কালোজিরা কি সকল রোগের মহৌষধ
Advertisements

এ কথা নির্দ্বিধ সত্য যে প্রসিদ্ধ দুই হাদীস গ্রন্থ বুখারী ও মুসলিমসহ আরও বহু গ্রন্থে একাধিক বর্ণনাকারী থেকে এই হাদীস বর্ণিত আছে – ”কালোজিরা ‘সাম’ ব্যতিত সকল রোগের ঔষধ স্বরূপ।” আর এই ‘সাম’ মানে হচ্ছে মৃত্যু।

কিন্তু বহুজন কেবলমাত্র বাণিজ্যিক কারণে কোনও প্রকার ব্যাখ্যাহীন এই হাদীসের যে সর্বময় ব্যবহার করেন সে প্রবণতা থেকে আমাদের বেরুনো উচিত। নূন্যতম হলেও এর অন্তর্নিহিত ভাব প্রসঙ্গে আমাদের ধারণা রাখা প্রয়োজন।

এই হাদীসের আক্ষরিক অর্থের উপর বিশ্বাস রেখে কেউ কালোজিরা সেবন করতে শুরু করলো। দেখা গেল এতে আরোগ্য মিলল না। তখন কারও কারও ক্ষেত্রে শয়তানের প্ররোচনায় হাদীসের উপর সন্দিহান হয়ে পড়ার যে আশঙ্কা সে সম্ভাবনা তো উপেক্ষা করা যায় না।

যা হোক, কালোজিরা সংক্রান্ত এই হাদীসসমূহের উপর আমাদের পূর্ববর্তী ইসলামের তারকাতুল্য অসংখ্য হাদীস বিশারদগণ বহু সবিস্তার মত ব্যক্ত করেছেন।

সে সমস্ত মতসমূহকে দুভাগে আলাদা করা যেতে পারে।

১।
যে সমস্ত আলেমগণ এই হাদীসের সরলার্থকে গ্রহণ করেছেন (according to general meaning)। ইবনে আবি যামরা, ইবনে তাইমিয়া, শামসুদ্দিন মোহাম্মদ ইউসুফ কিরমানি রহি. তাঁদের মধ্যে প্রধানতম।

এ ক্ষেত্রে ইবনে আবি যামরার অভিমত হচ্ছে, যারা চিকিৎসকদের অভিজ্ঞতার আলোকে বলছেন, কালোজিরা কিছু রোগে ঔষধ হিসেবে কাজ করবে এবং কিছু রোগের ক্ষেত্রে কাজ করবে না- তারা ওহীর ইলমের থেকে মানুষের বিবেচনাকে প্রাধান্য দিচ্ছেন। ফলত চিকিৎসকদের অভিজ্ঞতার উপর নয় আমাদের হাদীসের উপরই বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে।

ইবনে তাইমিয়া রহ. বলছেন, যেহেতু হাদীসে ‘সাম’ তথা ‘মৃত্যু’ ব্যতিত সকল রোগের কথা সুনির্দ্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। ফলত তা প্রত্যেক রোগের জন্যই আরোগ্য স্বরূপ।

২।
অন্য একদল উলামা এই হাদীসের ভাবার্থ গ্রহণের কথা বলছেন। ইবনে হাজার, ইবনুল ক্বাইয়্যিম, ইবনুল আরাবি, আল খাত্তাবি প্রমূখসহ বহু প্রসিদ্ধ হাদীসবেত্তাগণ এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন।

ইবনে হাজার আল আসক্বালানীর মতে, ‘সকল রোগ’ বলতে কালোজিরা প্রয়োগ করে চিকিৎসা সম্ভবপর এমন সকল রোগকে বুঝানো হয়েছে। কেননা কালোজিরা ঠাণ্ডাজনিত অসুস্থতায় কার্যকর। গরম জনিত অসুস্থতায় তা নয়।

আল খাত্তাবিও প্রায় একই অভিমত ব্যক্ত করে বলছেন, ‘এটা সাধারণভাবে প্রয়োগ করা হলেও এর উদ্দেশ্য সুনির্দ্দিষ্ট রোগসমূহ। যেমন আদ্রতার জন্য সৃষ্ট অসুস্থতায় কালোজিরে কার্যকর।’

ইবনুল আরাবি এবং ইবনুল ক্বাইয়্যিম রহ. কোরআন থেকে উদাহরণ টেনে দেখাচ্ছেন, কোরআনেও কখনো সাধারণভাবে সামগ্রিক অর্থে কোনও শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু তা সামগ্রিক নয় বরং সুনির্দ্দিষ্ট কিছু অংশকেই বুঝায়।

ইবনুল ক্বাইয়্যিম আদ জাতির উপর প্রেরিত আল্লাহর আজাব প্রসঙ্গে সূরা আহক্বাফের বর্ণনা এনেছেন। যেখানে বলা হচ্ছে, ‘প্রতিপালকের আদেশে সে সব কিছুকে ধ্বংস করে…..’ ঝড় প্রসঙ্গে এই কথা বলা হচ্ছে। পূর্ববর্তী আয়াতেই আল্লাহ তা বলেছেন।

