এবার চর দেখতে ২০ সরকারি কর্মকর্তার যুক্তরাষ্ট্র-অস্ট্রেলিয়া সফর
Advertisements

চরের মানুষের উন্নয়ন করতে হবে। কিন্তু কীভাবে হবে? তার জন্য তো অভিজ্ঞতা দরকার। সেই অভিজ্ঞতা আবার যেনতেন হলে তো চলবে না। উন্নত দেশের অভিজ্ঞতা লাগবে। সে কারণে ২০ জন সরকারি কর্মকর্তাকে যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়ায় পাঠিয়ে প্র‘শিক্ষিত’ করা হচ্ছে। তাঁদের মধ্যে ৯ জন ইতিমধ্যে অস্ট্রেলিয়া ঘুরে এসেছেন। বাকিরা শিগগির যুক্তরাষ্ট্রে যাবেন বলে ঠিক আছে।

যে প্রকল্পের অধীনে এই প্রশিক্ষণ সফর, তার নাম ‘চর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড সেটেলমেন্ট প্রজেক্ট ব্রিজিং (সিডিএসপি-বি)। এ প্রকল্পে বরাদ্দ মাত্র ১১ কোটি টাকা। কাগজ-কলমে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হচ্ছে চলতি জুন মাসেই। সে কারণে মেয়াদ শেষের আগেই এ সফর শেষ করার এত আয়োজন। সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তারাই বলছেন, সহকারী কমিশনার (ভূমি) পদের ওপরের কারও এ প্রকল্প থেকে নেওয়া জ্ঞান কাজে লাগানোর সুযোগ নেই। যদিও সফরকারীদের তালিকায় সচিব, মন্ত্রীর পিএস, সচিবের পিএস, দুই জেলা প্রশাসক, দুই অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকসহ বিভিন্ন পদমর্যাদার কর্মকর্তারা আছেন।

যুক্তরাষ্ট্র বা অস্ট্রেলিয়ায় কী চর আছে, না ভূমিহীন মানুষ আছে? তাহলে প্রশিক্ষণের জন্য এসব দেশে কেন যেতে হবে? প্রকল্পটির পরিচালক ও নোয়াখালীর জেলা প্রশাসক দেওয়ান মাহবুবুর রহমান এ প্রশ্নের জবাব দেননি।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বিষয়টি শুনেই বিস্মিত হয়ে বললেন, চর উন্নয়ন দেখার জন্য অস্ট্রেলিয়া-আমেরিকায় যেতে হবে? অজুহাতের তো একটা সীমা থাকে। তিনি বলেন, ‘এটা বলাই যেতে পারে এ সফরের ফলাফল কোনো কাজে আসবে না।’

এই সফরে যাঁরা যাচ্ছেন তাঁরা সৌভাগ্যবান। কারণ, সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফরে লাগাম টানার মাত্র তিন দিন আগে এই আদেশ হয়েছে। ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে ৮ মে দুই দফায় ২০ জন সরকারি কর্মকর্তার নামে জিও (সরকারি আদেশ) হয়েছে। যদিও ১২ মে সরকারি কর্মকর্তাদের সব ধরনের বিদেশ সফরে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে সরকার। বিদেশ সফরের ক্ষেত্রে এ ধরনের আদেশের নির্দেশনা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রজ্ঞাপন হিসেবে দেখানো হয়। এই প্রকল্পের ক্ষেত্রে তা দেখানো হয়েছে মন্ত্রণালয়ের নোটিশ বোর্ডে, যাতে সহজেই নজর এড়ানো যায়।

এই প্রকল্পের আওতায় অস্ট্রেলিয়া গিয়েছিলেন ভূমি মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো. তাজুল ইসলাম মিয়া ও মো. আসাদুজ্জামান, মন্ত্রণালয়ের জমি বন্দোবস্ত পরামর্শক মো. রেজাউল করিম, চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ নাজমুল আহসান, নোয়াখালী জেলার কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. জিয়াউল হক মীর, সুবর্ণচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা চৈতি সর্ববিদ্যা, পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন-মূল্যায়ন ও পরিবীক্ষণ বিভাগের উপসচিব সাইফুল ইসলাম, কোম্পানীগঞ্জের সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. আল-আমিন ও চট্টগ্রামের সন্দ্বীপের সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. মইন উদ্দিন। তবে যাওয়ার তালিকায় নাম থাকলেও ভূমি মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মো. মকবুল হোসেন অস্ট্রেলিয়ায় যাননি।

বাকি ৯ জন অস্ট্রেলিয়ার সিডনি, ক্যানবেরা ও মেলবোর্নে পাঁচ দিনের সফর শেষে ২০ জুন দেশে ফিরেছেন। অস্ট্রেলিয়া সফরের দলনেতা উপসচিব মো. তাজুল ইসলাম মিয়া আগামী সেপ্টেম্বরে অবসরে যাচ্ছেন। আবার সফর থেকে অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরে আসার পরদিনই ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে বদলি হয়েছেন উপসচিব মো. আসাদুজ্জামান। তাঁর নতুন কর্মস্থল এখন সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়। চরবিষয়ক অভিজ্ঞতা এখন তাঁর কী কাজে লাগবে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সফরের অভিজ্ঞতা তো অবশ্যই কাজে লাগবে, লাগবে না কেন? অস্ট্রেলিয়াতে চর নেই। মরুভূমি, বিরানভূমি তো আছে।’

