পর্ব ১-
এখন করোনা নিয়েই দুনিয়ার সব ভাষায় সবচেয়ে বেশি লেখা-লেখি চলছে। অনেকে মনে করেন এটা নিয়ে কথা বলার কাজ শেষ বরং মানসিক ভাবে ভালো থাকার জন্য এই বিষয়ে কথা কম বলতে ও শুনতে পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। কারণ, করোনা নিয়ে যে উদ্বেগ ও প্যানিক চারদিকে ব্যাপক ভাবে বিস্তার লাভ করেছে তাতে নিজের একান্ত/পারসোনাল দেহটাকে সুস্থ্য রাখার সংগ্রামে ব্যাক্তি-মানুষ বিপর্যস্ত।
করোনারকে বিভিন্ন দিক থেকে বুঝতে চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু একটা প্রশ্ন জরুরী ভাবে সামনে আসার করার দরকার ছিল। তা হলো, মহামারির সময়ে দর্শন কি ভূমিকা পালন করতে পারে? দর্শন কথাটার সাথে যেহেতু রাজনীতি কথাটার যোগসূত্রটা সরাসরি, তাই আমি দুটাকে পৃথক না করেই আলোচনা করছি। করোনার প্রতি আমাদের রাজনৈতিক ও দার্শনিক প্রতিকৃয়ার যে হতাশাজনক অবস্থা দেখা গেল তাতে এখনকার দুনিয়াতে ‘চিন্তা’র ভূমিকা নিয়ে আমি সত্যিই সংকিত। এই বিষয়ে অন্য সবার মতো আমাদের অনেক মহান চিন্তক/দার্শনিকরাও যেভাবে ফেনোমেনাকে/ঘটনাকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে গলাবাজ/ফ্যানাটিক হয়ে উঠেছেন তা দর্শনের দায়িত্ব বিষয়ে জনগনের কাছে যে বার্তা দিবে তা যে কোন চিন্তাশীল মানুষের জন্য লজ্জাজনক।
ষড়যন্ত্র তত্ত্ব
প্রথম থেকেই বিপুল মানুষের মগজ দখল করে আছে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব। অনেক মিডিয়াও এসব গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করেছে। একদিকে চায়না, রাশিয়া, ইরান অন্যদিকে আমেরিকা-ইউরোপ। এই দুই মেরুর ঝগড়া চলেছে। করোনা একটি বায়োলজিক্যাল ওয়েপন— এমন প্রচার মানুষের মুখে মুখে ফিরতে শুরু করেছিল। সোশাল মিডিয়া ও বিভিন্ন ইউটিউ চ্যানেলে এইসব ভিডিওর ছড়া-ছড়ি মানুষকে বেশ ভালই ব্যাস্ত রাখছে। যুক্তি হল, যেহেতু চায়না আমেরিকার বিশ্ব মোড়লিপনার জায়গাটা দখল করতে চায়, আর আমেরিকা তা কখনও হতে দিতে পারে না— তাই আমেরিকা-ইরায়েল চায়নার উহানে কৌশলে এই ভাইরাস ছড়িয়ে দিয়েছে। তার পরে ইউরোপের মধ্যে ইতালি যেহেতু চায়নার ওয়ান বেল্ট প্রকল্পে সাক্ষর করেছে তাই ইতালিকে ধরা হয়েছে। এবং ইরান তো চিরচেনা শত্রু। ফলে করোনা ভাইরাস একটি জিবানুঅস্ত্র। ঐসব দেশের অনেক উচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতা, সামাজিক একটিভিস্ট, লেখক, দার্শনিকরাও এই ধরণের মতামত প্রচার করেছেন। মূল পয়েন্টটা হল, বিশ্ব অর্থনীতির দখল নিয়ে জিবানুযুদ্ধ— যা জনগনও গিলেছে। অনেকে বলছিল, এটা একধরণের মেডিক্যাল-সন্ত্রাস। যারা এটা করেছেন তারাও আক্রন্ত হবেন। কিন্তু সেটাকে তারা সেই মধুর শব্দ দিয়ে জাস্টিফাই করবেন— ‘কোলেটারাল ড্যামেজ’। নিজেদের যে ক্ষয়-ক্ষতি হবে তা মেনে নিয়েই এই সন্ত্রাসের পথে এরা নেমেছেন। আমেরিকাও বলল, চায়না জানে কাকে ব্লেইম করতে হয়।
