মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে দেওয়া প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্নের আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নির্মাণে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি প্রকাশ পাচ্ছে। ইউএনও কিংবা ঠিকাদার দুর্নীতি করেছেন, তবে তা কি খুব বড় অংকের? কেউ কেউ বলছেন, নিন্মমানের ঠিকাদারি এবং দূর্নীতির কারনে ঘর গুলো ভেঙ্গে পড়ছে।বিষয়টা এমনই তবে মূল সমস্যাটা পরিকল্পনায়। ফাউন্ডেশান হীন ঘরের পরিকল্পনা ভুল ছিল, দালান বাড়ি শূণ্য ফাউন্ডেশানে অসম্ভব, এখানে কোন রড ব্যবহার হয়নি। সিমেন্ট বেশি দিলেও ঘর গুলো কিছুদিন পর ভেঙে পড়ত। ঘর প্রতি বরাদ্দ ছিল পৌনে দুই লাখ টাকা। এই প্রকল্পের পরিকল্পনায় গোড়ায় গলদ বলে মনে হচ্ছে।
যুগান্তরের এক প্রতিবেদনে উঠে আসে যে, দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া নয়, বর্ষা মৌসুমের ঘন বৃষ্টিই ঘর ভেঙ্গে পড়ছে।অনেক জায়গায় হস্তান্তরের আগেই ধসে পড়ছে নতুন ঘর। আবার হস্তান্তরের পরও কোনো কোনো জায়গায় ঘর ভেঙে পড়েছে। এতে উবে গেছে উপহার পাওয়া দরিদ্র মানুষের মুখের হাসি। দায়িত্বপ্রাপ্তদের বেশুমার অনিয়ম-দুর্নীতিতে রীতিমতো প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে আশাজাগানিয়া এ প্রকল্প-এমন মন্তব্য সংশ্লিষ্টদের। তাদের জিজ্ঞাসা-এর নেপথ্যে দায়ী কারা।
তারা আরও জানান, প্রকল্প বাস্তবায়নে অনেক স্থানে প্রাথমিক তদন্তে ভয়াবহ অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য উদঘাটিত হয়েছে। এ ব্যাপারে অভিযোগ উঠেছে খোদ প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির প্রধান সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী অফিসারের (ইউএনও) বিরুদ্ধে। প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে তাদের কেউ কেউ ধাপে ধাপে অনিয়ম-দুর্নীতি করেছেন। আবার অনেকে দায়িত্বহীনতার পরিচয়ও দিয়েছেন।
প্রাথমিক তদন্তে সত্যতা মেলায় এখন পর্যন্ত অন্তত ৫ জন এউএনওকে ওএসডি করা হয়েছে। এছাড়া নিুমানের কাজ ও ঘর বরাদ্দে অনিয়মের অভিযোগে ২২টি জেলার ৩৬টি উপজেলায় প্রকল্পসংশ্লিষ্টদের বিষয়ে তদন্ত চলছে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গে জড়িত আরও ৩৯ জন কর্মকর্তা ফেঁসে যেতে পারেন। তদন্ত শেষে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা দায়ের করা হবে। তবে অনেক প্রকল্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত দায়ী কর্মকর্তারা অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছেন।
আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের পরিচালক অতিরিক্ত সচিব মো. মাহবুব হোসেন বুধবার মোবাইল ফোনে বলেন, আমাদের কাছে যেখান থেকেই অভিযোগ আসছে সেখানেই চিঠি দিয়ে জেলা প্রশাসকদের তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এখন পর্যন্ত ৩৬টি উপজেলার অভিযোগ তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটির পাশাপাশি অনেক জায়গায় প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের প্রকল্প অফিস থেকে গোপনে তদন্ত দল পাঠানো হচ্ছে। এতে তদন্তে পক্ষপাতিত্বের সুযোগ কম থাকছে। দায়ী কেউ পার পাবে না।
