Rezaul-karim-rony-2
Advertisements

পর্ব ২

শরীর যখন বৈশ্বয়িক ঘটনা

শরীর মানে শুধু যে নিজের শরীর না, এটা সমাজের ভাল-মন্দের এমনকি রাষ্ট্রের— এখন দেখা যাচ্ছে গোটা বিশ্বের নিরাপত্তার সাথে সম্পর্কীত। ফলে শরীর আমার নিজের, সিদ্ধান্তের অধিকারও আমার— এই ব্যক্তিসর্বস্ববাদি প্রকল্প করোনা প্রশ্নে ধরা খেয়ে যাচ্ছে। নারীবাদি ডিসকোর্সগুলো বডি বা শরীরের এই যে প্রাইভেটাইজেশন ব্যক্তিআয়ন প্রকল্প নিয়ে এতদিন সোচ্চার ছিল তাও করোনার কালে নতুন করে সংকটে পরে গেল। এক দেহ থেকে গোটা দুনিয়াতে মাহামারি ছড়াতে পারে। এই বাস্তবতা ‘ইনডিভিজুয়াল’ শরীর ও তার যা খুশি ব্যবহারের স্বাধীনতার প্রশ্নকে নৈতিকভাব চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিল। গোটা দুনিয়ার জন্য তোমাকে সুস্থ্য থাকতে হবে। নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে শরীর।

ঐতিহাসিক ভাবে যেকোন মহামারির সময় শরীর ও সামাজের (আধুনিক কালে রাষ্ট্রের) সম্পর্ক নিয়ে অনেক কাজ হয়েছে। শরীর সমাজ রাষ্ট্র কীভাবে ফাংশন করে তা নিয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তাত্বিকদের কাজ আছে। দিপেশ চক্রবর্তী যেমন বলছেন, ‘শরীরের তাৎপর্য সামাজিক বা গোষ্ঠিগত। কল্পনায় এই শরীরকে আমরা সমাজিক শরীর নাম দিতে পারি’।

আর মিশেল ফুকো এই বিষয়ক কাজের জন্য তো বিখ্যাত। মহামারিতে রাষ্ট্রের ভূমিকা খোদ রোগের চেয়ে ভযংকর হতে পারে তার বহু নজির কলোনিয়াল বা উপনিবেশ অমলের সমাজে দেখা গেছে। এলিটরা নিজেরা বাঁচতে আমজনতাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে। আধুনিক কালের সব চেয়ে বড় বিষ্ময় হল, মানুষ নিজের ক্ষমতা নিয়ে যা ভেবেছে তা ভূল। মানুষ এখনও অসহায়। এই একবিংশ শতাব্দিতে, এই উত্তরাধুনিক কালেও মহামারি, তাও গ্লোবাল মহামারি সম্ভব— এটা বিশ্বাস করার মতো মানুষ করোনার আগে খুঁজে পাওয়া কঠিন ছিল। কিন্তু এখন এটাই বাস্তবতা।

শরীরের উপর রাষ্ট্রের এই দখলী কারবার (বায়োপলিটিক্স) নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। ফুকোর কাজ ধরে আমরা যদি রাষ্ট্রের এই জুলুমবাজ চরিত্রকে মাথায় রাখিও, তা হলেও এটাও মনে রাখতে হবে মিশেল ফুকো কিন্তু সমাজকে রক্ষার কথাও বলেছেন। আগামবেন ফুকোর কাজের ধারবাহিকতায় কাজ করেন। তিনি রাষ্ট্রের প্রশ্নে তাত্বিক ভাবে সঠিক হলেও করোনার কালে তিনি সমাজের প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়েছেন। রাষ্ট্র লকডাউনকে শোষণের হাতিয়ার করতে পারে এই আশঙ্কায় লকডাউন দেড়িতে হওয়াতে প্রাণহানির জন্য ইতালিতে দার্শনিকদের গালাগালি করা হচ্ছে। কিন্তু তারা তো সামাজিক ভাবে বিষয়টি মোকাবেলার কথা তুলতে পারতেন? আমাদের দার্শনিকদের একটা প্রবণতা হয়ে দাঁড়িয়েছে আমরা সমাজকে ভুলে গেছি রাষ্ট্রকে মোকাবেলা করতে গিয়ে, রাষ্ট্রের চালে আটকা পড়ছি। সমাজকে রক্ষা না করতে পারলে রাষ্ট্রকে মোকাবেলা করা সম্ভব না। আগামবেন এই দিকটিও ভাবতে পারতেন।

ফুকোর কথা বিস্তারিত আলোচনা করার দরকার। এখানে অল্পই বলার সুযোগ আছে। বিজ্ঞানের আলোচনায় এতদিন প্রাকৃতিক বিজ্ঞান বেশি গুরুত্ব পেলেও ফুকো মূলত মানবিক বিজ্ঞান নিয়ে কাজ করে দুনিয়াকে তাক লাগানো কিছু সমস্যার মুখমোখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন।

একটা সময়ে কুষ্ঠরোগিকে যেমন আলাদা রাখা হত। তাকে ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দেয়া হত, এখন করোনার কালেও একই ঘটনা দেখতে পাচ্ছি। অবশ্য রাষ্ট্র এখন বিজ্ঞানের (বলা ভাল) ‘মাইক্রোফিজিক্স’র উপর নিয়ন্ত্রণ নেয়ার মধ্য দিয়ে চালু করেছে কুয়ারেনটাইন ব্যবস্থাপনা। যা রাষ্ট্রের সিকিউরিটি বাহিনীর সাথে ডাক্তারী টিম মিলে কায়েম করে চলেছে উত্তারাধুনিক সময়ের মহামারির কালে। অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন সেই ১৮ শতকের ফুকোর মডেল এখন আলোচনা করার কোন মানে হয় ?

