ইসলামোফোবিয়া ও অপরাধ
Advertisements

আফ্রিকার নাইজারে ২৭ নভেম্বর শুক্রবার ওআইসির যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্মেলন হলো, তার মূল আহ্বান ছিল- শান্তি ও উন্নয়নের জন্য ইসলামোফোবিয়ার মোকাবেলা। ৫৭ রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের কাউন্সিল বা বিএফএম সম্মেলনের এটি ছিল ৪৭তম অধিবেশন। সম্মেলনের উদ্বোধন করেন নাইজারের প্রেসিডেন্ট মাহামাদু ইসোওইফু। বক্তব্য রাখেন ওআইসির মহাসচিব ড. ইউসুফ আল ওথাইমিন।

দুই দিনের অধিবেশনে বিশেষভাবে স্থান পায় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সঙ্কট, ফিলিস্তিন প্রশ্ন, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই, ধর্মীয় অবমাননা ইত্যাদি। কিন্তু এগুলোও শেষ অবধি ইসলামোফোবিয়ার সাথে নানাভাবে সম্পর্কিত। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বাস্তুচ্যুত করায়, ফিলিস্তিনে হত্যাতাণ্ডব জারি রাখায় কিংবা ইসলামের প্রতি অপমান প্রদর্শনের মধ্যে রক্তজল সরবরাহ করছে আসলে ইসলামোফোবিয়াই। বস্তুত এটি আরো বহুবিধ অপরাধের জমি তৈরি করে দেয়। এটি কেবল একক সমস্যা নয়, বহু সমস্যার জননী।

ইংরেজিতে Islamophobia মূলত ইসলাম সম্পর্কে খারাপ মানসিকতা ও শত্রুতা বা ঘৃণার অর্থে ব্যবহৃত হয়। ফরাসিতে Islamophobie-এর লিখিত ব্যবহার প্রচলিত হয় ঔপনিবেশিক আমলে। ১৯১০ সালে প্রকাশিত The Muslim Policy in French West Africa গ্রন্থে Alain Quellien পশ্চিম আফ্রিকার উপনিবেশসমূহে ফরাসিদের ইসলাম সম্পর্কিত মানসিকতা নির্দেশ করতে শব্দটির ব্যবহার করেন। সন্দেহ নেই, সেই মানসিকতা ঘৃণা ও শত্রুতায় একাকার ছিল। অষধরহ সমালোচনা করেন সেই বিদ্বেষের। তার প্রস্তাবনা ছিল, পিছিয়ে পড়া মুসলিম জনগোষ্ঠীকে ঘৃণা না করেও শাসন করা যায়। কারণ তারা easy to rule সহজে শাসনযোগ্য। ফরাসি শাসকরা সেখানে কঠিন উপায়ে তাদের শাসন করছিল এবং তাদের জন্য বরাদ্দ রেখেছিল রক্তচক্ষু, হত্যা ও এমন ভয়ানক আচরণ, যা কেবল অসভ্যদের প্রাপ্য। ফরাসি নৃতত্ত্ববিদ ও প্রশাসক Maurice Delafosse (১৮৭০-১৯২৬) একই সুরে প্রতিবাদ করেন শাসকদের এ মানসিকতার। মুসলিম জনগোষ্ঠীকে ঘৃণার লক্ষ্যবস্তু বানানো এবং যা কিছু বর্বরদের প্রাপ্য, সেগুলো তাদের জন্য বরাদ্দ করার দৃষ্টিভঙ্গিকে তিনি মনে করতেন ফরাসিদের উপনিবেশ বিস্তারের জন্য সহায়ক নয়। অতএব এ ধরনের ইসলামোফোবিক মানসিকতা পরিহার করা দরকার।

