ডোনাল্ড ল্যু ও তাঁর সফরের পরে!
Advertisements

ডোনাল্ড ল্যু ঢাকা সফর শেষে চলে যাবার পরে আমাদের সমাজের প্রায় সব কোণে বিস্তর আলাপ ও পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা শুরু হয়েছে এই বলে যে হলো-টা কী বা ব্যাপারটা কোথায় দাঁড়ালো – এধরণের! তবুও এটা এখন কমবেশি পরিস্কার – যেটা সোজাসাপ্টা বললে, ডোনাল্ড ল্যু কিছুটা পিছু হটাছেন অথবা এক দিশা হারানো বাইডেন প্রশাসনের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। এবং সেই অনুসারে তাদের এখনকার অবস্থানই যেন জানাতে এসেছিলেন। তারা যে তাদের আগের অবস্থান থেকে অন্তত কিছুটা সরে গেছেন সেই পিছু হটা অবস্থান অনুসারে বাকি সবকিছু এডজাস্ট করে নিতে বা সে অনুযায়ী একটু ঢেলে সাজিয়ে নিতে এসেছিলেন তিনি। যদিও মনে রাখতে হবে এই “পিছু হটা’ – এটা সাময়িক হতে বাধ্য! আমার বিচারে এটা স্থায়ী অবস্থা হবে না, বরং সাময়িক হতে বাধ্য। মানে বলতে চাচ্ছি ল্যু ও তাঁর ভাই-বেরাদরেরা তাদের এই পিছু হটা অবস্থানও ধরে রাখতে ব্যর্থ হবে; ফলে আবার আগের জায়গায় যেতে তাদের চেষ্টা করতে হবে! এজন্যই এটাকে ‘সাময়িক’ বলছি। কিন্তু এখন অবশ্যই এটা কিছুটা হলেও পিছু হটা !

কথাটা সম্ভবত আরেকভাবে বলা যায়। যদি অনুমান করে নেয়া যায়, বাইডেন প্রশাসনের ভিতরে দুটা ধারা আছে বা হয়ে গেছে। যার একটা ধারা যেটাকে আমরা এতদিন একমাত্র জ্ঞান করেই এসেছি সেটা হলঃ বাইডেন প্রশাসন ‘মানবাধিকার-স্যাংশন’ এই অস্ত্র নিয়ে এগিয়ে যেতে আর এভাবেই এশিয়ায় চীনবিরোধি আমেরিকান স্বার্থগুলো ভাল আদায় হবে বলে এতদিন মনে করে এসেছে এরা। এই ধারারই বাংলাদেশে সর্বশেষ পদক্ষেপ হল রাষ্ট্রদুত পিটার হাসের গুম-খুন-অপহরণ-গায়েবের যেসব ভিকটিম আছে তাদের সাথে দেখা করার প্রোগ্রামে শাহীনবাগে যাওয়া। আর তা থেকেই হাসিনা সরকারের সাথে আমেরিকার সম্পর্ক সরাসরি কিছুটা সংঘাতময় হয়ে উঠতে শুরু করেছিল।

অন্যদিকে, প্রশাসনের দ্বিতীয় ধারাকে চিনাতে বলা যায়, এরা মনে করে “মানবাধিকার ও স্যাংশন” এর কথা তুলে হাসিনা সরকারের উতখাতের ঝামেলায় যাবার দরকার নাই। অন্যভাবেই তাদের উদ্দেশ্য সাধিত হতে পারে…।

সেক্ষেত্রে তাহলে জানতে হবে বা শুরু করতে হবে যে তাহলে বাইডেনের মূল উদ্দেশ্য কী ছিল? এখান থেকে শুরু করতে হবে। কিন্তু এমন চিন্তা করা বা পিছু হটার কথা সহজেই বলতে পারছে কেন? আর কীইবা সেই উদ্দদেশ্য??

বাইডেন প্রশাসনের আসল উদ্দেশ্য বাংলাদেশে “মানবাধিকার লঙ্ঘন বন্ধ করা’ একেবারেই নয়। বরং সে জায়গায় তাদের মূল উদ্দেশ্য ‘বার্মা দখল’! কিন্তু সেক্ষেত্রে ‘বার্মা দখল’ করতে চাইলে হাসিনা উতখাতের দায় সাথে নিয়ে আগানো কেন? সেকথায় পরে আসছি।

আসলে প্রথম ধারার পথে চলতে গিয়ে এটা এখন অনুমানে বলাই যায় যে বাইডেনের আমেরিকার নিজ ‘বাংলাদেশ স্ট্রাটেজি” ধরে আগাতে গিয়ে এমনভাবে হাসিনা সরকারের সাথে মুখোমুখি সংঘাতে জড়িয়ে যাবে এটা তাদের কল্পনায় ছিল না। আগের দিনের মত সবই চুপচাপ পাড়িয়ে যেতে পারবে! কারণ, বিগত ১৯৪৫ সাল থেকে আমেরিকা গ্লোবাল নেতৃত্বে আসীন হবার পর থেকে প্রায় ৭৮ বছর হতে চলল – সেই অভ্যাস মতে আমাদের মত দেশের উপর আমেরিকান প্রভাবে তারা যা করতে চেয়েছে মোটামুটি তাই হয়েছে ও পেয়েছে।