তদন্তে দুর্নীতির অভিযোগের সত্যতা পাওয়ার পরও মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হামিদুর রহমানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে সহকারী কমিশনার (ভূমি) শেখ মেজবাহ-উল-সাবেরিনকে ওএসডি করার ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, একটু অপেক্ষা করুন। দোষী সবার বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অভিযোগ আছে, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিবের জামাই হওয়ার সুবাদে তিনি এখনো বহাল তবিয়তে আছেন- এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, অপেক্ষা করেন, পর্যায়ক্রমে দোষী সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সোমবার প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আহমদ কায়কাউস সাংবাদিকদের বলেছেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যেটিকে ইবাদত হিসাবে নিয়েছেন সেটাতে আমরা যখন ব্যর্থ হই তখন সেটা আমাদের ব্যর্থতা। এরই মধ্যে ২২ জেলার ৩৬ উপজেলার বিরুদ্ধে নি্নুমানের কাজ ও ঘর বরাদ্দে অনিয়মসহ নানা অভিযোগ উঠেছে। অনিয়মে জড়িত কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।
প্রসঙ্গত, প্রথম দফায় ৬৬ হাজারের বেশি মানুষকে ঘর দেওয়া হয়েছে। এ পর্যন্ত ৬৬ হাজার ১৮৯টি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে আধা-পাকা ঘর হস্তান্তর করা হয়েছে। দ্বিতীয় দফায় আরও এক লাখ ঘর তৈরি করে হস্তান্তরের কাজ চলমান। সরকারের ঘোষণা করা মুজিববর্ষের উপহার হিসাবে সব মিলিয়ে ৬৯ হাজার ৯০৪টি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে জমিসহ ঘর তৈরি করে দিচ্ছে সরকার।
অনুসন্ধানকালে সংশ্লিষ্ট নথিপত্র থেকে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এবং ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয় এই ঘর তৈরির ব্যয় নির্বাহ করছে। প্রাক্কলন পত্রে দেখা গেছে, প্রথম দফায় প্রতিটি ঘর তৈরির জন্য বরাদ্দ ছিল ১ লাখ ৭১ হাজার টাকা। এছাড়া মালামাল পরিবহণের জন্য ঘরপ্রতি বরাদ্দ ছিল আরও ৪ হাজার টাকা।
আর জায়গাভেদে প্রকল্প তদারকির জন্য তদারক কর্মকর্তার জ্বালানি খরচ বাবদ বরাদ্দ দেওয়া হয় ৫ থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত। যেসব প্রকল্পের ব্যয় ত্রাণ মন্ত্রণালয় জোগান দিচ্ছে সেখানে প্রাক্কলনের চেয়ে বেশি খরচ হলেও স্থানীয়ভাবে তা সমন্বয় করার নির্দেশনাও রয়েছে। এরপরও মানসম্মত কাজ হচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রথম দফার বেশির ভাগ প্রকল্পই অলিখিতভাবে ঠিকাদার নিয়োগের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। ওইসব প্রকল্প প্রধান হিসাবে অসৎ ইউএনওরা ঠিকাদারদের কাছ থেকে এককালীন ঘরপ্রতি ১৫-২০ হাজার টাকা ঘুষ নিয়েছেন। আর মালামাল পরিবহণ খরচের টাকাও ঠিকাদারদের না দিয়ে আত্মসাৎ করেছেন তারা।
