‘দশ ট্রাক অস্ত্র’ মামলা নিয়ে এই আলোচনা, একটা একাদেমিক পর্যায়ের সমাজতাত্বিক আলোচনা। যেমন এর প্রসঙ্গ শুরু করব, একট রাষ্ট্রে কয়টা বিচার বিভাগ থাকে? এখান থেকে!এমন প্রশ্ন যে কোন একাদেমিক ব্যক্তিত্ব শুনলেই তিনি বলে উঠবেন এটা তো কোন প্রশ্নই হয় নাই। কারণ, জনগণ সব রাষ্ট্রক্ষমতার উতস -এমন রিপাবলিক বা জনপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্র তিনটা প্রধান অঙ্গ থাকে। (প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতির নেতৃত্বে) নির্বাহি বিভাগ, ২. আইন সভা বা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিত্বমূলক আইন প্রণয়নের সংসদ আর ৩. বিচার বিভাগ। রাষ্ট্রক্ষমতার মূল অংশ থাকে নির্বাহী বিভাগের হাতে; আর সাথে কিয়দংশ থাকে বাকি দুই বিভাগের কাছে। এখন এই বিচার বিভাগ নিয়ে বিস্তারে কথা তুললে বলতে হয় এর কাঠামোটা আবার সাধারণত পিরামিড ধরনের হয়। মানে সমান্তরাল না। নিম্ন আদালতের রায় ওর চেয়ে উচ্চ আদালতে পর্যালোচনা যোগ্য বা বদলে রিভিউয়ের ক্ষমতা রাখা হয়। আর সবার উপরে থাকে সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগ। সেটাও আবার কয় বিচারক মিলে বেঞ্চ গঠিত এবিচারে ফুল বেঞ্চ এর উপরে আর কিছু নাই। এভাবে!
যেহেতু যেকোন পর্যায়ের আদালতের রায় ওর উপরের আদালতের আবার পর্যালোচনাযোগ্য রাখা হয়; যার লক্ষ্য অনিচ্ছার ভুল বা অবিচার ঘটে যাবার সম্ভাবনা কমানো। এছাড়া বিচারক ভেদে একই ধরনের অপরাধে দুই ধরনের শাস্তি যেন না হয় তাই পেনাল কোড ব্যবহার করা হয় যেখানে অপরাধ ও শাস্তি দুটাই যতটা সম্ভব আগাম সংজ্ঞায়িত করে রাখা হয়; ইত্যাদি এসব খুটিনাটি অনেক দিকই আছে। এছাড়া নিম্ন আদালতকে সুপ্রীম কোর্টের ব্যবস্থাপনার অধীনে এবং নজরদারি-তদারকিতে রাখা হয়। এসবের কারণেই বিচার ব্যবস্থাটা পিরামিড কাঠামোর হয়ে যায়। এসব বিষয়ে আইনজ্ঞরা আরো ভাল ভাল দিক তুলে ধরতে পারবেন। এই হল একটা দেশের একক বিচার বিভাগ এবং তা পিরামিড কাঠামোর এমন বিচার বিভাগ।
যে কোন রিপাবলিক রাষ্ট্রেই মোটাদাগে উপরের এই ভাগেই রাষ্ট্রক্ষমতা বিন্যাস্ত থাকতে দেখা যায়। কিন্তু এবার একটা ব্যতিক্রমের কথা বলব। সেটা হল এতসব কিছুর পরেও প্রত্যেক রাষ্ট্রেই আবার সিভিল আদালতের বাইরে একটা করে সামরিক আদালত (Martial Court) থাকতে দেখা যায় যেখানে, মূলত প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যদের কাজ-ততপরতা ও শৃঙ্খলাভঙ্গের বিষয়গুলো বিচার (court Martial) করা হয়। এবং সবচেয়ে বড় কথা এটা ঐ দেশের রাষ্ট্রীয় সিভিল বিচার বিভাগের এক্তিয়ারের বাইরে রাখা হয়। অর্থাৎ সামরিক আদালতকে পিরামিড কাঠামোর সিভিল বিচার বিভাগের ভিতরে কোথাও রাখা হয় না। কেন?