কিন্তু বারে বারে বলেছি এটা “পালা-বদলের কাল” যখন আমেরিকাকে চীনা চ্যালেঞ্জ ও প্রতিযোগিতায় মোকাবিলা করতে হবেই ও হচ্ছে। পালা-বদল” মানে যেটা গ্লোবাল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নেতৃত্ব বদলের এটা সময়কাল। যেটাকে অনেকেই বুঝতে ও ব্যাখ্যা করতে পারে না অক্ষম বলে তারা তাদের চিন্তার অসক্ষমতা, দুর্বলতা ঢাকতে “ভূরাজনীতিক” বলে একটা আবছা অর্থহীন শব্দ ব্যবহার করে নিজের অস্পষ্ট চিন্তার প্রকাশ ঘটায়ে থাকে। এই পালাবদলে “ভূ-” বা কোন দেশের বিশেষ “ভৌগলিক অবস্থানের” জন্য এসব ঘটছে তা একেবারেই নয়; তা ভাবার কোন সুযোগও নাই। ভুরাজনীতি শব্দটার ব্যবহার ও আবির্ভাব প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মাঝের সময়ে তবে এর শেষের দিকে। এবং সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ হল ১৯৪৪-৫ সালে জাতিসংঘ এবং আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের জন্ম ও উত্থান ঘটে যাবার পরে মানে এই তিন গ্লোবাল প্রতিষ্ঠানের জন্ম ও উদিত প্রভাবের পরে ‘ভুরাজনীতি’ শব্দটা সেবার হারিয়েই যায়। এর মূল কারণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কীভাবে শেষ হবে, কেন আমেরিকা এর একছত্র নেতা হিশাবে উঠে আসবে আর এই তিন গ্লোবাল প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রিক নয়া এক গ্লোবাল অর্ডার [new Global Order] বা বিশ্বব্যবস্থার শৃঙ্খলা চালু হবে সেটা কোন দেশেরই বিশেষ “ভৌগলিক অবস্থানের” কারণে-পরিণতিতে এমনটা ঘটে নাই। সে জন্য যারাই এই তিন প্রতিষ্ঠানের উত্থান ও এদের সেকাল থেকে নয়া ভুমিকা ও তাতপর্য ব্যাখ্যা করতে অপারগ তারাই geo- বা ভ্যু- বলে একটা পরাজিত ধারণাকে ধুয়ে মুছে আবার একালে খাড়া করে নিজেদের অকর্মণ্যতা আড়াল করে থাকে।

তবে এখন যেটাকে পালাবদল বলছি এতেও এমন অনুমান ভুল হবে যে, এতে আমেরিকা যেভাবে সেকালে গ্লোবাল নেতা হয়েছিল চীনও একইভাবে একই ধরণের নেতা হবে। এই অনুমান অতি সরলিকরণও হবে। তাই সাবধান থাকতে হবে। তবে জাতিসংঘ এবং আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক কেন্দ্রিক যে বিশ্ব ব্যবস্থা তখন জন্ম নিয়েছিল ও এখনও ধুকে হলেও চলছে – এখন পালাবদলে যেটা কেবল আমেরিকার জায়গায় চীনা নেতৃত্ব হয়ে যাবে এমনটা হল এক কপি-পেস্ট ধারণা। দুনিয়ায় কোন ঘটনাই একই রকমভাবে দ্বিতীয়বার ঘটে না। যদিও জাতিসংঘ এবং আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক প্রতিষ্ঠানগুলো হয়ত আবার পুনর্গঠিত হবেই।

আবার, এসব পালাবদল প্রসঙ্গে খোদ আমেরিকানদের কোন স্টাডি নাই বা ফেনোমেনাটা জানা নাই তা একেবারেই নয়। তবু তারা যেন নানার আমলে খাঁটি ঘি খাবার অভ্যাসে এখনও সহজেই আগের মতই তুড়ি বাজানোর চেষ্টা করে ও ফেল মারতে থাকবে। কারণ পরিস্থিতি যে আর আগের মত একই রকম নাই তাই তারা সময়ে ভুলে যায়। আর বার বার পরাজিত হয়। এধরণের উদাহরণের অভাব নাই। যেমন ২০১২ সালে বাংলাদেশের একটা ঘটনা। সে সময় আমেরিকা-বিশ্বব্যাংকের আগ্রহে তারা হাসিনার বিরুদ্ধে পদ্মা সেতু দুর্নীতি মামলা। এই দুর্নীতির মামলা সত্যি হোক বা না হোক, এটা মনে করা ভুল হবে না যে এমন মামলা করার পিছনের তাদের অপর উদ্দেশ্যের দিক ছিল। সম্ভবত তা হল, যাতে আরো ভাল করে আমেরিকার অধীনস্ততায় আনা যায় যাতে হাসিনা আরো অনুগত হয়। কিন্তু সবচেয়ে বড় আমেরিকান বেকুবিটা হল দুর্নীতি মামলাটা যখন আনলই তখন কয়েক বছর পরেই আবার শেষে আদালত থেকে ঐ মামলাটাই বিশ্বব্যাংক প্রত্যাহার করে নিয়েছিল কেন? অথচ তাতে আমেরিকার গ্লোবাল নেতৃত্ব নয়া এক হারুপার্টিতে পরিণতি পেল! সেটা কিভাবে?