এরপর আর প্রকল্পের দিকে তেমন নজরদারি করা হয়নি। ফলে ঠিকাদাররা তাদের খেয়ালখুশিমতো কাজ করার ফলে ঘরের ভিত্তি মজবুত হয়নি। এক্ষেত্রে নির্মাণ কাজের প্রতিটি ধাপে ধাপে প্রাক্কলনের চেয়ে কম ও নিুমানের সামগ্রী দিয়ে নির্মাণ কাজ করা হয়েছে। আবার যে ঠিকাদারকে দিয়ে কাজ করানো হয়েছে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাদের ইউএনও মনোনীত লোকদের কাছ থেকে মালামাল সরবরাহ নিতে বাধ্য করা হয়েছে। এ খাত থেকেও কমিশন পেয়েছেন ইউএনওরা।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সূত্রে আরও জানা যায়, পরিস্থিতি বিবেচনায় দ্বিতীয় দফার ঘর নির্মাণ ব্যয় আরও বাড়ানো হয়। ঘরপ্রতি মোট নির্মাণ ব্যয় ধরা হয় ২ লাখ ৩৬ হাজার ১৩৫ টাকা ৪৫ পয়সা। এর মধ্যে ঠিকাদারের লাভ ধরা হয় ৪৬ হাজার ৪৬ টাকা ৪১ পয়সা। এই বরাদ্দ পাওয়ার পরই বেশির ভাগ এলাকায় দায়িত্বপ্রাপ্ত ইউএনওরা নিজেরাই লেবার ঠিকাদারদের মাধ্যমে কাজ শুরু করেন।
এক্ষেত্রে তারা সরাসরি ঘুস না পেলেও পুরো টাকা নিজেদের হাতে খরচ করতে গিয়ে ধাপে ধাপে চুরি করেন বলে অভিযোগ আছে। কোন কোন ধাপে টাকা সরিয়েছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত ইউএনওরা-সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপকালে এর হিসাবও পাওয়া গেছে। প্রতিটি ঘর নির্মাণে ৬ হাজার ২০০টি এক নম্বর ইট দরকার। কিন্তু কোনো কোনো জায়গায় ঘরের উচ্চতা ও ১০ ইঞ্জি গাঁথুনি কম দিয়ে ১ হাজার ২০০ ইট সাশ্রয় করে এ খাত থেকে পকেটে তুলেছেন অন্তত ১৫ হাজার টাকা।
নিম্নমানের টিন ব্যবহার করে ঘরপ্রতি ১৫ হাজার টাকা সাশ্রয় করা হয়েছে। প্রাক্কলন অনুযায়ী প্রতিটি ঘরের নির্মাণ কাজ করতে ৪৮ বস্তা সিমেন্ট দরকার। কিন্তু ৩৮-৪০ বস্তা সিমেন্ট ব্যবহার করে এ খাত থেকে ঘরপ্রতি চুরি করা হয়েছে অন্তত ৪ হাজার টাকা। ঘরের জানালার লিংটেলে ১০ মিলিমিটার চারটি রড ও ৮ মিলিমিটার রডের রিংয়ের খাঁচা দিয়ে ঢালাই করার কথা থাকলেও অস্বাভাবিক কম ও বাংলা রড দিয়ে কাজ করে এ খাত থেকে ঘরপ্রতি অন্তত ১ হাজার টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।
বাথরুমের ট্যাংকি বানাতে ৬টি চাকের জায়গায় চারটি চাক ব্যবহার করে অন্তত ১ হাজার টাকা সাশ্রয় করা হয়েছে। এছাড়া দরজা-জানালায় নিুমানের স্টিল ও ঘরের চালায় অসারী কাঠ ব্যবহার করে এ খাত থেকে ঘরপ্রতি হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে আরও অন্তত ৫ হাজার টাকা। প্রকল্পের প্রকৌশল বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত একাধিক কর্মকর্তা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, তারা কৃচ্ছ্রসাধনের মধ্য দিয়েই প্রাক্কলন তৈরি করেছিলেন।
এখান থেকে যদি ধাপে ধাপে অর্থ সাশ্রয় করে ঘরপ্রতি কমবেশি ৪০-৫০ হাজার টাকা সরিয়ে নেওয়া হয় তাহলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। নিুমানের কাজ করার কারণেই অনেক জায়গায় নির্মাণ কাজের ত্রুটি-বিচ্যুতি বের হচ্ছে। এতে ক্ষুণ্ন্ন হচ্ছে সরকারের ভাবমূর্তি।
