ঘটনা-হিসেবে-মহামারি
Advertisements

করোনা শেষ না হলেও। মহামারীর প্রথম ধাক্কাটা এক রকম শেষ। শোকের আয়ু যেখানে হাতের আঙুলে গোনা যায় সেখানে মহামারীরও লম্বা সময় ধরে চলার সুযোগ নাই। নানান কারণে মৃত্যুর মিছিল সরবে বা নীরবে জারি আছে। সারা দুনিয়াতে একই কারণে মানুষের মৃত্যুর সাথে সাথে উত্তরাধুনিককালে প্যানিক বা আতঙ্ক করোনাকে বিশ্ব মহামারির মর্যাদা দিয়েছে। দুনিয়ার কিছু প্রান্তে এখনও করোনা বেশ দাপট দেখিয়ে যাচ্ছে। ফলে করোনার বিষয়ে খুব নিশ্চিত করে কিছু বলা আহাম্মকি। এই ক্ষুদ্র জীবাণুটি বিজ্ঞানী ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকেও বেকুব বানিয়ে ছেড়েছে। সম্প্রতি নেচার পত্রিকার একটি নিবন্ধ পড়েছি, করোনা ২০২১ ও তার পরের সময়গুলোতে কী প্রভাব ফেলতে যাচ্ছে সেই বিষয়ে আগাম কিছু ধারণা দেয়া হয়েছে তাতে। এগুলো হুবহু যে মিলবে তার কোন নিশ্চয়তা না থাকলেও একটা কথা বলা যায়, করোনা মহামারী আকারে না থাকলেও করোনা দুনিয়ার মানুষকে এখনই ছেড়ে যাচ্ছে না। কিন্তু কথা হলো, করোনা মহামারী শেষ হলেও সাহিত্যে মানে করোনাকে বিষয় করে রচিত সাহিত্য মহামারীর মতো বিস্তার লাভ করার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে করোনা-উত্তর কালে। করোনার পরের সাহিত্য কেমন হবে তা আমি আগাম বলে দিতে পারি! পারি। গণক হিসেবে না। বলতে পারি ইতিহাসের আলোকে এবং তা অবশ্যই বলা সম্ভব।

ক. শিল্প বিপ্লবের পরে মানুষের সাথে জগতের সম্পর্কের ধরণে এবং নিজের সাথে চারপাশের সম্পর্ক বিষয়ক ধরণে মানুষের ব্যাপক পরির্বতন আসে। যন্ত্র বা প্রযুক্তির কারণে এতদিনের জীবন ও জগৎ বিষয়ে চিন্তার ধরণে যে পরির্বতন আসে তাতে প্রথম আঘাতটা পড়ে প্রাকৃতিক পরিবেশের উপর। পরিবেশের সাথে মানুষের সম্পর্ক নির্ণয় হতে থাকে প্রযুক্তির উপযোগিতার দিকে লক্ষ্য রেখে। প্রচণ্ড গতি ও আধিপত্যের উগ্র বাসনায় শুরু হয় দখল। দুনিয়াতে উপনিবেশী শাসন কায়েম হতে থাকে প্রযুক্তির বলে বলীয়ান হয়ে। এরই ধারাবাহিকতায় আসে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। এই যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখে, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও প্রগতির উপর দুনিয়ার মানুষ আস্থা হারিয়ে ফেলেছিল। হাহাকারে ভরে উঠেছিল বিবেকবান মানুষের হৃদয়। কিন্তু কিছুদিন যেতেই প্রতিযোগিতা ও লোভ আরও প্রবলভাবে মানুষকে গ্রাস করতে থাকে। এই যুদ্ধ থেকে কোন শিক্ষাই আসলে নেয় নাই মানুষ। দ্রুত সব ক্ষতি ভুলে যুদ্ধের আগের মতোই নতুন করে উম্মাদনায় মেতে উঠেছিল আবার দুনিয়ার মানুষ।

খ. এই ভাবেই ডেকে এনেছিল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। চারদিকে লাশ আর লাশ। সভ্যতার সব হিসেব কেমন যেন প্যাঁচ খেয়ে যায় আবারও। শুধু রাশিয়াতেই নিহত হয়েছে দুই কোটির উপর মানুষ। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতির এই ভয়াবহ দিকটি আবারও চরমভাবে প্রত্যক্ষ করে দুনিয়ার মানুষ। পারমানবিক বোমার শক্তি পরীক্ষার জন্য যুদ্ধের শেষ দিকে জাপানে বোমা মারা, (যা বিজ্ঞানীদের মতামতের ভিত্তিতে প্রয়োগ করা হয়েছিল, মিলিটারি সিদ্ধান্ত ছিল না প্রথমত —‘সাইন্স এন্ড হেজিমনি’-আশীস নন্দী) বোমা মেরে মানুষকে নিজের শক্তি জানান দেয় আমেরিকা। কিন্তু যুদ্ধের পরে আবার সব ভুলে মানুষ মেতে ওঠে প্রতিযোগিতা ও উম্মাদনায়। মূলত অর্থ ও ক্ষমতা— এই দুটো বিষয়কে কব্জায় রাখার জন্য জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, সাহিত্য থেকে শুরু করে সব কিছুতে শুরু হয় অদম্য প্রতিযোগিতা। যা দিনকে দিন প্রবল হয়ে উঠছে।