মূল সংজ্ঞাটা সোজাঃ
আপনি যদি রাষ্ট্রীয় সিভিলিয়ান কর্মী হন তবে আপনি কোন সংজ্ঞায়িত অপরাধে জড়িয়ে পড়লে তা নিয়ে প্রথমে নিজ বিভাগের [জনপ্রশাসনের যে বিভাগের অধীনে কর্মচারি আপনি সেই বিভাগের জন্য গঠিত শৃঙ্খলা কমিটি] অধীনে বিচারের মুখোমুখি হতে হয় যেটাকে সংক্ষেপে অনেক মিডিয়া শুধু “বিভাগীয়” বিচার শাস্তি বলে লেখা হয়। এমনকি কিন্তু একইভাবে আপনি যদি কোন প্রতিরক্ষাবাহিনীর সদস্য হন অথবা ঘটনা বা অপরাধের বিষয়টা রাষ্ট্রীয় প্রতিরক্ষাবিষয়ক হয় সেক্ষেত্রে পুরা বিচার শাস্তির প্রক্রিয়াটাই সামরিক আদালতের এক্তিয়ারে সম্পন্ন করা হয়ে থাকে।
কিন্তু কেন?
একটা সোজ উদাহরণ দিয়ে বলা যাক। একজন সৈনিক রাষ্ট্রের সুরক্ষা-প্রতিরক্ষার কাজ করতে গিয়ে কাউকে খুন করে ফেলেছে। এখন এর বিচার কী সিভিল আদালত দেখবে?
একটা হাইপথিটিক্যাল বা কল্পিত ঘটনা- মামলা নেই। পদ্মা সেতু নির্মাণের সময় সেখানে [ধরা যাক] প্রচুর ভারতীয় র-বাহিনীর ট্রেইন লোক [যারা বাংলা বলতে পারে না, ভাঙ্গাবাংলা বা হিন্দিতেই কথা বলে] তবে যারা তথ্য সংগ্রহে পারদর্শী; এদের দিনে-রাতে এমন লোকেদের আনাগোনা ঐ এলাকায় বেড়েছে দেখা গেল! তাদের উদ্দেশ্য হল, ব্রীজ নির্মানের কনট্রাক্টর চীনা কোম্পানি এখানে আবার কী করতেছে এটা নিয়ে ইন্ডিয়ার কালো মনে সন্দেহ এর হাল করা। তাই ইন্ডিয়া রিস্ক নিয়ে হলেও এসব তথ্য সংগ্রহে পারদর্শী লোক পাঠিয়েছিল। বলাই বাহুল্য এমন ব্যক্তিদের বাংলাদেশে প্রবেশই বিরাট শাস্তিযোগ্য ও অবৈধ কাজ। এর উপর আবার মনে রাখতে হবে, আমাদের সরকার ঐ নির্মিয়মান সেতু অঞ্চল-এলাকাকে আগে থেকেই কী-পয়েন্ট ইন্সটলেশন [Key-point instalation বা কেপিআই] বলে ঘোষণা করে রেখেছিল। এই টার্মটার সংজ্ঞা হল রাষ্ট্র যেকোন নির্মাণ-স্থাপনা-কে নিজ রাষ্ট্রস্বার্থের জন্য প্রতিরক্ষা পর্যায়ের গুরুত্বপুর্ণ বলে গণ্য করেছে, এমন ঘোষণা করতে পারে। তাই কেপিআই এলাকা মানে হল যা সামরিক নিয়ন্ত্রণে পাহারা এলাকা হয়ে যাবে সেটা। যেমন আপনার কোন ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় প্রবেশ ও ততপরতা সীমিত করে দেয়া হয়। কেবল উপযুক্ত পরিচয় ও অনুমতি সাপেক্ষেই সেখানে প্রবেশ করা যায়। এককথায় ঐ এলাকাটাতে কোন বিদেশি অন্তর্ঘাতমূলক [subversive activity] কাজে বাধা ও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা। [subversive শব্দটা অপরিচিত শুনালেও এর অর্থ কঠিন কিছু নয়। sub মানে অধস্তন অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বকে অমান্য করা; নিচা বা খাটো-অধীনস্ত করে দেখা। আর এমনটা দেখে আমরা শঙ্কিত হই যে রাষ্ট্র ও জনগণের জন্য ক্ষতিকর যেকোন কাজে লিপ্ত হওয়া এখানে ঘটতে পারে। ইন্ডিয়ান ‘র’-এই প্রতিষ্ঠানটা বাই-ডেফিনেশন ইন্ডিয়ার বাইরে অন্তর্ঘাতমূলক [subversive activity] সংগঠিত করার জন্য প্রতিষ্ঠিত!
