পুরনো পথেই হাঁটবে ইসরাইলের নতুন সরকার
Advertisements

নেতানিয়াহুর শেষ রক্ষা হল না। দীর্ঘ ১২ বছরের শাসন পর্বের ইতি ঘটল। গাজা উপত্যকায় বিশাল ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েও রক্তপিপাসু নেতানিয়াহু তার প্রধানমন্ত্রিত্ব রক্ষা করতে পারলেন না।

ইয়ামিনা পার্টির প্রধান নাফতালি বেনেট নতুন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন। দুই বছর তিনি এই পদে থাকবেন। পরবর্তী মেয়াদে ইয়েস আতিদ দলের নেতা ইয়ার লাপিদ বেনেটের স্থলাভিষিক্ত হবেন।
কে এই নাফতালি বেনেট?

কট্টর ডানপন্থী হিসেবে পরিচিত নাফতালি বেনেট একজন প্রযুক্তি উদ্যোক্তা ছিলেন। অতি ধার্মিক ইহুদিদের মতো তিনি মাথায় কিপা পরেন। ইহুদি জাতীয়তাবাদ এবং জাত্যাভিমানের এক প্রতীক এই বেনেট।

যুক্তরাষ্ট্র বংশোদ্ভূত বেনেট নেতানিয়াহুর সংস্পর্শে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। তিনি ২০০৬ সাল থেকে দুই বছর নেতানিয়াহুর চিফ অব স্টাফ ছিলেন। অর্থ ও শিক্ষামন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।

২০০৮ সালে লিকুদ পার্টি থেকে বের হয়ে কট্টর ইহুদি দল ‘জিউয়িশ হোম’ পার্টিতে যোগ দেন। এই দলেরই বর্তমান নাম ইয়ামিনা। ২০১৩ সালে প্রথম এমপি হন। তিনি পশ্চিম তীরে ইহুদি বসতি স্থাপনের কট্টর সমর্থক। বসতি স্থাপনকারীদের সংগঠন ‘ইয়েশা কাউন্সিল’-এর তিনি প্রধান ছিলেন।

ফিলিস্তিন সমস্যাকে তিনি ইসরাইলের ‘পশ্চাৎদেশের ওপর বিষফোঁড়া’ বলে বর্ণনা করেছেন। ফিলিস্তিনিদের যৌক্তিক আন্দোলনকে তিনি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড মনে করেন। এই কাজে জড়িতদের তিনি হত্যা করতে মত দিয়ে থাকেন। যদিও ইসরাইলে মৃত্যুদন্ডের বিধান নেই। তিনি বলেছিলেন, ‘ফিলিস্তিনি সন্ত্রাসীদের হত্যা করা উচিত, মুক্তি দেওয়া নয়।’

নেতানিয়াহু পুনরায় ফিরবে কি?

৮ টি দল নিয়ে গঠিত জোটের উপর সওয়ার হয়ে বেনেট ও ইয়ার লাপিদ সরকার গঠন করেছেন। যে কোনো সময়েই এই জোট ভেঙে যেতে পারে। পার্লামেন্টের ১২০ আসনের মধ্যে নতুন গঠিত জোট ৬০ টি আসন নিশ্চিত করেছে। খোদ বেনেটের দল ইয়ামিনা পার্টির একজন এই জোট গঠনে সমর্থন দেয়া থেকে বিরত থেকেছে।

বর্তমানে ৫৯ টি আসন নিয়ে বিরোধী দলের নেতা হিসেবে রাজনীতিতে সক্রিয় থাকছেন নেতানিয়াহু৷ নাফতালি বেনেট ও ইয়ার লাপিদের অদ্ভূত এই জোটকে ভাঙতে নেতানিয়াহু নতুন খেলার ছক তৈরি করবেন।

এই ছক তৈরিতে আপাতত নেতানিয়াহুকে কিছু বাঁধা মোকাবেলা করতে হবে। এই বাধা উতরাতে না পারলে তিনি একেবারে ক্ষমতার বাইরে চলে যেতে পারেন।

