সম্প্রতি ভারত বাংলাদেশে পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করার পর, হঠাৎ করে দেশে পেঁয়াজের দাম কয়েকগুণ বেড়ে যায়। বাংলাদেশে বাৎসরিক পেঁয়াজের চাহিদার ৪০ শতাংশ আমদানি করতে হয়, যার ৯৫ শতাংশ আসে ভারত থেকে।
সেজন্যই ভারত রপ্তানি বন্ধ করলে বাংলাদেশের বাজারে দাম বাড়ে।
একই ঘটনা ঘটে চিনি, গম, ভুট্টা, মসুর ডাল কিংবা মসলা যেসব দেশ থেকে আসে, তারা রপ্তানি বন্ধ করলেও।
যদিও, বাংলাদেশে বছরের খাদ্যশস্য ও মসলার যে চাহিদা তার প্রায় সবই দেশে উৎপাদন হয়। কিন্তু এর বাইরে একটি বড় অংশের খাদ্যশস্য ও অন্যান্য পণ্য আমদানি করে বাংলাদেশ।
এর মধ্যে চাল, গম, ভুট্টা, পেঁয়াজ, মসুর ডাল, ছোলা, সয়াবিন তেল, চিনিসহ নানারকম নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্য রয়েছে।
আমদানিতে শীর্ষে দেশসমূহ
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে চার লাখ ৩৮ হাজার কোটি টাকার বেশি পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ।
আমদানি পণ্যের মধ্যে এক পঞ্চমাংশ নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রী।
এর মধ্যে সর্বোচ্চ আমদানি হয় চীন থেকে, মোট আমদানির ২৬ শতাংশের বেশি। তালিকায় এরপরেই রয়েছে ভারত, যে দেশটি থেকে মোট আমদানির প্রায় ১৫ শতাংশ আমদানি হয়।
এরপর ক্রমে সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, মালয়েশিয়া, ব্রাজিল, দক্ষিণ কোরিয়া এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত রয়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী জুলাই মাসে যে খাদ্য সামগ্রী আমদানি করা হয়েছে, তার শীর্ষ দশটি পণ্যের মধ্যে রয়েছে যথাক্রমে অপরিশোধিত চিনি, পাম তেল, সয়াবিন তেল, দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য, আদা, মরিচ, গম, চাল, মসুর ডাল এবং পেঁয়াজ।
এছাড়া রসুন, চা, তেলবীজ এবং হলুদ রয়েছে শীর্ষ খাদ্য সামগ্রী আমদানির মধ্যে রয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ২০১৮-১৯ অর্থবছরের হিসাব অনুযায়ী, ভোজ্য তেল আমদানি হয়েছে ১৪ হাজার ৪৩২ কোটি টাকার, গম ৯ হাজার ৬৪২ কোটি টাকার, চাল এক হাজার ৪৪ কোটি টাকার, তেলবীজ ৫ হাজার ৪৯২ কোটি টাকার, চিনি ৫ হাজার ৪৩২ কোটি টাকার, এবং তিন হাজার ৪৫৭ কোটি টাকার ডাল জাতীয় খাদ্যশস্য আমদানি হয়েছে।
বাংলাদেশে এছাড়াও ভুট্টা, শুকনো সবজি, আপেল ও সিট্রাসজাতীয় ফল এবং জাফরান ও হলুদসহ বিভিন্ন মসলা আমদানি করা হয়।
কোন্ দেশ থেকে কী আসে?
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ টিসিবি’র আওতায় নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মধ্যে চিনি, সয়াবিন তেল, পেঁয়াজ, মসুর ডাল, ছোলা, খেজুরসহ বেশ কিছু পণ্য আমদানি করা হয়।
এর বাইরে চাল, গম এবং ভুট্টার মত খাদ্যশস্য আমদানি হয় জিটুজি মানে সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারের সাথে বাংলাদেশের সরকারের চুক্তির মাধ্যমে, এবং ব্যক্তি উদ্যোগে।
চীন
বাংলাদেশ তার আমদানির সবচেয়ে বড় অংশটি করে চীন থেকে।
প্রধান আমদানি পণ্যের মধ্যে রয়েছে সয়াবিন তেল ও পাম অয়েল, এবং গম।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী এ বছরের জুলাইতে চীন থেকে ৮ হাজার ৭৫৯ কোটি টাকার পণ্য আমদানি করা হয়েছে।
ভারত
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ভারত থেকে বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পণ্য আমদানি হয়।
দেশটি থেকে যেসব খাদ্য-পণ্য আমদানি হয় দেশে তার মধ্যে রয়েছে পেঁয়াজ, দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার, সূর্যমুখী ও সয়াবিন তেলসহ ভোজ্য-তেল, চিনি, মধু, কোমল পানীয়, চিপস, বিস্কুট, চকলেট ও ক্যান্ডি জাতীয় খাবার।
বাংলাদেশে বাৎসরিক পেঁয়াজের চাহিদার ৪০ শতাংশ আমদানি করতে হয়, যার ৯৫ শতাংশ আসে ভারত থেকে।
ব্রাজিল
বিশ্বের নবম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ ব্রাজিল থেকে বাংলাদেশে খাদ্য সমাগ্রীর মধ্যে গম, চিনি, মাংস এবং নানা ধরণের শুকনো ফল ও মসলা আমদানি হয়।
ইন্দোনেশিয়া
বাংলাদেশের পামতেল আমদানিতে বড় উৎস ইন্দোনেশিয়া, দেশের প্রায় ৮৫ শতাংশ পামতেল আসে এই দেশটি থেকে। এছাড়া সুগন্ধি চাল এবং মসলা আনা হয় ইন্দোনেশিয়া থেকে।
আমদানি নির্ভরতা কেন কমানো যায় না?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সায়মা হক মনে করেন, সরকারের দেশীয় চাহিদা অনুযায়ী বছরের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয় না।
ফলে প্রতিবছরই দেশে উৎপাদনের পরেও চালের মত আবশ্যিক খাদ্যশস্যের একটি অংশ আমদানি করতে হয়।
এক্ষেত্রে সরকারকে আগে থেকে প্রস্তুতি নিতে হবে, প্রয়োজনে প্রতিটি খাদ্যশস্যের চাহিদা হিসাব করে গবেষণা এবং বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে সরকারকে আমদানি নির্ভরতা কমানোর জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করতে হবে।
গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুনও আমদানি নির্ভরতা কমাতে সরকারের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার কথা বলেছেন।
তবে কিছু ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমকে মেনে নিয়েই সামনে এগুতে হবে। এক্ষেত্রে তিনি চীনের উদাহরণ দেন।
চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ প্রায় ১৩ হাজার মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এখন বাংলাদেশের সাথে চীনের শিগগির বাণিজ্যে সমতা আনা সম্ভব হবে না। কিন্তু যদি আমরা চীনের প্রয়োজন মাথায় রেখে রপ্তানি বাড়াতে পারি, তাহলে বাণিজ্য ঘাটতি কমবে।
সূত্রঃ বিবিসি