অন্যদিকে সিআই এ ও এম আই সিক্স এর মতো ১৭ টি দেশের গোয়েন্দা সংস্থা সম্মিলিত ভাবে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে, কিছু মিডিয়াতে (যেমন আরটি, সানডে টেলিগ্রাফ-অস্ট্রেলিয়া) এইসব খবর আবার গোপনসূত্রে প্রকাশ করা হয়েছে। এই সংস্থাগুলো করোনার যে মূলত ল্যাবে তৈরি একটা জাইনিজ ভাইরাস এই ধরণের বৈজ্ঞানিক গবেষণাকে সমর্থন করছে। তারা একটি প্রতিবেদন তৈরি করছে। করোনার কারণে সারা দুনিয়াতে কি পরিমাণ ক্ষয়-ক্ষতি হচ্ছে তার একটা হিসেব হয়তো দেয়া হবে। তার পরে এই ক্ষতিপূরণ আদায়ের জন্য আমেরিকা-ইউরোপ মিলে চায়নার বিরুদ্ধে কড়া পজিশন নিবে। মূলত একটা যুদ্ধের ইঙ্গিত এই ধরণের খবরের মাধ্যমে পাওয়া যাচ্ছে। আদতে এগুলার কোনটা কতটা বাস্তবে ঘটবে তা দেখতে অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নাই।
কিন্তু বন্ধু-শত্রু সবার ঘরে করোনা হানা দিলো এবং মৃত্যুর মিছিল যখন আমেরিকাতে নজিরবিহীন দৃশ্য তৈরি করল তখন এইসব ষড়যন্ত্র তত্বের চেয়ে মৃত্যুর ভয়াবহতার দিকেই মানুষের নজর বেশি আবদ্ধ হয়ে রইলো। কিন্তু মিডিয়া ও রাজনৈতিক অঙ্গনে থেমে নেই এইসব ষড়যন্ত্র তত্বের জাল বিস্তারের কাজ।
ফ্যাসিবাদি করোনা, গনতন্ত্র ও মানবতাবাদ
করোনা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বেশির ভাগ রাষ্ট্রপ্রধান যে বক্তব্য দিয়েছেন তাতে প্রথমেই বলা হল, এটা একটা ‘যুদ্ধ’ পরিস্থিতি। এটা যুদ্ধ বটে, কিন্তু শত্রুকে খালি চোখে দেখা যায় না। অন্যদিকে করোনার জন্য যে ধরণের নিয়ম পালন করতে বলা হচ্ছে তার সবই গণতন্ত্রবিরোধী। করোনা যেন, একটি ফ্যাসিবাদি জিবানু। জনসমাগম করা যাবে না। সামাজিক দূরত্ব বাজায় রাখতে হবে। একা একা থাকা। এমনকি বাধ্যতামূল গৃহবন্দি থাকতে হবে। ফলে এটা যতটা না মহামারি তার চেয়ে এটা রাজনৈতিক ভাবে একটি ফ্যাসিবাদি শাসন কায়েমের সহযোগি ব্যাধি।
আমরা দেখলাম, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র থেকে শুরু করে ফ্যাসিবাদি রাষ্ট্রগুলো পর্যন্ত করোনাকে রাজনৈতিক ভাবে ব্যবহারের প্রতিযোগিতা শুরু করে দিল। করোনা মোকাবেলার সব ব্যার্থতার জন্য বিরোধী দলগুলোকে দায়ী করল প্রায় সব দেশের ক্ষমতাসীনরা।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক ভাবে বন্দি, বলা হয় সবচেয়ে জনপ্রিয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেয়া হল। যখন লকডাউন চলছে ও রাস্তায় সেনা টহল শুরু হয়েছে। কেউ পথে নামছে না। দুই বছর ধরে আবেদন করলেও আদালত জামিন দেয়নি। কিন্তু হুট করে মুক্তি দিয়ে দেয়া হল লকডাউনের মধ্যেই। অথচ তার মুক্তি মানেই বর্তমান সারকারের পতনের আন্দোলনের পথ তৈরি হওয়া, কিন্তু করোনার কারণে এই মুক্তি কোন আওয়াজই তৈরি করেনি। করোনার সর্বোচ্চ রাজনৈতিক ফায়দা নিয়ে নিলো এই সরকার।
