বর্তমানে বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে করোনা ভাইরাস মহামারী আকার ধারণ করেছে। সবাই বাঁচার জন্য চিৎকার করছে। জন্মদাতা পিতামাতা আপন সন্তানকে ভুলে যাচ্ছে। আদরের ছেলে মেয়েরাও পিতামাতাকে মুহুর্তের মধ্যে ভুলে যাচ্ছে কেউ কারোর প্রতি আর ভালোবাসা দেখাচ্ছে না। কিছুদিন আগেও একটা ভিডিও দেখলাম কলিজার টুকরো একমাত্র সন্তান করোনা রোগে আক্রান্ত হয়েছে ছেলে গ্লাসের ভিতরে মা মা করে চিৎকার করছে। মা গ্লাসের বাইরে থেকে চোখের পানিতে বুক ভাসিয়ে দিচ্ছে আর আফসোস করছে কিন্তু সন্তানের কাছে যাচ্ছে না।
ইতিপূর্বে সন্তান অসুস্থ হলে একমাত্র মা সবসময়ই সন্তানের পাশে থেকে সেবাযত্ন করতেন। এখন নিজে বাঁচার জন্য ইয়া নাফসি ইয়া নাফসি করছে। আবার পিতামাতা করোনা রোগে আক্রান্ত হয়েছে আদরের ছেলে মেয়েরা গ্লাসের বাইরে থেকে কান্নাকাটি করছে। কিন্তু কেউ পিতামাতার পাশে যাচ্ছে না তার মানে সবাই বাঁচার জন্য ইয়া নাফসি ইয়া নাফসি করছে। আসলে এই দৃশ্য দেখে মনে হয় মহান আল্লাহ্ তায়ালা ও তাঁর প্রিয় হাবিব হযরত মুহাম্মাদ সাঃ যে কেয়ামতের দৃশ্যের কথা যেভাবে বর্ণনা করেছেন- যে কেয়ামতের দিন মা তার আদরের ছেলে মেয়েকে ভুলে যাবে পিতা তার সন্তানদের ভুলে যাবে। সন্তানেরা তার পিতামাতাকে ভুলে যাবে কেউ কারো পরিচয় দিবে না।
স্বামী তার আদরের স্ত্রীকে ভুলে যাবে যে স্ত্রীকে না দেখলে একটি রাত ভালো করে চোখে ঘুম আসতো না সেই মহব্বতের স্ত্রীকে ভুলে যাবে, স্ত্রী তার স্বামীকে ভুলে যাবে স্ত্রী বলবে আমার জীবনে কোনোদিন বিয়েই হয়নি কোথা থেকে আমার স্বামী আসবে।কেমনে আমার সন্তান হবে? অনুরূপভাবে বর্তমানে নোভেল করোনা ভাইরাস মহামারী আক্রান্ত দেশগুলোতে একই আকার মনে হচ্ছে এই বুঝি কেয়ামতের ভয়াবহ দৃশ্য। আর মনে হয় বেশিদিন বাঁচব না পৃথিবীর আয়ুকাল শেষের দিকে। ঠিক এই মুহুর্তে গছিডাঙ্গা গ্রামে বসবাস করতো আহাদ আলী নামে একজন দিনমজুরে। প্রতিদিন অন্যের জমিতে কাজ করে কোনমতে সংসার চলতো। আহাদ আলীর দুই ছেলে এক ছেলে বাবার সাথে অন্যের জমিতে কাজ করে আর এক ছেলেকে পড়াশোনা করিয়ে অনেক বড়ো অফিসার বানিয়েছে।