এখান আসেন ঐ পদ্মা সেতু কেপিআই এলাকায় র-বাহিনীর ট্রেইন লোককে সন্দেহজনক ততপরতা রোধ করতে গিয়ে আমাদের সেনাবাহিনী তাকে ধরা যাক হত্যা করে ফেলেছে। তাহলে এখন প্রশ্ন হল যেহেতু হত্যা মামলা তাহলে এটা নিয়ে কী আমাদের সিভিল আদালতে ৩০২ ধারায় মামলা রুজু করা হবে? করা যাবে? জবাব হল, কোন মতেই হবে না। যেতে পারে না। আবার প্রায় একই ধরনের ঘটনায় বাংলাদেশের সাথে কোন (কল্পনা করে বলছি) যুদ্ধে আমাদের সৈনিকেরা যদি প্রতিপক্ষের সৈন্য হত্যা করে ফেলে সেক্ষেত্রেও কী ঘটনাটা হত্যার যেহেতু তাই আমাদের সিভিল আদালতে আমাদের সেনাদের বিচার হবে? প্রশ্নই আসে না। এমন হলে আর রাষ্ট্র থাকার দরকার কী? আমাদেরই প্রতিরক্ষা বাহিনী আমাদেরি রাষ্ট্র সুরক্ষা করতে গেছে আর আমরাই সেজন্য তাঁকে আমাদের সিভিল আদালতের মুখোমুখি করবো?????? এটা ত মাথার দোষ থাকলেও কাউকে করতে দেয়া যাবে না!
কথা লম্বা না করে সারকথাটা বলে দেই। প্রথমত আমাদের দেশরক্ষা করতে গিয়ে আমাদের সেনাদের হাতে বিদেশি কেউ যদি আহত-নিহত হয় সেটা আমাদে সিভিল আদালতে তোলাই যাবে না। কারণ এক. ওরা বিদেশি এবং শত্রুপক্ষ বলে; মানে আমাদের দেশের নাগরিক নয় বলে। এমনকি আমাদের দেশে ভ্রমণে আসা বিদেশি ব্যক্তি আহত-নিহত হলেও আমাদের সিভিল আদালতে এর বিচার হবে; সেটা হলেও। কারণ এদুইটা একই ধরনের ঘটনা নয়। এককথায় বাংলাদেশের ভুখন্ডে যেকোন হত্যা অপরাধ হওয়া মানেই তা আমাদের সিভিল আদালতের বিচার্য বিষয় বা এক্তিয়ারে নাও আসতে পারে। কথাটা আরেক দিক থেকে বললে, ঘটনা যদি রাষ্ট্রের সুরক্ষা-প্রতিরক্ষাবিষয়ক হয় সেক্ষেত্রে যেমন, আমাদের একজন সৈনিক রাষ্ট্রের সুরক্ষা-প্রতিরক্ষার কাজ করতে গিয়ে কাউকে খুন করে ফেলে থাকে এটা সিভিল আদালতের এক্তিয়ারের বাইরের ঘটনা হবে। এনিয়ে যদি কিছু করতেই হবে সেটা সামরিক আদালত তাদের বিবেচনা ও এক্তিয়ার অনুসারে যা করার করবে।
এখানে প্রুডেন্ট একটা খুব গুরুত্বপুর্ণ ধারণাঃ
