছে। সলিমুল্লাহ খান বর্তমানে এই রাজ্জাক-ছফা ধারাটির বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

অন্যদিকে নব্বই দশকের শুরুতে সোভিয়েত পতন উত্তর বিপর্যস্ত মার্কসবাদের স্থূল বস্তুবাদ এবং ব্যক্তিবিরোধীতা থেকে উত্তরণের চেষ্টায় তরুণ মার্কসের পুনর্পাঠকে সামনে নিয়ে এলেন কবি ও ভাবুক ফরহাদ মজহার। ফকির লালন সাঁইয়ের দেহাত্মবাদের সংযোগে তিনি মার্কসের ব্যবহারিক সম্বন্ধের দর্শন দিয়ে এই প্রচলিত ও প্রথাগত মার্কসবাদের অতিবস্তুবাদ ও ব্যক্তিহীনতার একটা সম্পূরণ করতে চাইলেন। এছাড়া জর্মান প্রাতিভাসিক দর্শনের বিশ শতকীয় রূপকার হাইডেগারের সূত্রে তিনি মার্কসের দর্শন ও চর্চার একটি প্রথম পুরুষের চৈতন্যে প্রতিফলিত পাঠের নিরীক্ষায় নিযুক্ত হলেন। এভাবে ইউরোপের মহাদেশীয় দর্শনের বস্তুবাদ ও ভাববাদের বাইনারি বিরোধ ও বিযুক্তি অপনোদিত হল এবং লালনের দেহাত্মবাদের সূত্রে বাংলার ভাবান্দোলনের সঙ্গেও তা সম্পৃক্ত হল।

বিশ শতকের শেষ এবং একুশ শতকের সূচনায় এভাবে ফরহাদ মজহার মার্কসের প্রাক্সিস ও হাইডেগারিয়ান ফেনোমেনোলজির সহযোগে বাংলার ভাবান্দোলনের একটি সমৃদ্ধ, বহুস্তর ও ন্যায়ানুগ নবপ্রাণ দিতে চেয়েছেন। অগ্রসর দার্শনিক প্রকল্প হিশেবে যা যথেষ্ট শক্তিশালী ও আবেদক। প্রাণ ও প্রকৃতির হেফাজতে সক্রিয় এক রাজনৈতিক রুহানিয়াতের প্রস্তাব তিনি উত্থাপন করেছেন। যেখানে এসে লালন, মার্কস, ভাসানী, হাইডেগার, ফুকো প্রমুখের এক চিন্তাসুষমা রচনা করেছেন তিনি।

আন্দ্রেয়াস ক্যালিভাসের গাঠনিক ক্ষমতা প্রত্যয় বা বর্গের অনুপ্রেরণা নিয়ে ফরহাদ মজহার একটি বহু ঐতিহ্যিক গণরাজনৈতিক ধারা গঠন করতে চান। এই লক্ষ্যে গণঅভ্যুত্থান গড়ে তুলে গণসার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করে গঠনতন্ত্র পরিষদ আহ্বান করতে চান। সেখানে উকিল মুন্সীর উপনিবেশিক সংবিধান বাতিল করে নতুনভাবে গঠনতন্ত্র পরিগঠন করতে চান। এইভাবে একটা রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী ও পরিসর গড়ে তুলতে চান। এসবের মাধ্যমে বাংলা ভাষায় ইসলাম প্রশ্নের জাতিবাদী পর্যায় অতিক্রম করে একটা গঠনবাদী পর্যায়ের উদ্বোধন তিনি ঘোষণা করেছেন। এটা একটা গুণগত উত্তরণের নির্দেশনা দিচ্ছে, নিঃসন্দেহে।

এই বিভিন্ন ইউরোপীয় দর্শন এবং বঙ্গীয় ভাবের সংশ্লেষণ করতে গিয়ে তিনি এই অঞ্চলের আরেকটি প্রধান জ্ঞানকান্ডিক উৎস ইসলামের সঙ্গেও দার্শনিকভাবে প্রলিপ্ত হতে চেয়েছেন। বাংলা ভাষায় ইসলামের অভিপ্রকাশ করতে উদ্যত হয়েছেন। বাংলার ভাবান্দোলনের শীর্ষবিকাশ হিশেবে ফকির লালন সাঁইকে ফরহাদ মজহার অনুসরণ করেছেন। লালন নকশবন্দী-চিশতী সূফি তরিকা দ্বৈতবাদী হবার কারণে তা গ্রহণ করেন নি। এই সূত্রে এক অর্থে ইসলামের দার্শনিক বলয় থেকে লালন প্রস্থান করেছেন বলা যায়। অর্থাৎ লালনের ভাব ইসলামের সূফিভাষ্যের একটি বিশেষ তরিকার সঙ্গে দার্শনিকভাবে প্রলিপ্ত হয়েছে ঠিকই, কিন্তু এর বেশি কিছু নয়; অর্থাৎ লালন তার দেহকেন্দ্রিক অদ্বৈত ভাবের উৎকর্ষের জায়গায় কোনো ছাড় দেননি। এই কারণে লালনকে বাংলার ভাবের অনুশীলক হিশেবে পাঠ করাই সঙ্গত হবে; ইসলামের দার্শনিক জায়গা থেকে লালনকে পাঠ করলে প্রতিসরণ ও প্রস্থান দৃশ্যমান হওয়াটাই স্বাভাবিক বলে মনে হবে।

