গ্যাসসঙ্কটে যমুনার পর বন্ধ হলো সিইউএফএল
Advertisements

হঠাৎ করে গ্যাসের চাপ কমে যাওয়ায় সার উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেল দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ সার উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেডের (সিইউএফএল)। ১৯ জুলাই রাত সাড়ে ৯টা থেকে সরবরাহকৃত গ্যাসের চাপ কমে যাওয়ায় ইউরিয়া সার উৎপাদন বন্ধ রয়েছে বলে গতকাল বিকেলে নিশ্চিত করেন সিইউএফএলের জিএম অপারেশন প্রদীপ চন্দ্র নাথ। বর্তমানে ওই সার কারখানায় শুধুমাত্র ইউরিয়ার সার উৎপাদনে সরবরাহকৃত গ্যাসের চাপ ৪৭ মিলিয়ন ঘনফুট প্রয়োজন। কবে নাগাদ প্রয়োজনীয় গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করা হবে বিষয়টি জানতে একাধিকবার কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির কর্মকর্তাদের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলেও কেউ বিষয়টি নিশ্চিত করেননি।
গ্যাসের সরবরাহ না পেয়ে ইউরিয়া উৎপাদনকারী যমুনা ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেড (জেএফসিএল) প্রায় এক মাস ধরে সার উৎপাদন করতে পারছে না। আগামী তিন মাস কারখানাটি চালু হওয়ার কোনো সম্ভাবনা দেখছেন না সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

চট্টগ্রাম ব্যুরো জানিয়েছে, গ্যাসসঙ্কটের কারণে এবার বন্ধের তালিকায় দেশের অন্যতম রাষ্ট্রায়ত্ত সার কারখানা চিটাগং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার কোম্পানি (সিইউএফএল) যুক্ত হলেও চালু রয়েছে বহুজাতিক সার কারখানা কাফকো। ২০১৩ সালের জানুয়ারি থেকে একাধিকবার গ্যাস সরবরাহজনিত কারণে সিইউএফএলের সার উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। প্রতিবারই গ্যাস সরবরাহে সঙ্কট দেখা দিলে সিইউএফএল বন্ধ রেখে কাফকো চালু রাখা হয়।

চট্টগ্রামের আনোয়ারায় অবস্থিত চিটাগং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড (সিইউএফএল) কোম্পানির সূত্রগুলো জানিয়েছে, ইউরিয়া ও অ্যামোনিয়া সার উৎপাদনে প্রাকৃতিক গ্যাস প্রধান কাঁচামাল হওয়ায়, উৎপাদনকার্যক্রম সচল রাখতে হলে সিইউএফএলের দৈনিক ৪১ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ দরকার।

চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার রাঙ্গাদিয়ায় ২৯ অক্টোবর ১৯৮৭ সালে ১৫৫৬ কোটি টাকা ব্যয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত সার কারখানা সিইউএফএল প্রতিষ্ঠা লাভ করে। পরীক্ষামূলকভাবে উৎপাদন শুরু হয় ২৯ অক্টোবর ১৯৮৭ সালে। আর বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু করে ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৮ থেকে। শুরুতে এর উৎপাদনক্ষমতা ছিল প্রতিদিন ১৭০০ মেট্রিকটন হিসাবে বছরে ৫ লাখ ৬১ হাজার মেট্রিকটন ইউরিয়া এবং প্রতিদিন ১০০০ মেট্রিকটন করে বছরে ৩ লাখ ৩০ হাজার মেট্রিকটন অ্যামোনিয়া। আর এই কারখানাটির উৎপাদনসক্ষমতা নির্ধারণ করা হয়েছিল শুরু থেকে ২০ বছর।

গ্যাসসঙ্কটে একের পর এক সার কারখানা বন্ধ হয়ে গেলে খাদ্যনিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়তে পারে। কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক নিজেই বলেছেন, দু’টি কারখানার ইউরিয়া সার উৎপাদন বন্ধ হলে শঙ্কা সৃষ্টি হতে পারে। তিনি অবশ্য উল্লেখ করেন, দেশে সারের কোনো সঙ্কট হবে না, তবে রাশিয়া-ইউক্রেনের চলমান যুদ্ধ প্রলম্বিত হলে ভর্তুকি আরো বাড়বে। আর যমুনা ও চট্টগ্রাম সার কারখানা গ্যাসসঙ্কটের কারণে সার উৎপাদন সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ইউরিয়া সার নিয়ে কিছুটা শঙ্কা রয়েছে। কারখানা দু’টি চালু করার জন্য আমরা চেষ্টা করছি। স্থানীয়ভাবে উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেলে ইউরিয়া সার আমদানিতে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হবে এবং সারে ভর্তুকির পরিমাণ আরো বাড়বে। এ ছাড়া, গ্যাসসঙ্কটের কারণে সার কারখানা বন্ধ হলে খাদ্য উৎপাদন ব্যাপকভাবে ব্যাহত হবে।