তাহলে দেখা যাচ্ছে, Alain Quellien এবং Maurice Delafosse ফরাসি শাসকদের একটি ভীতি ও ঘৃণার সমালোচনা করছেন, যা বাস্তব ভিত্তিহীন বা অলীক। কিন্তু বদ্ধমূল হয়ে আছে তাদের মনোলোকে। অলীক ভীতিটাই মূলত ফোবিয়া। যে ভীতির সাথে জড়িয়ে থাকে অকারণ দুশ্চিন্তা, আতঙ্ক, বিরক্তি। ফলত ভয়ের বিষয়কে এড়িয়ে চলার বা মোকাবেলা করতে অক্ষমতার একটি অনুভূতি ভীতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে তাড়িয়ে বেড়ায়। সেটা একপর্যায়ে পরিণত হয় রোগে। যখন সে ভয় বা ঘৃণাজনিত কারণে অন্যের ক্ষতি ডেকে আনতে শুরু করে, অন্যের জন্য হয়ে ওঠে বিপজ্জনক। এ ভীতিরোগ চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডার। এটি স্বাভাবিক জীবনকে এবং জীবনের স্বাভাবিকতাকে ব্যাহত করে। এমন ভয়ের নানারূপ থাকতে পারে। যেমন একাকী থাকার আতঙ্ক বা Autophobia, গোসল করা, ধোয়ামোছা অথবা পরিষ্কার করার ভয় বা Ablutophobia, মানুষের প্রতি ভয়, মানুষের সঙ্গী হওয়ার ভয় কিংবা এ জাতীয় সামাজিক ভয় বা Anthropophobia, ফুলের প্রতি ভয় বা Anthophobia, খাবারের প্রতি বিরক্তি-ভয় বা Cibophobia, Sitophobia।

ইসলামোফোবিয়া এমনই এক ভয়। এই ভয়ের জায়গা থেকে ইসলাম সম্পর্কে রোগী ও রাগী যে প্রতিক্রিয়া আসে, সেটি যত গুরুত্ববহ জায়গা থেকেই আসুক, এতে ইসলাম শব্দের মানে (শান্তি ও আত্মসমর্পণ) বদলে যায় না, বিপদ ও ভয়ে পরিণত হয়ে যায় না! ইসলামোফোবিয়া ইসলামের সাথে সম্পর্কিত সব কিছুকে ভয়ের নজরে দেখে ও দেখায়। আমেরিকান লেখক-সাংবাদিক স্টিফেন সোলাইমান সোয়ার্জ (জন্ম : ১৯৪৮-) দেখিয়েছেন, ইসলামোফোবিয়া কিভাবে পশ্চিমা মানসে বর্ণবাদ, এন্টিসেমিটিজম ইত্যাদির মতো অমোচনীয় রোগ হয়ে গেছে! সোয়ার্জের বিচারে ইসলামোফোবিয়া হচ্ছে, সমগ্র ইসলাম এবং তার ইতিহাসকে ঘৃণা করার সেই চর্চা, যা ধারাবাহিক পদ্ধতিতে পরিণত হয়েছে। এটি বহু শতাব্দী ধরে চলে আসা অসুখের ফসল, যা আধুনিক দুনিয়ায় ব্যাপক মাত্রা ও ভয়াবহতা নিয়ে চিৎকৃত। সে বৈধতা দিচ্ছে ইসলাম ও মুসলিমবিরোধী মিথ্যা, হত্যা, লুণ্ঠন, যুদ্ধ, দখল, অবিচারকে!

ফিলিস্তিনের মুক্তির ন্যায্যতার আওয়াজকে সন্ত্রাসের প্রচারে ঢেকে রেখে জায়নবাদী দখলদারির অবৈধতাকে সমাদর করা হচ্ছে কিসের প্রশ্রয়ে? প্রশ্রয় দিচ্ছে ইসলামোফোবিয়া। এমনই জায়গা থেকে ১৯৮৫ সালে, ফিলিস্তিনি চিন্তাবিদ অ্যাডওয়ার্ড সাঈদ (১৯৩৫-২০০৩) শব্দটিকে একাডেমিক জার্নালে হাজির করেন। বিগত শতকের নব্বইয়ের দশকে এর ব্যবহার বেড়ে চলে। বিশেষত সভ্যতার সঙ্ঘাত তত্ত্বের নতুন উল্লম্ফন এবং নাইন/ইলেভেনের পরে ইসলামভীতি ও ঘৃণা দেশে দেশে চিন্তা ও রাজনীতির কেন্দ্রে আসতে থাকে।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক রানিমেইড ট্রাস্ট ১৯৯৬ সালে সব ধর্মাবলম্বী বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে ১৮ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিশন গঠন করে, যার প্রধান ছিলেন অধ্যাপক গর্ডন কনওয়ে। ওই কমিটি যে রিপোর্টগুলো প্রকাশ করে, তার শিরোনাম ছিল- Islamophobia a Challenge For Us All। রিপোর্টটি প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথে ব্রিটিশ মিডিয়ায় তোলপাড় শুরু হয়। অনেকেই একে অবাস্তব বলে উড়িয়ে দেন।