এছাড়া কোথাও কোথাও ঘর ধসে পড়ার অন্যতম কারণ হিসেবে ভুল জায়গা নির্ধারণ ও কাঁচা ভরাটে তড়িঘড়ি নির্মাণ কাজ শেষ করার বিষয়টিকেও দায়ী করেছেন তদন্ত দলের এক সদস্য। নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক প্রকল্পসংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেন, ইউএনওরা প্রকল্প পাওয়ার পরই তাদের মেয়াদকালে কাজ শেষ করে টাকা কামাতে গিয়ে হযবরল পাকিয়েছেন।
আবার কোনো কোনো এলাকায় ইউএনও কাজ শুরু করে দিয়ে বদলি হয়ে অন্যত্র চলে গেছেন। নতুন ইউএনও যোগ দিয়ে দায়ভার আগেরজনের ওপর চাপিয়ে নিজের আখের গুছিয়েছেন। এসব কারণেই প্রকল্পের কাজ নিয়ে এখন প্রশ্ন উঠছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত মুন্সীগঞ্জ সদর, সিরাজগঞ্জের কাজীপুর, বগুড়ার শেরপুর, শাজাহানপুর, হবিগঞ্জের মাধবপুর, সুনামগঞ্জের শাল্লা, তাহিরপুর, বরগুনার আমতলীতে ঘর নির্মাণে অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়টি প্রাথমিক তদন্তে সত্যতা পাওয়া গেছে।
এছাড়া আরও ২৯টি উপজেলায় ঘর নির্মাণে অনিয়মের অভিযোগের তদন্ত প্রায় শেষ পর্যায়ে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে বগুড়ার আদমদিঘী, কুমিল্লার দেবিদ্বার, খাগড়াঝড়ির মহালছড়ি, মাদারীপুরের কালকিনি, লালমনিরহাট সদর, গাজীপুরের শ্রীপুর, সিরাজগঞ্জের তারাস, নেত্রকোনার খালিয়াজুরি, মোহনগঞ্জ, কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী, জামালপুরের ইসলামপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল, ময়মনসিংহ সদর, দিনাজপুরের ফুলবাড়ী, হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ, চুনারুঘাট, ভোলার লালমোহন, পাবনার সাঁথিয়া, মানিকগঞ্জের ঘিওর, নাটোর সদর এবং ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুর। এসব উপজেলার ঘর ধসে পড়া, ফাটল সৃষ্টি হওয়াসহ নানা অভিযোগ উঠে এসেছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, পদাধিকারবলে ৫ সদস্যবিশিষ্ট প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির প্রধান থানা নির্বাহী অফিসার। অন্য সদস্যরা হলেন সহকারী কমিশনার (ভূমি), এলজিইডির উপজেলা প্রকৌশলী, উপজেলা প্রকল্প বায়স্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) এবং সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য। এই চারজনকেই ইউএনওর কাছে তাদের কাজের জবাবদিহি করতে হয়। তাই প্রকল্প বাস্তবায়নে ইউএনওদের অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে তারা মুখ খুলতে সাহস পান না। তবে কোনো কোনো জায়গায় প্রকল্প থেকে ইউএনওদের অবৈধ আয়ের ভাগ পিআইও এবং জেলা প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরাও পেয়েছেন বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।
স্পর্শকাতর এমন একটি প্রকল্পের কাজে স্থানীয় প্রশাসনের কর্তাদের অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়ানোর বিষয়ে সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান বলেন, এমন স্বপ্নের একটি প্রকল্প সবার জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। এটা বাস্তবায়নের দায়িত্ব যাদের কাছে তাদের আরও দায়িত্বশীল হতে হবে। এখানে কারও দায়িত্ব পালনে অবহেলা প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধে সরকারি বিধি মোতাবেক বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