এখন প্যারাডাইম বা বাস্তব প্রেক্ষিতের পরির্বতন হয়েছে। মনে রাখতে হবে, সমস্যা প্যারাডাইম/প্রেক্ষিত পরির্বতন করতে পারে আবার নতুন নতুন সমস্যা নতুন নতুন প্যারাডাইম তৈরি করলেও ফলাফাল অভিন্ন হতে পারে।

করোনার কালে তাই ফুকোর বায়োপাওয়ার, বিজ্ঞানের সাথে ক্ষমতার সম্পর্ক, রাষ্ট্র ও বিজ্ঞান এমন ভাবে ফাংশন করছে, দেখা যাচ্ছে, রোগের উপর রোগির কোন নিয়ন্ত্রণ নাই, নিয়ন্ত্রণ আছে রাষ্ট্রের। হাতিয়ার হিসেবে পাশাপাশি কাজ করে গোটা রাষ্ট্রযন্ত্র ও বিজ্ঞান। ফলে মানবিক বিজ্ঞানের জ্ঞানের সাথে ক্ষমতার সম্পর্ক নিয়ে ‘বার্থ অব ক্লিনিকে’ ফুকো যে মডেল হাজির করেছেন তার প্যারাডাইম পরির্বতন হলেও করোনার কালেও একই রকম কানুনের বা নিয়মের চর্চা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এখন বরং দেখা যাচ্ছে, শরীর একটি গ্লোবাল ফেনোমেনা।

এই অবিশ্বাস্য বাস্তবতা ব্যক্তি মানুষকে আরও নতুন এক চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করিয়েছে। সেটা হল— সেক্রিফাইস বা আত্মত্যাগের প্রশ্ন। একটা এথিক্যাল/নৈতিক প্রশ্ন আবার সামনে চলে এসেছে। কেউ যদি করোনায় আক্রন্ত হন, তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে তিনি নিজেই মরবেন। সতর্ক থাকবেন। অন্যকে বাঁচানোর জন্য নিজেকে আড়াল করে নিবেন। সে চাইলেই স্বাধীনভাবে মারা যাওয়ার আগে মদের পার্টিতে নিজেকে শামিল করতে পারবে না। মৃত্যুর আগে তার যদি শেষ ইচ্ছে হয় প্রেমিকাকে চুমু খাবেন, তাও তিনি করবেন না। নিজে মরতে মরতেও পরিবারকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন। কারণ, তিনি নিজেকে বঞ্চিত করে হলেও অন্যকে বাঁচতে সাহায্য করবেন। এই এথিক্যাল সিদ্ধান্ত নেয়ার নজির এখন প্রচুর দেখা যাচ্ছে। চিকিৎসকরা এখন হিরো। অনেক অনুন্নত দেশে ডাক্তারদের যথেষ্ট পিপিই ছিল না। তার পরেও মানবিক বোধে তাড়িতে হয়ে করোনা রোগিদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে নিজেও সংক্রমিত হয়ে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে গিয়েছেন। আর মিডিয়াতে ব্যাপক সাড়া ফেলছে এমন সব নিষ্ঠুর- মানবিকতার গল্প। উন্নত বিশ্ব ও দরিদ্র বিশ্ব উভয়ের মধ্যে বিপর্যয়ের এক সাম্য আমরা দেখতে পাচ্ছি। এই ভোগের দুনিয়া থেকে বিদায় নেয়ার ভয়ে রোগের চেয়ে প্যানিকে বেশি মানুষ মানসিক ভাবে অসুস্থ্য এখন।

একবিংশ শতকে মানুষ এগিয়েছে— এই কথা আর জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না। সভ্যতার সব ডিসকোর্স বাস্তবতার কাছে মুখ থুবড়ে পড়েছে দুনিয়া জুড়েই। একের পর এক তত্ত্ব দিয়ে যে দার্শনিককূল দুনিয়াকে ব্যাস্ত রেখেছিল তারাও খেই হারিয়েছে। ফলে কালে কালে এক এক সময়ে এক এক মতাদর্শ দুনিয়াতে আসলেও ‘জীবন’ নিয়ে মানুষের প্রতিযোগিতা পশুর প্রতিযোগিতার মতোই দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে এই সব তত্বের ভিড়ে মানুষ কোন এক মৌলিক বিষয় থেকে দূরে সরে গেছে

