নির্ভরতা-বাড়ছে-অর্গানিক-পণ্যে
Advertisements

একটা সময় ছিল যখন দেশের প্রায় সব খাদ্যপণ্যই উৎপাদন হতো প্রাকৃতিক সুবিধাদি ব্যবহার করে। মাছ উৎপাদন হতো নদী বা পুকুরে, ধান-চাল, শাক-সবজি চাষ হতো বৃষ্টির পানি আর জৈব সার দিয়ে। গ্রামে ঘুরে ঘুরে সরিষা সংগ্রহ করে তা থেকে ঘানিতে হতো তেল, আর মুড়ি ভাজা হতো হাতে কোনো রকম সার ছাড়াই। নিজেদের উৎপাদিত ফসল থেকেই সংরক্ষণ হতো বীজ। অবশ্য তখন উৎপাদন হতো কম।

সময়ের বিবর্তনে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতাকে কাজে লাগিয়ে মানুষ খাদ্যপণ্যের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে অল্প জমিতে অধিক ফসল উৎপাদন প্রক্রিয়া গ্রহণ করে। শুরু হয় উচ্চ ও অধিক ফলনশীল বীজের ব্যবহার, বাজার থেকে কিনতে হয় এবং একবারই ব্যবহার করা যায়। জৈবসারের পরিবর্তে ব্যাপকভাবে ব্যবহার হয় ইউরিয়া, পটাশ, ফসফেটসহ বিভিন্ন রাসায়নিক সার। পোকা দমনে ব্যবহার হয় বিভিন্ন ধরনের কীটনাশক। এতে চাল, ডাল, শাক-সবজিসহ কৃষিজাত পণ্য উৎপাদন বেড়ে দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও বেড়েছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। নষ্ট হয়ে গেছে মাটি ও পরিবেশের গুণাগুণ। খাদ্য নিরাপত্তা বাড়লেও নিরাপদ খাদ্যে পিছিয়ে যায়। গত বছর খাদ্যে মাত্রাতিরিক্ত ক্ষতিকর পদার্থ পাওয়ায় ৫২টি পণ্য বাজার থেকে তুলে নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। এতে নিজেদের ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন ভোক্তারা। ফলে নিরাপদ খাদ্যের প্রয়োজনে বেড়েছে অর্গানিক পণ্যের চাহিদা।

বর্তমানে উচ্চ ও মধ্যবিত্তের অনেকেই দৈনন্দিন বাজারের প্রতিটি পণ্যই অর্গানিক কেনার চেষ্টা করছেন। ফলে দ্রুত বাড়ছে অর্গানিক পণ্যের বাজার। তবে চাহিদার সুযোগ নিয়ে অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান অর্গানিক নাম দিয়ে ভেজাল পণ্যও বিক্রি করছেন, যা এ বাজারের আস্থা নষ্ট করছে বলে মনে করেন উদ্যোক্তারা। অর্গানিকের সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা ও মান যাচাইয়ের ব্যবস্থা না থাকায় এমনটা হচ্ছে বলে তাঁরা মনে করেন। এ জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মানের পরীক্ষাগার গড়ে তোলার দাবি করছেন এ খাতের উদ্যোক্তারা। পাশাপাশি সরকারের তদারকির কথাও বলছেন তাঁরা।

অর্গানিক পণ্য কী?

অর্গানিক শব্দের বাংলা অর্থ জৈব। সাধারণভাবে অর্গানিক খাদ্য বলতে কোনো প্রকার রাসায়নিক বা কীটনাশক ব্যবহার ছাড়া উৎপাদিত পণ্যকে বোঝায়। এ ক্ষেত্রে আরো কিছু শর্ত পূরণ করতে হবে। জমিতে আগে রাসায়নিক ব্যবহার হলে তা মুক্ত করা, বীজ হতে হবে প্রাকৃতিকভাবে সংগৃহীত, বাজার থেকে কেনা হাইব্রিড বীজ নয়। উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাত থেকে শুরু করে বাজারজাতকরণ পর্যন্ত কোনো ধরনের রাসায়নিক ব্যবহার করা যাবে না ওই পণ্যে।