গতকাল বুধবার দুপুরে সচিবালয়ে ঢাকায় নিযুক্ত সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত নাথালি চুয়ার্ডের সাথে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের কৃষিমন্ত্রী আরো বলেন, যুদ্ধের কারণে আমরা রাশিয়া ও বেলারুশ থেকে সার আমদানি করতে পারছি না। তবে সরকারের ত্বরিত পদক্ষেপে বিকল্প উৎস কানাডা থেকে সার আনা সম্ভব হচ্ছে। এই মুহূর্তে সারের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। টিএসপি, এমওপি ও ডিএপি সারের যে মজুদ রয়েছে, তাতে আগামী বোরো মৌসুম পর্যন্ত কোনো সমস্যা হবে না।

কৃষিমন্ত্রী বলেন, রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা বিশ্বের নিষেধাজ্ঞার কারণে বাংলাদেশ সার আমদানি করতে পারছে না এবং এর ফলে সরকারকে সারে অতিরিক্ত দুই হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। মন্ত্রী বলেন, সার রফতানিতে রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া উচিত।

জানা গেছে, চট্টগ্রাম ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড (সিইউএফএল) কোম্পানি বন্ধ হওয়ার পর শাহজালাল ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরি লিমিটেড এবং আশুগঞ্জ ফার্টিলাইজার অ্যান্ড কেমিক্যাল কোম্পানিও একই ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে।
পেট্রেবাংলার তথ্যানুসারে, সার উৎপাদনকারী কারখানাগুলো চালু রাখতে হলে দৈনিক ৩১৬ মিলিয়ন ঘনমিটার গ্যাস দরকার। কিন্তু কারখানাগুলো পাচ্ছে ১৫৯ মিলিয়ন ঘনমিটার। যে কারণে সবগুলো কারখানায় উৎপাদন চালু রাখা সম্ভব নয়। গত মাস পর্যন্ত দৈনিক ৩,১০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করেছে পেট্রোবাংলা, এর মধ্যে ৭৫০ থেকে ৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট ছিল তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি)। আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য অস্থিতিশীল হওয়ায় এলএনজি সরবরাহ সীমিত করে সরকার, ফলে দৈনিক সরবরাহ ২,৮০০ মিলিয়ন ঘনফুটে নেমে এসেছে। বর্তমানে আমদানিকৃত এলএনজি থেকে মাত্র ৪৯০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে।

জেএফসিএলের কর্মকর্তারা জানান, চলতি অর্থবছরে সাড়ে চার লাখ টন সার উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হয়েছে। কিন্তু তিন মাস যদি কারখানা বন্ধ থাকে তাহলে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে না। পূর্ণ সক্ষমতায় চললে কারখানাটি দিনে ১,৭০০ টন সার উৎপাদন করতে পারে। গত ২২ জুন থেকে বন্ধ রয়েছে যমুনা সার কারখানা। তার আগে গ্যাস সরবরাহ কম থাকায় দিনে ১,২৭৫ টন সার উৎপাদন করেছে।

যমুনার একজন শীর্ষ কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে জানান, প্রায় মাসখানেক ধরে গ্যাসসঙ্কটের কারণে কারখানায় উৎপাদন বন্ধ। আমরা আমাদের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোকে জানিয়েছি, চিঠি দিয়েছি, বারবার মিটিং করছি। কিন্তু এখনো এর কোনো সমাধান হয়নি। জেএফসিএলের কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, শিল্প মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি) চেষ্টা করছে কারখানাটিতে গ্যাসের সরবরাহ দেয়ার জন্য।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে রাসায়নিক সার আমদানির ব্যয় অনেক বেশি হওয়ায় সরকার এমনিতেই চাপে রয়েছে। তিনগুণ দাম দিয়ে সার কিনতে হচ্ছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুসারে, ২০২০-২১ অর্থবছরে এক কেজি ইউরিয়া সার আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ৩২ টাকা। চলতি বছর তা কিনতে হচ্ছে ৯৬ টাকা বা তারও বেশি দাম দিয়ে। এই হিসাবে সরকার প্রতি কেজিতে ভর্তুকি দিচ্ছে ৮২ টাকা। এই অবস্থায় গ্যাসের অভাবে স্থানীয় ইউরিয়া সার উৎপাদন ব্যাহত হলে আমদানির ওপর চাপ তৈরি হবে। কোনো কারণে আমদানি করতে না পারলে তার আঘাত আসবে দেশের খাদ্য উৎপাদনে।

কৃষি অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, ‘বিশ্বব্যাপী এখন জ্বালানি ও খাদ্যসঙ্কট তৈরি হয়েছে। কোনোটারই বৈশ্বিক সরবরাহব্যবস্থা স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। এর মধ্যে বাড়তি খাদ্য উৎপাদন করতে হলে, অবশ্যই সারের জোগান ঠিক রাখতে হবে। আগে থেকে এই বিষয়গুলো নিয়ে ভাবলে হয়তো স্থানীয় উৎপাদন বাড়ানোর পরিকল্পনায় যাওয়া যেত। কিন্তু এখন যে অবস্থা তাতে সার উৎপাদক কারখানা বন্ধ করা মোটেও যুক্তিযুক্ত সমাধান নয়। ব্যয় সঙ্কোচনের জন্য স্থানীয়ভাবে সারের উৎপাদন বাড়ানোই এখন মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত হবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষেও জন্য।