প্রুডেন্ট [Prudent] বা বাংলায় একে বিচক্ষণ বা দুরদর্শী বলতে পারি; এখন প্রুডেন্ট জাজ বা বিচক্ষণ বিচারক বলে বা [juris-prudence বলে যে উপ-সাবজেক্ট ডাক্তারদেরও পড়তে হয়] একটা কথা আছে। বিচক্ষণ জাজ বলতে মূলত যে বুকিশ [bookish] নয়; মানে বইয়ে পড়া কোন ধারণা পেলেই তা সাধারণ আক্কেলজ্ঞান বা বুদ্ধিবিবেচনা ছাড়াই যে প্রয়োগ করতে যায় না! যে আইন দেখলে বা জানলেই চোখ বন্ধ করে তা প্রয়োগ করে না অথবা যেকোন মামলা তার সামনে আনলেই তিনি তা বিচারে বসে যান না। তা না করে বরং এর সুদুর প্রসারি দিক অথবা পারিপাশ্বিক অন্যান্য বিষয়ও যিনি বিবেচনায় আনেন এরপর বিচারে বসেন তিনি প্রুডেন্ট জাজ। প্রুডেন্ট জাজ বুঝতে পারেন কোন মামলা তাঁর গ্রহণ করাই উচিত না।
এবার আসি ‘দশ ট্রাক অস্ত্র’ মামলায়ঃ
এবার আসি ‘দশ ট্রাক অস্ত্র’ মামলায়; সম্প্রতি (১৮ ডিসে. ২০২৪) ‘দশ ট্রাক অস্ত্র’ মামলা নিয়ে [ডেথ রেফারেন্স বিষয়ক] এক মামলার রায় প্রকাশিত হয়েছে। বলা যায় রাজনৈতিক প্রভাবিত হয়ে গত ১৬ বছর ধরে চলা বাংলাদেশের আদালত ব্যবস্থা চর্চা হাসিনা উতখাতের পরে এবারই প্রথম এনিয়ে প্রথম একটা রায় দিল। অনেকের সাজা কমানো হয়েছে, অনেককে খালাস ইত্যাদি দেয়া হয়েছে নতুন রায়ে। কিন্তই সেসব দিক এখানে আলোচনার বিষয়বস্তু নয়।
মূলত এখানে এটা একটা একাদেমিক আলোচনাঃ
হা ঠিক তাই, এটা একটা একাদেমিক আলোচনা। সুনির্দিষ্ট কোন মামলা নিয়ে নয়। তবে বাস্তবের উদাহরণ হিসাবে ‘দশ ট্রাক অস্ত্র’ মামলাকে সময়ে রেফারেন্স হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে। বলা যায় এটা একটা লিগাল-একাদেমিক [legal-academic] আলোচনা। আর অনুমান করি, ফরমাল আদালতে পেশ করা ডকুমেন্টে খুব সম্ভবত সেখানে চোরাচালান শব্দটা আছে। [আমি নিজে দেখিনাই ফলে আমি নিশ্চিত নই।] কোন কোন মিডিয়া রিপোর্টিংয়ে শব্দটা আছে এভাবে যে “দশ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালান” মামলা এটা। আসলে এটাই এই মামলায় সব রহস্যের গোড়া!