বিশ্বব্যাংক মানে হল নানান অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্পে কম সুদে যে ঋণদাতা – তা ছোট বড় সব প্রকল্পে সে এমন ঋণ দিয়ে থাকে। আর এথেকেই “পড়ে পাওয়া বাড়তি চার আনার মত ঘটনাটা হল – আমাদের মত দেশের উপর আমেরিকার প্রভাব বেড়ে যাওয়া।
তাহলে দুর্নীতির মামলা এনে পরে পিছু হটে যাওয়ার আমেরিকানদের পরিণতি কী হয়েছিল? হয়েছিল এই যে নয়া ঋণদাতা উতস হিশাবে ‘অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্পে ঋণদাতা’ হতে অপেক্ষা করছিল চীন বা প্রতিদ্বন্দ্বি হতে চেয়ে অপেক্ষা করা চীন এই ফাঁকে সে বাংলাদেশে প্রবেশ ও নিজের হাজিরা নিশ্চিত করে ফেলেছিল। যেটা এরপর হাসিনার চীন-সফর আর পরে ২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট সি জিনপিংয়ের ঢাকা সফর শেষে ২০ বিলিয়ন ডলারের অধিক (যেটা পরে ঠেকেছিল ২৬ বিলিয়নে) প্রকল্পের বন্যা বাংলাদেশে বয়ে গেছিল।

তাহলে চীনকে অবকাঠামো ঋণদাতা হয়ে বাংলাদেশে ঢুকতে রাস্তা করে দিয়েছিল কে??? এটাই আমেরিকান বেকুবি!! অথচ ঋণদাতা মানেই ওর ঋণগ্রহিতা দেশের উপর দাতার প্রভাব হাজির হওয়া বা বেড়ে যাওয়া। অনেকে আমাদের মত দেশের উপর আমেরিকার প্রভাব বলতে পরাশক্তির ‘সামরিক ক্ষমতা’ বলে বুঝে থাকে। এটা ভুল মিথ্যা। গ্লোবাল নেতা দেশের প্রভাব-আধিপত্য বলতে সেটা প্রধাণত নেতা দেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা, মানে যেমন তার ব্যাপক ‘ঋণদানের সক্ষমতা’ একেই বুঝায়। তাহলে দাড়ালো যে আমেরিকা সেই বার নিজের পায়ে কুড়াল মেরেছিল আর তাতে চীন উত্থান বা চীনা প্রভাব কমানোর বদলে তা বাড়িয়ে দিয়েছিল। সম্ভবত এবারও দ্বিতীয়বারও এমন কিছু একটা ঘটতে পারে সে ইঙ্গিত ফুটে উঠছে!!

এবার বাইডেন প্রশাসন শপথ নিবার পর থেকে আমরা দেখছি তিনি আরেক “বাংলাদেশ প্রকল্প” খুলতে চাচ্ছেন – যেটাকে আমরা “মানবাধিকার ও স্যাংশন” প্রকল্প বলে চিনাতে পারি। বাংলাদেশের মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘণ অবস্থায় উঠেছে এব্যাপারে সন্দেহ নাই। কিন্তু প্রশ্ন হল বাইডেন কী আসলেই বাংলাদেশের মানবাধিকার চরম লঙ্ঘণ নিয়ে উদ্বিঘ্ন? মিন করেন? ঠিক তাই বুঝাতে চান???

না একেবারেই না। তা সরাসরিই বলা যায়। যেমন এবার বাংলাদেশের বা হাসিনার দুর্নীতি নিয়ে কথা বলার পিছনে আমেরিকার দ্বিতীয় বা সেকেন্ডারি উদ্দেশ্যটা কী সেদিকে মনোযোগ দেই। বাইডেনের আরেক উদ্দেশ্য বা মুল উদ্দেশ্য ছিল ও এখনও আছে – তা হল ‘বার্মা দখল”। এটাই তার মুখ্য উদ্দেশ্য। কিন্তু এটাকে পরোক্ষে বা পিছনে লুকিয়ে রেখে বাইরের প্রকাশ্য উদ্দেশ্যটা বাইডেন মিথ্যা করে জানিয়ে চলছিলেন যে বাংলাদেশের হাসিনার মানবাধিকার লঙ্ঘণের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া তার প্রধান উদ্দেশ্য। আবার হাসিনার গুম-খুন-অপহরণ উঠায়ে নেয়া- ক্রসফায়ার ইত্যাদিতে মহামারি লাগিয়ে দেয়া এগুলোও বাস্তব ও সত্য। অর্থাৎ বাইডেনের “মানবাধিকার ও স্যাংশন” প্রকল্প তো বাস্তবতার উপরেই দাঁড়ানো। হা অবশ্যই তাও সত্য । কিন্তু যদি প্রশ্ন করেন গত পনেরো বছরের যেগুলো হাসিনা গুম-খুনের মহামারি হয়ে চলছিল তা তো আমেরিকা অজানা ছিল না। তবুও তখন কোন আমেরিকান প্রশাসন এদিকে মনোযোগ দেয় নাই – আসে নাই বা “মানবাধিকার ও স্যাংশন” নিয়ে তাদের কোন কথা ছিল না কেন? যেটা আসলে অন্ধ ও নিশ্চুপ হয়ে পরোক্ষে হাসিনাকে সমর্থন দেয়া – তা করে গেছিল কেন? এর জবাব মিলে না! কবি নীরব এখানে!

এর জবাব হল, ডোনাল্ড ল্যু যতই বলুক যে আমেরিকার ফার্স্ট এমেন্ডমেন্টে [1st amendment of US constitution, 1791] যে পাঁচ মৌলিক অধিকারের কথা দেয়া বা বলা আছে এনিয়ে আমেরিকা দেশে দেশে কথা বলবেই – সেকথা সবটা সত্যি না। সত্যিটা হল, ঐ পাঁচ মৌলিক মানবাধিকারের লঙ্ঘণ হলেই হবে না সাথে ঐ লঙ্ঘণের বিরুদ্ধে তখনই প্রশাসন কিছু বলবার পক্ষ নিবে যখন আমেরিকান রাষ্ট্র নিজের গভীর স্বার্থ ওর মধ্যে দেখবে বা থাকতে হবে তবেই আমেরিকা আগাবে এবং “মানবাধিকার ও স্যাংশন”এর সাইনবোর্ড টাঙিয়ে আগাবে। আর আমেরিকান রাষ্ট্রের গভীর স্বার্থগুলোকে আড়ালে ও পরোক্ষে রেখে দিবে। তাহল বাংলাদেশেও হাসিনার বিরুদ্ধে “মানবাধিকার ও স্যাংশন”এর সাইনবোর্ড নিয়ে এগিয়ে আসার পিছনের আমেরিকান গভীর স্বার্থটা কী?