গ. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে সারা দুনিয়াকে একসাথে প্রভাবিত করার মতো সবচেয়ে বড় ঘটনার কথা বললে এই করোনার কথাই মনে আসবে, এর বিস্তার এবং প্রভাবের কথা মাথায় রাখলে। যদিও দুনিয়ার সব দেশে ও সমাজে এর প্রভাব স্বাভাবিক কারণেই একই রকম নয়। কিন্তু করোনায় গোটা দুনিয়া থমকে দাঁড়ায়। বিজ্ঞান ও প্রগতির প্রতি মানুষ ঠিক আস্থা রাখতে পারছিল না আবারও। মানুষ অস্থির হয়ে ওঠে। করোনায় বন্দি থেকে উপলব্ধি করে যেভাবে দুনিয়া চলছিল তা ঠিক ছিল না। অনেক অসঙ্গতি মানুষ নিজে থেকেই বুঝতে পারে। কিন্তু যেই ধাক্কাটা কমতে শুরু করল, মানুষ বলতে শুরু করলো- আবার সব নর্মাল হবে কবে? আবার কবে জমবে উৎসব? মানে, বিপদের সময় মনে হয়েছিল, যেভাবে দুনিয়া চলছিল তা ঠিক ছিল না। কিন্তু বিপদ কমতেই আগের অবস্থাকেই মানুষ ‘নর্মাল’ -বলতে শুরু করলো। আগের অসাম্য ও জুলুমের বাস্তবতাকেই সুন্দর স্বাভাবিক বলে মেনে নিয়ে -সেই অবস্থাতে ফেরার জন্য দুনিয়া এখন আবার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। যুদ্ধ, অন্যায় বাণিজ্য, স্বৈরাচারী সব কিছু যেন আরও ক্ষীপ্রগতিতে শুরু হওয়ার জন্য সবাই তাতিয়ে উঠছে। এর মধ্যে করোনার ভ্যাকসিন নিয়ে শীতলযুদ্ধের ইঙ্গিত দিয়ে প্রতিদিন সংবাদ ও মতামত ছাপা হচ্ছে। অবস্থার এই বয়ান থেকে করোনার পরের কালে সাহিত্য কেমন হবে তার একটা চিত্র আমরা বুঝতেই পারছি। আমি আরও একটু আগবাড়িয়ে বলব, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে অনেক কাজ হয়েছে। সেই অভিজ্ঞতার আলোকে দুনিয়ার সাহিত্য ভাণ্ডারে অনেক অপ্রয়োজনীয় শব্দজঞ্জাল যেমন তৈরি হয়েছে তেমনি অনেক মূল্যবান সম্পদও জমা হয়েছে। কিন্তু এবার, এই করোনা-উত্তর কালে জঞ্জালই বেশি দেখা দেবে। বাংলায় ‘যুগ-লক্ষণ’ বলে একটা কথা আছে। সেই দিক থেকে দেখলে, ১৯ শতক ছিল রেঁনেসার যুগ। ২০ শতক ছিল, প্রযুক্তি, আধুনিকতা ও জাতিরাষ্ট্রের বিস্তারের যুগ আর একুশ শতক হলো, ফ্যানাটিক/ হুজুগের যুগ। তাই এই যুগের সাহিত্যও মোটা দাগে ফ্যানাটিক বা হুজুগে লোকদের শব্দ-জঞ্জাল তৈরির কসরতে পরিণত হবে এটাই স্বাভাবিক।

আমাদের জন্য সবচেয়ে দরকারি পয়েন্ট হলো, খোদ ‘লিখন’ প্রক্রিয়াটির দার্শনিক হদিস। লেখা ও বলার মধ্যে যে ধরণের তফাৎ করা হয়। যে ধরণের বাইনারি পদ্ধতিতে এতদিন চিন্তা করা হতো তিনি তার সমস্যাকে খুব শক্তভাবে চিহ্নিত করেন। অনেকে দেরিদার এই ইন্টারভেনশনকে ভাষাতাত্ত্বিক ব্যাপার বলে চালিয়ে দিতে চান

কিন্তু এভাবে মোটাদাগে আগাম বলে দিলেই বিষয়টির সুরাহা হয় না। শুধু করোনা কেন? যে কোন ঘটনার সাথে সত্য ও সাহিত্যের সম্পর্ক বিচারের প্রশ্নটি খতিয়ে না দেখলে এই বিষয়ে চিন্তার হক আদায় করা হয় না। কিন্তু এখানে বিস্তারিত আলোচনার যেহেতু সুযোগ নাই আমি অতি সংক্ষেপে এই বিষয়ক চিন্তার কিছু প্রাথমিক দিক নিয়ে কয়েকটি পয়েন্টে আলোচনা করেই শেষ করবো।