যেমন এর মানে কী, এটা চোরাচালানের অপরাধ? এভাবে চোরাচালান না বললে এটাকে অপ্রাধ বলা যাচ্ছে না তাই? – ‘দশ ট্রাক অস্ত্র’ মামলা – এটা কেন মামলা হতে পারল, এখানে অপরাধ টা কী? কেন সেটা অপরাধ – এটাই এই আলোচনার বিষয়বস্তু।
কী অপরাধ ঘটানোর জন্য এই মামলাঃ
প্রথম আলোর রিপোর্ট অনুসারে, “.….. ২০০৪ সালের ১ এপ্রিল সিইউএফএল ঘাট থেকে আটক করা হয় ১০ ট্রাক ভর্তি অস্ত্রের চালান। এ নিয়ে কর্ণফুলী থানায় ১৮৭৮ সালের অস্ত্র আইন ও ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে চোরাচালানের অভিযোগ এনে দুটি মামলা হয়। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) পুলিশ দুটি মামলা একসঙ্গে তদন্ত করে। এর বিচারও একসঙ্গে শুরু হয়। অস্ত্র আইনে করা অন্য মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ হয় একই আসামিদের।
সরকারী মামলা দেওয়ার ক্ষেত্রে সাথে বাড়তি ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের মামলা দেখা যাচ্ছে দেয়া হয়েছে তাহলে এর অর্থ হল, মামলাকারি সরকার পক্ষ নিশ্চিত হতে চাইছেন যে -মূল যে অভিযোগে মামলা – তা যদি কোন ত্রুটির কারণে প্রতিষ্ঠাই না করা যায় তবে তাতে যে আসামি খালাস হয়ে বের হয়ে না যায় তাই এই ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের মামলা সাথে দিয়ে রাখা হয়েছে বলে মনে করা হয়। অর্থাৎ যে মামলাটা দেয়া হয়েছে এর মূল অপরাধ হল, অস্ত্রের চোরাচালান। খোলাখুলি বললে অস্ত্রের চোরাচালানি মানে চোরাচালানি ব্যবসা বা ব্যবসার উদ্দেশ্যে চোরাচালানি পণ্য দশ ট্রাক ভর্তি অস্ত্রপাতিকে দেখা বা গ্রহণ করা এক জিনিষ; যেটাকে আমরা অস্ত্রের চোরাচালানি কাজ বলতে পারি। কিন্তু এটা আর ১৮৭৮ সালের অস্ত্র আইন – এদুইটা সামঞ্জস্য নাই। কারণ অস্ত্র আইন টা লেখা হয়েছে বা এটা ডিল করে ব্যক্তি বা কিছু ব্যক্তিবর্গ যদি অস্ত্র হেফাজতে রাখে, বহণ করে, কারও উপর ব্যবহার করে এবং সর্বোপরি সেই অস্ত্রগুলো যে বিনা লাইসেন্সের হয়ে থাকে। ১৮৭৮ সালের অস্ত্র আইন মোটামুটি এধরণের মামলাগুলোকে ডিল করার জন্য বানান।
দশ ট্রাক অস্ত্র মামলা আর ১৮৭৮ সালের অস্ত্র আইন এদুটোর মধ্যে মৌলিক ফারাক হল, প্রথমটা বাংলাদেশে বিক্রি, ব্যবহারের জন্য নয় তৃতীয় দেশে পাচার বা বিক্রির উদ্দেশ্যে। অর্থাৎ এখানে চোরাচালানি পণ্যটা কী সেটার চেয়ে এটা তৃতীয় দেশে চোরাচালানি – সেটাই মুখ্য। আর একটা দিক হল, এই অস্ত্র বাংলাদেশে বিক্রি বা ব্যবহার এর উদ্দেশ্য নয়। সোজাকথায় এই মোটিভ-গুলোই আসলে বলছে এই মামলা ১৮৭৮ সালের অস্ত্র আইন এর অপরাধ হিসাবে পড়ে বা সামলানো বা কাভার করার যায় এমন নয়। কারণ, অস্ত্রের চোরাচালান সামলানীর জন্য ১৮৭৮ সালের অস্ত্র আইন রচনা করা হয় নাই।
অস্ত্রের চোরাচালান সামলানীর জন্য ১৮৭৮ সালের অস্ত্র আইন রচনা করা হয় নাই।
এটা এই আইনি দুর্বলতার কথা, মামলাদাতা সরকার ও সরকারি লোকেরা জানতেন তা বুঝাই যায়। সেজন্যই কী চোরাচালান শব্দটা জুড়ে দিয়েছেন? কিন্তু দশ ট্রাক অস্ত্র মামলা কী শ্রেফ একটা চোরাচালানি মামলা?
এমনিতেই “চোরাচালানী রোধে” – সুনির্দিষ্ট করে অস্ত্রের চোরাচালিনী – এবং তাও আবার বাল্ক [bulk] মানে পাইকারি চোরাচালানির বিরুদ্ধে কোন আইনের কথা আমরা জানি না। সারকথায় দশ ট্রাক অস্ত্র মামলা ১৮৭৮ সালের অস্ত্র আইন দিয়ে কাভার করার দিক থেকে খুবই ছোট। কারণ, এটা পাড়ার একটা ছেলে কয়েকটা পিস্তল কিনে এসেছে বিদেশ থেকে তেমন ঘটনা বা মামলা নয়। আর এটা সরকার বা মামলাকারিদের কর্তাদের না জানার কথা না। তাহলে সমস্যাটা কোথায়???