আর কারও বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হলে দুর্নীতি দমন কমিশন তদন্ত করে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে। এরই মধ্যে যেসব জায়গায় ঘর ধসে গেছে, ত্রুটি-বিচ্যুতি দেখা দিয়েছে সেগুলো মেরামত করে যেভাবে দেওয়ার কথা ছিল সেভাবে হস্তান্তর করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের তদন্তের বাইরেও দেশের বিভিন্ন এলাকা বাস্তবায়ন হওয়া ও চলমান প্রকল্পের কাজ নিয়ে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ঢাকার উপকণ্ঠ সাভার, মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া, নীলফামারীর ডোমার, জামালপুর সদর, দেওয়ানগঞ্জ, মেলান্দহ উপজেলা, ময়মনসিংহের গৌরীপুর, নাটোরের বাগাতিপাড়া থেকেও ঘর নির্মাণে অনিয়মের অভিযোগ এসেছে।
সরেজমিন ঘুরে এসে জামালপুর প্রতিনিধি জানিয়েছেন, সম্প্রতি দেওয়ানগঞ্জের মধ্য চুকাইবাড়ি গ্রামের নির্মাণাধীন ঘরের দেওয়াল ধসে মমতাজ বেগম নামের ৮০ বছরের বৃদ্ধা ও তার নাতি রাসেল আহত হন। তাদের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করে চিকিৎসা দেওয়া হয়। ইমলামপুর উপজেলার সদর ইউনিয়নের পঁচাবহলা গ্রামের উপকারভোগী বদু মন্ডল ও আলম মন্ডলের অর্ধেক ঘর ধসে গেছে।
তাদের অভিযোগ, ঘরের ভিটিতে মাটি ও নির্মাণ কাজে সিমেন্টের অংশ কম দেওয়ায় এ ঘটনা ঘটেছে। সদর উপজেলার তলশিরচর ইউনিয়নের কাজল বেগম জানান, ঘর নির্মাণের সময় তিনি ২০ বস্তা সিমেন্ট কিনে দিয়েছেন। মেলান্দহ উপজেলার নয়ানগর ইউনিয়নের সাদেক আলী জানান, তাদের ওখানে অনেক খাস জমি ছিল। কিন্তু নদীর তলার কাছে ঘর বানিয়ে তাদের দেওয়া হয়েছে। বছরের ছয় মাস সেখানে বসবাস করা যাবে না বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি।
এসব ব্যাপারে জামালপুরের জেলা প্রশাসক মুর্শেদা জামান বলেন, কোথাও কোথাও কিছু অনিয়ম হয়েছে। যখন যেখানে অভিযোগ পাওয়া গেছে সেখানেই তাৎক্ষণিভাবে সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এখনো অভিযোগ পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
নীলফামারী প্রতিনিধি জানান, সেখানে ঘর নির্মাণে অনিয়ম ও টাকার বিনিময়ে হস্তান্তরের অভিযোগ পাওয়া গেছে। ডোমার উপজেলায় ১০ বিঘা জমি রয়েছে এমন ব্যক্তিকেও টাকার বিনিময়ে ঘর দেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান তোফায়েল আহমেদ জানান, ইউএনও নিজেই সবকিছু করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর বরাদ্দ দেওয়ার বিষয়ে তাকে কিছু জানানো হয়নি।
নাটোর প্রতিনিধি জানান. লালপুর উপজেলায় ঘুস দিয়েও প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর পাননি স্থানীয় সুপদ কুমার শীল নামের এক দরিদ্র ব্যক্তি। আবার টাকার বিনিময়ে ঘর পেয়েছেন কীটনাশক ও মুদি দোকান মালিক আব্দুর রহমান। নাটোর সদরের দিয়ার সাতুরিয়ায় তৈরি করা হয়েছে ৯৪টি ঘর। প্রতিটি ঘরের সামনে পানি জমে কাদার সৃষ্টি হয়েছে।