অর্গানিক লোগো

জানা যায়, ২০১৫ সালে বাংলাদেশ অ্যাগ্রিকালচারাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট (বারি) অর্গানিক পণ্য নিয়ে একটি গাইডলাইন তৈরি করে। গাইডলাইন অনুযায়ী পণ্য তৈরি করলে বারি থেকে অর্গানিক সনদ ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়। বারির সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা নাজিম উদ্দিন বলেন, ‘আমাদের গাইডলাইনে অর্গানিক পণ্যের প্রতিটি স্তরের ব্যবস্থাপনার আলাদা আলাদা করণীয় বলা হয়েছে। অনেকেই সে আলোকে পণ্য উৎপাদনও করছেন। যাঁরা করছেন তাঁদের আমরা একটি ‘অর্গানিক লোগো’ দিয়েছি যা, পণ্যে ব্যবহার করতে পারবে। এতে মানুষ বুঝবে এটি আসলেই অর্গানিক পণ্য। এটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ‘আইফম অর্গানিক’ এর আলোকে তৈরি করা হয়েছে।’

পরিবেশবান্ধব কৃষি

আন্তর্জাতিক অর্গানিক পণ্যের মান ও গাইডলাইন তদারকি প্রতিষ্ঠান আইফম অর্গানিক ইন্টারন্যাশনালের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, অর্গানিক কৃষি প্রচলিত কৃষিকাজের চেয়ে পরিবেশবান্ধব। এ ক্ষেত্রে ফসল ও প্রাণিসম্পদ উৎপাদনে কোনো প্রকার কীটনাশক, সার, জিনগতভাবে পরিবর্তিত জীব, অ্যান্টিবায়োটিক এবং গ্রোথ হরমোন ব্যবহার করা যাবে না। পণ্যের পুষ্টির প্রাকৃতিক উৎস যেমন কম্পোস্ট, ফসলের অবশিষ্টাংশ দিয়ে তৈরি সার ব্যবহার করতে হবে। এ ছাড়া শস্য এবং আগাছা নিয়ন্ত্রণের প্রাকৃতিক পদ্ধতি ব্যবহার করতে হবে। অর্গানিক পণ্য উৎপাদনে আইফমের চারটি মূলনীতি রয়েছে—স্বাস্থ্য, বাস্তুশাস্ত্র, ন্যায্যতা ও যত্ন।

কেন প্রয়োজন

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অধিক উৎপাদনের আশায় দেশে উচ্চ ফলনশীল হাইব্রিড ও জিএম শাক-সবজিসহ অন্যান্য ফসল ও ফলমূল উৎপাদনে ঝুঁকছেন কৃষক। এসব পদ্ধতিতে দফায় দফায় প্রয়োগ করা হয় বিষাক্ত কীটনাশক। আবার বাজারজাত করার আগে পাকানোর জন্য কার্বাইড ও পচন রোধে অতিমাত্রায় রাসায়নিক প্রয়োগ করা হচ্ছে। ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে শাক-সবজি ও ফলমূলে মেশানো হচ্ছে নানা বিষাক্ত পদার্থ, যা ওই সব খাদ্যের সঙ্গে মানবদেহে প্রবেশ করছে। এসব খাদ্য খেয়ে কমে যাচ্ছে জীবনী শক্তি ও আয়ুষ্কাল। সঙ্গে শরীরে বাসা বাঁধছে নানা রোগব্যাধি। ভয়ংকর এসব বিপদ থেকে রক্ষা পেতে প্রয়োজন অর্গানিক পণ্য।

মান যাচাই হচ্ছে না

আন্তর্জাতিক সংজ্ঞা, বারির গাইডলাইন থাকলেও দেশে অর্গানিক পণ্যের মান যাচাইয়ের কোনো ব্যবস্থা নেই। নেই কোনো তদারকির ব্যবস্থাও। জানতে চাইলে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউটের (বিএসটিআই) পরিচালক সাজ্জাদুল বারী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘অর্গানিক পণ্যের মান সনদ বা যাচাই-বাছাইয়ের জন্য আলাদাভাবে কোনো ব্যবস্থা নেই। এ বিষয়গুলো তদারকির দায়িত্বও আমাদের নয়। আমাদের আওতাধীন ১৮১টি বাধ্যতামূলক পণ্যের মান যাচাই করি।’ খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এ বিষয়ে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের কাছেও কোনো নীতিমালা নেই।

