মানুষ নিজের প্রয়োজনে সবার সাথে মিলেমিশে থাকে, পরিবার গড়ে তোলে, সমাজবদ্ধ জীবনযাপন করে। সমাজবিচ্ছিন্ন মানুষকে তাই এরিস্টটল মানবেতর নয়তো অতিমানব আখ্যা দিয়েছিলেন। দৈনন্দিন জীবনের বাস্তবতায় তাঁর কথা ভুল কিছু নয়। কারও জন্য একা থাকা খুব কঠিন, দুঃসহ। প্রতিদিন আমরা যেসবের প্রয়োজন অনুভব করি, তা খাদ্য হোক কিংবা বস্ত্র, সবই অসংখ্য হাত ঘুরে আমাদের কাছে আসে। এতো গেলো বস্তুগত প্রয়োজনের কথা। ঘনিষ্ট মানুষ না থাকলে মানসিক প্রশান্তির আশাও বৃথা। স্ত্রী-সন্তান-পরিবারহীন কোন মানুষ জীবনকে অর্থহীন ও নিরানন্দের ভাবতেই পারেন।
আমরা দেখি হযরত যাকারিয়া আলাইহিস সালাম আল্লাহর কাছে সন্তান চেয়ে বলছেন, ‘আল্লাহ! আমাকে একাকী রাখবেন না।’ (আল কুরআন ২১: ৮৯)
আধুনিক বিশ্বে পারিবারিক বন্ধন ক্রমেই শিথিল হয়ে আসছে। বিপুল জনসংখ্যার এই পৃথিবীতে থেকেও মানুষ একা। সবাইকে নিঃসঙ্গতা আর একাকীত্ব কুঁরে কুঁরে খাচ্ছে। পেশাগত জীবন আর রুটিনমাফিক ব্যাস্ততায় সবাই মগ্ন; এতটুকু কথা বলার সময়ও কারও নেই। এই নিঃসঙ্গতার ফলাফল আসলেই ভয়াবহ। সারা পৃথিবীতে অসংখ্য মানুষ একাকীত্বের অবসাদে আত্মহত্যা করছেন। ব্রিংহ্যাম ইয়ং ইউনিভার্সিটির একটি গবেষণায় দেখা গেছে স্থুলতা কিংবা সিগারেটের চেয়েও একাকিত্বের জন্য মৃত্যুর ঝুঁকি বেশি। একাকিত্বে ভোগা আর প্রতিদিন নিয়ম করে পনোরোটি বিড়ি ফোঁকা একই জিনিস।
আশ্চর্যের বিষয় হল সুফিগণও নিঃসঙ্গ থাকার কথা বলেন; সাধনার একটি পর্যায়ে একাকিত্ব অবলম্বন করতে বলেন। সমাজের ভেতর থেকে, সামাজিক মানুষের মতো আচরণ করে ভেতরে ভেতরে একাকিত্বের চর্চা করেন। এটি নকশবন্দিয়া সুফিদের চারটি মূলনীতির একটি- ‘খুলওয়াত দর আঞ্জুমান’ অর্থাৎ জনারণ্যে থেকেও একাকিত্ব। এরপরও তারা তো আত্মহত্যা বা আত্মবিনাশের দিকে যান না। ড্রাগস কিংবা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়ান না। কারণটা কি? এ প্রশ্নের জবাবেই বর্তমান পৃথিবীর নিঃসঙ্গতাবোধ ও আত্মহত্যার প্রবণতার সমাধান আছে।
এককথায় জবাব হল, সুফিরা বাহ্যিকভাবে মানুষ থেকে নিঃসঙ্গতার চর্চা করলেও তারা আদৌ কখনও নিঃসঙ্গ হন না, একাকিত্বও বোধ করেন না। তাদের কাছে এই সৃষ্টি জগত অনিত্য, নশ্বর। কিন্তু স্রষ্টা অবিনশ্বর, চির-বর্তমান; তিনি সবসময় সাথেই আছেন, দেখছেন, শুনছেন সব প্রার্থনা; এমনকি তাৎক্ষণিক জবাবও দিচ্ছেন। তাই একটুখানি কথা বলার কাউকে না পাওয়া গেলে, সঙ্গীহীন হলে আসলেই কিছু যায় আসে না।
আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা যেখানেই থাকো না কেন, আল্লাহ তোমাদের সাথেই আছেন।’ (আল কোরআনুল কারিম ৫৭:৪)