গোড়ার স্বার্থ আমেরিকা চায় ‘বার্মা দখল’ করতেঃ
হা, আমেরিকা চায় ‘বার্মা দখল’ করতে আর এটাই তার গোড়ার গভীর স্বার্থ। কিন্তু তাতে বাংলাদেশকে জড়ানো কেন? বা হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার বাসনা পর্যন্ত উঁকি মারা কেন? কী দরকারে?

আমেরিকার বার্মা দখলের বাসনা বলতে এমনকি আবার সেটাও ঠিক যে এটা শুধু- সু চিকে মুক্ত করা বা বার্মিজ জেনারেলদের উতখাত ও শায়েস্তা করা নয়। এগুলো পরোক্ষ উদ্দেশ্য। আর মুখ্য বা প্রধান উদ্দেশ্য হল এশিয়াতেই চীনবিরোধীতা [কোয়াড বা ইন্দো-প্যাসেফিক স্ট্রাটেজির খাড়া করার মতই তবে আরেকটা পদক্ষেপ] ও চীনকে চ্যলেঞ্জ করে নয়া কল্পিত হবু বার্মায় আমেরিকান উপস্থিতি ঘটিয়ে দেখানো।

কিন্তু বার্মা দখল মানে তো নুন্যতম একটা সেনা সমাবেশ ঘটানোর ব্যাপার। হা তাই। তবে দখল কাজটা কম পয়সা খরচে, নিজ সেনা কম করে জড়িয়ে ও আয়েসে এই দখল ঘটাতে গেলে আমেরিকান স্টাইলটা হল, নিজ দেশের “এরিয়াল সাপোর্ট”[aerial support] দেয়া আর এই ছায়ায় সম্ভাব্য কোন দেশের (বাংলাদেশের!) একটা পদাতিক বাহিনী মার্চ করিয়ে বার্মা দখল নেয়া। তাই হাসিনাকে সরানো দরকার – এইছিল এতদিনের বাইডেনের গৃহিত লাইন এবং মূল স্বার্থ। কারণ তাহলে সহজেই বাংলাদেশের অন্তর্বর্তিকালীন সময়ের পদাতিক বাহিনীকে দিয়ে বার্মা দখল সহজ! যেটা “মানবাধিকার ও স্যাংশন” এর কথা তুলে বাইডেন সেরে ফেলতে চেয়েছিল।

এরিয়াল সাপোর্ট মানে কী?
আরেক ভাষায় বললে এর অর্থ বার্মার নিজের আকাশ সীমানার উপর আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা আরোপ। সেটা এই বলে যে, বার্মিজ বিমান বাহিনী যেন কোন উড়া-নড়াচড়া না করতে পারে এই মর্মে বার্মিজ বিমান বাহিনীর উপর এক ‘নো ফ্লাই জোন’ ঘোষণা করে দেয়া। সেটা আবার কী? মানে হল, বার্মার আকাশ-সীমার উপর আমেরিকার ‘নো ফ্লাই জোন’ঘোষণা বা দাবি জানিয়ে দেয়া। আর তাতে এরপরে বার্মীজ কোন আকাশযান মানে কোন সামরিক-এয়ারফোর্স সক্ষমতা যাই থাক – বার্মার কোন হেলিকপ্টার বা যুদ্ধবিমান বার্মার নিজ আকাশের উপর দিয়ে উড়তে চাইলেও সেই বিমানের উপর আমেরিকান কোন জেট সেটার উপর বোমা ফেলে গুড়িয়ে দিবে এই হুশিয়ারি আগাম দিয়ে রাখা।

এতে সুবিধা হল, যেহেতু বিমান সক্ষমতা বার্মার থাকলেও সে ব্যবহার করতে পারবে না বা করলে তা মোকাবিলা করবে কোন আমেরিকান জেট ফলে সেই আড়ালে একেবারে সহজেই কেবল একটা পদাতিক বাহিনী মার্চ করিয়ে বার্মা দখল করে নেয়া সহজ। এই কারণে “বাংলাদেশের পদাতিক বাহিনীই” বাইডেনের আকাঙ্খা ও মূল কাম্য এবং টার্গেট। আর সে প্রয়োজনেই মূলত হাসিনার অপসারণ বা না-অপসারণের ‘এদুই লাইনের’ মাঝে দোল খাচ্ছে বাইডেন প্রশাসন।

আর বরং হাসিনাই যদি বাইডেনের বার্মা দখল আকাঙ্খায় পদাতিক বাহিনী সরবরাহকারি হিশাবে সামিল হতে রাজি হয়ে যায়??? এরাই হল সেকেন্ড অপিনিয়নধারী!!!! বা দ্বিতীয় ধারা! কিন্তু “মানবাধিকার ও স্যাংশন”এর সাইনবোর্ড টাঙিয়ে এর আড়ালে তো বাইডেন ভালই আগাচ্ছিল, এখন নয়া এপথের উত্থান হল কেন? দুইটা কারণে।