কী ধরনের আইনি মামলা এটা তা সাব্যস্ত করতে মূল সমস্যাটা কোথায়ঃ
এটাই হল মূল রহস্য।দশ ট্রাক অস্ত্র মামলা – এটা মূলত রাষ্ট্রের সুরক্ষা-নিরাপত্তা [State Security] সংক্রান্ত মামলা। এটা সেসময়ের সরকার ও সরকারী কর্তারা সকলেই জানতেন। এটা বুঝতে পারা কঠিন কিছু নয় যে এই অস্ত্র আনার মোটিভ বাংলাদেশে এর বিতরণ একেবারেই নয়। বাংলাদেশের বাইরে কোন বিচ্ছিন্নতাবাদি রাজনৈতিক গোষ্ঠির হাতে পাঠানোর জন্যই তা আনা হয়েছিল। যেটা সরাসরি বাংলাদেশের রাষ্ট্রস্বার্থ, এর সুরক্ষা-নিরাপত্তা [State Security] হতে পারে এবং সেসুত্রে কিছুটা তা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সবমিলিয়ে এসব অর্থে রাষ্ট্রীয় প্রতিরক্ষা ইস্যু। অতএব এই মামলা বাংলাদেশের সিভিল আদালতে তোলার মত কোন মামলাই নয়। আর এনিয়ে যদি কোন ক্রিমিনাল অপরাধ হয়েছে বলে মনে হয় তবে সেটা আমাদের সামরিক আদালতই দেখবে আর সেটাই এর সঠিক এক্তিয়ার হত। অথচ ইন্ডিয়া হাসিনাকে ক্ষমতায় বসানোর গ্যারান্টার তাই পুরা মামলাটাকেই সিভিল আদালতে ফেলা হয়েছে। যাতে ইচ্ছা মত এটাতে মোচড় দেয়া যায়!
অথচ যেখানে এই মামলায় অপরাধ টা আসলে কী? এর সদুত্তর নাই।
অথচ যেখানে এই মামলায় অপরাধ টা আসলে কী? এর সদুত্তর নাই। রাষ্ট্র যেখানে নিজ রাষ্ট্রস্বার্থের প্রয়োজনে দেশের বাইরে আরেক স্থানে অস্ত্র পৌছে দিতে কী পারবে না??? এটাকে অপরাধ হিসাবে সিভিল আদালত দেখবে কোন এক্তিয়ারে? অস্ত্রের চোরাচালান মানে কী চারপাঁচটা পিস্তল নিয়ে এসে নিজ রাজধানী শহরে গুন্ডামি করতে দেয়া – এটা কী এমন কোন মামলা???
বাস্তবতা হল, পাকিস্তানের বেলুচিস্তানে বিচ্ছিন্নতাবাদি আন্দোলন আছে আর তাতে ইন্ডিয়া সহায়তা করে থাকে বহু যুগ থেকেই। পাকিস্তানও এর পালটা সেই পাকিস্তান আমল থেকে ভারতের নর্থ-ইস্টে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনগুলোকে সহায়তা দিয়ে থাকে! পাকিস্তানে চীনের [৪০ বিলিয়নের উপরে বিনিয়োগ] গোয়াদর প্রকল্প চলছে যার অনেক অংশ চালুও হয়ে গেছে। সেখানে চীনা উইঘুর সন্ত্রাসবাদীদেরকে দিয়ে প্রশ্রয় দিতে হামলা করিয়ে ১৩ জন চিনা ইঞ্জিনিয়ার মেরে ফেলা হয়েছে। যার পিছন থেকে সহায়তা করেছে আমেরিকা ও ইন্ডিয়া !!! এই হল অভিযোগ। সারকথায় পরস্পর শ্ত্রুদেশ পরস্পরের দেশের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠিওগুলোকে সহায়তা করার টিট ফত টেট ধরনের ততপরতা এগুলা।
এগুলো সিভিল আদালতে বিচার্য বিষয়ক মামলাই নয়ঃ
তাই মূলত এগুলো সিভিল আদালতে তুলে বিচার্য বিষয়ক মামলাই নয়। রাষ্ট্রস্বার্থে রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা-নিরাপত্তা [State Security] সংক্রান্ত ঘটনাবলী এগুলো। রাষ্ট্র সেকাজে কী নীতি নিবে তা সিভিল আদালতের এক্তিয়ার হতেই পারে না। এই গভীর বিবেচনা এতটুকু প্রুডেন্ট বিচারক তার মানে কী আমাদের নাই???? কারও এই পয়েন্টা মাথাতেই এলো না যে এগুলো কী সিভিল আদালতে তোলার মত মামলা??