‘তিনি তো তোমাদের ঘাড়ের ধমনী থেকেও নিকটে।’ (আল কোরআনুল কারিম ৫০:১৬)
‘বরং তিনিই, যিনি বিপদগ্রস্থের ডাকে সাড়া দেন, যখন সে তাঁকে ডাকে।’ (আল কোরআনুল কারিম ২৭: ৬২)
‘আমার বান্দারা যখন আপনার কাছে আমার কথা জিজ্ঞেস করে, বলুন– আমি তো অতি নিকটে। আমি প্রার্থনাকারীর ডাকে সাড়া দেই, যখন সে ডাকে।’ (আল কোরআনুল কারিম ২:১৮৬)
পরম সম্পর্ক তো স্রষ্টার সাথেই, মানুষের সাথে তো নয়। ঘনিষ্ঠ মানুষও কখনও না কখনও চোখের আড়াল হয়। কিন্তু একজন সুফি সবসময় প্রবলভাবে আল্লাহর উপস্থিতি অনুভব করতে পারেন। এটা সার্বক্ষণিক যিকরও বটে। মানুষের সাথে অতিরিক্ত মেলামেশার জন্য যদি এই অনুভবে বাধার সৃষ্টি হয়, তবে সেটাই তাদের কাছে ‘ওয়াহশাত’ বা নিঃসঙ্গতা। ধরুন, শহরে লোডশেডিং হয়েছে। আপনি গভীর আনন্দ নিয়ে জোছনা উপভোগ করছেন। এ সময় বিদ্যুত চলে আসল; কৃত্রিম ঝকঝকে আলোর জন্য আপনার আনন্দের নিদারুন পরিসমাপ্তি ঘটল।
শুয়ায়ব ইবন হারব বলেছেন, আমি একবার কুফায় মালিক ইবন মাসউদের বাসায় গেলাম। সেখানে তিনি একাই ছিলেন। বললাম, ‘আপনার একা একা মনে হয় না?’ তিনি জবাব দিলেন, ‘আল্লাহর সাথে থেকেও কেউ একাকী হয় বলে আমি মনে করি না।’
তাই আল্লাহ তায়ালাকে, আমাদের স্রষ্টা, জীবনদাতা, জীবিকাদাতাকে গভীরভাবে অনুভব করার মাধ্যমে একাকিত্বের অবসাদ থেকে আমরা মুক্তি পেতে পারি, অন্তরঙ্গতার আনন্দ উপলব্ধি করতে পারি। প্রতি চল্লিশ সেকেন্ডে একজন মানুষ আত্মহত্যা করেন। এই বিপুল সম্ভাবনার মৃত্যুও এভাবে ঠেকানো সম্ভব।
শিতালং ফকিরের একটি উক্তি আমার খুব প্রিয়:
“আর লা-মাকানে ছিলা আনন্দিত মন
ভবে আসি পিঞ্জরাতে হইলা বন্ধন।”
প্রায় একই কথা আরও আগে চমৎকার এক উদাহরণ দিয়ে বলে গেছেন মওলানা রুমি। আমরা আল্লাহর কাছে আলমে আরওয়াহে ছিলাম। সেখান থেকে চলে আসতে হয়েছে এই পৃথিবীতে। তাই মানবমন সবসময়ই কাঁদে আবারও আল্লাহর সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য। এটা না পেলেই নিঃসঙ্গতাবোধ আর একাকিত্ববোধের শিকার হতে হয়। বাঁশি যে বাজে, তা বাঁশির গান নয়, বাঁশির কান্না। বাঁশঝাড়ে কাটানো দিনগুলোর কথা ভেবে সে কাঁদে। মাওলানা রুমি মসনভির একেবারে শুরুতে বলেছেন,
“বেশনো আয নায় চুঁ হেকায়াত মি কুনাদ
আয জুদাইহা শেকায়েত মি কুনাদ।”
“মন দিয়ে শোনো বাঁশি কি বলে-
সে তো তার বিচ্ছেদের জন্য অনুযোগ করছে।’’
তথ্যসূত্র:
১. আল কোরআনুল কারিম
২. আর রিসালাতুল কুশায়রিয়্যাহ
৩. মসনভিয়ে মানভি
৪. সাইকোলজি টুডে ডটকম
৫. নিউ ইয়র্কার ডটকম