তেমিন, ভারতে করোনাকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে এরা মসজিদ থেকে করোনা ছাড়াচ্ছে। এভাবে আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা সহ গোটা দুনিয়ায় করোনাকে স্বৈরতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতা পোক্ত করার অজুহাত হিসেবে ব্যাবহার করছে। এগুলো নিয়ে বেশ কিছু প্রতিবেদনও গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।
ভারতে করোনাকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে এরা মসজিদ থেকে করোনা ছাড়াচ্ছে। এভাবে আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা সহ গোটা দুনিয়ায় করোনাকে স্বৈরতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতা পোক্ত করার অজুহাত হিসেবে ব্যাবহার করছে। এগুলো নিয়ে বেশ কিছু প্রতিবেদনও গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে
অনেক দেশের সরকারই করোনার কালে নিজেদের সুবিধা মতো আইন পরির্বতন করে নিচ্ছে। ফলে করোনা থেকে এক ধরণের রাজনৈতিক সুযোগ নেয়ার চেষ্টা সারা দুনিয়াতেই দেখা গেছে। কিন্তু যখন মৃত্যু ছোবল বসাতে শুরু করছে তখন দেখা যাচ্ছে একধরণের হাইপার এ্যাক্টিভিটি। রাষ্ট্রগুলো মূলত দুইটা পদ্ধতিতে করোনা মোকাবেলা করার উদ্যোগ নিয়েছে-
১.
স্বৈরাচারী শাসকরা করোনা রোগটাকে নিয়ন্ত্রণে নেয়ার চেষ্টা না করে বরং করোনার খবর, মিডিয়া ও পরিসংখ্যান নিজের দখলে রাখার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়েছে। আর সরকারের কথা জনগন যখন অবিশ্বাস করছে তখন গুজব ছড়ানোর অভিযোগে নাগরিকদের গ্রেফতার ও হয়রানি করা হচ্ছে। আমাদের চিন্তকরা করোনার কালে ক্ষমতার সাথে ভাষার দখল নিয়েও তেমন কথা বলছেন না। আসলে গুজব বলে কিছু নাই।
তথ্যে যেহেতু সত্য নির্ণয় হয় না তাই গুজব বলে কিছু নাই। সরকারের কথায় জনগন আস্থা রাখে না। জনগন যখন নিজেদের মতো করে তথ্য, খবর, মতামত সোসাল মিডিয়া বা অন্যকোন মাধ্যমে নিজের মতো করে প্রচার করে সরকার সেটাকে তখন গুজব বলে অখ্যায়িত করে, কঠোর ভাবে দমন করে।
অবশ্যই আইনের নামে এই দমন চলে। ফলে গুজব মানে সরকারের প্রতি গণঅনাস্থা। কিন্তু যেহেতু ভাষার উপর ক্ষমতা তার দখল পুরোপুরী কায়েম রাখতে চায় তাই নাগরিকদের তথ্য প্রবাহকে সে গুজব বলে আখ্যায়িত করে থাকে। এভাবে সরকারের বিপক্ষে গেলে সেটা যতই সত্য হোক না কেন তার তকমা জুটে গুজব হিসেবে।
২.