৫. ইসলামের দার্শনিক অভিপ্রকাশে মনোনিবেশ করা দরকার। কিন্তু এটা করতে গিয়ে ইসলামের জ্ঞানকান্ডিক পরিসর থেকে প্রস্থান করার কোনো জরুরত নাই। আরবি, ফারসি ও উর্দু ভাষায় ইসলামের জ্ঞানকান্ডিক বৃহৎ পরিমন্ডলে বিচরণ করেই অনেকে এই লক্ষ্য পূরণে নিযুক্ত আছেন। আমরা জানি হিন্দুস্তান ও বাংলাও মুঘল আমলে ফারসি ভাষা ভিত্তিক জ্ঞানচর্চার হিস্যাদার ছিল। তাই ফারসি ভাষায় বিধৃত মারেফাতী, ইশরাকী ও হিকমাতী তুরাস থেকে আমরা চাইলেই আমাদের চিন্তাকান্ডের রস আহরণ করতে পারি। মূল ভাষা ও বাংলায় অনুবাদ—এই দুই সূত্রেই আমরা এই কাজ করতে পারি। এসবের প্রত্যাদেশনির্ভর, বর্ণনামূলক কিংবা আখ্যানমূলক আদেশ-নিষেধের বয়ান থেকে প্রতার্কিক ও জ্ঞানতাত্ত্বিক বয়ানে উত্তরণ খুবই সম্ভব। একটি ক্রস-কালচারাল, বহুশাস্ত্রীয়, দার্শনিক ও মনোবৈজ্ঞানিক প্রতর্ক আকারে চিন্তার বিন্যাস করা অসম্ভব নয়। এই প্রক্রিয়ায় প্রতিবেশী বিভিন্ন ভাষা ও ঐতিহ্যের ধ্রুপদী ও লোকায়ত জ্ঞানকান্ডের সঙ্গে প্রলিপ্ত হতে দ্বিধাগ্রস্ত হবার কোনো সুযোগ নেই।

তাই কখনোই আমাদের চিন্তার শিকড় উল্লেখিত মারেফা, ইশরাক ও হিকমা থেকে অন্য কোথাও প্রস্থান না করেও এর লক্ষ্য পূরণ করতে পারে। সূফি ও হিকমার বিপুল ঐতিহ্য ও ঐশ্বর্যে এই বয়ানের পূর্বসূত্র খুঁজে পাওয়া খুবই সম্ভব। এর উপরে দাড়িয়েই পশ্চিম ও পূর্বের নানাবিধ জ্ঞানকান্ডিক বিকলন ও আধিপত্যের পর্যালোচনা করা যায়। একটা নীতি-নৈতিক ও রুহানি সামাজিকতা ও রাজনৈতিকতার পরিসর প্রস্তাব করা যায়। তুলনামূলক, বহুত্বধারক ও বহুস্বরীয় উপস্থাপনার মাধ্যমে এইসব তর্কপ্রস্তাবকে শক্তিমান ও গ্রহণযোগ্য করে তোলা যায়। আর এসব করতে গিয়ে কোনোরকম পরিচয়বাদী এবং জাতিবাদী অহংবোধ ও অভিমানকে প্রশ্রয় দেয়ারও কোনো আবশ্যকতা নেই। ফলে স্থূল অর্থে বাঙালি বনাম মুসলমান/বাংলাদেশী/বাঙালি মুসলমান, বাঙালি বনাম আরব/ইরান/তুরান, আরব বনাম ইরান/তুরান, বাংলা বনাম হিন্দুস্তান কিংবা মুসলিম বনাম খ্রিস্টান/ইহুদী অথবা মুসলিম বনাম হিন্দু এবং/বা বৌদ্ধ ইত্যাদি দ্বৈত বিরোধ এইসব চিন্তা ও ক্রিয়ায় অনিবার্য নয়।

Advertisements