১.আমরা গোড়ার প্রশ্নটা ধরেই আলাপ শুরু করি। সাহিত্য কি? কেন একধরণের লেখা সাহিত্য বলে গণ্য হয় এবং আর একধরণের লেখা সাহিত্য হিসেবে বিবেচনায় নেয়া হয় না? এই প্রশ্নটা জ্যাক দেরিদা খুব গুরুত্ব দিয়ে তুলেছেন। একটা কথা বলা দরকার, সাহিত্য বিষয়ক ধারণা —দেরিদার জন্মের আগে একরকম ছিল এবং উনার জন্মের পরে সেই ধারণার আমূল বদল ঘটেছে। এবং বিষয়টা ইউরোসেন্ট্রিক বা পশ্চিমা ভূগোলেই সীমাবদ্ধ নয়। সাহিত্য, রচনা, অর্থ, ভাষা, প্রকাশ এবং খোদ লিখন প্রক্রিয়ার দার্শনিক ভিত্তিই ডিকন্সট্রাক্ট বা পুনঃনির্মাণ হতে শুরু করেছে এই বিষয়ে দেরিদার ইন্টারভেনশনের পর থেকে। লম্বা আলাপের সুযোগ নাই। আগ্রহীদের জন্য শুধু প্রাথমিক কিছু কথাই এখানে বলা সম্ভব হবে। দেরিদার চিন্তার পরিধি বিশাল আকার নিয়ে বিভিন্ন ডিসিপ্লিনে ছড়িয়ে পড়েছে এখন। আমাদের জন্য সবচেয়ে দরকারি পয়েন্ট হলো, খোদ ‘লিখন’ প্রক্রিয়াটির দার্শনিক হদিস। লেখা ও বলার মধ্যে যে ধরণের তফাৎ করা হয়। যে ধরণের বাইনারি পদ্ধতিতে এতোদিন চিন্তা করা হতো তিনি তার সমস্যাকে খুব শক্তভাবে চিহ্নিত করেন। অনেকে দেরিদার এই ইন্টারভেনশনকে ভাষাতাত্ত্বিক ব্যাপার বলে চালিয়ে দিতে চান। কিন্তু বিষয়টা ভাষাগত মাত্র না। আবার অনেক সময় উনার চিন্তাকে খুব সরলভাবে অনুবাদ করার ফলে কিছু ভাসা ভাসা (সারফেস লেভেলের) চটকদার ভাষ্য উনার নামে চাউর হতে শুরু করেছে। গভীর দৃষ্টি ও ধ্যানী মন নিয়ে চিন্তার গভীরতার দিকে মনযোগী হওয়ার মানসিকতা না থাকায় খণ্ডিত ও আরামদায়ক পাঠই মূল ভাষ্য হিসেবে দাঁড়িয়ে যায়। বাংলাদেশী বংশজাত দুনিয়ার পরিচিত তাত্ত্বিক গায়ত্রী স্পিভাক দেরিদার নামে অনেক আজগুবি কথা চালু করেছেন।

দেরিদার চিন্তার গভীর ও জটিল আবিষ্কারগুলো নিজের মনের মাধুরি মিশিয়ে এমন অরাজকতাপূর্ণ অনুবাদ করেছেন এবং পরে সেগুলা আবার বাংলাতে মানুষ এমন ভাবে এনেছেন যে, দেরিদার বক্তব্যের উল্টা ভাষ্যই এখানে চালু হয়েছে। একটা ছোট উদাহরণ দেই যেমন, খুব জনপ্রিয় একটি কথা উনার নামে চালু করা হয়েছে— “there is nothing outside the text”’, ‘রচনা’ বা লিখিত কিতাবের বাইরে কিছু নাই। ফরাসিতে, “il n’y a pas de hors-texte”—দেরিদার এই বিখ্যাত উক্তিটির প্রকৃত অনুবাদ হবে,“there is no outside-text”, অর্থ হবে, বাইরে থেকে বা ট্রান্সিডেন্টাল অর্থাৎ লোকোত্তর বা মনুষ্যজ্ঞানের অতীত কোন কিছু থেকে রচনা বা কিতাব সৃষ্টি হয় না (মনে রাখতে হবে, এখানে মানুষের লেখা-লেখি নিয়ে কথা হচ্ছে, ঐশী কিতাব নিয়ে নয়) । অথচ অনুবাদে ঠিক উল্টো অর্থটাই চালু করা হয়েছে। এবং এখন প্রশ্ন হলো, এই যে মানুষের বাইরে কিতাবের কোন আবির্ভাব নাই এই বিষয়টির সাথে কোন ঘটনা ও সত্যের সম্পর্ক কি? মানুষ যখন কোন বিশেষ বা অবিশেষ অভিজ্ঞতার বা কোন বাস্তবতার ভেতর দিয়ে যায় তখন কোন বিষয়কে, ইভেন্ট মানে ‘বিশেষ ঘটনা’ আর কোন বিষযয়টাকে কোন ঘটনাই মনে করে না -তা কীভাবে নির্ণয় করা হবে? এখানেই কোন ঘটনা পরবর্তী লিখিত বিষয়ের সাথে ব্যাক্তি মানুষের সত্যের সাধনার সম্পর্ক। দেরিদার আলোচিত মডেল বা আবিস্কার —‘ডিফারেন্স’। এই যে কোন ঘটনা আদতে যা আর মানুষ যা প্রকাশ করে এর মধ্যে যে পার্থক্য সূচিত হয় এটাই মানুষকে সত্যের প্রকৃত স্বরুপ বুঝতে অসুবিধায় ফেলে। এখানে আমাদের আলোচ্য বিষয় হলো, সাম্প্রতিক মহামারী। তো এটার উপর রচিত সাহিত্য বা লেখা-লেখি আর এটার প্রকৃত স্বরূপের পার্থক্য এতোটাই যে আদতে আমরা এখনও জানি না করোনা আসলে কি? এক একজন এক এক রকম তথ্যকে ‘সত্য’ বলে প্রচার করছে। ফলে এই অজানাকে ‘জানি’ বলে ধরে নেয়া এবং তার উপর ভিত্তি করে সাহিত্য ও লেখা-লেখির পাহাড় নির্মাণ করার কাজ শুরু করলে সেটা একটা শব্দের বিশাল অট্টালিকা হতে পারে কিন্তু তার সাথে সত্যের কোন সম্পর্ক থাকবে না। এই পার্থক্যকে বুঝতে পারা এবং এটাকে মোকাবলা করাই সত্যের জন্য সংগ্রাম করা। আর কে না জানে যে কোন মহৎ কর্ম তার আপন সত্যের কাছে পৌঁছানোর সংগ্রাম ছাড়া কোন তাৎপর্য ধারণ করতে পারে না। ফলে করোনার পরের সাহিত্যে প্রচেষ্টায় এই সাধনার লক্ষণ দেখা যাবে বলে মনে হয় না। কারণ আগেই বলেছি, যুগটাই যে হুজুগের।