ঠিক যেমন ইন্দির গান্ধীকে ১৯৭৫ সালে আমাদের পাহাড়ীদেরকে আমাদের সরকারের বিরুদ্ধে ট্রেনিং দিয়ে অস্ত্র হাতে বাংলাদেশে উস্কানি দেয় নাই। শেখ মুজিব মরার পরে কাদের সিদ্দিকীর বাহিনীকে ট্রেনিং-অস্ত্র দিয়ে ইন্দিরা কী বাংলাদেশে [subversive activity] তে আমাদের পাবলিক যাত্রী-রেলের পাতি তুলে নিতে পাঠায় নাই? তখন এই আদালত এর মুরুব্বিরা কোথায় ছিল? তার কিইবা করার ছিল? কী প্রতিকার করেছিল? তারা দেখে নাই শুনে নাই এসব ইতিহাস?
কাজেই আমাদের আবেদন আমাদের আদালত অন্তত একটু প্রুডেন্ট হোক, সেই চর্চায় আলোকপাত করুক!
আবার আরেকটা হতে পারে যেমন, পররাষ্ট্রনীতিতে যেমন ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ একমতের একটা চুক্তি করল, যে তারা একে অপরের দেশে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনকে সহায়তা কার করবে না। কিন্তু সেক্ষেত্রেও লক্ষ্যনীয় এটাও আদালতের ইস্যুই নয়।
কাজেই আদালত প্রুডেন্ট হলেই সেটা বাস্তবে মহামান্য আদালত হয়ে উঠতে পারে!!!
এসব বিবেচনা থেকে এসপ্তাহের রায়ে প্রকাশিত বিচার রিভিউটাতে যদি পুরা (দশ ট্রাক অস্ত্র মামলা) মামলাটাই খারিজ করে দিতে পারত তবে সেটা বোধহয় বুদ্ধিমানের কাজ হত। নইলে যেমন ধরেন, এধরণের কাজ তো ভবিষ্যতে আমাদের রাষ্ট্রস্বার্থে করতে হতেও পারে। তখন কী তেমন উতসাহী সাহসী সৈনিকদের কে কী আমরা পাবো??? এখন সেসব কাজের জন্য আমাদের সৈনিকদেরকে যদি সিভিল জেল খাটতে হয় এটা তো খারাপ উদাহরণ, আত্মঘাতি! সাহসী সৈনিক গড়তে কী কষ্ট তা আমাদের অনুমান করা কী কঠিন?? সেখানে আময়ার এক ডিসকারেজিং উদাহরণ রেখে দিচ্ছি!!! তাই না কী? এই মামলায় অনেক গোয়েন্দা বিভাগের সিনিয়ার অফিসারকেও জেল খাটতে হয়েছে। এটা কাউন্টার প্রডাকটিভ। যদিও এমন প্রধান অফিসারও আছেন যারা অর্থের বিনিময়ে বিক্রি হয়ে এই তথ্য সংশ্লিষ্ট দেশে পাচার করে হারাম-আয় করেছেন। সেটা যতটুকু সত্যি-মিথ্যা যাই হোক, এসবও দেখা সামরিক আদালতের এক্তিয়ার!
আমরা কী সবাই যার যার স্তরে একটু প্রুডেন্ট হতে পারিনা, পারবোনা কেন!! এই দেশটা তো আমাদেরই!