ইরানের সাথে আমেরিকার সাম্য অবস্থা কল্পনা করা কোন অতি মানবিক মানুষের পক্ষেও এখন সম্ভব না। কিন্তু বিপর্যয়কর মৃত্যুদৃশ্য ও হাহাকার এক অব্যাখ্যাত সাম্য অবস্থার তৈরি করেছে। করোনার আগেও গোটা পৃথিবীতে একই রকম প্যানিক (ক্রেতার উপচে পড়া ভিড়) দেখা গেছে বিভিন্ন দেশের দোকানগুলোতে।

প্যানিকড বাইয়িং ও সোসাল মিডিয়া মিলে আমরা যে দুনিয়াকে দেখলাম তাতে মৃত্যুর মহিমা দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছে। মৃত্যুর জন্য বরাদ্ধ সম্মনটুকুও মৃত্যু হারিয়েছে যেন। আমাদের পণ্যমুখিনতা, আত্মসুখি হবার প্রতিযোগিতায়, মৃত্যুর জন্য যে আবহ, যে পরিবেশ দরকার তাও বিলোপ হয়ে গেছে এই ভোগের প্রতিযোগিতার কারণে।

ফলে এখানে মৃত্যুর সাথে সংগ্রামের চেয়ে (প্রয়োজনের চেয়ে বেশি) পণ্য কিনে মৃত্যুর আশঙ্কা থেকে পালিয়ে, নিজেকে (এই বিপদ থেকে) বাঁচিয়ে বাজার খালি করে ঘরে বসে বসে সময়টা কীভাবে উপভোগ করা যায়— সেই প্রতিযোগিতা দেখা যাচ্ছে। তাই স্বাভাবিক ভাবেই এই ভোগের দুনিয়া থেকে বিদায় নেয়ার ভয়ে রোগের চেয়ে প্যানিকে বেশি মানুষ মানসিক ভাবে অসুস্থ্য এখন।

একবিংশ শতকে মানুষ এগিয়েছে— এই কথা আর জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না। সভ্যতার সব ডিসকোর্স বাস্তবতার কাছে মুখ থুবড়ে পড়েছে দুনিয়া জুড়েই। একের পর এক তত্ত্ব দিয়ে যে দার্শনিককূল দুনিয়াকে ব্যাস্ত রেখেছিল তারাও খেই হারিয়েছে। ফলে কালে কালে এক এক সময়ে এক এক মতাদর্শ দুনিয়াতে আসলেও ‘জীবন’ নিয়ে মানুষের প্রতিযোগিতা পশুর প্রতিযোগিতার মতোই দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে এই সব তত্বের ভিড়ে মানুষ কোন এক মৌলিক বিষয় থেকে দূরে সরে গেছে।

আরও একটি বিষয় লক্ষনীয়, যত আলোচনা হচ্ছে তার একটা বড় অংশ জুড়ে থাকছে করোনার পরে জীবন কেমন হবে? মূলত অর্থনৈতিক দিক থেকে এই প্রশ্নটা বেশি বেশি উচ্চারিত হচ্ছে। এখনও আমাদের চিন্তকদের ভাবনায় খোদ জীবনের চেয়ে কীভাবে জীবনটা ‘যাপন’ করা হবে সেই প্রশ্নই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

যে অর্থ-ব্যবস্থা, যে নৈতিক স্পিরিট/প্রেরণা করোনার আগে ছিল, করোনার কালে চলছে, করোনার পরেও একই পাটাতনকে ব্যবহার করে দ্রুত ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা হবে। তাতে যে প্রাণ-প্রকৃতি ও প্রতিবেশের অবস্থার উন্নতির চেয়ে অবণতিই বেশি হবে— এটা বুঝতে পন্ডিত হতে হয় না।

করোনার কালে আরও একটি প্রশ্ন উঠেছে, কোন জীবন বেশি গুরুত্বপূর্ণ? মহামারি সামাল দিতে গিয়ে (বয়ষ্কদের চেয়ে) তরুণদের জীবন রক্ষার জন্য ডাক্তারদের বলা হচ্ছে কিছু দেশে। এই সিদ্ধান্তের ‘নৈতিক’ ভিত্তি কি? কোন জীবন, কোন কারণে বেশি গুরুত্ব পাবে তা ঠিক করার এখতিয়ার কার?

করোনা আরও একটি অদ্ভুত বিষয় আমাদের সামনে হাজির করেছে। তা হলো, আমরা নিজেরাই আমাদের এই উন্নয়ণ, এই বিজ্ঞানায়ন, এই বিশ্বায়ন বিশ্বাস করি না। এগুলার সুবিধা ভোগ করি কিন্তু বিশ্বাস করি না। মানে, যত্ম/কেয়াও করি না।