২. আর জরুরি কিছু বিষয়ের দিকে আমাদের মনযোগ ফেরাতে হবে। তেমন একটি বিষয় হলো, বিশ্ব-সাহিত্য ধারণাটি। কোনটা বিশ্ব-সাহিত্য, কোনটা নয়? এটা কে ঠিক করবে? সাহিত্য বা লিখন বিষয়বস্তু সবসময়ই প্রচারের রাজনীতির সাথে সম্পর্কিত। তো এমন ফ্যানাটিক যুগে কোন বৈশ্বিক ঘটনাকে নিয়ে ‘সাহিত্য’ করার মানেই কি বিশ্ব-সাহিত্য চর্চা করা? এডওয়ার্ড সাঈদের ছাত্র, আমির আর মুফতি সাঈদের তত্ত্বাবধানে একটি গবেষণা করেছেন। যা পরে ২০১৮ সালে, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস থেকে, ‘Forget English! Orientalism and World Literature’—নামে বই আকারে প্রকাশিত হয়। এখানে লেখক এই প্রশ্নটা বিস্তারিত ভাবে মোকাবেলা করেছেন। বিশ্ব-সাহিত্য ধারণাটি একটি ভাষা আধিপত্য ও ক্ষমতার রাজনীতির সাথে সরাসরি জড়িত। ভাষা একটি চিহ্ন ব্যবস্থা, ফলে যে কোন চিহ্ন ব্যবস্থায় লিখিত সাহিত্যই বিশ্ব-সাহিত্য হয়ে উঠতে পারার কথা কিন্তু তা হয় না। একদিকে ইংরেজি অন্য দিকে দুনিয়ার সকল ভাষা। আমির মুফতি যেটাকে বলছেন, ‘ইংরেজি বিশ্ব ও তার অপর’। বিশ্ব-সাহিত্যের বিশ্বটা কোথায় আসলে? ফলে এই বাস্তবতায় একটা মহামারীর মতো ঘটনাতে যখন দুনিয়ার সব লোকই কম বেশি কোন না কোন মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্থ তখন সেই ঘটনা উত্তর সাহিত্যের ঢেউকে বিশ্ব-সাহিত্য কাঠামোর এই অসাম্যের অবস্থায় কি ভাবে বিচার করা হবে তা নিয়ে চিন্তা করতে হবে। বাংলাদেশের চরের এলাকায় একটা গরীব লেখকের লেখা আর নিউ ইয়র্কের এক লেখকের করোনা বিষয়ক লেখা-লেখির মধ্যে যে বিপুল পার্থক্য তা তো শুধু মাত্র কোন ‘সাহিত্য’ বিষয়ক প্রশ্ন নয়। ফলে কোনটাকে আমরা সাহিত্য বলছি, বা বিশ্ব-সাহিত্য বলছি তার সাথে ভাষার বা লিখন প্রক্রিয়ার বাইরেও ‘সাহিত্য’ নামক যে ধারণা আমাদের দুনিয়ায় আগামভাবে জারি আছে তার পর্যালোচনা না করে এই প্রশ্নের সুরাহা করা সম্ভব হবে না। এই আগাম ধারণার মধ্যে কেউ যখন একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে সাহিত্য করতে মনস্থির করেন তখন এই অসাম্যের বিরুদ্ধে কোন সত্যে সেই সাহিত্য পৌঁছাতে সক্ষম তা বিশ্বাস করা মুশকিল।

গভীর দৃষ্টি ও ধ্যানী মন নিয়ে চিন্তার গভীরতার দিকে মনযোগী হওয়ার মানসিকতা না থাকায় খণ্ডিত ও আরামদায়ক পাঠই মূল ভাষ্য হিসেবে দাঁড়িয়ে যায়। বাংলাদেশি বংশজাত দুনিয়ার পরিচিত তাত্বিক গায়ন্ত্রী স্পিভাক দেরিদার নামে অনেক আজগুবি কথা চালু করেছেন

