চীনের উত্থান বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। দেশটিকে ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র সকল প্রচেষ্টাই চালু রেখেছে। ট্রাম্প আমলে চীন-যুক্তরাষ্ট্র বিরোধ বাণিজ্য যুদ্ধের মধ্যে উত্তাপ ছড়িয়েছিল।
ইন্দো প্যাসিফিক কৌশল নিয়েও অল্পস্বল্প উত্তেজনা ছড়িয়েছিল। বাইডেনের আগমনে অনেকে ভেবেছিলেন দেশ দুটির অহিনকুল সম্পর্ক কমে যাবে। যুক্তরাষ্ট্রের নানা কর্মকাণ্ড সেই প্রত্যাশাকে বাতিলের খাতায় ফেলে দিয়েছে।
ক্ষমতার আসার পরেই বাইডেন কোয়াড বৈঠক করেছেন। কিছুদিন আগে জি- ৭ জোট ও ন্যাটোর সম্মেলনে হাজিরা দিয়েছেন। সব ফোরামেই বাইডেন সরবে-নীরবে চীনকে শায়েস্তা করার কথাই বলেছেন।
চীনের বিআরআই (Belt and Road Initiative) -কে টেক্কা দিতে বি৩ (Build Back Better world) ফর্মুলা দিয়েছেন। চীনকে ঠেকাতে ২০১৯ সালে গঠিত Blue Dot Network -কেও সচল করেছেন। চীনের সামরিক ও অর্থনৈতিক উচ্চাশাকে ধূলিসাৎ করতে যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট ২৫০ বিলিয়ন ডলার অনুমোদন করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের এতসব হাকডাক শুনে চীনও জোরেশোরে জবাব দিতে শুরু করেছে। চীন নেকড়ে যোদ্ধা কূটনীতি অনুসরণ করতে শুরু করেছে। এই কূটনীতির মোদ্দা কথা হল চীনের বিরুদ্ধে প্রচারিত সব প্রোপাগাণ্ডার সমুচিত জবাব দিতে কড়া ভাষার ব্যবহার।
সম্প্রতি কমিউনিস্ট পার্টি অব চায়নার শতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে শি জিন পিং বলেছেন, ‘চীনের বিরুদ্ধে লাগলে মাথা ভেঙে দেয়া হবে।’ এমন দম্ভোক্তি অবশ্য আগে খুব বেশি শোনা যেত না। চীনা রাষ্ট্রদূত কোয়াডের ব্যাপারে বাংলাদেশকেও শক্ত বার্তা দিয়েছেন।
চীনের এমন দম্ভোক্তি পূর্ণ আচরণ আগে খুব বেশি শোনা যেত না। আগে চীন চুপচাপই থাকতো, শক্তির প্রদর্শনীও কম করতো। এখন সময় বদলেছে চীন চড়া সুরে কথা বলতে শিখেছে। তবে কি চীন তার প্রত্যাশিত সময়কে পেয়ে গিয়েছে? দেং জিয়াও পিং বলতেন, ‘ Hide one’s strength and bide one’s time’.
চীনের অর্থনৈতিক পাটাতন এতটাই শক্ত হয়েছে যে পুরো বিশ্ব আজ নানাভাবে চীনের উপর নির্ভরশীল। চীনের এই উত্থানের পিছনে পুরো অবদান হল কমিউনিস্ট পার্টি অব চায়নার। ৭০ বছর ধরে দলটি চীন শাসন করছে।
দলটির সম্পর্কে কিছুমিছু তথ্য জানা থাকলে নিশ্চয় মন্দ হয় না। চলুন দলটি সম্পর্কে কিছু তথ্য জেনে নেয়া যাক।
করোনা মহামরি, রাজনৈতিক ও দার্শনিক পর্যবেক্ষণ
কমিউনিস্ট পার্টি অব চায়না
১৯২১ সালে দলটির জন্ম হয়। দলটির প্রথম সম্মেলন হয় সাংহাইয়ে৷ দলটি গঠনে সোভিয়েত ইউনিয়ন কমিউনিস্ট পার্টি সাহায্য করেছিল। মাও জে দং সহ ১২ জন নেতার মাধ্যমে দলটির সূচনা হয়। ২০০০ বছরের রাজতান্ত্রিক শাসন শেষ হলে চীনে একের পর এক রাজনৈতিক মডেল ব্যর্থ হয়। এই সময় কার্ল মার্ক্সস এর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তৈরি হয় ‘কমিউনিস্ট পার্টি অব চায়না’। এটি বর্তমানে বিশ্বের ২য় বৃহত্তম, কিন্তু আকারে ভারতীয় জনতা পার্টির অর্ধেক।
প্রথম সম্মেলনের সময় মাও জে দং হুনান প্রদেশের প্রতিনিধি ছিলেন। ১৯৩৫ সালে তিনি রেড আর্মির সেনাপতি পদে বসেন। ১৯৪৯ সালে সাংস্কৃতিক বিপ্লব সংঘটিত হয়। এর মধ্য দিয়ে বর্তমান চীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। মাও জে দং এই বিপ্লবের মূল কারিগর ছিলেন।
চীনের সব জনগণ কি দলটির সদস্য?