এক. লিকুদ পার্টিতে তার অবস্থান শক্ত করতে হবে। দলের প্রধান হিসেবে আগের চেয়ে এখন তার অবস্থান একটু নড়বড়ে।

দুই. তার বিরুদ্ধে চলমান মামলাগুলোর নিষ্পত্তি করা। দুর্নীতি, বিশ্বাস ভঙ্গ ও সংবাদ মাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে তিনটি মামলা রয়েছে।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী এহুদ এলমার্টের মতো নেতানিয়াহু দোষী সাব্যস্ত হলে তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার এখানেই শেষ হয়ে যাবে৷ নেতানিয়াহু এখনই তার ক্যারিয়ারে সমাপ্তি রেখা টানতে অনিচ্ছুক। ইতোমধ্যে তিনি বেনেট-লাপিদ জোটকে ইসরাইলের নিরাপত্তার জন্য হুমকি আখ্যা দিয়েছেন। এই জোট বৈশ্বিক হুমকি,তারা ইরানকে মোকাবিলা করতে অক্ষম এমন প্রচারণাও শুরু করে দিয়েছেন।

লোকরঞ্জনবাদী নেতা নেতানিয়াহু ভালো করেই জানেন কিভাবে জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায়। যদিও গাজায় সম্প্রতি ১১ দিনের হামলা নেতানিয়াহুকে বাড়তি কোনো সুবিধাই এনে দেয়নি, তবুও তার পরবর্তী কর্মকাণ্ড নতুন কোন সুযোগ তৈরি করলেও করতে পারে। এজন্য এখনই বলা যাবে না নেতানিয়াহু যুগের অবসান হবে।

কে এই নেতানিয়াহু?

ইসরাইলের রাজনীতিতে লৌহমানব হয়ে উঠেছিলেন বেনজামিন নেতানিয়াহু ওরফে বিবি। সমর্থকদের কাছে তিনি ইসরাইলের শক্তিশালী মুখপাত্র হিসেবে পরিচিত। তিনি অবলীলায় জনসম্মুখে অসুখকর সত্য কথা বলতে পারেন।

কট্টর ইরান বিরোধী হিসেবে নাম লিখিয়েছেন। ইরানের সাথে সম্পাদিত পরমাণু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে নিতে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। ‘আব্রাহাম একর্ড’ সই করে মুসলিম দেশগুলোতে ইসরাইলের প্রভাব বৃদ্ধি করেছেন।

শত্রু পক্ষকে ধরাশায়ী ও কথার বাণে জর্জরিত করতেও তিনি পারদর্শী ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্র সর্বদা ইসরাইলকে সমর্থন দিয়ে থাকে। এরপরও হিতে বিপরীত হলেই তিনি রাখঢাক না রেখেই যুক্তরাষ্ট্রকে তুলোধুনো করেছেন। সর্বশেষ বিদায়ী বক্তব্যে তিনি ইরান ইস্যুতে বাইডেনকে আক্রমণ করেছেন।

রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার পূর্বে তিনি ইসরাইলের সামরিক বাহিনী ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন।

১৯৬৭ সালে সামরিক বাহিনীতে যোগ দেন, দ্রুতই এলিট কমান্ডো গ্রুপে যুক্ত হন। ১৯৭৩ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধে ক্যাপ্টেন ছিলেন। ১৯৮২ সালে ডেপুটি চিফ হিসেবে ওয়াংশিটনে ইসরাইলি দূতাবাসে নিয়োগ পান। ১৯৮৪ সালে রাষ্ট্রদূত পদ অলংকৃত করেন।

১৯৮৮ সালে প্রধানমন্ত্রী আইজাক শামিরের মন্ত্রিসভায় সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে যোগ দেন। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে প্রথম ক্ষমতায় আসেন। এর পর ২০০৯ থেকে ২০২১ পর্যন্ত পাঁচ দফায় টানা ১২ বছর প্রধানমন্ত্রী ছিলেন।