কী সেই দুই কারণঃ

এক. মূলত বার্মা দখলের আমেরিকার এই আকাঙ্খাটাই অবাস্তব। মনে হচ্ছে এনিয়ে যথেষ্ট হোমওয়ার্ক আগে করে নেওয়ার দিক থেকে আমেরিকার ঘাটতি আছে! যেমন যেটা আমেরিকার প্রাথমিক অনুমান যে সরাসরি “বার্মা দখল” এই ভাষায় না বলে ‘আরাকান ভুখন্ড’ দখল করে বাংলাদেশকে দিয়ে দেয়া – এমন মানে জুড়ে দিয়ে কথাটা তারা বাংলাদেশকে বলতে চেয়েছিল। মনে করেছিল – এভাবে বললে নিশ্চয় বাংলাদেশ খুব খুশি হয়ে সামিল হতে চাইবে! বা পদাতিক বাহিনী নিয়ে সামিল হবে!!! সেই কূটচাল এই হাসিনাই বহু আগেই (২০১৯ সালেই) প্রত্যাখান করে দিয়েছিলেন খুবই সঠিক ও কঠোর ভাষায়।

কারণ কোন দেশের ভুখন্ড আমেরিকা অপর দেশের সাথে জুড়ে দিবার ক্ষেত্রে কে?? কেউই নয়! আমেরিকার কোন এক্তিয়ারই নাই। কোন দেশই একাজ করতে পারে না, ক্ষমতা রাখে না। জাতিসংঘের চোখে এটা গর্হিত ও অপরাধ্মূলক কাজ।

একারণেই বার্মার ক্ষমতাসীন জেনারেলদেরকে ক্ষমতাচ্যুত করার আড়ালে আমেরিকা আমাদেরকে বলতে চায় এতে আমাদের রোহিঙ্গা সমস্যা মিটিবে বলে আমেরিকার ধারণা আমরা খুশি হব এতে। অথচ এই অনুমান ভিত্তিহীন। যদিও ২০১৯ সালে হাসিনার এই আমেরিকান প্রস্তাব প্রত্যাখানের ক্ষেত্রে মুল চালিকা ছিল চীনের এব্যাপারে আমাদের সাহায্য চাওয়া; শুধু তাই না ভারতও আমেরিকার এই খায়েশের বিরুদ্ধে ছিল। ওদিকে আমেরিকানদের ধারনা তারা বার্মার দখল নিয়ে কোন এক পছন্দের জেনারেলকে বা সুচি-কে বসিয়ে নয়া বার্মা সরকার চালু করতে পারলে সেটা এক প্রো-আমেরিকান পুতুল সরকারই হবে! কিন্তু বলাই বাহুল্য ঠিক এই দিকটার কারণের ভারত ও চীন ঘোরতরভাবেই এই ইস্যুতে আমেরিকার চরমবিরোধী অবস্থান নিয়েছিল। বার্মাদেশের সাথে চীন ও ভারতের লম্বা সীমান্ত আছে তাই এদুই দেশ কিছুতেই বার্মায় এক প্রো-আমেরিকান পুতুল সরকার দেখতে চাইতে পারে না। এটাই স্বাভাবিক!

শুধু তাই না বাইডেন এমন এক সময়য়ে তার বার্মা দখলের খায়েশের পিছনে ছুটছে যখন আমেরিকান এই খায়েসের বিরুদ্ধে শুধু চীন-ভারতই না রাশিয়াও (ইউক্রেন যুদ্ধের পুটভুমিতে) খুবই সবল বিরোধীতা করতে আসবে। গত ২০১৯ সালের দিকে পরিস্থিতি ছিল একরকম কিন্তু এখনকার পটভুমিতে আমেরিকান নো ফ্লাই ছত্রছায়ায় যেকোন দেশের পদাতিক বাহিনী সীমানা অতিক্রম করে বার্মায় প্রবেশ মানে সেটা এক তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের মত যুদ্ধের ঘটনার সম্ভাবনা তৈরি হবে; বলে আমেরিকা এতই প্রবল প্রতিরোধের সম্মুখীন হবে।
মানে হল, আমেরিকার বার্মা দখলের উদ্দেশ্য হল চীনকে দুর্বল করা, চীনের ঘাড়ের উপর নিশ্বাস ফেলা মত কাজ। অথচ এখন এই আকাঙ্খা বাস্তবায়নের চেষ্টা করা মাত্রই চীন দুর্বল হবার পরিবর্তে উলটা আমেরিকার তিন শত্রুদেশ (চীন-ভারত-রাশিয়া) একজোট হয়ে যাবে। একেবারে হিতে-বিপরীত অবস্থা। একারণের পিটার হাসের শাহীনবাগ ততপরতায় কিছুটা বাধা পেয়ে আমেরিকান প্রশাসন আভ্যন্তরীণ রিভিউয়ে বসলে সেই উসিলায় প্রশাসনের এসব দুর্বলতার দিক সামনে চলে এসেছিল বলে অনুমান করা যায়। আর তাতেই এই ডামাডোলে দ্বিতীয় ধারা যারা হাসিনাকে “মানবাধিকার ও স্যাংশন”এর সাইনবোর্ড টাঙিয়ে অপসারণের পক্ষে কাজ করতে চায় না – এই ধারা উপরে উঠে বা সামনে চলে আসে।

পরে তাদের প্রস্তাব হল, তাহলে বাইডেনের এক প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা আইলিন লা বাকারকে [Director for South Asia Rear Admiral Eileen Laubacher] পাঠানো। উদ্দেশ্য খোদ হাসিনাকেই বার্মা দখল প্রোগ্রামে সামিল করা বিনিময়ে তার ক্ষমতাচ্যুতির প্রসঙ্গ চাপা দিয়ে রাখা হবে – এই প্রস্তাব কতটা কার্যকর করা যায় তা দেখতে।