কিন্তু এর মানে এই নয় যে, সে ঝড় সব ধ্বংস করেছে। বরং যা যা ধ্বংস হওয়ার কেবল তাই হয়েছে। তেমনি হাদীসে কালোজিরার প্রসঙ্গও তাই।

ইবনুল আরাবি বলছেন, কোরআনে আল্লাহ বলছেন, ‘মধুর মধ্যে রয়েছে নিরাময়’। সেখানেও তো তা অধিকাংশ রোগের ক্ষেত্রে বলা হচ্ছে। কিছু কিছু রোগ এমনও আছে, যা মধু খেলে বাড়তে পারে। সেখানে কালোজিরা তো সার্বিক প্রসঙ্গে হতেই পারে না। ‘

যা হোক, আল্লাহ তাঁদের প্রত্যেকের উপর রহম করুন। যে সমস্ত ব্যাপারে উলামাদের দ্বিমত রয়েছে সেসব ক্ষেত্রে নিজের বুঝার সুবিধার্থে আমি সাধারণত রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সিরাতকে দেখবার চেষ্টা করি। দেখি তিনি নিজে এর উপর কিভাবে আমল করেছেন।

যদি কালোজিরাই সকল রোগের জন্য ঔষধ রূপে ব্যবহার করা যেত তবে তিনি নিশ্চয় জীবনে এর ব্যাপকতর ব্যবহার করতেন। অন্তত বেশিরভাগ রোগের চিকিৎসায়।

কিন্তু হাদীসের সংশ্লিষ্ট অংশ এবং সিরাত বিবেচনায় নিলে দেখা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পৃথক পৃথক রোগের জন্য পৃথক পৃথক চিকিৎসা দিয়েছেন।

  1. তিনি মাথা ব্যথার জন্য শিঙ্গা লাগিয়েছেন।
  2. নাকে তরল ঔষধ সেবন করেছেন।
  3. তিনি চোখের রোগে সুরমা ব্যবহার করতে বলেছেন।
  4. তিনি মাশরুমকে চোখের চিকিৎসায় ব্যবহার করতে বলেছেন।
  5. জ্বর হলে তিনি পানি ঢালতে বলেছেন।
  6. উটের দুধের দ্বারা চিকিৎসা করিয়েছেন।
  7. কুষ্ঠের মত রোগে তিনি আইসোলেশনের কথা বলেছেন।
  8. তিনি নিজে তাঁর অসুখ তীব্র হলে সূরা ফালাক্ব ও নাস পড়ে ফু দিতেন।
  9. তিনি নানা অসুস্থতায় ঝাড় ফুঁক করেছেন।
  10. আজওয়া খেজুর, যাইতুন ও তালবিনা প্রভৃতি দ্রব্যসমূহকে পৃথক পৃথক রোগের চিকিৎসায় ব্যবহার শিক্ষা দিয়েছেন।
  11. শ্বাসনালীর ব্যাথায়, পাঁজরের ব্যথায়, আল জিহ্বা ফুলে উঠা (Inflammation) এর মত রোগে তিনি ভারতীয় চন্দনের ব্যবহার করার কথা বলেছেন।

 

এই সব বর্ণনাই আগ্রহীজন বুখারীর চিকিৎসা সংক্রান্ত অধ্যায়ে সবিস্তারে দেখে নিতে পারেন। চিকিৎসা সংক্রান্ত অসংখ্য বর্ণনার মধ্য থেকে আমি কেবল সামান্যই উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেছি।

তবুও এখান থেকেই ধারনা লাভ করা যায়, ভিন্ন ভিন্ন রোগের ক্ষেত্রে পৃথক পৃথক চিকিৎসার প্রয়োগ খোদ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম করেছেন। তিনি সকল রোগেই কালোজিরেকে সম্পৃক্ত করেন নি। এমনকি কালোজিরা থেকে বহু মূল্য ও আরবে দূর্লভ ভারতীয় চন্দনের ব্যবহার করার কথা অবধিও তিনি বলেছেন।

যদি কালোজিরা সকল রোগেরই চিকিৎসা হত, মানে হাদীসকে এর সরলার্থেই গ্রহণ করা হত তবে আল্লাহ্‌র রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সমগ্র জীবনজুড়েই এঁর ব্যাপক প্রয়োগ দেখা যেত।

ফলত আমি বিনীতভাবে মনে করি এই হাদীস প্রসঙ্গে ইবনে হাজার, ইবনুল ক্বাইয়্যিম, ইবনুল আরাবি, আল খাত্তাবি রহ. এঁর মতই অধিক প্রাণিধানযোগ্য।

কালোজিরা অবশ্যই পথ্য ও ঔষধি গুণসম্পন্ন। সুতরাং তা খাওয়া উত্তম। সওয়াবের নিয়তেও তা খাওয়া যেতে পারে। কিন্তু কালোজিরা সকল রোগের একমাত্র চিকিৎসা নয়। বরং হাদীসে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং আরও প্রভূত কল্যাণ নিহিত থাকার জন্যই কালোজিরা খাওয়ায় উৎসাহিত করা হয়েছে।

Advertisements