অর্গানিক স্ট্যান্ডার্ড বোর্ড

বাংলাদেশ সরকার অর্গানিক চাষাবাদ বাড়াতে ‘ন্যাশনাল অর্গানিক অ্যাগ্রিকালচার পলিসি-২০১৬’ বাস্তবায়ন ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে ‘ন্যাশনাল অর্গানিক স্ট্যান্ডার্ড বোর্ড’ গঠনের পরিকল্পনা নিয়েছে। ইতিমধ্যেই ‘অর্গানিক অ্যাগ্রিকালচার স্ট্যান্ডার্ড’ নামে একটি নীতিমালার খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। তার আগে ২০১৬ সালে মান ও নীতিমালা তৈরি করতে কৃষিসচিবকে সদস্যসচিব করে একটি জাতীয় কমিটি করা হয়। ১৩ সদস্যের কমিটিতে এই খাতের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অর্গানিক প্রডাক্ট ম্যানুফ্যাকচারার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি কামরুজ্জামান মৃধাও রয়েছেন। তিনি বলেন, ‘এই নীতিমালা পাস হলে এই খাতে শৃঙ্খলা আসবে বলে আমরা মনে করছি। মান যাচাই, সার্টিফিকেশন ও বাজার তদারকির ব্যবস্থা না থাকলে বিভিন্ন ব্যক্তিপ্রতিষ্ঠান অর্গানিক নাম দিয়ে পণ্য বিক্রির সুযোগ পাবে, যা এখন হচ্ছে। এ ছাড়া ভোক্তাও প্রতারিত হবেন। এসব বিবেচনায় এই নীতিমালা করার জন্য আমরা সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছিলাম। নীতিমালায় এই খাতের দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান, সনদ প্রদানের নিয়ম, আবেদনের নিয়ম, উৎপাদন নীতি, সিনথেটিকস ব্যবহারের নীতি ইত্যাদি সব কিছুই বিস্তারিত বলা হয়েছে।’

বড় হচ্ছে বাজার

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ছোট ছোট দোকান গড়ে তুলে সেখানে অর্গানিক পণ্য বিক্রি করা হচ্ছে। অনেকে ব্যক্তি উদ্যোগে খামারে অর্গানিক পণ্য উৎপাদন করছেন। গত দু-তিন বছরে কিছু কিছু বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে অর্গানিক পণ্য উৎপাদন ও বিপণনে। বাজারে এখন কাজী গ্রুপের চা, পুর্ণাভা নামের একটি প্রতিষ্ঠানের চাল, সুপারশপ মীনা বাজারে চাল, শাক-সবজিসহ আরো অনেক প্রতিষ্ঠানের পণ্য পাওয়া যায়। এ ছাড়া অনেক প্রতিষ্ঠান অর্গানিক ফার্টিলাইজার, পেস্টিসাইড, মুড়ি, মধু, ফল, সরিষার তেল, দই ইত্যাদি পণ্যও তৈরি করছে। তবে কতটি প্রতিষ্ঠান আছে এবং কী পরিমাণ পণ্য এই খাতে তৈরি হচ্ছে তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান তৈরি হয়নি। যদিও অর্গানিক পণ্য তৈরিকারী উদ্যোক্তাদের অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য ৫২টি প্রতিষ্ঠান।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এখনো অর্গানিক পণ্য বিশেষ করে শাক-সবজি ও কৃষিজাত পণ্য উৎপাদন হয় ব্যক্তি উদ্যোগে এবং সেগুলো খুব সীমিত। ফলে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করেই তাদের খরচ তুলতে হয়। এ ছাড়া এসব পণ্যের ক্রেতা সীমাবদ্ধ থাকছে উচ্চবিত্তদের মধ্যেই। মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্তের নাগালের বাইরেই থাকছে এসব পণ্য।

সূত্রঃ কালের কন্ঠ

Advertisements