আদর্শ উদাহরণ মাইকেল কুগেলম্যানঃ
এই প্রসঙ্গে আগ্রহিরা কুগেলম্যানের লেখা ও আরেক সাক্ষাতকার পড়ে দেখতে পারেন। মাইকেল কুগেলম্যান [Michael Kugelman] হচ্ছেন মূলত এক থিঙ্কট্যাঙ্ক উইলসন সেন্টারের [WILSON Centre] ফেলো। তিনি এই প্রতিষ্ঠানের সাউথ এশিয়ান ডিরেক্টর। কিন্তু অন্য থিঙ্কট্যাঙ্কের চেয়ে এই সেন্টারের ফারাক হল এই প্রতিষ্ঠানটা সেমি-গভর্মেন্ট। মানে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ফান্ড সরকারের দেয়া। এমনকি ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্টের অনেক কথা বলার সুযোগ বা পছন্দ প্রকাশের সুযোগ আছে। ফলে কুগেলম্যান-কে নিয়োগ দেয়া হয়েছে বাইডেন ক্ষমতাসীন হবার পরে পরেই; আর তা এই চিন্তা করে যে কুগেলম্যান সাউথ এশিয়ান রাজনৈতিক পরিস্থিতি বাইডেনের চোখের দেখে তাঁর অবজারভেশন ফরেন পলিসি [Foreign Policy] পত্রিকায় নিয়মিত লিখবেন। যা বাইডেন প্রশাসনের জন্য হবে এক ভাল ফিডব্যাক। এককথায় কুগেলম্যান অনেক বেশি বাইডেন প্রশাসন ঘনিষ্ট ব্যক্তিত্ব। এখন আসল কথাটা হল যে কুগেলম্যান গত তিনমাসের বিএনপির আন্দোলন নিয়ে নাখোস! বিএনপির জনসমাবেশকে তাই তিনি লাখে নয় হাজারে গুনে বলা উচিত বলে দাবি করেছেন। তিনি আসলে প্রায় একজন – বাইডেনের ওবায়দুল কাদের। মানে হাসিনার জন্য একটা ওবায়দুল কাদের অবশ্যই সামঞ্জ্যপুর্ণ যেটা বাইডেনের জন্য বা এক্ষেত্রে একটা ভাঁড় অবশ্যই। তিনি পরিস্কার বলছেন বাংলাদেশ যত খারাপ কিছুই (অনুমান করি তিনি গুম-খুনের মানবাধিকারের লঙ্ঘনের ইঙ্গিত করছেন) ঘটে চলুক…… হাসিনাকেই ক্ষমতায় রেখেই অনেক কিছু তার দিবার আছে …… the bottom line is that there is still a lot for the government in Bangladesh which helps it sustain a significant level of success and there are people who see reasons to support it. বাংলাদেশে এই লেখা ইংলিস এবং বাংলায় ছাপা হয়েছে। আগ্রহিরা দেখতে পারেন।

কুগেলম্যান এর এই অবস্থান এটাই বাইডেন প্রশাসনের দ্বিতীয় ধারা। এটা প্রমাণ করে “মানবাধিকার” বাইডেনের ইস্যুই না; এটা কেবল হাসিনার মানবাধিকার লঙ্ঘনের দিকটাকে পুঁজি করে তাকে ক্ষমতাচ্যুতির ভয় দেখিয়ে কাজ আদায় করা বাইডেনের লক্ষ্য।

তাহলে আইলিন লা বাকারকে পাঠিয়ে তাদের কী লাভ বা অগ্রগতি হলঃ
মূলত তিনি এসেছিলেন দুটা সমর বিষয়ক চুক্তিতে বাংলাদেশকে সামিল করা যায় কিনা, তা দেখতে। নাম হিশাবে এরা হল General Security of Military Information Agreement (GSOMIA) and the Acquisition Cross-Servicing Agreement (ACSA)। তবে প্রথমটার ব্যাপারে আমেরিকা খুবই আগ্রহি, এটা সামরিক তথ্য সুরক্ষা ও শেয়ার বিষয়ক। যেটা ইন্দো-প্যাসিফিক ইস্যুতে এর আগেও বাংলাদেশের সামনে এনে রাখা হয়েছিল। আর এবার এনিয়ে আলোচনার ফাঁকে হাসিনা সরকার বার্মায় পদাতিক বাহিনী পাঠানোতে আগ্রহি হতে পারে কিনা সে চেষ্টাও বাজিয়ে দেখা হয়েছিল বলে অনুমান করা হচ্ছে।

আবার অনুমান করা হয় যে এই একই অনুমানের কারণেই চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীও ভোর রাতে এসে হাজির হয়েছিলেন। যতটুকু জানা যায় যে সরকার চীনের সাথে কোন প্রতিশ্রুতিতে যায় নাই। এতে বলা যায় অসন্তুষ্ট হয়েই চীনা মন্ত্রী মাত্র আধাঘন্টা মিটিং করে ঐ রাতেই চলে যান। কিন্তু এর মানে আবার আমাদের সরকার আইলিন লা বাকার-কেও কোনই প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বা করেছেন তাও না। কিন্তু তাতে পুরা আসরের সব পক্ষগুলো পরস্পরের প্রতি পরস্পর সন্দেহ করে গেছেন, তা এড়ানো যায় নাই।