যখন ঘটনাটা উহানে ছিল, তখন দুনিয়ার অন্য অঞ্চলের মানুষ ভাবতেও পারে নাই এই সংকট তাদের জন্যও অপেক্ষা করছে। অনেক দেশ এটাকে চায়নার নিজেদের ঘরোয়া সমস্যা হিসেবে আখ্যায়িত করে নাগরিকদের চিন্তামুক্ত থাকার নির্দশ দিয়েছে। ফলে দেখা গেল, দুনিয়ার পন্য ব্যবস্থাপনায় আমরা বিশ্বায়নে বিশ্বাস করলেও মহামারির বিশ্বায়নে আমরা এই একবিংশ শতাব্দিতে আর বিশ্বাস করতে পারি না।

আরও একটি বিষয় দেখা যাচ্ছে, করোনার কালে লকডাউনের সময় সবাই ঘরে থাকি জীবন বাঁচাই আন্দোলনে সোচ্চার। কিন্তু পৃথিবীর প্রতিটি নগরে অসংখ্যা মানুষ ভাসমান। তাদের জন্য কেউ কি বলব— স্টে হোম, উইথআউট হোম (ঘরহীন ঘরেই থাকো)। উন্নয়ণশীল দেশের নগরগুলোতে লক্ষ লক্ষ মানুষ গৃহহীন। রাস্তায়, পার্ক বা স্টেশনে থাকেন তারা। তাদের জন্য এখন সারা নগরিই নীরব ঘর। ফলে সরকার ও মধ্যবিত্ত নাগরিক সমাজ করোনা মোকাবেলায় সব দিক থেকে সলিডারিটি/সংহতি দেখাতে ব্যার্থ হয়েছে। আমি নিশ্চিত করে বলতে চাই সলিডারিটির গল্প পড়তে সুন্দর, কিন্তু মানবতা যখন ‘সিলেকটিভ’ মানে বিশেষ একটা গোষ্ঠির জন্য নির্ধারিত হয়ে যায় তখন মানবিকতার নৈতিক ভিত্তিই উবে যায়।

এইসব কিছুর মূলে নতুন করে যেটা এই মহামারির কালে দেখা গেল, ব্যাক্তি মানুষের শরীরই এখন বিশ্ব ফেনোমেনা। আর এই ফেনোমেনা দেখে ফ্যানাটিক হয়ে উঠছেন আমাদের শ্রদ্ধেয় দার্শনিকরাও।

একটি রাজনৈতিক ও দার্শনিক প্রতিক্রিয়ার খোঁজে

আমাদের মহান চিন্তকরা করোনার ধাক্কাতে এবং মিডিয়ার তাৎক্ষণিক উত্তেজনাতে সাড়া দিতে গিয়ে আমাদেরকে যে শুধু হাতাশ করেছেন তাই নয়, বরং (আধুনিক রাষ্ট্র ও চলতি শাসনতান্ত্রিক কাঠামোর অন্তঃসারশূণ্যতা তারা যেহেতু নিয়মিত উম্মোচণ করে থাকেন, তাই রাষ্ট্রকে কখনোই বিশ্বাস করার সুযোগ নাই) রাষ্ট্র যখন যা বলেছেন তারা যার যার তাত্বিক পজিশন থেকে ঠিক উল্টা কথা বলতে চেষ্টা করেছেন। কিন্তু অদ্ভুত ভাবে ফল হয়েছে একই রকম। কারণ করোনা নিজেই এখানে ‘সাবজেক্ট’ বা বিষয় বা কর্তা। আমাদের চিন্তকরা জনেন, রাষ্ট্র সবসময় ইমারজেন্সি/জরুরী অবস্থা পছন্দ করে। ইমারজেন্সি এমন একটা সুযোগ যার মাধ্যমে রাষ্ট্র তার ক্ষমতার ব্যবহার মনের মাধুরি মিশিয়ে চালিয়ে যেতে পারেন। এই জন্য অনেক সময় রাষ্ট্রগুলো কৃত্রিম ইমারজেন্সি অবস্থারও তৈরি করে থাকে। করোনার কালে আমরা দেখতে পাচ্ছি ‘ওয়াল্ড স্টেট অব ইমারজেন্সি’ বা বৈশ্বয়িক রাষ্ট্রীয় জরুরী অবস্থা চলছে। প্রতিটি রাষ্ট্রই তার সামর্থ্য মতো ইমারজেন্সি অবস্থায় চলে গেছে। এতে বাস্তব অবস্থা আর ‘বাস্তব’ নাই। এটাকে বলতে হবে একটা ‘হাইপার(অতিবাস্তব অবস্থা) রিয়ালিটি’ তৈরি হয়েছে। আরও একটি অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। সব রাষ্ট্রগুলো ইমারজেন্সিতে থাকাতে— রাষ্ট্র বলতে স্বাভাবিক যে ধারণা বা কাঠামোর অস্তিত্ব আমরা এতদিন দেখে আসছি তার বিলয় হতে চলেছে। গোটা দুনিয়া এখন একটা ‘পোষ্ট ন্যাশনাল ওয়াল্ড’ মানে রাষ্ট্রউত্তর দুনিয়া’র দিকে যাচ্ছে। করোনার কারণে হয়তো এটা অল্পস্থায়ী হবে। কিন্তু কোন জনগোষ্ঠি যদি ইডিওলজিক্যাল পজিশন (মাতাদর্শগত অবস্থান) থেকে সারা দুনিয়ার উপর এই ধরণের ইমারজেন্সি আরোপ করে (সেটা যুদ্ধ বা যে কোন কারণেই হোক) তখন দুনিয়ার বাস্তবতা ‘পোষ্ট ন্যাশনাল ওয়াল্ড’ হিসেবে হাজির হবে। তখন জাতীরাষ্ট্রের এতদিনের চলতি নিয়মগুলো ও স্থানিক বাস্তবতা বলে কিছু থাকবে না। এটা যে হবেই তা বলছি না। তবে করোনার কালে এটার লক্ষণ দেখা দিয়েছে। যখন সব রাষ্ট্রের বাস্তবতা একই রকম হয়। যখন সব রাষ্ট্রেই ইমারজেন্সি ‘সাধারণ’/নরমাল বিষয় হয়— তখন যে অবস্থা হাজির হয় তাকেই বলছি, ‘পোস্ট ন্যাশনাল ওয়াল্ড’।