৩.খোদ লিখন প্রক্রিয়ার একটি রাজনীতি আছে। সেটা আমরা অনেক সময়ই ধরতে পারি না। আমরা মনে করি, রাজনীতি নিয়ে লিখলেই বুঝি সেটা রাজনীতি হয়। নাহ, কোন লেখক যে প্রক্রিয়ায় লিখেন তার কতগুলো রাজনৈতিক দিক আছে। আগেই বলেছি যে কোন ধরণের লেখা-লেখি এক ধরণের প্রচার প্রক্রিয়ার অংশ। আধুনিক এবং আধুনিকোত্তর সময়ে লেখা-লেখিতে সত্যের হাজিরার চেয়ে ভাষার কচকচানি একটি বড় মনোযোগের জায়গা দখল করে আছে। লেখা-লেখি যেন হয়ে উঠেছে লিঙ্গুইসটিক পারফর্মের এক রঙ্গমঞ্চ। এবং এই ধরণের লিখন প্রক্রিয়ার সাথে সেল্ফ-সেন্সরশিপের একটা সম্পর্ক আছে। সেটা সহজে ব্যাখ্যা করার জন্য উমবার্তো ইকোর ‘অ্যাবসুলেট লাইং’ বিষয়ক ধারণাটা কাজের। সাহিত্যে ট্রুথফুল লাইং বা সত্যিকারের মিথ্যার একটা স্বরূপ দেখা যায়। কিন্তু ভাষার ক্যাদরানির দিকে লেখক বেশি মনযোগী হয়ে গেলে সে মিথ্যাটাও সত্য করে বলতে পারে না। মিথ্যাটাকে তখন আরও মিথ্যা মনে হয়। এভাবে বিষয় ও বাস্তবের মধ্যে এক বিরাট তফাত ঘটতে শুরু করে। সেটাকে ভাষা ও কল্পনা দিয়ে সাময়িক ভাবে আড়াল করলেও বাস্তবতা যেহেতু পরর্বতন হয়ে যায় ফলে সাহিত্য শেষপর্যন্ত জীবন থেকে চলে যায় আর্কাইভে।

অন্যদিকে, প্রচুর শব্দের সহযোগে উৎপদিত সাহিত্য একধরণের সেল্ফ সেন্সর প্রকৃয়া তৈরি করে। সত্য ও সত্তার সাথে সম্পর্কগুলো বিবেচনায় না নিয়ে চলতি আমোদে মেতে বা নিজের ব্যক্তি আমির বিকারের জন্য লিখিত সাহিত্য একধরণের সেল্ফ সেন্সর। কারণ, এই ধরণের সাহিত্যে নিজের সত্তার সত্যের প্রতি আকুতিজনিত উপস্থাপনের চেয়ে বাইরের ফেনোমেনা বেশি প্রভাব বিস্তার করে। সেই সাহিত্য তখন কোন বিশেষ বিষয় বা ধারণার প্রচার কাজের বাহন হয়ে যায়। ফেনোমেনলজির আলোচনায় এই বিষয়গুলো আরও বিষদ ভাবে ব্যাখ্যা করা হয়। ফলে আমাদের মনে রাখতে হবে। শুধু ভাষা বা শব্দেই লেখক নিজের সাহিত্য বা লিখন কর্ম হাজির করতে সক্ষম নন, নীরবতারও একটা ভূমিকা আছে। শব্দ নিয়ে নৈঃশব্দের লিখন প্রকৃয়া এখনও সাহিত্য আয়ত্ত করতে পারে নাই। ফলে লেখা-লেখি অনেক সময় সত্তার দুষনে আক্রন্ত হয়। আধুনিক বাজার ও ব্যক্তির অহং প্রকাশের বাহন হয়ে যায় ভাষা। এই কাজে সে চারপাশের সব কিছুকে ব্যবহার করে উপকরণ হিসেবে। নিজের জীবন ও চাপাশের হাজির জগতের সাথে একটা হেজিমনিক সম্পর্ক তৈরি হয়। এভাবেই লেখা-লেখির নামে চলতে থাকে অসম ক্ষমতা সম্পর্কের চর্চা।

করোনার মধ্যে এই সমস্যা আরও প্রবল হবে। কারণ অভিজ্ঞতার এই যে বৈশ্বিক রূপ তার হাজিরের মধ্যে বৈচিত্র আনতে লেখকরা এতো বেশি কসরত করবে যে, করোনা বিষয়ক সাহিত্য একটা বিরক্তির কারণ হয়ে উঠতে পারে।

নায়িকার পর্নভিডিও ভাইরাল হওয়া আর একটি মাহামারি হওয়া অথবা একটি বিরাট চিত্র বা সাহিত্য কর্মের জন্ম বা প্রেমে পড়া- সবগুলোই ইভেন্ট! এই সবগুলোই কোন না কোন মানুষকে আন্দোলিত করে রাখে। কিন্তু তার পরেও এই সবগুলোই কোন ভাবেই একই মাত্রায় বিবেচিত হওয়ার মতো ঘটনা নয়

৪.লিখনের আগে কি —এই প্রশ্নটা গভীরভাবে বিবেচনার দাবি রাখে। দেরিদার কল্যাণে, আমরা জানি, একটি রচনার অসংখ্য অর্থ ও রিডিং সম্ভব। ফলে একটা রিডিং বা অর্থকে সমাজে চালু করা এবং বাকি রিডিংগুলো পাত্তা না পাওয়ার যে ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটে এর কারণ কি? এর কারণ হলো, একটি রচনার রিডিং শুধু রচনার মধ্যেই (মানে কিতাবের মধ্যেই) নিহিত থাকে না। একটি সমাজে কোন ধরণের রচনার কি ‘পাঠ’ তৈরি হবে তা নির্ভর করে সেই সমাজে কোন ধরণের ডিসকোর্স (যার বাংলা করেছি শাসনতান্ত্রিক হুকুমত বা বয়ান) চালু আছে তার উপর। ফলে করোনা-বিষয়ক সাহিত্যের বেলায় দেখা যাবে, যেহেতু একটা কমন বিজ্ঞানবাদী, প্রযুক্তিমুগ্ধ জনচৈতন্য আগাম হাজির আছে, ফলে এই বিষয়ক সাহিত্যের মাল্টি রিডিং তৈরি হওয়া মুশকিল। অন্যদিকে লিখনের আগেই হাজির থাকা (যে আগাম জনসংষ্কৃতির ভিতর একজন লেখক কাজ করেন তার) বিষয়ে একটি রচনা যদি কোনো পর্যালোচনার কাজ (লিখার আগেই) সুরাহা করে না নেন, তখন চলতি ফ্যানাটিক বা হুজগের জিকির থেকে সেই লেখক ও রচনা রক্ষা পাওয়ার সুযোগ কমে যায়।