চীনের মোট জনসংখ্যার মাত্র ৬.৭ ভাগ কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছে। প্রথম দিকে দলটি কৃষক ও খেতমজুরদের নিয়ে গঠিত হয়েছিল।১৯৮২ সালে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র, ২০০২ সালে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের জন্য পার্টির দরজা খুলে দেওয়া হয়।দলটিতে পুরুষদের আধিপত্য রয়েছে। উপরের সারির ৭ জন নেতার সবাই পুরুষ। দলটির মোট সদস্যের মাত্র ২৮.৮ ভাগ হল মহিলা। দলটিতে ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর হিস্যা রয়েছে মাত্র ৭.৫ ভাগ যা চীনের মোট জনসংখ্যার অনুপাতে খুবই নগণ্য।দলটির সদস্যরা কোন ধর্মে বিশ্বাস করেন না, এমনকি সদস্য হতে হলে চীনের শতাব্দী কাল আগে থেকে চলে আসা ধর্মবিশ্বাস বৌদ্ধবাদ ও তাওবাদ-কে ত্যাগ করতে হয়।
চীনে বাজার অর্থনীতি চালু আছে
দলটি মার্ক্সের ইউটোপিয়ান কমিউনিজম মতবাদকে ত্যাগ করেছে। উৎপাদনের যৌথ মালিকানা ও সামাজিক শ্রেণীবিভাগ ও বৈষম্যহীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই মার্ক্সবাদের মূলকথা। ১৯৮০-৯০ সালে দেং জিয়াও পিং সংস্কার প্রক্রিয়া শুরু করেন। মুক্ত বাজার অর্থনীতি চালু করেন, চীনের বাজার উন্মুক্ত করে দেন, আন্তর্জাতিক অনেক সংস্থায় চীন যুক্ত হয়। দলটি সমাজতন্ত্রের চীনা ভার্সন প্রতিষ্ঠিত করেছে, লেনিনের কর্তৃত্ববাদী নীতিকে আঁকড়ে ধরে চীনে এক দলীয় শাসন কায়েম করেছে।
দলের সদস্য হতে লম্বা পথ পাড়ি দিতে হয়
চীনা তরুণেরা ৭ বছর বয়স থেকেই দলের রাজনৈতিক ইতিহাস সম্পর্কে জানতে শুরু করে। প্রাইমারিতে পড়ার সময় মেধাবী তরুণদের শিক্ষকের বাছাই করে ‘Young Pioneers’ এ যুক্ত করেন। বাছাইকৃতদের লাল কলার ব্যান্ড পরিয়ে দেয়া হয়। সাধারণ ছাত্রদের নিয়ন্ত্রণ করতে তাদের দায়িত্ব দেয়া হয়। এর মধ্য দিয়ে নেতৃত্বের গুণাবলী বিকশিত হয়। একই পদ্ধতি মাধ্যমিক পর্যায়েও অনুসরণ করা হয়। এখানে ভাল ছাত্ররা দলের টিনেজ শাখা ‘যুবলীগ’ এ যুক্ত হয়। দলের প্রকৃত সদস্য হিসেবে যুক্ত হতে কঠিন পদ্ধতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এই প্রক্রিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হয়ে ২/৩ বছর পর্যন্ত চলে।
প্রক্রিয়ার অনেকগুলো ধাপ পেরিয়ে দলের হাতুড়ি -কাস্তে পতাকার সামনে দাঁড়িয়ে শপথ গ্রহণের মধ্য দিয়ে সমাপ্ত হয়। দলের সদস্যরা চীনে মর্যাদাবান হিসেবে বিবেচিত হন। সদস্যপ্রাপ্তি উন্নত ক্যারিয়ার তৈরিতেও সহায়ক। সদস্যরা সরকারী ও বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠানে পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধাসহ চাকরি করতে পারে। সদস্যদের দলীয় নিয়ম শৃঙ্খলার প্রতি অনুগত থাকতে হয়। ২০১২ সালে শি জিং পিং আসার পর নিয়ম-কানুনে আরো বেশি কঠোরতা আরোপ করা হয়েছে। জিং পিং প্রায় ১.৪ মিলিয়ন সদস্যকে দুর্নীতি ও অনিয়ন্ত্রিত ব্যয় করার অপরাধে শাস্তি দিয়েছেন।
।চীন-ইরানের চুক্তি; ভূ-রাজনীতিতে কি পালা বদল হবে ?
সিপিসি কতটা শক্তিশালী?