লকডাউন স্বাভাবিক বা জনগনের অভ্যাসে পরিণত হতে পারে, এটার জন্য প্রযুক্তিকে আরও উস্কে দিতে হবে। লকডাউন যে বিচ্ছিন্নতা বাস্তবে তৈরি করেছে, প্রযুক্তির কারণে মানসিক ভাবে এই অবস্থার জন্য দুনিয়ার জনগোষ্ঠি এক ধরণের তৈরিই ছিল।

খাবার, যৌনতা, সেলফোন, ব্যাক্তিমানুষ— এটাতেই তো চলছিল একটা জীবন। সো লকডাউনের জন্য মানসিক প্রস্তুতি তো ছিলই আমাদের এই টেকনোসেন্ট্রিক দুনিয়ার। বরং প্রযুক্তির সাথে নাগরিকদের যে ধরণের সম্পর্ক তৈরি হয় তাতে একটা ‘রিজিম অব নারসিসিজম ও রেজিম অব ডেসপায়া’ (দেখুন, আশিস নন্দীর বই) কন্ডিশন তৈরি হয়। বাংলাতে বলা যায়, একই সাথে প্রচন্ড স্বার্থপর, ব্যক্তিসর্বস্ব ও একই সাথে বেপরোয়া মানসিকতার নাগরিক তৈরি হয়। পশ্চিম ও অপশ্চিম উভয় দেশের বিপ্লবী ইন্ডিভিজুয়ালিস্ট/ব্যাক্তিবাদি নাগরিকদের মধ্যে দেখা যায় এন্টি-ডেমোক্রেটিক প্রবণতা। এবং টেকনোলজিক্যাল সিঙ্গুলারিটি/এককত্ব কায়েম হয় সামাজিক পরিসরে। ফলে প্রযুক্তিনির্ভর সমাজ গণতন্ত্রের নামে আসলে একটা ‘টেকনো-ফ্যাসিজম’ই উপহার দেয়।

কাজেই এই বৈশ্বয়িক পরিস্থিতিতে আমাদের এক একটি দেশকে আলদা আলদা ভাবে বিশ্লেষণ কারার পাশাপাশি গোটা দুনিয়ার মূল প্রবণতাকে আমলে নিয়ে ‘ওয়াল্ড স্টেট অব ইমারজেন্সি’র ব্যাপরটা বুঝতে পারা দরকার।

আমাদের চলতি দুনিয়ার দার্শনিকরা প্রথম গলদ যেটা করেছেন তা হল— তারা সরাসরি ‘জীবন’ বা মানুষকে এড্রেস/নিশানা না করে এড্রেস করেছেন প্রতিষ্ঠান বা রাষ্ট্রকে। ‘ওয়াল্ড স্টেট অব ইমারজেন্সি’তে একটি দেশ বা এড়িয়ার লকডাউনে জনগনের স্বাধীনতার কিছু যায় আসে না— এটা আগামবেন তখন বুঝে উঠতে পারেন নি।

ফলে দেখা যাচ্ছে, আগামি দিনের দুনিয়াতে দার্শনিকদের চিন্তা করার অভিমূখ সঠিক না হলে আরও লজ্জাজনক অবস্থার মুখমুখি হতে হবে আমাদের।

করোনা ইস্যুতে আগামবেনসহ আমাদের আরও কিছু চিন্তক যখন জীবের জীবন/ব্যারি লাইফকে নিয়ন্ত্রনের জন্য রাষ্ট্র আরও আগ্রাসি হয়ে উঠবে বলে সতর্ক করেন, তখন আসলে করোনাকে রিড করতে দুই ধরণের মিসটেক/গলদ করেছেন তারা।