বড়ো ছেলে আকরাম অফিসার হওয়ায় বাবাকে আর মানুষের বাড়িতে কাজ করতে হয় না। ছোট ভাইকেও আর বাবার সাথে কাজ করতে হয় না। বড় ছেলের চাকরির সুবাদে ঢাকায় থাকতে হয়। ঢাকায় কিছুদিন থাকার পড়ে। একা একা আর ভাল্লাগেনা ছেলে বাবাকে বলছে বাবা চলো আমরা সবাই ঢাকায় থাকবো। কারণ তোমাদের গ্রামে রেখে আমি একা একা শহরে থাকতে পাচ্ছি না আমার মন বলে আমি সবসময়ে বাবা মায়ের সাথে থাকি। কিন্তু মা তো আমাদের ছেড়ে অনেক আগেই না ফেরার দেশে চলে গেছেন। ছোট ভাইকে গ্রামে রেখে বাবাকে নিয়ে ঢাকায় একটা বাসা ভাড়া নিয়ে থাকে। বাবার বয়স হয়েছে এখন আর আগের মতো চলাচল করতে পারেন না। বাসায় তেমন লোকজনও নেই একটা কাজের মেয়ে আর স্ত্রী।
ছেলের বউটা একটু উচ্চ বংশের হওয়ায় বয়স্ক শ্বশুরকে তেমন দেখতে পায় না। রোজরোজ স্বামীর কাছে অভিযোগ তুলে ধরে তোমার বাবাকে গ্রামে রেখে আসো। কিন্তু কোনো কাজ হয় না। কারণ আকরামের কথা যে বাবা আমাকে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে মানুষের বাড়িতে কাজ করে আমাকে পড়াশোনা করিয়ে আমাকে এতো বড়ো অফিসার বানিয়েছেন। আমি সেই বাবাকে ভুলতে পারবো না প্রয়োজন হলে তুমিও তোমার বাবার বাড়িতে চলে যাও আর আমার এখানে থাকলে আমার বাবাকে সেবাযত্ন করতে হবে। আমার বাবা যতদিন বাঁচবে ততদিন পর্যন্ত আমাদের সাথেই থাকবে। আকরাম যে অফিসে চাকরি করে সেটা অনেক বড় কোম্পানি। তার কাজের সফলতার জন্য কোম্পানি থাকে বিদেশে ভ্রমণের সুযোগ করে দিয়েছে।
সে কোম্পানির সুবাদে বিভিন্ন দেশ সফর করেছে। এইতো অল্প কিছুদিন আগেও কথা যখন বাংলাদেশে করোনা ভাইরাস আসেনি বা অন্যান্য দেশেও তেমন আকার ধারণ করেনি। ঠিক তখনই তার কোম্পানি থেকে ইতালি সফরের সিদ্ধান্ত হয়। যাওয়ার আগে স্ত্রীকে বারবার বলে যায় আমি সফরে যাচ্ছি আমার বাবার যেনো কোনো সমস্যা না হয়। ইতিমধ্যে আকরামের একটা ছেলে সন্তান হয়েছে তার বয়স পাঁচ বছর। সে সবসময় দাদুর সাথে খেলাধুলা করে। আর ছেলেকে বলে যায় আব্বু তুমি তোমার দাদুর খেয়াল রেখো। কোনো সমস্যা হলে আমাকে জানাবে। আচ্ছা ঠিক আছে বাবা। এবার আকরাম বাবার কাছে দোয়া নিয়ে ইতালি সফরে চলে যায়। ইতালিতে আসার দুইদিন পরেই নোভেল করোনা ভাইরাস মহামারী আকার ধারণ করে।
সেই কারণে কেউ কোনো দেশ থেকে অন্য কোনো দেশে আসতে পারবে না যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। আকরাম টেনশনে পড়ে যায়। কি হবে আমার বাবার। ছেলেটা ফোনে আব্বু আব্বু করে ডাকে আর বলে আব্বু তুমি কবে আসবে। দাদুর অবস্থা তেমন ভালো না। আস্তে আস্তে বাংলাদেশেও করোনা ভাইরাস আক্রমণ শুরু করে দেয়। সর্দি,জ্বর,মাথা ব্যথা, কাশি হলে করোনা হওয়ায় সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু আকরামের বাবা তো আগে থেকেই অসুস্থ বয়স্ক মানুষ সর্দি জ্বর কাশি হতেই পারে তাই বলে তো তিনি করোনা রোগে আক্রান্ত নন। আহাদ আলী ছেলের চিন্তায় আরো বেশি অসুস্থ হয়ে যায়। আর নিরবে নিস্তব্ধে কেঁদে কেঁদে জারেজার। হায়রে আমি যদি এখন মারা যাই তাহলে আমাকে মাটি দেয়ার মতো কেউ থাকবে না।