৫.ঘটনা ও সত্যের সম্পর্ক বিচারের আগে ‘রচনা’ ও আমি’র সম্পর্ক কি —এটা খতিয়ে দেখতে হবে। একটি ঘটনাকে লেখক ব্যক্তি কি অবজেক্ট আকারে দেখছেন নাকি তিনি ঘটনার অংশ হিসেবে দেখছেন এই প্রশ্নই রচনা ও আমি’র সম্পর্ক নিয়ে আলোচনার দিকে আমাদের নিয়ে যায়। ব্যক্তির হাজির থাকা আর কোনো ঘটনার হাজির থাকার মধ্যে যে পার্থক্য তা কীভাবে রচনায় ডিল করা হচ্ছে- তা খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এই প্রশ্নের সাথে আরও আলোচিত হবে, নন্দনের রাজনীতি। যেকোন রচনাকে সাহিত্য বলার জন্য কিছু ধারণাকে অভিভাবক হিসেবে হাজির করা হয়। কিছু বিষয়কে নির্ধারক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। এটাই সাহিত্যের নন্দনতাত্বিক রাজনীতির আসল পুলিশ। যা দিয়ে একজনকে মহান লেখক, অন্যজনকে গার্বেজ বলে আখ্যায়িত করা হয়। ফলে ঘটনা, সাহিত্য, সত্য ও আমি’র সম্পর্ক আজ আর কোনো প্রশ্ন হিসেবে আমাদের সামাজে আলোচিত হয় না। কারোনার পরের সাহিত্য নিয়েও নতুন কোন জোয়ার আসবে এমনটা মনে করা মুশকিল।

অল্প কয়েকটা কথা বলেই শেষ করি, ঘটনা ও ইতিহাস এবং সাহিত্যের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করার সময় একটা উপন্যাসের কথা না বললে মনে শান্তি হবে না। সেটা হলো, ওয়ার অ্যান্ড পিস। মিলান কুন্দেরা ‘উপন্যাস, ইতিহাস, ব্যক্তি’ প্রবন্ধে এটা নিয়ে আলোচনা করেছেন। নেপোলিয়নের যুদ্ধের ৫০ বছর পরে তলস্তয় যুদ্ধের যে ছবি উপন্যাসে বর্ণনা করেছেন। তা ইউরোপ ও অ-ইউরোপিয়দের জন্য সমান মর্মঘাতী হয়ে দেখা দেয়। উপন্যাসটি এমনভাবে লেখা যাতে পাঠক ঠিক বুঝতে পারেন না কোন যুদ্ধ, কিন্তু তাতে পাঠকের কোন সমস্যা হয় না। তলস্তয় এখানে মূলত যে বিষয়ে আগ্রহী তা হলো, মানুষের সাথে ইতিহাসের সম্পর্ক। গোটা উপন্যাসে এটাকেই তিনি অনুসন্ধানের বিষয় করে তুলেছেন। তিনি দেখান ইতিহাস নিজেই নিজেকে তৈরি করে। কোন মহান ব্যাক্তি বা ঘটনা ইতিহাসকে তৈরি করতে পারে না। এই ঘটনা দেখা যাবে আলবেয়ার কাম্যু’র বিখ্যাত উপন্যাস প্লেগ-এও। উপন্যাসটি মোটেও প্লেগ নিয়ে নয়। ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’ যেমন যুদ্ধ নিয়ে নয়। কাম্যু এখানে স্বৈরাচারী ক্ষমতা ও মহামারির সময়ে মানুষের স্পিরিট বা একজিসটেনশিয়াল প্রশ্নটিকে খতিয়ে দেখেছেন। এই দুটি রচনা নিয়ে হাজার হাজার পৃষ্ঠা লেখা হচ্ছে। এখানে প্রাসঙ্গিক হলো, ঘটনা ও লিখন প্রক্রিয়ার সাথে স্পিরিট ও সত্যের সম্পর্কের জন্য ঘটনার তথ্যগত সত্যের বাইরেও আছে নিজের সত্তাকে সত্যের সংগ্রামে নিয়োজিত করে সত্যেকে বুঝবার চেষ্টা।

যে কোন চিহ্ন ব্যবস্থায় লিখিত সাহিত্যই বিশ্ব-সাহিত্য হয়ে উঠতে পারার কথা, কিন্তু তা হয় না। একদিকে ইংরেজি অন্য দিকে দুনিয়ার সকল ভাষা। আমির মুফতি যেটাকে বলছেন, ‘ইংরেজি বিশ্ব ও তার অপর’। বিশ্ব-সাহিত্যের বিশ্বটা কোথায় আসলে?