এক. ক্যাটাগরিক্যাল বা বিভাগ বিভাজনগত দিক থেকে গলদ।

দুই. ম্যাথডলজিক্যাল বা পদ্ধতিগত গলদ

সবাই আমরা করোনাকে আউট সাইডার এনিমি বা অবজেক্ট (বহিরাগত শত্রু) হিসেবে ধরে নিয়েছি। ফলে যার যার মতো করে ডিটারমিনেশন বা বিচারবিহীন স্থিরচিন্তা করে নিয়েছেন। হেগেলিয়ান অর্থেও আমরা সতর্ক থাকলে, এই মিসটেক এড়িয়ে যাওয়া যেত। আমরা আসলে এই কালে করোনা ফেনোমেনার ‘স্পিরিট’ বা মৌলিক প্রেরণা আবিষ্কার করতে ব্যর্থ হয়েছি। সরাসরি জীবনের দিকে না তাকিয়ে মিডিয়া, প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্র ক্ষমতার দিকে আমাদের দৃষ্টি আটকে ফেলার জন্য এই ঘটনা ঘটেছে বলে মনে করি

প্রথম গলদটা আমরা সবাই করেছি কমবেশি। সবাই আমরা করোনাকে আউট সাইডার এনিমি বা অবজেক্ট (বহিরাগত শত্রু) হিসেবে ধরে নিয়েছি। ফলে যার যার মতো করে ডিটারমিনেশন বা বিচারবিহীন স্থিরচিন্তা করে নিয়েছেন। হেগেলিয়ান অর্থেও আমরা সতর্ক থাকলে, এই মিসটেক এড়িয়ে যাওয়া যেত। আমরা আসলে এই কালে করোনা ফেনোমেনার ‘স্পিরিট’ বা মৌলিক প্রেরণা আবিষ্কার করতে ব্যর্থ হয়েছি। সরাসরি জীবনের দিকে না তাকিয়ে মিডিয়া, প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্র ক্ষমতার দিকে আমাদের দৃষ্টি আটকে ফেলার জন্য এই ঘটনা ঘটেছে বলে মনে করি।

এই অবজেক্টিভ ও আউট সাইডার আকারে করোনাকে আগাম ডিটারমিন করার ফলে উদ্ভুত ফোনোমেনা আমাদের নিয়ন্ত্রণ করেছে। আমরা ফেনোমেনাকে রিড/পাঠ করতে পারি নাই। বরং দেখা গেছে, আমরা প্যানিকের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে গিয়েও প্যানিকড হয়েছি। এটার মূল কারণ আমরা বিজ্ঞানের জ্ঞান তত্বের দিকে বেশি মনযোগি ছিলাম। জ্ঞানত্বের সাথে ফেনোমেনার সম্পর্ক মিলাতে গিয়ে আমরা সত্যে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়েছি। এই পুরানা তর্কটাই অন্টলজিক্যাল বা আরও স্পষ্ট করে বললে, একজিসটেনশিয়াল (সত্ত্বাতাত্বিক) দার্শনিকরা করে আসছিলেন। সেই কিয়েরকিগার্ড থেকে হাইডেগারের কাজে ঘুরে ফিরে এই সমস্যার কথা এসেছে। কিন্তু আমরা আমাদের সত্তার/অন্টিক অবস্থানকে গুরুত্ব না দিয়ে বাইরের অদেখা জীবানুকে জ্ঞান-তাত্বিক ভাবে মোকাবেলা করতে গিয়ে মানুষের জীবনের বাস্তবতাকে পাঠ করতে ভুল করেছি। প্রশ্নটা ছিল সত্তার/একজিসটেনশিয়াল থাকা না থাকার আর আমরা এটাকে অপ্রমাণিত এপিসটিক বা জ্ঞান বা বিজ্ঞান-ভিত্তিক ভাবে মোকাবেলা করতে গিয়েছি। এটা করোনা প্রশ্নে আমাদের বড় ম্যাথডলজিক্যাল বা পদ্ধতীগত গলদ। এটা গেল একটি দিক।

অন্যদিকে আগামবেন তাঁর ‘স্টেট অব একসেপশন’ তত্বের আলোকে যে পজিশন নিছেন তা ঠিক আছে ম্যাথডলজিক্যাল/পাদ্ধতিগত ভাবে। কিন্তু তিনি করোনা প্রশ্নে ক্যাটাগরিক্যাল মিসটেক করেছেন। ফলে করোনার কালে লকডাউন দিয়ে জীবন রক্ষার চেষ্টা আর রাষ্ট্রের ‘স্টেট অব একসেপশন’ যে এক না তা আলদা করার দরকার ছিল। তাই এটাকে আমি ক্যাটাগরিক্যাল মিসটেক বলছি।

আগামবেন ছোট ছোট তিনটা লিখা লিখেছেন। এবং একটা সাক্ষাৎকারে নিজের পজিশন পরিস্কার করেছেন। আগামবেন যেহেতু আমারও পছন্দের দার্শনিক, করোনার সময়ে তার এই ক্যাটগরিক্যাল মিসটেক আমাকেও অবাক করেছে। তাই বলে তার মূল তত্বের গুরুত্ব এতোটুকুও কমে নাই। বায়োপলিটিকস নিয়ে তার কাজের গুরুত্ব আগামিতে বাড়বে বই কমবে না বলেই মনে হয়। এটা যেন আমরা না ভুলে যাই। এটা নিয়ে অনেক সমালোচনা হয়েছে। আগামবেন নিজের মতো করে অনেক জবাবও দিয়েছেন।