চীনের সবচেয়ে শক্তিশালী ও প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠান হল ‘কমিউনিস্ট পার্টি অব চায়না’।দলটি চীনের পার্লামেন্ট নিয়ন্ত্রণ করে, প্রয়োজন অনুযায়ী আইন প্রণয়ন ও সংশোধন করতে পারে। আদালত ও আইনপ্রয়োগ কারী সংস্থাকে সিপিসির কাছে জবাবদিহি করতে হয়।রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম দলের এজেন্ডা বাস্তবায়নের মেশিন হিসেবে কাজ করে। সিপিসির অতীত কালো ইতিহাস বিস্মৃতির অতলে পাঠিয়ে দিতে গণমাধ্যমকে ব্যবহার করা হয়।
সামরিক বাহিনীর পুরো নিয়ন্ত্রণ রয়েছে শি জিং পিং এর হাতে। তিনি একই সাথে সিপিসির সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় সামরিক পরিষদের চেয়ারম্যান। বলা যায় দলটির বিচরণ চীনের সর্বজায়গায়। প্রত্যেকটি সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে দলের শাখা গঠিত হয়। প্রতিষ্ঠানগুলোতে দলের দুই বা তিন জন সদস্য কর্মরত থাকলে শাখা গঠন অপরিহার্য। সদস্যদের কোনো পরিচিতি কার্ড দেওয়া হয় না। প্রত্যেক সদস্যকে তাদের আয়ের ০.৫ -২ ভাগ দলকে দিতে হয়। শি জিং পিং অবশ্য সদস্যের স্তর অনুযায়ী পার্টি ব্যাজ পরতে অনুপ্রাণিত করেন।
সিপিসি চীনকে এগিয়ে নিয়েছে সত্য, তবে সিপিসির কিছু কালো অধ্যায়ও আছে। বিশ শতকের বড় বড় বিক্ষোভ বা বিশৃঙ্খলার বিষয়গুলো সিপিসি আড়ালে রাখতে চেষ্টা করে। ঐতিহাসিকদের মতে, এসব বিদ্রোহে লাখো মানুষ মারা গেছেন।১৯৫৮ থেকে ১৯৬০ সালের ‘গ্রেট লিপ ফরোয়ার্ড’ নামের দুর্ভিক্ষ, ১৯৬৬ সাল থেকে শুরু হওয়া ‘সংস্কৃতি বিপ্লব’ ও ১৯৮৯ সালের তিয়েনআনমেন স্কয়ারের হত্যাকাণ্ডের বিষয়গুলো এখনো মুছে যায়নি।
।কাশ্মীরে ফেল হিন্দুত্ববাদ, মোদীর দায় হয়ে উঠবে
অন্যদিকে চীন জনগণের উপর নজরদারিতে শীর্ষে। জর্জ অরওয়েলের যুগ চীন থেকে শুরু হলেও অবাক হওয়ার থাকবে না। জর্জ অরওয়েলে ১৯৪৯ সালে নাইটিন এইটিফোর উপন্যাসে এক কাল্পনিক পৃথিবীর চিত্র এঁকেছিলেন। যেখানে মানুষের বাক-স্বাধীনতার কোনো স্থান নেই, মানুষের যাবতীয় কর্মকাণ্ড সরকার পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। সেখানে একটি বিখ্যাত উক্তি ছিল ‘Big Brother is watching you’. চীনের কর্মকাণ্ড সেই যুগকেই যেন সামনে নিয়ে আসছে। রয়টার্সের এক গবেষণার তথ্য বলছে, শুধু ২০১৯ সালেই চীন সরকার ৫৮ হাজার নয়শটি নজরদারি বিষয়ে বিভিন্ন অ্যাপ, সফটওয়্যার ও পণ্যের কপিরাইটের জন্য আবেদন করেছে। সারা বিশ্বে প্রায় ৭৭০ মিলিয়ন নজরদারি ক্যামেরা চালু আছে যার ৫৪ শতাংশ রয়েছে চীনে।
মাইক্রোসফটের প্রেসিডেন্ট ব্রাড স্মিথও এক আলোচনায় জর্জ অরওয়েলের এই উপন্যাসের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, ২০২৪ সালের মধ্যেই হয়তো আমরা ‘নাইনটিন এইটিফোর’-এ বর্ণিত পৃথিবীতে নিজেদের দেখতে পাবো।’পৃথিবী সেই দিকেই এগিয়ে চলছে। ১৯৮৪ এ বর্ণিত পৃথিবীর যাত্রা চীন থেকেই শুরু হয় কিনা দেখার অপেক্ষা!
সর্বশেষ, ইতিহাসবিদ টিফার্ট এর আপ্তবাক্য স্মরণ করিয়ে দিয়ে শেষ করছি। তিনি লিখেছেন, ‘ সিপিসি এখন আর কমিউনিজমের কথা বলে না, তারা মানুষকে ভালো রাখার কথা বলে। আর তা টেকসই করতে সব ভুল পদক্ষেপগুলো গোপন করতে চায়।