অন্যদিকে কিছু শাসক করোনাকে শুরু থেকেই গুরুত্ব দিয়ে রোগটার বিস্তার নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেছে। প্রচুর মানুষকে দ্রুত চিকিৎসার আওয়তায় আনা হয়েছে। দ্রুত চেস্ট করার ব্যাবস্থা করা হয়েছে। এভাবে জনগন সহজেই সেবা পাওয়ার ফলে ক্ষতির পরিমাণ কম হয়েছে কিছু দেশে।
করোনাকে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও নাগরিক অধিকার হরণের অজুহাত হিসেবে ব্যাবহার করার চেষ্টা করছে রাষ্ট্রগুলো— এই জায়গা থেকে অনেক লেখক, দার্শনিক, তাত্বিক যার যার মতো করে সক্রিয়তা দেখিয়েছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো— তাদের সক্রিয়তার ধরণের সাথে ফ্যানাটিক রাজনৈতিক নেতাদের সক্রিয়তার ধরণের কোন তফাৎ নাই। রাজনৈতিক নেতারা করোনার প্রভাব যেমনই হোক নিজেদের পজিশন আগে জাস্টিফাই করে নিয়ে পরে করোনাকে বুঝতে চেষ্টা করেছেন ও জনগনকে বুঝিয়েছেন। তেমনকি আমাদের অনেক মহান দার্শনিকও নিজেদের তাত্বিক পজিশন ঠিক রেখে করোনাকে নিজেদের জায়গা থেকে ব্যাখ্যা করেছেন। প্রতিক্রিয়া ব্যাক্ত করেছেন।
তাদের প্রতিকৃয়া চিন্তাশীল দুনিয়াকে বিষ্মিত করেছে। আগামবেন, এলান বাদিও, স্লাভোক জিজেক উনারা করোনাকে যে ভাবে ব্যাখ্যা করেছেন, তাতে প্যানিক যে তাদের ভালো মতোই পেয়ে বসেছিল তা পরিস্কার। অনেকে আবার মানুষ মরছে এই অসহায় মৃত্যুর মিছিল দেখে সব দেশকে এক হয়ে সব বিভেদ ভুলে শুধু মানবতাবাদী জায়গা থেকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার ডাক দিয়েছেন। লিখেছেন। বক্তব্য দিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবে তেমন কোন বিশ্ব মানবতাবাদী জোয়ার সৃষ্টি হয় নাই।
কোন দার্শনিকের চিন্তাকে যেকোন পরিস্থিতিতে আগাম তাত্বিক কাঠামোর আলোকে প্রয়োগের বিপদের বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। প্রতিটি নতুন পরিস্থিতি নতুন করে চিন্তা ও দার্শনিক ইন্টারভেনশনের দাবি রাখে। আগামবেন কি করে ভুলে যান রাষ্ট্র মানেই, ‘স্টেট অব এক্সেপশন’। যখন দরকার হয় তখন এটা সে প্রকাশ করে যখন দরকার হয় না তখন সে এটা নিজের ক্ষমতার পাখার আড়ালে লুকিয়ে রাখে। কাজেই নতুন করে করোনার কালে রাষ্ট্রের ‘স্টেট অব এক্সেপশন’ নিয়ে চিন্তিত হওয়ার কিছু নাই
করোনা-কালে পশ্চিমা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র জনগণের উপর যে ধরণের ‘সোশ্যাল কন্ট্রোল’ বা সামাজিক নিয়ন্ত্রণ এবং ‘সারভেইলেন্স’ বা নজরদারি আরোপ করছে, তা সেসব দেশে “স্টেট অব এক্সেপশন” বা রাষ্ট্রের জরুরী/ অস্বাভঅবিক অবস্থায় ভূমিকা পালনের প্রবণতাকে স্থায়ী করে তুলতে পারে এমন আশঙ্কা করেছেন বিখ্যাত ইতালিয় দার্শনিক আগামবেন।