এই বিষয়ে এলান বাদিউ ‘অন দ্যা এপিডেমিক সিচুয়েশন’ নামে ২১ মার্চ লিখেছেন। এটার ২টা ইংরেজি অনুবাদ আমি পড়েছি। চিন্তক আলবার্ত তসকানো একটা অনুবাদ করেছেন। আর তার আগেই আমার এক বন্ধু মূল ফরাশি থেকে ইংরেজি করে আমাকে পাঠিয়েছেন। যেহেতু আমি খুব ভাল ফরাশি জানি না তাই, মূল ফরাশির সাথে দুটা অনুবাদ মিলিয়ে পড়েই উপকৃত হয়েছি।

এলান বাদিউ ক্যাটাগরিক্যালি করোনাকে ঠিকই একটি পুরনা সমস্যা হিসেবে হাজির করেছেন। সার্স ভাইরেসের পরের এই করোনা নিয়ে তিনি যে পজিশন নিয়েছেন তা ক্যাটাগরিক্যালি অনেক ভাল মনে হয়েছে আমার কাছে। কিন্তু করোনার আলোচনায় তিনি ম্যাথডলজিক্যাল/পদ্ধতীগত মিসটেক করেছেন। তিনি এই সময়ের জীবিত দর্শনিকের মধ্যে প্রবীণতম, তার চিন্তার গুরুত্ব নিয়ে কোন সন্দেহ নাই। তিনি অদ্ভুত এক পজিশনে থেকে কাজ করেন। তাকে না বলা যায়, পোষ্ট স্টাকচারালিস্ট না তিনি এ্যানালিটিক্যাল। বরং তার ‘বিং এন্ড ইভেন্ট’ কাজটি বুঝতে চেষ্টা করলে দেখা যায়, আধুনিক অন্টলজিক্যাল/সত্ত্বার প্রশ্ন নিয়ে পুরো সজাগ থাকার পরেও তাঁর কাজের মূল ফোকাস যেহেতু দর্শনকে একটা প্রকসিসের তৎপরাতার অভিমূখ হিসেবে দেখা, ফলে সবসময় একটিভিজমের ধরণে তিনি চিন্তা নিয়ে হাজির থাকেন। এই পদ্ধতিগত অবস্থান করোনা ইস্যুতে তাঁর পজিশনকে আমাদের কাছে অকার্যকর মনে করিয়ে দিল। কারণ, করোনার বা যে কোন ঘটনা দার্শনিক ভাবে বুঝবার আগেই এক্ট/কিছু করার দাবি করে না। তিনি করোনার বেলায় এই অদার্শনিকসুলভ একটিভিজম উপহার দিলেন।

তাছাড়া তাঁর মাওবাদি ফ্যান্টাসি এই করোনা নিয়ে লেখাটিতেও ধরা পড়েছে।

বাদিউ বলছেন, মহামরিকে সাধরাণত দেখা হয় ন্যাচারাল ও সোসাল ডিটারনিমেশন দিয়ে। এবং কখন ন্যাচারাল ডিটারমিনেশন সোসাল ডিটারমিনিশনকে ছড়িয়ে যায় তার ওপরই আসলে এই মাহামারির প্রতিক্রিয়া নির্ভর করে।

“The complex thing about an epidemic is that it is always a point of articulation between natural determinations and social determinations. Its complete analysis is transversal: one must grasp the points where the two determinations cross each other, and from that draw the consequences.”

একবিংশ শতাব্দিতে একটা গ্লোবাল মাহমারি হতে পারে তা এই উত্তরাধুনিক কালের মানুষ কল্পনাও করতে পারে নাই। কারলেও সব কিছু তাদের নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা আছে— এই বিশ্বাস তাদের ছিল। ফলে এই যে অবিশ্বাস্য ভাবে মহামারির বিশ্বায়ন তা আর্টিকুলেশনে আমাদের মহান চিন্তকরা নতুন করে ভাবতে পারেন নাই

করোনার ক্ষেত্রে বিষয়টা এমন ছিল না। তিনি চায়নার উহানের প্রাণীর বাজার থেকে করোনা ছড়ানোর সংবাদকে সত্য ধরে নিয়ে প্রাকৃতিক ও সামাজিক ডিটারমিনেশন আকারে মাহামারিকে দেখার এই তত্বায়ন করেছেন। কিন্তু শুরু থেকে এটা এমন ছিল না। আসলে একবিংশ শতাব্দিতে একটা গ্লোবাল মাহমারি হতে পারে তা এই উত্তরাধুনিক কালের মানুষ কল্পনাও করতে পারে নাই। কারলেও সব কিছু তাদের নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা আছে— এই বিশ্বাস তাদের ছিল। ফলে এই যে অবিশ্বাস্য ভাবে মহামারির বিশ্বায়ন তা আর্টিকুলেশনে আমাদের মহান চিন্তকরা নতুন করে ভাবতে পারেন নাই। অন্যদিকে বাদিউ যেহেতু বিপ্লবকে এবং কমিউনিজমকে (নন মার্কসিস্ট অর্থে) দুনিয়ার জন্য এখনও রেলিভেন্ট/দরকারী মনে করেন, ফলে আধুনিক প্রযুক্তির সাথে মানুষের সম্পর্কটা তারা শ্রম-পুঁজি-ক্ষমতার বাইরে ভাবার অবকাশ পান নাই।