২০ বছর পরে রানিমেইড প্রকাশ করে এর ফলোআপ। যার শিরোনাম ছিল- Islamophobia –still a challenge to us all । এর মানে পরিষ্কার, ইসলামোফোবিয়া কমছিল না। বরং সত্য হলো, বেড়েই চলেছে।

পশ্চিমা মিডিয়া একে ঘরে ঘরে পৌঁছে দিচ্ছিল। কোনো মুসলিমের তরফে অপরাধ ঘটলে তাকে ইসলামী সন্ত্রাস, মুসলিম রাষ্ট্র সমরাস্ত্র তৈরি করলে তাকে ইসলামী অস্ত্র, ইসলামের বিশ্বজনীনতার প্রতিশ্রুতিকে ইসলামী সাম্রাজ্যবাদ ইত্যাদি আখ্যা দেয়ার মধ্যে এমন তীব্র বিদ্রূপ ও বিদ্বেষ গচ্ছিত রাখা হয়, যার ফলে একজন সাধারণ শ্রোতা কিংবা পাঠক ভীতি ও ঘৃণারোগে আক্রান্ত না হয়ে পারছিল না।এভাবেই মুসলিমদের এই কাল, এই সমাজ ও গতিশীল এই পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন দেখা ও দেখানোর প্রচেষ্টা জোরদার হলো। কারণ, তারা ইসলামের অনুসারী। যে ইসলাম ‘সভ্যতার যাত্রাপথে জগদ্দল এক আপদ’! যে ইসলাম ‘ভয়াবহ রকম মনোলিথিক, স্বভাবতই উত্তেজিত, সন্ত্রাসের উৎস’! যে ইসলাম ‘অসহনশীল, বহুত্ববিরোধী, সহ্য করে না ভিন্নমত’! ‘সভ্যতা, শান্তি, মানবাধিকার, নারী স্বাধীনতা, পশ্চিমা সংস্কৃতি-মূল্যবোধ এবং ভিন্নধর্মীদের জন্য’ যে ইসলাম এক ‘নিরেট আপদ’! পশ্চিমা সভ্যতাকে অবশ্যই তার হাত থেকে মানবতাকে রক্ষায় প্রয়াসী হতে হবে! বিশেষত যখন সে সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠাকামী! ইসলামের প্রতি ভীতি অতএব ‘ন্যাচারাল’ ‘একান্তই স্বাভাবিক’!

এমনই দাবির ওপর খাড়া হয় ইসলামোফোবিয়া। এসব দাবি বা অভিযোগের জবাব মুসলিম তো বটেই, অমুসলিম চিন্তকদের অনেকেই দিয়েছেন। তারা প্রমাণ করেছেন, এগুলোর ভিত্তি অজ্ঞতা, বিদ্বেষ ও মধ্যযুগীয় গালগল্প; ইসলামের ব্যবস্থা ও জীবনাচারের সাথে এর সম্পর্ক অপ্রমাণিত। উল্টো বরং ইসলাম শান্তি, প্রগতি ও মানবমুক্তির মহত্তম আশ্বাস ও নিশ্চয়তাকে ধারণ করে। যা চিন্তা ও মনের স্বাধীনতা, মানব মর্যাদা ও অধিকার, নারীর প্রতি ইনসাফ, ন্যায়ের শাসন, সার্বজনীনতা, বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি ও বহুত্ব, ভিন্নধর্মী ও ভিন্ন মতাবলম্বীর প্রতি সহনশীলতা এবং সহাবস্থানের পথিকৃৎ।’

কিন্তু ইসলামোফোবিয়া ইউরোপ মহাদেশের উত্তর থেকে দক্ষিণ, অসলো থেকে লিসবন- সমাজ ও রাজনীতিতে টগবগ করতে লাগল। হাঙ্গেরি, সুইজারল্যান্ড, পোল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, অস্ট্রিয়া বা ডেনমার্কের মতো দেশে রাজনীতির নির্ণায়ক হয়ে ওঠে ইসলামোফোবিয়া। পশ্চিমাদের দুই নম্বর মহাযুদ্ধের পরে সাত দশক ধরে ইউরোপ যেখানে রাজনৈতিকভাবে খ্রিষ্টান গণতান্ত্রিক ধারা, সামাজিক গণতান্ত্রিক ধারা, লিবারেল গণতান্ত্রিক ধারা এবং বাম রাজনৈতিক ধারার চর্চা করছিল, সেখানে ইসলামঘৃণাকে কেন্দ্রে রেখে চরম জাতীয়তাবাদী নব্য নাৎসি দলগুলোর উত্থান ব্যাপক রূপ নিলো।