আর এ মাসে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার কথা রয়েছে ভূমি মন্ত্রণালয়ের সচিব মোস্তাফিজুর রহমান, সচিবের একান্ত সচিব (পিএস) মো. আবু হাসান সিদ্দিক, ভূমিমন্ত্রীর একান্ত সচিব মো. রাজ্জাকুল ইসলাম, পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লি প্রতিষ্ঠানের জয়েন্ট চিফ মোহাম্মদ এনামুল হক, ভূমি মন্ত্রণালয়ের উপসচিব জাহিদ হাসান পনির, নোয়াখালীর জেলা প্রশাসক ও প্রকল্প পরিচালক দেওয়ান মাহবুবুর রহমান, চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ও অতিরিক্ত প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ মমিনুর রহমান, নোয়াখালীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ও উপ-প্রকল্প পরিচালক মো. রবিউল হাসান, সন্দ্বীপের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও উপ-প্রকল্প পরিচালক সম্রাট খীসা এবং সুবর্ণচর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. আরিফুর রহমান।

তিন বছরের এই প্রকল্পে ৭ কোটি ৮৭ লাখ ৭১ হাজার টাকা দেবে ইফাদ (আন্তর্জাতিক কৃষি উন্নয়ন তহবিল)। বাকি টাকা দেবে বাংলাদেশ সরকার। এ প্রকল্পে এ পর্যন্ত বাস্তবায়ন হার ৭০ শতাংশের মতো। যদিও এ জুনেই প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা ছিল।

নোয়াখালীর সুবর্ণচর ও কোম্পানীগঞ্জ এবং চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রকল্পের মাধ্যমে উপকূলীয় অধিবাসীদের নিরাপদ বসতি স্থাপন ও তাদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন করা।

প্রকল্প পরিচালক ও নোয়াখালীর জেলা প্রশাসক দেওয়ান মাহবুবুর রহমান বলেন, প্রকল্পের আওতায় অনেক কাজ হচ্ছে। ভূমিহীনদের জমি বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। এ পর্যন্ত প্রায় চার শ ভূমিহীন জমি পেয়েছেন। চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ ও নোয়াখালীর চরাঞ্চলে এ কাজ চলছে।

প্রকল্পের নথিপত্রে দেখা গেছে, ১৯৮০ সাল থেকে দেশে ভূমি পুনরুদ্ধার প্রকল্পের মাধ্যমে সমুদ্র থেকে ভূমি পুনরুদ্ধার ও চর উন্নয়নের কাজ শুরু হয়। পরে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল, বিশেষত নোয়াখালীতে চর উন্নয়ন ও বসতি স্থাপন প্রকল্প-১,২, ৩ ও ৪-এর মাধ্যমে ১৯৯৪ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ব্যাপক চর উন্নয়ন এবং ভূমি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ভূমি বন্দোবস্তের কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়। ইতিমধ্যে এ প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে ২৫ বছরে সমুদ্রে জেগে ওঠা ৪৫ হাজার একর জমির সার্বিক উন্নয়ন সাধন করে ভূমি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে নদীভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত ৩৫ হাজার ভূমিহীন পরিবারকে কৃষি খাসজমি বন্দোবস্ত দিয়ে পুনর্বাসন করা হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় এই প্রকল্প চলছে।

মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, অনেক দিন ধরে দফায় দফায় চর ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ হচ্ছে। তাই এ প্রকল্পে বিদেশ সফরে কোনো প্রয়োজন ছিল না। যদি যেতেই হয় তাহলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের যাওয়া উচিত ছিল। সহকারী কমিশনার (ভূমি) পদের ওপরের কারও এ প্রকল্প থেকে নেওয়া জ্ঞান কোনো কাজে লাগানোর সুযোগ নেই। তিনি আরও বলেন, বিদেশ সফর থেকে আসার পর এক কর্মকর্তা বদলি হয়ে গেছেন। আরও দুজনের তিন থেকে চার মাসের মধ্যে অবসরে যাওয়ার কথাও রয়েছে।

জানতে চাইলে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, যাঁরা এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাঁদের জবাবদিহির আওতায় আনা উচিত, বিষয়টি খতিয়ে দেখাও উচিত। অর্থসহায়তাকারী হিসেবে ইফাদেরও দায় আছে। তাদের দেখা উচিত ছিল, সফরের স্থান নির্বাচন ও কারা সফরে যাচ্ছেন এবং তাঁদের দ্বারা প্রকল্পের কতটা উপকার হবে।

সূত্রঃ আজকের পত্রিকা

Advertisements