তাই করোনার তাত্বায়নে বাদিউ পদ্ধতিগত ভাবে মিসটেক করে বসে আছেন তাঁর দার্শনিক প্রপজিশন/মূলপ্রস্তাবনা অনুসারেই। কারণ, পোষ্ট মার্কসবাদি দুনিয়ার তাত্বিকতায় যে সভ্যতার প্রস্তাবনা আমরা দেখি তাতে চানায়ার বাস্তবতা বাদ দিলেও ‘ওয়াল্ড স্টেট অব ইমারজেন্সি’ এবং ‘পোষ্ট ন্যাশনাল ওয়ার্ল্ড’ তাদের প্রকল্পের মধ্যে হাজির আছে। মানে এখনও যদি কোন ধরণের বামপন্থি একটি শাসন ব্যাবস্থার কথা আমরা চিন্তা করি তা (আমরা যে সভ্যতার ভিতর দুনিয়াকে আগাতে দেখি তার থেকে) ভিন্ন কোন সভ্যতার প্রস্তাবনা হাজির করতে পারে নাই। অন্যসব বাদ দিলেও পুঁজির যে বিশ্বায়ন তার বাইরে যাইতে পারে নাই।

আর কারোনার কালে দেখা যাচ্ছে— বাদিউ’র যে ধরণের তত্ব সেটাও মানুষের জীবনকে নিরাপদ করতে পারে না, সেটা এখন তো দেখাই যাচ্ছে। কাজেই বাদিউ’র দার্শনিক বিশ্ব-প্রকল্প নতুন কোন সভ্যতার বা দুনিয়ার সম্ভবানা আমাদের দেখান না।

এখানে মনে রাখতে হবে, ফেনোমেনা যাই হোক দার্শনিক হিসেবে আমাদের পয়েন্ট হল- ‘জীবন’। যা করোনার কালে নতুন তত্বায়নের দাবি রাখে। এই দাবি পূরণে আমাদের চিন্তরা ব্যার্থ হয়েছেন।

বাদিউ বা জিজেক এখানে ক্যাপিটালিজমের সংকট, নতুন কমিউনিস্ট বাস্তবাতা হাজিরের নানান কথা বলছেন। জিজেক তার বই ‘PANdemIC! Covid-19 Shakes the World’তে যেসব কথা বলেছেন তা পড়তে আরামদায়ক। কিন্তু চিন্তা হিসেবে বেশ উৎকল্পনায় ভরা। তিনি বলছেন, করোনার ফলে পুঁজিবাদের যে অবসান দশা হাজির হবে তাতে নতুন করে কমিউনিজমের সম্ভাবনা দেখা দিবে। যেহেতু একটা বিধ্বস্ত দুনিয়াতে এমনটা ঘটবে তাই এটাকে তিনি বলছেন, Disaster Communism. এমন অনেক ফিকশনার চিন্তা তিনি করছেন। মূলত বাক্যবাগিশ হলে একজন চিন্তকের যে অবস্থা হয় জিজেকের এই বেলায় তাই হয়েছে। যা হোক আমরা বাদিউতে ফিরি।

‘সত্যকে যেহেতু নিয়ন্ত্রণ করে বিজ্ঞান’— ফলে নতুন এক রাজনৈতিক বস্তবতার কথা বা স্বপ্নের কথা বলছেন বাদিউ। অথচ এই তর্ক কতবার দর্শনে হয়েছে, থমাস কুন থেকে পপার এখনও হচ্ছে। আর দেখা যাচ্ছে সত্য তো দূরের কথা, যে জীবনের উপর বিজ্ঞান নিয়ন্ত্রণ (দখল) নিয়ে বসে আছে, এটার উপরই বিজ্ঞান কোন সত্যে পৌঁছাতে পারে নাই। সে দাবি করে অনেক কিছু কিন্তু এইসব দাবি জীবনের সত্যের সমর্থন আজও অর্জন করেনি। ফলে বিজ্ঞান জীবনের জন্য কখনো সাবজেস্টিভ বা কর্তার অবস্থায় নিজেকে নিয়ে আসতে পারে নাই। তার অবস্থান অবজেক্টিভ/বিষয়ী জায়গায়। জীবনের মৌলিক রহস্য আজও জীবনের ভিতরই নিহিত। বিজ্ঞান এই জীবনের কিছু কার্যকারণ নিয়ে কারবার করে কিন্তু তা সব সময় সব ক্ষেত্রে সত্য না। ফলে সত্যের দখলদারিত্ব বিজ্ঞানের হাতে নাই।

প্রকাশিতব্য গ্রস্থ: `The war between faith and science: philosophical response on a twenty-first-century pandemic’ থেকে দরকারী কিছু অংশ নিয়ে ভাওয়াল বার্তার পাঠকদের জন্য এই প্রবন্ধটি তৈরি করা হয়েছে

Advertisements