যখন কোন ঘটনা ঘটে তখন আসলে কি ঘটে? মানে কোন ইভেন্ট কি দিয়ে গঠিত হয়? নায়িকার পর্নভিডিও ভাইরাল হওয়া আর একটি মাহামারি হওয়া অথবা একটি বিরাট চিত্র বা সাহিত্যকর্মের জন্ম বা প্রেমেপড়া- সবগুলোই ইভেন্ট! এই সবগুলোই কোন না কোন মানুষকে আন্দোলিত করে রাখে। কিন্তু তার পরেও এই সবগুলোই কোন ভাবেই একই মাত্রায় বিবেচিত হওয়ার মতো ঘটনা নয়। এই যে বিবেচনার তারতম্য, এই যে একটাকে ঘটনা অন্যটাকে ঘটনাই মনে না করা। এই বিভাজনের মেকানিজমটা কি? বিং অ্যান্ড ইভেন্ট (দেখুন, অ্যালান বাদিয়্যুর বই) ধরে লম্বা আলোচনা করা দরকার। এখানে সেই সুযোগ নাই। বাদিয়ু সাবজেক্ট মানে কর্তা ও একটি ইভেন্টের সাথে সত্যের সম্পর্ককে দেখছেন, সত্যের বিপ্লবী হাজিরা সম্ভবনা আকারে। বাদিয়ু দেখছেন, একজিসটেন্স বা সত্ত্বার অনন্তরুপে হাজির থাকার দর্শন নির্ভর করছে চলতি সময়ের নিরিখে সত্য নির্নয়ের যে প্রকৃয়া তার উপর। যা কলে কালে ভিন্ন ভিন্ন সত্যের ধারণা হাজির করে (ঘটনার আলোকে সত্যের ধারণাও পাল্টে যায়)। অন্যদিকে আছে, দর্শনের নিজের সত্য নিয়ে পদ্ধতিগত পর্যালোচনা এবং কিছু ধারণা। যেটাকে মূলত সাবজেক্ট ও তার এপিয়ারিং(হাজির হওয়ার বিষয়) আকারে আলোচনা করা হয়। কোন বিষয় আদতে যা, আর তার হাজির হওয়ার মধ্যে যে তফাৎ তাতেই সাত্যের অবলোপন ঘটে। এই ধারণা দার্শনিক ভাবে বেশ জোড়ালো ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে আছে। দিকটির বাইরে বাদিয়ুর কাছে আর্ট, রাজনীতি, বিজ্ঞান ও প্রেম – এই চারটি ক্ষেত্রকে কেন্দ্র করে বাদিয়ু সত্য ও ঘটনার আলোকে বিং বা কোন কিছুর থাকার ধারণাকে থিওরাইজ করেন। তার কাছে এটা মোটেও জরুরী না যে, চলতি সময়ে কোনধরণের বিষয় (কন্ডিশন) সত্যকে প্রভাবতি বা নির্ণয় করে চলেছে। বরং তিনি এই চারটা বিষয়কে এক মেটা-অন্টলজির মধ্যে বিশ্লেষণ করে দর্শনের এতদিনের প্রস্তাবনার বাইরে নতুন করে সত্যের সমস্যাকে চিহ্নিত করতে চেয়েছেন।

(বিং এন্ড ইভেন্ট –ব্লুমসবেরি-২০০৭, ফরাশি থেকে অনুবাদ- অলিভার ফেন্থাম)

এই কাজে তিনি গণিতকে সত্ত্বাতত্ব হিসেবে আমলে নিচ্ছেন। তিনি বলছেন, ‘ম্যাথমেটিকস ইজ অন্টলজি’। এই জটিল আলোচনা এখানে আর বড় করবো না। শুধু এটাই উল্লেখ করে শেষ করছি যে, তিনি দেখাচ্ছেন, সত্য, ঘটনা বা দর্শনের জন্য বাইরে থেকে আরোপ করা কিছু শর্তকে (কন্ডিশন) আমলে নেয়া হয়। এই যে ‘কন্ডিশন’ এটাই কোন ঘটনাকে নিজগুণে সত্য হয়ে উঠতে দিতে পারে না। শর্তহীনভাবে দর্শন কীভাবে নিজগুণেই সত্য হয়ে উঠতে পারে তার জন্য তিনি সেট থিওরিকে সামনে এনেছেন। দেখাতে চাচ্ছেন, এখানে এমন ভাবে ঘটনা ঘটে এবং যার জন্য বাইরের দিক থেকে কোন কিছুকে সেই ঘটনাকে সত্য হয়ে উঠার জন্য সাহায্য ( কন্ডিশন) করার দরকার হয় না। তার নিজের ভেতরই একটা সংক্রিয় প্রকৃয়া আছে। কোনো শর্তাধীন নয় যে প্রকৃয়া। এমন প্রকৃয়ার আলোকে ঘটনাকে যদি আমরা বুঝতে পারি তবেই প্রায়োগীক অবস্থার সাথে সত্যের বিবাদ মিটানো সম্ভব। মূলত রাজনৈতিক কর্মসূচিকে বিপ্লবের পথে নিয়ে যাওয়ার দিকে লক্ষ্য রেখে বাদিয়ু উনার ধারণার তত্ত্বায়ন করেন। এবং এটার বেশ কিছু ক্রিটিকও আছে। এই দিকটি নিয়ে আরও বিস্তারিত আলোচনার ইচ্ছে রইলো। আজ শেষ করি।