অন্যদিকে অনেক দেশে লকডাউন দেয়া হয়নি প্রথম দিকে। অর্থনৈতিক অবস্থা ও সাধারণ শ্রমিকদের কথা চিন্তা করে। এবং তাতে বাকিদের জীবন যখন হুমকিতে তখন বরং “স্টেট অব এক্সেপশন” জারি করে হলেও করোনা মোকাবেলার জন্য রাষ্ট্রকে চাপ দিচ্ছেন কিছু মানুষ। তা হলে দেখা যাচ্ছে পশ্চিমের চিন্তার ধারাবাহিকতা অপশ্চিমা এরিয়াতে ফলো করার বিপদ অনেক। পশ্চিম চিন্তা করছে রাষ্ট্রের সর্বময়/টোটালিটেরিয়ান হয়ে যাওয়া নিয়ে। আর অনেক দেশের জনগন ভাবছে রাষ্ট্রের টোটালিটেরিয়ান ও কঠোর অবস্থানের মধ্য দিয়েই তারা মহামারির সংকটের ভয়াবহতার থেকে রেহাই পাবেন। সমাজের মধ্যবিত্ত ও এলিট শ্রেণী এই চিন্তাই করছে। কে না জানে এরাই রাষ্ট্রকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করে। আগামবেনের চিন্তার ক্রিটিক অনেকেই করছেন। ফলে কোন দার্শনিকের চিন্তাকে যেকোন পরিস্থিতিতে আগাম তাত্বিক কাঠামোর আলোকে প্রয়োগের বিপদের বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। প্রতিটি নতুন পরিস্থিতি নতুন করে চিন্তা ও দার্শনিক ইন্টারভেনশনের দাবি রাখে। আগামবেন কি করে ভুলে যান রাষ্ট্র মানেই, ‘স্টেট অব এক্সেপশন’। যখন দরকার হয় তখন এটা সে প্রকাশ করে যখন দরকার হয় না তখন সে এটা নিজের ক্ষমতার পাখার আড়ালে লুকিয়ে রাখে। কাজেই নতুন করে করোনার কালে রাষ্ট্রের ‘স্টেট অব এক্সেপশন’ নিয়ে চিন্তিত হওয়ার কিছু নাই। এটা করোনা-কালীন সমস্যা নয় বরং রাষ্ট্রগঠনের দার্শনিক সমস্যা। ফলে এটাকে করোনার কালে রাষ্ট্রের আচরণ হিসেবে ব্যাখ্যার বিপদ উপরের আলোচানায় আশা করি কিছুটা পরিস্কার হয়েছে।
অন্যদিকে দার্শনিক পদ্ধতীর দিক থেকে তাদের লেখা ও প্রতিকৃয়া পড়ে পাঠকরা বলছেন, উনারা এতো ভাল ভাল বই কি করে লিখলেন? আমি উমবার্ত একোর কথা ধার করে বলেছি, তাদের বইগুলো তাদের চেয়ে বুদ্ধিমান।
প্রত্যোকের বক্তব্য নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করলে অনেক সময় লাগবে আমি এখানে মূলত করোনাকে আমরা দার্শনিক ভাবে(ম্যাথডলজিক্যালি/পদ্ধতীগত ও ক্যাটাগরিক্যালি/বিভাগ ভিত্তিক) যে ভাবে চিহ্নিত করতে ব্যার্থ হয়েছি সেই দিকটা বলেই শেষ করবো।
বিশ্বাস নিয়ে সংগ্রাম
আধুনিক রাষ্ট্র কোন দিক থেকেই ধর্মহীন হতে পারে নাই। ধর্ম কথাটাকে আমরা যদি ইডিওলজি বা মতাদর্শ ও রিচুয়াল বা আনুষ্ঠানিকতা উভয় দিক থেকে বিবেচনা করি তা হলে দেখা যাবে আধুনিক রাষ্ট্র বরং আরও পোক্ত করেই ধর্মকে আকড়ে ধরে আছে। কিন্তু যেহেতু রাষ্ট্র প্রযুক্তি ও আধুনিকতার মুখোশটা পড়ে থাকে তাই আধুনিক রাষ্ট্রের ধর্মমুখটা সব সময় দেখা যায় না।
অন্যদিকে বিজ্ঞান সরাসরি এখনও এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে কোন প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে নাই। কিন্তু প্রতিদিন নতুন নতুন থিসিস বাজারে আসছে। বিপুল লোককে বিজ্ঞানে আস্থাশীল রাখার জন্য একদল বিজ্ঞানবাদীর প্রচেষ্টা করোনা মোকাবেলার স্বেচ্ছাসেবীদের চেয়ে বেশি সক্রিয়। বিজ্ঞানের উপর এই বিশ্বাস উঠে গেলে আসলে আধুনিক রাষ্ট্রের ভিতই নড়বড়ে হয়ে যাবে— এটা যেমন সত্য, অন্যদিকে বিজ্ঞানের এই চ্যালেঞ্জ সফল হওয়া না হওয়ার উপর নির্ভর করছে পশ্চিমা সভ্যতার ভবিষ্যত।