আকরামও খুবই আতঙ্কে আছে কারণ ইতালিতে প্রতিদিন প্রায় ৮০০/ ৯০০/ ১০০০ জন মানুষ মারা যাচ্ছে না জানি কখন কি হয়? এদিকে আকরামের স্ত্রী ছেলেকে নিয়ে বাবার বাড়ি চলে যায়। আহাদ আলীর করুণ অবস্থা। দেখার মতো আর কেউ রইলো না। একমাত্র নাতিই ছিলো কাছে থাকা বা কথা বলার মানুষ। কিন্তু সেই নাতিও আজ নেই একা একা নানান চিন্তায় কাতর কে রান্না করে দিবে বা কে গোসল করিয়ে দিবে? কেউ কারো বাসায় যাওয়া আসা করে না সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। আকরামের স্ত্রীর ধারণা তার শ্বশুর করোনায় আক্রান্ত হয়েছে সেই কারণে শ্বশুরকে ফেলে রেখে বাবার বাড়িতে চলে যায়। বাড়িওয়ালা কাজের ছেলেকে দিয়ে দুই-একদিন খাবার দিতো।
কিন্তু পরেরদিন সকালবেলা খাবার নিয়ে গিয়ে ডাকাডাকি করলে কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে কাজের ছেলে বাড়িওয়ালাকে বলে। বাড়িওয়ালা থানায় ফোন করে। থানা থেকে প্রশাসন এসে থাকে পরীক্ষা নীরিক্ষার পরে জানা যায় তিনি এমনিই জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছেন। বাড়িওয়ালা আকরামকে ফোন করে জানায় যে আপনার বাবা মারা গিয়েছে কিন্তু আপনার ওয়ারিশ পাওয়া যাচ্ছে না। আপনার প্রাণের স্ত্রীও বাবার বাড়িতে চলে গেছে। শুরু হয়ে গেলো কান্নার আহাজারি। স্ত্রীকে ফোন করে কিন্তু ভাগ্যক্রমে ফোন রিসিভ করে তার আদরের ছেলে। বাবার ফোন পেয়েই বলতে থাকে বাবা তুমি কেমন আছো? বাবা আমি দাদুর কাছে যাবো। দাদুর সাথে খেলাধুলা করবো, আমি দাদুর মুখে গল্প শুনবো। কিন্তু আম্মু আমাকে যেতে দেয় না। বাবার মুখে কোনো কথা নেই।
ছেলে আবারও বলছে বাবা তুমি কথা বলছো না কেন? কি হয়েছে তোমার? বাবা বলে তোমার দাদু আর তোমার সাথে খেলাধূলা করবে না আর তোমাকে গল্প শুনাবে না। ও আমি বুঝতে পেরেছি দাদু আমার উপর রেগে আছে আমাকে দেখলেই দাদু সব ভুলে যাবে বাবা। তুমি একটু আম্মুকে বলে দাও আমি দাদুর কাছে যাবো। না বাবা তোমাকে আর দাদুর কাছে যেতে হবে না। কারণ তোমার দাদু আকাশের তারা হয়ে না ফেরার দেশে চলে গেছেন। তোমার আম্মুকে বলো যে তোমার দাদু আর কাউকে বিরক্ত করবে না আর কারো ঘুম নষ্ট করবে না। তোমরা সবাই ভালো থেকো সুস্থ থেকো। আর তোমার দাদুর জন্য দোয়া করো।