বাংলাদেশের যেকোন রাজনীতি বা রাজনীতিবিদ তাতে সে সরকার বা বিরোধী যাই হোক এদের সবার জন্য যেটা নো-গো এরিয়া [no-go area] তা হল, সামরিকভাবে কোন দেশের পক্ষে বা বিপক্ষের সাথেই না জড়ানো; এটা করাই যাবে না। এমন ভিমরতি যেন কাউকে না ধরে। আর একটা দিক হচ্ছে চীন ও আমেরিকা প্রসঙ্গে তাদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও ক্যাচালে আমাদের (লীগ বা বিএনপি) কোন দলই যেন এদুই দেশের মধ্যে একেকটা দেশের পক্ষে একেকটা দল তাদের এজেন্ট এর ভুমিকা না নিয়ে বসে। যেমন লীগ যদি এই সীমারেখা না মেনে আমেরিকার এজেন্ট হয়ে বসে তবে সিওর বিএনপি তখন চীনের এজেন্ট হয়ে বসবে – অথবা ঠিক এর উলটা বা ভাইস-ভারসা! তাই সীমারেখা লঙ্ঘনের পরিণতি কী হবে তা সবার আগে থেকে জানা থাকতে হবে; কেউ যেন না বলে আমি আগে বুঝি নাই। এই সুযোগ নাই। আজকের শ্রীলঙ্কা এর সবচেয়ে ভাল উদাহরণ। ক্ষমতায় থাকার লোভে তারা এই সীমারেখা ভেঙ্গে এখন পস্তাচ্ছে! এই সীমা ভাঙ্গার কাজ করা যাবে না।

তাহলে ডোনাল্ড ল্যু এর ভারত সফরের অর্থ-তাতপর্য কীঃ
আসলে পিটার হাসের শাহীনভাগ সংশ্লিষ্ট ঘটনাবলীর পরে হোয়াইট হাউজের রিভিউ মিটিংয় থেকে সবাই বুঝে যায় বার্মা দখল বা হাসিনা মানবাধিকার লঙ্ঘণের বিরুদ্ধে ততপরতার কথা তাদের যেভাবে ভাবা হয়েছিল সেভাবে আগায় নাই। মূল কারণ, বার্মা দখল এর চিন্তাটাই যথেষ্ট হোমওয়ার্ক করে করা হয় নাই। তাই বার্মা দখলের খায়েসে তা চীনের বিরুদ্ধে আমেরিকা এক মোক্ষম জবাব হবার পরিবর্তে তা উলটা হয়ে গেছে; তা হয়ে গেছে আমেরিকার তিন শত্রু চীন-ভারত-রাশিয়াকে কাছাকাছি ঘনিষ্ঠতায় এনে দেওয়া। যা বার্মা দখল নিয়ে ফারদার চিন্তা পরিকল্পনাটাকে অসম্ভব, অকেজো করে তুলেছে।

এই কারণে, ডোনাল্ড ল্যু ভারত এসেছিলেন ভারতকে ঐ ‘ঘনিষ্ঠতা’ থেকে আলাদা করা যায় কিনা তা যাচাই করতে। ডোনাল্ড ল্যু এর সাথে NDTV এর এক সাক্ষাতকার প্রচারিত হয়েছে। সেখানে ল্যু ব্যাখ্যা করছিলেন তার সফরে আসার কারণ ও কী তিনি ভারতকে অফার করতে চান।
বুশ ২০০৬ সালের মার্চে প্রথম ভারত সফরে এসেছিলেন। গত ২০০১ সাল থেকে ওয়ার অন টেররের প্রধান এলায়েন্স পার্টনার হিশাবে ভারতকে আরও কাছে টেনে চীনের উত্থান ঠেকানোর কাজে চীনের বিরুদ্ধে ভারতকে আমেরিকা ব্যবহার করতে চাওয়ার খায়েস থেকে। তখন থেকে বুশ অফার করেছিলেন বছরে ১৬ বিলিয়ন ডলার জিএসপি এক্সপোর্ট সুবিধা ভারত পাবে তাতে। যে সুবিধাটা ট্রাম্পের আমলে ২০১৭ সাল থেকে তিনি তা নাকচ করে দেন। এরই এক্সটেনডেড অংশ হল ২০০৭ সাল থেকে বাংলাদেশকেও ভারতের হাতে তুলে দেওয়া। ল্যু বলছিলেন আগের দেয়া ঐ এক্সপোর্ট সুবিধা আবার ভাববার কথা। ল্যু এর কথাবলার স্টাইলও ছিল এপিজিং [appeasing] বা তেলানোর…। ওদিকে ল্যু এর সারকথা ছিল ভারত যদি আমেরিকার বার্মা দখলে আমেরিকার পক্ষে থাকে তাহলে সে কৃতার্থ হয়……।