সহজ করে যদি আবারও প্রশ্নটাকে বলতে চেষ্টা করি- কোনো ঘটনার সাথে আমাদের সত্ত্বার অবস্থানের বা আমাদের থাকার সম্পর্ক কি। অথবা ঘটনা কীভাবে আমাদের সত্ত্বার থাকাকে প্রভাবিত করে এই প্রশ্ন খুব জরুরি। অন্যদিকে যে কোন ঘটনাকে নিয়ে সাহিত্য রচনা হলে তা সেই ঘটনার সাহিত্য হয়ে ওঠে না। সেটা কোন না কোনভাবে কনটেমপোরারি হয়ে ওঠে (জর্জ আগাবেন- হোয়াট ইজ কনটেমপোরারি)। যেমন, ৫ হাজার বছর আগে যদি কোন বই লেখা হয়। এবং সেই বইটা যদি আপনি এখন পড়েন- সেটা কনটেমপোরারি। কারণ, সেই বই ও বিষয় ৫ হাজার বছর আগে গিয়ে আপনার কাছে ধরা দিবে না। ধরা দিচ্ছে এখন। এই সময়ে। ফলে লিখন বা কিতাবের সাথে সময়ের এই ধারণার বিচারও জরুরি। লিখন প্রক্রিয়ার রহস্যময়তা আসলে মানুষের আরোপিত অ-বিদ্যার ফল। এটাও চিন্তার একটা ক্ষেত্র। যেকোন জ্ঞান যেমন সত্যে পৌঁছাইতে চায়। তেমনি ঘটনা, তথ্য, ভাষা সব ছাপিয়ে মহৎ সাহিত্যেরও অনন্ত সত্যের দিকে যাওরার সংগ্রাম থাকে। আর সেটা না হলে, তথ্য, ঘটনা, মিডিয়া ও ভাষার কচকচানিতে কিছুদিন মজে সেই সাহিত্য আর্কাইভ হয়ে যায়। অমর সাহিত্য বলে কিছু নাই। কনটেমপোরারি সাহিত্যই অমর।

রিডিং বা অর্থকে সমাজে চালু করা এবং বাকি রিডিংগুলো পাত্তা না পাওয়ার যে ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটে এর কারণ কি? এর কারণ হলো, একটি রচনার রিডিং শুধু রচনার মধ্যেই (মানে কিতাবের মধ্যেই) নিহিত থাকে না। একটি সমাজে কোন ধরণের রচনার কি ‘পাঠ’ তৈরি হবে তা নির্ভর করে সেই সমাজে কোন ধরণের ডিসকোর্স (যার বাংলা করেছি শাসনতান্ত্রিক হুকুমত) বা বয়ান চালু আছে তার উপর

মনে রাখতে হবে সাহিত্যের ইতিহাসে ঘটনা বা ইভেন্টকে অতি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচেনা করা হয়। সাহিত্য বলতে কবিতা-গল্প বা সিনেমা সব কিছুকে যদি ধরা হয়, দেখা যাবে সাহিত্যকে কেন্দ্র করেই সমাজে বা রাষ্ট্রে ইতিহাস বিষয়ক ধারণা বিস্তার লাভ করে। এবং এই গজিয়ে ওঠা ধারণার সাথে ক্ষমতার রাজনীতির সম্পর্ক সরাসরি। বাংলাদেশের মানুষকে মোটামুটি সাহিত্যগ্রস্থ বলা চলে। এখানে বিষাদ সিন্দুর বয়ানকে সত্য হিসেবে ধরে নিয়ে অনেক ধরণের রিচুয়াল/রীতি তৈরি হয়েছে। ৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তো বিশাল বাণিজ্য ও ক্ষমতার লড়াই চলছে। এই সবই কোন না কোনভাবে সাহিত্যের প্রভাবে জনচৈতন্যকে প্রভাবিত করেছে। তাই ইভেন্ট বা ঘটনাকে বুঝতে হবে ডিসকোর্স এর ভেতর থেকেই। যে ডিসকোর্স ক্ষমতা তৈরি করে সাহিত্য হয়ে তাকে সার্ভ করে, না হয় তার বিরোধীতা করবে। এর বাইরে যে সাহিত্য হয় তাকে নিজেই একটা ডিসকোর্স তৈরির ক্ষমতা ধারণ করতে হবে, না হয় অন্ধ ক্ষমতার বিকারে পরিণত হবে। ফ্যাসিবাদি শাসক সেই সাহিত্যকে ব্যবহার করবে গণহত্যার সংষ্কৃতিকে স্বাভাবিক করতে। ইতিহাসে এর প্রচুর নজির আছে। ঘটনায় যা’ই ঘটুক আমাদের নজর যেন সত্যের অন্বেষণ থেকে না সরে যায়। তা না হলে সাহিত্য শেষ পর্যন্ত শব্দের কসরত ও একটা সময়ের পরিস্থিতির গোলামিতেই আটকে থাকবে। মুক্তি ঘটবে না সাহিত্যের। সত্য ছাড়া মুক্তির আর কোন রাস্তা দুনিয়ার মানুষের জানা নাই। এবং সত্যের সাধনা যেহেতু সহজ নয় তাই ছদ্ম সত্য উৎপাদন করে আত্মক্ষয়ের উৎসবকে মহান হিসেবে চর্চার রেওয়াজ চালু হয় পপুলিস্ট ও টেকনোলজিক্যাল ফটকা বাস্তবতার সময়ে।

এই সময়ে সাহিত্যের এক নম্বর কাজ হলো, চলতি চালাকিকে পাশ কাটিয়ে, আত্মসত্তার প্রতি সত্য হয়ে ওঠার জন্য লড়াই করা, এবং এই ছদ্ম, শিক্ষা, সাহিত্য ও বুদ্ধিজীবীতাকে নির্মূল করা।

Advertisements