ফাইভজির যুগে
Advertisements

বাংলাদেশে গতকাল রোববার রাষ্ট্রীয় টেলিকম কোম্পানি টেলিটক দেশের ছয়টি জায়গায় পরীক্ষামূলকভাবে পঞ্চম প্রজন্ম বা ফাইভজি মোবাইল ইন্টারনেট সেবা চালু করেছে। কর্মকর্তারা বলছেন জাতীয় সংসদ ভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, সচিবালয়, ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু জাদুঘর, জাতীয় স্মৃতিসৌধ, গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় টেলিটকের গ্রাহকরা আজ থেকে ফাইভজি মোবাইল ইন্টারনেট সেবা পাবেন। প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ এই সেবা উদ্বোধন করেন।

ফাইভজি নিয়ে টেলিটক বাংলাদেশ লিমিটেডের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ সাহাব উদ্দিন বিবিসিকে বলেছেন, “এখন পরীক্ষামূলকভাবে চালু হচ্ছে। এর মাধ্যমে আমরা আগে অভিজ্ঞতা সংগ্রহ করবো। আমাদের একটি প্রকল্প অনুমোদনের পর্যায়ে আছে। সামনে ২০০ স্থানে আমরা বাণিজ্যিকভাবে ফাইভজি চালু করবো।” বিশ্বের কিছু দেশে ফাইভজি চালু আছে যাতে বর্তমানের তুলনায় ১০ থেকে ২০ গুণ বেশি গতির ইন্টারনেট পাওয়া যায়। সরকার তার প্রচারণায় বলছে, “বাংলাদেশ ফাইভজি যুগে প্রবেশ করেছে।”

বেশ ঢাকঢোল পিটিয়ে ফাইভজি’র কথা বলা হলেও টেলিটকসহ দেশের অন্য সব টেলিকম কোম্পানিগুলো এখনো ফোরজি সেবাই সঠিকভাবে দিতে পারছে না। ফোরজি নিয়েই গ্রাহকদের অনেক অভিযোগ রয়েছে। ঢাকায় একটি বেসরকারি কোম্পানিতে কাজ করেন ফারজানা চৌধুরী। ব্যক্তিগত ও পেশাগত কারণে একের অধিক মোবাইল ফোন ও কোম্পানির সিম ব্যাবহার করেন তিনি। তিনি বলছিলেন, “বাড়িতে এবং অফিসে আমরা তো আজকাল বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ওয়াইফাই ব্যাবহার করি। কিন্তু যখন অফিস-বাসা যাওয়া আসা করি তখন রাস্তায় ট্রাফিক জ্যামে বসে মোবাইল ইন্টারনেট ব্যাবহার করি। প্রায়ই দেখা যায় যে ইউটিউবে একটা ভিডিও দেখবো, অথবা কোন কিছু আপলোড বা ডাউনলোড করবো, লোড হতে মাঝে মাঝে এত সময় নেয় যে বিরক্ত হয়ে বন্ধ করে দেই বা অন্য কিছু করা শুরু করি।”

বাংলাদেশে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের কয়েকটি স্থানে মোবাইলে ফোরজি ইন্টারনেট নেটওয়ার্ক চালু করে তিনটি মোবাইল ফোন অপারেটর। শুরু থেকেই সেনিয়ে গ্রাহকদের রয়েছে অনেক অভিযোগ। সেই অভিযোগ এখনো রয়েছে। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা নাঈমা জামান বলছেন, “যখন ফোরজি চালু হয়, সেসময় বিজ্ঞাপনে যেভাবে প্রচারণা হয়েছিল তাতে মনে হয়েছে ফোরজি’র গতি হবে বিদ্যুতের মতো। অথচ দেখেন এখনো এমনকি ফেসবুক লোড হতেই মাঝে মাঝে অনেক সময় নেয়, ঢাকার মধ্যেও। কোন ভিডিও দেখতে চাইলে বড়জোর কয়েক সেকেন্ড বাফারিং সহ্য করা যায়, এর বেশি না।”

এতো গেল খোদ রাজধানী ঢাকার অবস্থা। আর ঢাকার বাইরে কেমন অভিজ্ঞতা সেটি বলছিলেন একটি ব্যাংকের কর্মী বরগুনার জহিরুল ইসলাম। “আমার ভাই চাকরি করে দক্ষিণ কোরিয়া। আমাদের এখানে ফোরজি আছে বলা হয়। কিন্তু ভাইয়াকে ভিডিও কল করতে যে কি সমস্যা, ভিডিওর কথা কেটে যায়, ছবি ঝাপসা দেখায়, আটকে যায়, লাইন কেটে যায়। অথচ আমাদের কিন্তু ওই দেশ থেকে ভাইয়ার পাঠানো খুব উন্নত স্মার্টফোন আছে।”