সরকারি তথ্যানুসারে, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৬৭ লাখ টন রাসায়নিক সারের চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে শুধু ইউরিয়ার চাহিদাই আছে ২৬ লাখ টন। দেশের চারটি কারখানায় সাড়ে ১০ লাখ মেট্রিকটনের মতো ইউরিয়া উৎপাদন হচ্ছে। অর্থাৎ, বাকি ১৬ লাখ মেট্রিকটন আমদানি করতে হবে। কাফকোকে সরকার ভর্তুকি মূল্যে গ্যাস সরবরাহ করলেও এই কারখানা থেকে সার কিনতে হয় আন্তর্জাতিক বাজারদরে।

বিশ্বব্যাপী সার উৎপাদনকারীরা একই ধরনের গ্যাসসঙ্কটের মুখোমুখি হচ্ছে এবং দাম বাড়ানোর কারণে আমদানিও ব্যয়বহুল হবে। সস্তায় রাশিয়ান গ্যাস সরবরাহের ওপর নির্ভরশীল কিছু ইউরোপীয় সার প্রস্তুতকারক এমনকি গ্যাসের অভাবে উৎপাদন বন্ধ করতেও বাধ্য হয়েছিল।

গ্যাস সরবরাহের ঘাটতি ভারতে সার উৎপাদনে প্রভাব ফেলছে এবং সেখানে খারিপ ফসলকে হুমকির মুখে ফেলছে। ভারতের কৃষি ভর্তুকি বেড়েছে এবং গত বছরের দামে সারের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা সরকারের জন্য একটি বড় উদ্বেগ বলে জানাচ্ছে সে দেশের গণমাধ্যমের প্রতিবেদন। ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশগুলোর জন্য একই ধরনের উদ্বেগ প্রকাশ করে জানিয়েছে, সারের দাম বৃদ্ধি এবং প্রাপ্যতা নিয়ে উদ্বেগ নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে দীর্ঘ সময়ের জন্য ভবিষ্যতের ফসল এবং খাদ্যনিরাপত্তার ওপর ছায়া ফেলবে। বাংলাদেশের মতো দেশে সারে উচ্চ ভর্তুকি ব্যবস্থা কৃষকদের দামের ধাক্কা থেকে মুক্তি দিতে পারে, কিন্তু এতে বাজেটের ওপর প্রচণ্ড আর্থিক চাপ সৃষ্টি হবে বলেও সেখানে সতর্ক করা হয়েছে।

সরকার আগে যেখানে সারে ভর্তুকি দিত ৮-৯ হাজার কোটি টাকা, সেখানে গত অর্থবছর আমদানিতে ২৮ হাজার কোটি টাকা খরচের কথা জানিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। সারের দাম আকাশচুম্বী হওয়ায় গত অর্থবছরের মে পর্যন্ত ১১ মাসে বাংলাদেশকে ৪০০ কোটি ডলারের বেশি ব্যয় করতে হয়েছে, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ২২৩ শতাংশ বেশি।

বৈশ্বিক খাদ্যসঙ্কটের সময়ে দেশে খাদ্যশস্য উৎপাদন বৃদ্ধির সরকারি উদ্যোগ সারসঙ্কটে হুমকির মধ্যে পড়েছে। আমদানির বড় দুই উৎস দেশ রাশিয়া ও বেলারুশ থেকে সার আমদানি বন্ধ হয়ে গেছে। কানাডা, সৌদি আরব, চীন, মরক্কো, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, তিউনিসিয়াসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানির সুযোগ রয়েছে, কিন্তু এসব উৎসেও সারের দাম বেড়েছে। বাড়তি দামের চাপ পড়বে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভে।

এ দিকে শিল্প মন্ত্রণালয়ের সৌদি আরব, কাতার ও দুবাইয়ের সাথে চুক্তি রয়েছে। যেখান থেকে নিয়মিত সার আমদানি করা হয়। কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্র থেকে জানা গেছে, ইউরিয়ার চাহিদা আমাদের ২৬ লাখ মেট্রিকটন, একইসাথে এক বছরের জন্য নিরাপত্তা মজুদ রাখতে হয় ৮ লাখ টন। সব মিলে ইউরিয়া লাগে ৩৪ লাখ টন। ডিসেম্বর পর্যন্ত আমাদের ইউরিয়ার কোনো ঘাটতি নেই। তবে এই অবস্থা চলতে থাকলে এর পরে গিয়ে সঙ্কটের সম্ভাবনা রয়েছে। যেভাবেই হোক সারের জোগান ঠিক রাখার কোনো বিকল্প নেই।

আমন মৌসুমে সাড়ে সাত লাখ টন ইউরিয়া সারের প্রয়োজন হবে। এরপর আসবে সবচেয়ে বড় ফসল- বোরো উৎপাদনের মৌসুম, তখন মোট সার সরবরাহের ৬০ শতাংশ ব্যবহারের চাহিদা থাকবে।

সূত্রঃ নয়া দিগন্ত

Advertisements