বিজ্ঞান যেভাবে জ্ঞানের উপর দখল নিয়ে নিয়েছে। অর্থাৎ এপিটোমলজির বা জ্ঞানতত্বের জগতটা বিজ্ঞান যেভাবে দখল নিয়েছে, কার্ল পপারের পরে দার্শনিকরা মূলত জ্ঞান তত্বের জগতে তেমন একটা সক্রিয়তা আর দেখান নাই। সর্বশেষ মিশেল ফুকো বিজ্ঞানকে জ্ঞান ও ক্ষমতার সমন্বয় হিসেবে নতুন করে দেখবার যে চেষ্টা করেছেন তাতেই নতুন বিপ্লব শুরু হয়েছিল চিন্তার দুনিয়ায়। যাহোক এখন এই হেজিমনিক রোল ধরে রাখার জন্য এখন সব চেয়ে বেশি সংগ্রাম করতে হচ্ছে বিজ্ঞানকে।
অন্যদিকে তার প্রতিদন্দ্বী হিসেবে আছে ধর্ম। যাকে কোন ভাবেই দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়া যায়নি। ফলে বিজ্ঞানও তার প্রতি মানুষের বিশ্বাস যেন অটুট থাকে এই জন্য ধর্মের চেয়ে বেশি মরিয়া হয়ে উঠেছে। বিজ্ঞান এবং ধর্ম উভয়ে করোনা-কালে তাদের উপর মানুষের বিশ্বাস ফিরানোর লড়াইয়ে নিয়োজিত আছে।
বিজ্ঞান যেভাবে জ্ঞানের উপর দখল নিয়ে নিয়েছে। অর্থাৎ এপিটোমলজির বা জ্ঞানতত্বের জগতটা বিজ্ঞান যেভাবে দখল নিয়েছে, কার্ল পপারের পরে দার্শনিকরা মূলত জ্ঞান তত্বের জগতে তেমন একটা সক্রিয়তা আর দেখান নাই। সর্বশেষ মিশেল ফুকো বিজ্ঞানকে জ্ঞান ও ক্ষমতার সমন্বয় হিসেবে নতুন করে দেখবার যে চেষ্টা করেছেন তাতেই নতুন বিপ্লব শুরু হয়েছিল চিন্তার দুনিয়ায়। যাহোক এখন এই হেজিমনিক রোল ধরে রাখার জন্য এখন সব চেয়ে বেশি সংগ্রাম করতে হচ্ছে বিজ্ঞানকে
করোনা-কালে আমরা যা যা দেখলাম, দেখছি। সব কি নতুন? অবশ্যই নতুন না। এই কথাটা মনে রাখতে হবে। এখন সব চেয়ে বেশি উচ্চারিত শব্দের একটি হচ্ছে, ‘লকডাউন’। নাহ এটাও নাতুন না। তবে এটার ভুক্তভোগিরা নতুন। আমরা উইঘোর লকডাউন দেখেছি। কাশ্মির লকডাউন দেখেছি। গোটা ফিলিস্তিন, বিশেষ করে গাজার লকডাউন তো সবারই জানা। অনেক মাস না বছরের পর বছর ধরে লকডাউন চলে এইসব অঞ্চলে।
কিন্তু সেই সব কলডাউনের সাথে সেনা ও ক্ষমতা মানে শাসক ও শোষিতের যে সম্পর্ক তা দুনিয়ার পণ্য ব্যবস্থাপনাতে কোন সমস্যা তৈরি করে নাই। লকডাউন ও লাশ সবই সেখানে স্বাভাবিক চিত্র। আর এইসব এরিয়ার জনগনের উপর এমন অন্যায় চাপিয়ে দেয়ার পেছনে আছে বিশেষ ধর্ম-বিশ্বাস ও জাতীয়তার সম্পর্ক।
দুনিয়ার এক অঞ্চলে লকডাউনের সময় যেমন, ধরি কাশ্মিরে লকডাউনের সময় গ্লোবাল সলিডারিটি/ বিশ্ব-সংহতি কোথায় ছিল? কাশ্মিরের কান্না শোনার লোক দুনিয়াতে খুব কমই ছিল! ফলে কারেনার সময় এই লকডাউন যখন সবার ভাগ্যেই জুটছে তখন এটা একটা ন্যাচারাল পানিশমেন্ট হিসেবে হাজির হয়েছে বলে অনেকে বক্তব্য দিচ্ছেন। অন্যদিকে করোনার জন্য যে সব আচরণ নিজেকে নিরাপদ রাখতে পারে তার বিধানগুলো যে সব ধর্মাচরণের সাথে মিলে যাচ্ছে সেই ধর্ম করোনা যুদ্ধে নিজেকে এগিয়ে রাখার জন্য প্রতিযোগিতা শুরু করেছেন।