‘Three noes’ নীতির জন্যও তিনি পরিচিত ছিলেন। এক. প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র, দুই. গোলান মালভূমি, তিন. জেরুজালেম এর ভবিষ্যৎ – এই তিনি ইস্যুতে তিনি কোনো ছাড় দিতে রাজি ছিলেন না।

প্যালেস্টাইন-ইসরাইল সমস্যা সমাধানে অধিকাংশ শান্তি চুক্তির বিরোধিতা করলেও ইয়াসির আরাফাতের সাথে ১৯৯৮ সালে ‘ওয়াই রিভার চুক্তি’ করেছিলেন। ২০০৫ সালে গাজা উপত্যকা থেকে ইসরাইলি সেনা সরিয়ে নেয়ার প্রতিবাদে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছিলেন।

ইসরাইলের স্বার্থ সংরক্ষণে নির্বিচারে ফিলিস্তিনিদের হত্যায় মদদ দিয়েছেন এই নেতা। ইসরাইলিদের কাছে প্রশংসিত ও বিবেকবান মানুষদের কাছে একজন নিন্দিত নেতা হিসেবেই বিবেচিত হবেন নেতানিয়াহু।

প্যালেস্টাইন সংকটের কি হবে?

প্যালেস্টাইন সংকট প্রশ্নে ইসরাইলের নতুন সরকারের আগমনে নতুন কোন আশা নেই। কারণ নেতানিয়াহু চলে গেলেও নেতানিয়াহুর সহকর্মীরাই ক্ষমতায় এসেছেন। আর গঠিত জোটে অন্তর্ভূক্ত দলগুলো আদর্শিক ভেদাভেদ ভুলে শুধু নেতানিয়াহুকে হটাতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন। এর বাইরে অন্য কোনো কিছুই বদলাবে না। নতুন সরকার পুরানো পথেই চলবে এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।

নতুন প্রধানমন্ত্রী বিগত রেকর্ড পর্যালোচনা করলে ফিলিস্তিনিদের জন্য আশাদায়ক কোনো কিছু প্রত্যক্ষ করা যায় না। বেনেট বলেছিলেন, ‘ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাত কখনও শেষ হবে না। এটাকে মেনে নিতে হবে।’

বেনেটের এই ভাষ্যকে মেনে নিয়েই হয়ত ইউনাইটেড আরব লিস্ট বেনেট-লাপিদ জোটে হাত মিলিয়েছে। ইসরাইলের মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশ আরব মুসলিম। মনসুর আব্বাসের এই জোটভুক্তিও ইসরাইলি আরবদের জন্য কিছুটা সুফল বয়ে আনলেও ফিলিস্তিনিদের কোন উপকারে আসবে না।

মোদ্দা কথা হল, দ্বি-রাষ্ট্র ভিত্তিক সমাধান ব্যানেট মানতে নারাজ। এ নিয়ে বেনেটের মন্তব্য হল ‘এমন একটা অমূলক বিষয় নিয়ে এত শক্তি কোথাও খরচ হয়নি। আমাদের এই ধ্যাণ ধারণা থেকে বের হয়ে আসা প্রয়োজন।’

হামাস সহ পুরো বিশ্বের অধিকাংশ পক্ষই ১৯৬৭ সালের যুদ্ধ পূর্ববর্তী সীমানা নিয়ে দ্বি-রাষ্ট্রের ব্যাপারে একমত হয়েছেন। সদ্য শেষ হওয়া গাজা আগ্রাসনের পর দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানকেই সংকট সমাধানের একমাত্র উপায় বলে মন্তব্য করেছেন বাইডেন।

নতুন সরকার এই সমাধান গ্রহণ করলেই সংকট নিরসনের পথ সহজ হতো। এই পথে নাফতালি বেনেট কিংবা ইয়ার লাপিদ কেউ যাবেন না এটা বুঝতে পারা যায়। ফিলিস্তিনিদের সংগ্রাম চালু রাখা ব্যতীত আপাতত অন্য কোন পথ খোলা নেই।

নাফতালি বেনেট কি নেতানিয়াহুকে ছাড়িয়ে যাবেন?