আবার প্রায়শই দেখা যায় এক এলাকায় একটি কোম্পানির নেটওয়ার্ক ভাল কাজ করে, সেই সিম নিয়ে অন্য জেলায় গেলে ভালো কাজ করে না। অনলাইনে ইন্টারনেটের গতি দেখা যায় এমন একটি জনপ্রিয় ওয়েবসাইট জানুয়ারি মাসে স্পিডটেস্টের একটি গ্লোবাল ইনডেক্স প্রকাশ করে। তাতে বলা হয়েছে, মোবাইল ইন্টারনেটের গতির দিক দিয়ে আফ্রিকার দরিদ্র দেশ বলে পরিচিত ইথিওপিয়া ও সোমালিয়ার চাইতেও খারাপ অবস্থা বাংলাদেশের। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের চাইতে কম গতির ইন্টারনেট রয়েছে শুধু আফগানিস্তানে।

এপ্রিল মাসে চারটি বিভাগে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের করা এক জরিপের ফল প্রকাশ করা হয়। তাতে বলা হয়েছে, দেশের সকল মোবাইল ফোন অপারেটরের ফোরজি ইন্টারনেট সেবায় নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে গতি কম। টেলিটকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ সাহাব উদ্দিন বলছেন, “এখানে ব্যবহারকারীদেরও একটি বিষয় আছে। যদিও আগের চেয়ে স্মার্টফোন অনেক বেড়েছে কিন্তু দেখা যায় যে বেশিরভাগের হাতেই ফোরজি মানের স্মার্টফোন নেই।” তিনি জানিয়েছেন, বাংলাদেশে প্রতি ১০০জন গ্রাহকের মধ্যে শুধুমাত্র ৩৫ জনের কাছে ফোরজি স্মার্টফোন রয়েছে।

মোবাইল অপারেটরদের সংগঠন এমটবের মহাসচিব ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অবঃ) এস এম ফরহাদ বলেছেন, “দেশের সবগুলো জেলাতেই ফোরজির সেবা রয়েছে। তবে সমস্ত এলাকাতেই যে ফোরজি সেবা পাওয়া যাবে তেমনটি নয়। গ্রাহকের প্রয়োজনীয়তা বিবেচনা করে বিশ্বের সব দেশেই নেটওয়ার্ক ডিজাইন করা হয়। বিভিন্ন ইনডেক্সে বাংলাদেশে মোবাইল ইন্টারনেটের যে গড় গতির কথা বলা হয় তা যেকোনো প্রাত্যহিক কাজের জন্য যথেষ্ট ভালো।” তিনি আরও বলেছেন তুলনামূলকভাবে ভালো মানের স্মার্টফোন থাকার পরেও বিভিন্ন কারণে ইন্টারনেটের গতি বিঘ্নিত হতে পারে৷ ব্যবহারকারী লিফটে চড়লে, উঁচু ভবনে থাকলে, দ্রুত চলাচলের সময়, কোথাও পকেট থাকলে কিংবা আবহাওয়া খারাপ থাকলেও ইন্টারনেটের গতি বিঘ্নিত হতে পারে।

বেসরকারি মোবাইল ফোন কোম্পানি রবি আজিয়াটা’র চিফ কর্পোরেট ও রেগুলেটরি অফিসার সাহেদ আলম বিবিসিকে বলেছেন, এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ দুটি বিষয় হল স্পেকট্রাম বা বেতার তরঙ্গ এবং অপটিক্যাল ফাইবার। “আমাদের দেশে বেতার তরঙ্গের উচ্চ মূল্যের কারণে যথেষ্ট পরিমাণ তরঙ্গ অপারেটরদের হাতে নেই। আবার অপটিক্যাল ফাইবারের অপ্রতুলতার কারণে ফোরজি সেবায় কাঙ্ক্ষিত মান নিশ্চিত করা সম্ভব কঠিন হচ্ছে।” সাহেদ আলম বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বলছেন, ফোরজির তুলনায় ফাইভজি একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রযুক্তি। ফাইভজি’র ব্যবহার গ্রাহক পর্যায়ের তুলনায় প্রাতিষ্ঠানিক এবং এন্টারপ্রাইজ পর্যায়ে বেশি। তাই ফোরজির সাথে সরাসরি ফাইভজি’র তুলনা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় বলে তিনি মন্তব্য করেছেন।

অন্যদিকে এমটবের মহাসচিব বলেছেন, “ভালো মানের সেবা পেতে হলে পর্যাপ্ত তরঙ্গের যেমন বিকল্প নেই তেমনি টাওয়ারগুলো ফাইবার কেবলের মাধ্যমে কানেক্ট করারও কোনও বিকল্প নেই। এই দুই ক্ষেত্রেই আমরা পিছিয়ে আছি। তবে বিটিআরসির সংগে আমরা আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি এবং আশাকরি অচিরেই অবস্থার উন্নতি ঘটবে।” কিন্তু এই কথা বোধহয় মোবাইল গ্রাহকরা শুনে আসছেন বাংলাদেশে মোবাইল ইন্টারনেট চালু হওয়ার পর থেকেই।

সূত্র: বিবিসি বাংলা।

Advertisements