পা রাখার কোনো জায়গা নেই। খসে পড়ছে অনেক দেওয়াল ও বারান্দার খুঁটির আস্তর। বাগাতিপাড়া (নাটোর) প্রতিনিধি জানান, উপজেলার পাকা ইউনিয়নের বেগুনিয়া গ্রামের ১৬টি ঘরে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। নিচু স্থানে নির্মাণ করায় বুধবারের টানা বৃষ্টিতে ঘরগুলো জলমগ্ন হয়ে পড়ে।
গৌরীপুর (ময়মনসিংহ) প্রতিনিধি জানান, উপজেলার অচিন্তপুর ইউনিয়নের শাহগঞ্জ বাজার এলাকায় সুরিয়া নদীর পাড়ে নির্মাণ করা আশ্রয়ণ প্রকল্পের কাজ শেষ না হতেই এক দফা ভাঙনের কবলে পড়েছে। এছাড়া বৃষ্টি হলে ঘরে চালা দিয়ে পানি পড়ে বলে জানান বাচ্চু মিয়ার স্ত্রী মনোয়ারা খাতুন। তিনি আরও বলেন, ঘরের দরজায় সিটকানি নেই, ভেঙে গেছে সিঁড়ি। উঠে গেছে মেঝের আস্তর।
হবিগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, মাধবপুর উপজেলার বাঘাসুরা ইউনিয়নের রূপনগর এলাকায় ২৭টি পরিবার উপহারের ঘর পেয়েছে। গত বছরের জানুয়ারিতে ঘরগুলো হস্তান্তর করা হয়েছে। কিন্তু একটু বৃষ্টি হলেই সেখানে ঘরের চারপাশে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। অকেজো হয়ে গেছে কয়েকটি টিউবওয়েল। যেগুলো সচল আছে সেগুলোর পানিতে চরম দুর্গন্ধ হওয়ায় ব্যবহারের অনুপযোগী। সব মিলিয়ে সুবিধাভোগীদের দুর্ভোগের শেষ নেই।
বগুড়া ব্যুরো জানায়, আশ্রয়ণ প্রকল্প-২ এর আওতায় শেরপুর উপজেলার খানপুর ইউনিয়নে খানপুর বুড়িগারি এলাকালায় খালের কিনারায় ২২টি বাড়ি নির্মাণ করা হয়। গত বছর জানুয়ারি মাসে ঘরগুলো হস্তান্তর করা হয়েছে। এরই মধ্যে খালের মাটি সরে যাওয়ায় গত ২২ জুনের আগে সুবিধাভোগী হায়দার আলী, আবদুল কাদের, বাদশা মিয়া, শেফালী বেগম, নদীয়ার চাদ, মোকছেদ আলী ও সোনাউদ্দিনের বাড়ির বাথরুম ও রান্নাঘরের অংশ ধসে খালে ভেসে যায়। অন্য ঘরগুলো ভাঙনের ঝুঁকির মুখে। সেগুলোতে এখন কেউ থাকতে সাহস পাচ্ছেন না।
বিশ্বনাথ (সিলেট) প্রতিনিধি জানান, উপজেলার বিশ্বনাথ ইউনিয়নের দন্ডপানিপুর গ্রামের পাশে নির্মিত ১৬টি ঘরের বেশ কয়েকটির দেওয়াল ও মেঝেতে ফাটল দেখা দিয়েছে। বৃষ্টি হলে ঘরের চালা দিয়ে পানি পড়ে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুমন চন্দ্র দাস জানান, মুজিববর্ষে ঘরগুলো উদ্বোধনের জন্য তাড়াহুড়ো করে মাটি ভরাট করা হয়। নতুন মাটিতে ঘর নির্মাণ করায় মেঝেতে একটু ফাটল ধরেছে। এতে বসবাসরতদের আতঙ্কের কিছু নেই।
মৌলভীবাজার প্রতিনিধি জানান, সদর উপজেলার চাঁদনীঘাট ইউনিয়নের মাইজপাড়া এলাকায় মনু নদীর প্রতিরক্ষা নদীর বাইরে নির্মাণ করা হয়েছে ৪০টি ঘর। স্থানীয়রা বলেছেন, আর কিছুদিন পর কেউই এই ঘরে বসবাস করতে পারবে না। কারণ প্রায় প্রতিবছরই উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল, অতিবৃষ্টি ও বর্ষাকালীন ওই জায়গায় ১০-১২ ফুট ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়।
ওই সব ঘরে যাতায়াতেরও কোনো রাস্তা নেই। পত্নীতলা (নঁওগা) প্রতিনিধি জানান, সেখানে হস্তান্তরের কয়েক মাসের মধ্যেই অনেক ঘরে ফাটল দেখা দিয়েছে। দায়সারাভাবে নিুমানের সামগ্রী দিয়ে নির্মাণ কাজ করায় ধসে গেছে ঘরের মেঝে। এ কারণে অনেক ঘরের চাবি বুঝে পেলেও উপকারভোগীরা ঘরে থাকতে পারছেন না।