নাফতালি বেনেট দম্ভভরেই বলেছিলেন, ‘আমি আমার জীবনে বহু আরব মেরেছি এবং এটাতে কোনো সমস্যা নেই।’

২০১৩ সালে ‘কানা গণহত্যা’- কে ইংগিত করে বেনেট এক বক্তব্যে এই উক্তি করেছিলেন। দক্ষিণ লেবাননের একটি গ্রামের নাম কানা। ১৯৯৬ সালে ইসরাইলি সেনাবাহিনীর একজন কমান্ডো হিসেবে তিনি এই হামলা পরিচালনায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এতে ১০৬ জন বেসামরিক লেবানিজ মারা গিয়েছিল। লেবানন প্রতি বছর এই গণহত্যায় নিহতদের স্মরণ করে থাকে।

নতুন সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর পরই জেরুজালেম অভিমুখে পদযাত্রার অনুমতি দিয়েছে। পতাকা হাতে ইহুদীরা এই পদযাত্রায় অংশ নিয়ে ফিলিস্তিনিদের উদ্দেশ্য উসকানিমূলক শ্লোগান দিয়েছে। ‘আরবদের মৃত্যু হোক’ এমন শ্লোগান উত্তেজনা ছড়াবে এটাই স্বাভাবিক।

জেরুজালেম অভিমুখে পদযাত্রার প্রতিবাদে ফিলিস্তিনিরাও বিভোক্ষ করছে। হামাস ও ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষও পদযাত্রা নিয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন।

১৯৬৭ সালে পূর্ব জেরুজালেম দখলের বার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষ্যে এই পদযাত্রা করে থাকে ইহুদিরা। এই ধরণের উসকানি মূলক কর্মকাণ্ড যে কোন সময় সহিংসতায় রূপ নিতে পারে।

সর্বশেষ খবর হল, ইসরাইল পুনরায় গাজায় বোমা বর্ষণ করেছে। ইসরাইলি ডিফেন্স ফোর্স (IDF) বলছে, গাজা থেকে ইসরাইলের দক্ষিণ অঞ্চলে আগ্নেয় বেলুন (Incendiary Ballon) উড়ানো হয়েছে। এর প্রতিবাদে তারা খান ইউনিস ও গাজা শহরের ঘাটিতে বিমান হামলা চালিয়েছে। ২১ মে যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পর এটাই প্রথম সংঘাত।

নাফতালি বেনেট এর মধ্য দিয়ে কঠিন বার্তাই দিলেন। তিনি ইরানের পরমাণু চুক্তি হতে না দেয়ার ব্যাপারেও দৃঢ় মত ব্যক্ত করেছেন। প্রধানমন্ত্রিত্ব পেতে না পেতেই বেনেট আগ্রাসী আচরণ প্রদর্শন করছেন। সামনের দিনে মধ্যপ্রাচ্য সংকট প্রশমিত হওয়ার কোনো লক্ষণ নেই।

বেনেট নিজেকে নেতানিয়াহুর চেয়ে ‘অধিকতর ডান’ মনে করেন। তিনি তার কর্মে নেতানিয়াহুকে ছাড়িয়ে গেলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। বেনেট তো ফিলিস্তিনি প্রতিটি শিশুকেও সন্ত্রাসী মনে করেন।

বেনেট-লাপিদ- নেতানিয়াহু বা অন্য কেউ যেই ইসরাইলের শাসনভার হাতে নিক তা ফিলিস্তিনিদের জন্য কোনো সুখের গান নিয়ে আসবে না। প্যালেস্টাইন সংকট নিয়ে আলোচনায় এই মোদ্দাকথাকে স্মরণ রাখতে হবে।

Advertisements