এনিয়ে সুবীর ভৌমিক কী বলেছেনঃ
সেকথারই আরো বিস্তার পাওয়া গেছে সুবীর ভৌমিকের লেখায়। বলা যায় এই লেখায় সুবীর আমাদের অনুমানগুলোকেই যেন বাস্তবতা দিয়েছে।
উপরে বার্মা দখল প্রশ্নে বাইডেনের যে এরিয়াল সাপোর্টের কথা বা নো ফ্লাই জোন বানানোর কথা বলেছিলাম, সুবীরও সেই কথারই প্রতিধ্বনি করেছেন। সুবীরের লেখার শিরোনাম – “ আমেরিকা কী বার্মা-কে বসনিয়া বানাবে? নো ফ্লাই জোনের পরিকল্পনায় ভারত সামিল হবে” [Will US do a Bosnia on Myanmar? No-fly-zone move may involve India]? ক্লিনটনের আমলে বসনিয়াকে রক্ষার জন্য তিনি বসনিয়ার আকাশের উপর এমন “নো ফ্লাই জোন” ঘোষণা করেছিলেন। বাবা অথবা সিনিয়র বুশ এবং ক্লিনটনও ততকালীন সাদ্দামের ইরাকের উপরে “নো ফ্লাই জোন” ঘোষণা দিয়ে সাদ্দামকে অকেজো করে দিয়েছিলেন। তো বুঝা যাচ্ছে যে ল্যু এর ভারত সফরের উদ্দেশ্য হল, ভারতকে নো ফ্লাই জোন আরোপে আমেরিকার সাথে সামিল করে বার্মা দখল পরিকল্পনায় সম্ভাব্য জোটবদ্ধ করে নেয়ার সম্ভাব্যতা যাচাই। যাতে “চীন-রাশিয়া-ভারত” এই জোট থেকে ভারতকে আলাদা করার চেষ্টা করে দেখা যায়। যদিও দিনকে দিন এটা পরিস্কার হচ্ছে যে বার্মা দখল পরিকল্পনা নিয়ে দুর্বল হোমওয়ার্কের কারণে এই আমেরিকান পরিকল্পনাটা পরিত্যক্ত হবার দিকে আগাচ্ছে!

যদিও ভারতীয়দের মধ্যে এমন ধরণের একটা ভ্যানিটি ভেসে থাকতে দেখা যায় যেন লেখক (সুবীর) বলছে চান যে “দেখেছো চীন-আমেরিকার আমাকে নিয়ে কাড়াকাড়িয়ে আমার দাম কত উপরে উঠেছে?” – সুবীরের আলোচ্য লেখাটাও আসলে এদিক থেকে কোন ব্যতিক্রম নয়। আসলে ভারতের ইন্টেলেক্ট বা নীতিনির্ধারকদের মধ্যে এই বলে একটা ভাবনা কার্যকর থাকতে দেখা যায় যে সে আর চীন বা আমেরিকা কোন একটার পক্ষে সহসা ঝুকবে না। কেবল নিজের দাম বাড়িয়েই চলবে যাতে এক পর্যায়ে এই উত্থিত দামকে ব্যবহার করে সে চীন-আমেরিকারও উপরে উঠে যেতে পারে!! এমন ভাবনার বিষয়টা অবশ্যই আবেগে টইটম্বুর বা স্বপ্নে পোলাও খাওয়ার মত, বিশেষত যখন আমার জানাই নাই যে পোলাও কী করে পেতে হয়, রান্না করতে হয় ইত্যাদি। গত ২০১৩ সালে চীনা বেল্টরোড উদ্যোগ প্ররকল্পের প্রথম সম্মেলনের সময়ে ভারতকে চীনা দাওয়াত দেওয়ার পরে ভারত এভাবে বলেই তা প্রত্যাখান করেছিল।

তবে সেসব যাই হোক ভারত এখন একালে বাইডেন আর পুতিনের তুলনায় অনেক বেশি পুতিনের দিকে থাকতে মন বেধে ফেলেছে। যদিও মুখে বলছে রাশিয়ার উপরে ভারতের গোলাবারুদে ৬০% নির্ভরশীলতার কারণে সে এই পথ সে নিয়েছে। কিন্তু কার্যত দেখা যাচ্ছে রাশিয়ার সস্তা তেলের সরবরাহ পাওয়া এর পিছনের কারণ। এমন কী তৃতীয় দেশে তা পাচার করার সুবিধাও ভারত পাচ্ছে। যেমন খোদ বৃটেনের ঋষি সুনাক তিনিও গোপনে রাশিয়ার তেল কিনছে ভারতের মাধ্যমে। আসলে খারাপ গ্লোবাল অর্থনীতি অ এতে ধস নামার সময়ে সস্তায় রাশিয়ান তেল পাওয়াকে সকলেই বিশাল রিলিফ বলে গণ্য করছে!! আর সাধারণভাবে ভারত আবার আমেরিকার ঘনিষ্ট হবে কিনা সেই সিদ্ধান্ত ভারত তলে রেখেছে – ২০২৪ সালের নভেম্বরের নির্বাচনের পরে, দেখে শুনে তখন তারা সিদ্ধান্ত নিবে!

সবশেষে বলি, লেখা অনেক বড় হয়ে গেছে। তাই সংক্ষেপে।
তাহলে কী ল্যু এর পিছু হটা বা বিশেষ করে প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা আইলিন লা বাকার হাসিনাকে টলাতে ফেল করার পর ল্যু যা প্রলেপ দিয়ে গেলেন যেটাকে অনেকেরই কল্পনায় ধরা আছে দেখা যাচ্ছে। যে কল্পিত হাসিনা ও ল্যু এর মধ্যে কোন রফা হোক আর নাই হোক আর তাতে আমেরিকার সাথে বিএনপির সম্পর্কের মধ্যে এখন কোন দুরত্ব বোধ আমরা কেউ দেখতে পাই আর নাই পাই – আগামিতে সম্ভবত মাস খানেকের মধ্যে ল্যু বা বাইডেন প্রশাসনে আবার পল্টি আসবে। প্রথম ধারা আবার জেগে উঠার সম্ভাবনাই বেশি নানান কারণে। মানে মানবাধিকারকে কেন্দ্র করে নিয়ে আগের মতই বাইডেন প্রশাসন আবার স্পষ্ট করে সোচ্চার হবে, এমন অনুমান করছেন অনেকেই!!

লেখকঃ রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com

Advertisements