কেবল পশ্চিমা রাজনীতি নয়, অর্থনীতিতেও ইসলামোফোবিয়া হয়ে উঠেছে গুরুত্বপূর্ণ। একে ঘিরে গড়ে উঠেছে ইন্ডাস্ট্রি। ইসলামভীতি এখন লাভজনক এক ব্যবসা। অনেকের কাছে সম্পদ কামাইয়ের জন্য ইসলামোফোবিয়া ছড়ানোর কাজে নিয়োজিত হওয়া সহজ এক মাধ্যম। উইলফ্রেডো রোইজ দেখিয়েছেন, এ পথে লোকেরা প্রতি বছর মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার কামাই করছে! অনেকেই সাজছে নকল ইসলামবিশেষজ্ঞ!

Council on American-Islamic Relations এবং Center for Race and Gender at UC Berkeley-এর যৌথ গবেষণায় দেখা গেছে, কেবল আমেরিকায় ২০০৮-২০১৩ এর মধ্যে ২০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থ ব্যয় হয়েছে ইসলাম সম্পর্কে ঘৃণা ও ভীতি ছড়াতে। অর্থের বিনিময়ে এতে কাজ করেছে ৭৪টি গ্রুপ। এসব গ্রুপ অত্যন্ত প্রভাবশালী, যাদের মধ্যে আছে মিডিয়া হাউজ, নারীবাদী সংস্থা, থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ইত্যাদি। এর সাথে যুক্ত ছিল পরাশক্তির রাজনীতি। Confronting Fear শিরোনামের এই গবেষণায় দেখানো হয়েছে, ২০১৩ সাল অবধি আমেরিকায় বেড়ে যায় আইন প্রণয়ন বা আইনের সংশোধনী। সেগুলো ইসলামকেই টার্গেট করছিল মূলত। এ সময়ে প্রণীত আইন বা সংশোধনীর ৮১টিই তৈরি হয় ইসলামের অনুশীলনকে আঘাত করার মধ্য দিয়ে। যার ৮০টি প্রণীত হয় রিপাবলিকান দলের হাতে। এ সবের বিষফল ছিল অবধারিত। হিজাব নিষিদ্ধ হয় দেশে দেশে। কুরআন পোড়ানোর ঘটনা, মহানবী সা:-এর অপমান ও ব্যঙ্গ কার্টুন প্রকাশ চলতে থাকে। মুসলিম জনগোষ্ঠী গভীর সঙ্কটের মুখোমুখি হয়। তারা আক্রান্ত হয় গোষ্ঠীর হাতে, সমাজের হাতে, রাষ্ট্রের হাতে। একান্ত ন্যায্য মনে করেই মুসলিমদের বিরুদ্ধে অপরাধ ঘটানো জারি থাকে। মুসলিমদের আঘাত, অপমান এমনকি হত্যার মতো ঘটনা অব্যাহত থাকে।

প্রাচ্যের নানা দেশেও ইসলামোফোবিয়া তৈরি করে হুমকি ও অপরাধের বিশাল বলয়। মিয়ানমার, ভারত, চীন প্রভৃতি রাষ্ট্রে জাতিগত উচ্ছেদ ও গণনিধনের পরিপ্রেক্ষিত তৈরিতে ইসলামোফোবিয়া বারুদের কাজ করে। ভারতের তো প্রেমকে জড়িয়ে লাভ জিহাদ এমনকি করোনার বিস্তারকে করোনা জিহাদ আখ্যা দিয়ে মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর আক্রমণ জারি আছে। এমনকি মুসলিমপ্রধান দেশগুলোতেও ইসলামোফোবিয়াকে অবলম্বন করে গড়ে ওঠে ঘৃণা-আশ্রয়ী প্রপাগান্ডা, অপবাদ এমনকি গুম, খুন, হামলা-মামলার বিচিত্র ক্ষমতাচক্র!

এ বাস্তবতায় ইসলামোফোবিয়ার মোকাবেলায় ওআইসির মতো সংগঠনের এমন ঘোষণার গুরুত্ব আছে। কিন্তু তা কি কেবল কথা ও কাগজে আটকে থাকবে নাকি এর বাস্তবায়নে ফলপ্রসূ ও যথাযথ প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে, সে প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ।

লেখক : কবি, গবেষক

Advertisements