বিজ্ঞান যেহেতু মুত্যু তো বটেই মহামারিতে পুরোপুরি কাজে আসছে না। জীবন রক্ষা করতে পারছে না। উন্নত বিশ্বেই লাশের ঢল, ফলে ধর্ম কোন ভাবেই নিজেকে পশ্চাৎপদ বলে এখন আর মেনে নিবে না। করোনা বিজ্ঞানের হেজিমনিক রোলের উপর একটা বড় ধরণের হুমকি হিসেবে হাজির হয়েছে। অন্যদিকে যে সব রিচুয়ালকে বা আনুষ্ঠানিকতাকে পশ্চাৎপদ মনে করা হতো তা মহামারির কালে বরং অনেক দরকারী— এমনটাই অনেকে প্রচার করছেন। যেমন হিজাব। সারা শরীর ঢাকা। আফগানি নারীদের মতো পর্দা মূলত ভাইরাস থেকে নিজেকে রক্ষার জন্য সহায়ক— এমন প্রচার চলছে।
প্রয়াত তাত্বিক সাবা মাহমুদ ‘পলিটিক্স অব পাইটি’ বইতে এইসব প্রতিকের বয়ান হাজির করেছেন যদিও তা অন্য প্রেক্ষিতে। কিন্তু এখানেও দেখতে পাচ্ছি ধর্ম নিজেকে স্বমহিমায় সামনের সারিতে রেখেছে করোনার বিরুদ্ধে লড়াইতে।
মুসলিমদের নামাজের জন্য দিনে ৫ বার (ওজু) হাত-মুখ ধুতে হয়। এটাও প্রচারে উল্লেখ করা হচ্ছে। অনেকে আবার নিজ ধর্মকে বড় করতে গিয়ে অনেক মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। গোমূত্র খেলে করোনা ভাল হয়, এমন প্রচারে ভারতে গোমূত্র খেয়ে অনেকে অসুস্থ্য হয়েছেন। অনেক ভুল কবিরাজ বা রাজনৈতিক নেতার মন গড়া ঔষধ খেয়ে অনেকে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন। ট্রাম্পের কথায় কুইনাইন জাতীয় মেলেরিয়ার ঔষধ খেয়ে আফ্রিকাতে অনেকে মারা গেছেন।
বিজ্ঞানের উপর জনগন বিশ্বাস রাখবে নাকি আবারও ধর্ম বিশ্বাসের দিকেই বিপুল ভাবে ফিরে যাবে এমন বিভাজন অনেক সমাজের জনগনের মধ্যেই দেখা দিয়েছে এই করোনার কালে। এই প্রসঙ্গে বারবার ফিরে আসছে আলবেয়ার কামুর উপন্যাসের চরিত্রগুলো। ইতমেধ্য প্রচুর লেখা হয়েছে কামুর প্লেগ উপন্যাসটি নিয়ে। করোনার কালেও সমাজে ঠিক প্লেগ উপন্যাসের চরিত্রগুলো যেন আবার জেগে উঠছে। কামুর উপন্যাসে মৃত্যুর চেয়ে সংগ্রাম যেমন প্রধান হয়ে উঠেছিল করোনার কালে বরং উল্টা। মৃত্যুই এখানে মূলত গোটা দুনিয়াকে প্যানিকে ফেলে দিয়েছে।
তবে এই বিবাদে দর্শনের সাথে বিজ্ঞানের যে বাহাস তা আবার শুরু হওয়ার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। আসলে দেকার্ত বা কান্টের পরে এই তর্ক অনেক শক্তিশালী জায়গা অর্জন করলেও আজও এই তর্ক সব মীমাংসার পথ তৈরি করতে পরে নাই। ফলে এখানেও দর্শনের দায়িত্ব রয়ে গিয়েছে।
প্রকাশিতব্য গ্রস্থ: `The war between faith and science: philosophical response on a twenty-first-century pandemic’ থেকে দরকারী কিছু অংশ নিয়ে “ভাওয়াল বার্তা” পাঠকদের জন্য এই প্রবন্ধটি তৈরি করা হয়েছে।