ইসলাম আসলে কী? অথবা, প্রচলিত অর্থে ধর্মতাত্ত্বিক ব্যাখ্যার বিকল্প হিসাবে ইসলামের কি আলাদা কোনো দার্শনিক ব্যাখ্যা হতে পারে? হলে, সমস্যা কী? তাহলে কি ‘ইসলামী দর্শন’ কথাটা আদতে ভুল? তাই যদি হয়, এতো এতো মুসলিম দার্শনিকরাই বা কী করেছেন? আল গাজ্জালী বা আল্লামা ইকবালের ‘ইসলামী দর্শন’ কি প্রমিন্যান্ট দর্শন হিসাবে স্বীকৃত নয়? এসব প্রশ্নের ‘ইঙ্গিতমূলক’ অর্থাৎ সংক্ষিপ্ত উত্তর নিয়েই এই নিবন্ধ।
ইসলামী ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন
ইসলামের দার্শনিক ব্যাখ্যার প্রসঙ্গ আসলে ইসলামের প্রচলিত ব্যাখ্যা-পদ্ধতি কী তা নির্ণয়ও প্রাসঙ্গিক হয়ে দাঁড়াবে। ইসলামকে বুঝা-জানা ও এর ব্যাখ্যা-ভাষ্য রচনার প্রচলিত পদ্ধতিটা হচ্ছে ধর্মতাত্ত্বিক পদ্ধতি। আমরা জানি, কোনো ধর্ম সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট ধর্মগ্রন্থ ও ধর্মগুরুর সিদ্ধান্তের প্রতীয়মান অর্থ অনুসারে ধর্মের নানা বিষয়ে ব্যাখ্যা দেয়া ও ভাষ্য রচনার যে পদ্ধতি, তা-ই হলো ধর্মতাত্ত্বিক পদ্ধতি। ধর্মগ্রন্থে যা বলা আছে এবং ধর্মবেত্তাগণ তা যেভাবে ব্যাখ্যা করেছেন তার মূলগত দিকটা অক্ষুণ্ণ রেখেই ধর্মতাত্ত্বিক ভাষ্য তৈরি হয়।
ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত, প্রচলিত এবং প্রায়শই আক্ষরিক অর্থের বাইরে ধর্মের বিষয়সমূহকে (notions or issues) যুক্তি ও বুদ্ধির নিরিখে স্বাধীন ও স্বতন্ত্রভাবে যাচাই করাকে ধর্মের দার্শনিক ব্যাখ্যা হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে । সোজা কথায়, ধর্মের বিষয়গুলো নিয়ে দর্শন চর্চা বা ধর্মকে দর্শনের আলোকে দেখাই হচ্ছে ধর্মের দার্শনিক ব্যাখ্যাপদ্ধতি।
ব্যাপারটা তাহলে দর্শনের সংজ্ঞায় এসে ঠেকলো। তাই না? মজার ব্যাপার হলো, পৃথিবীর তাবৎ দার্শনিকরা একমত হয়েছেন, দর্শনের এমন কোনো সংজ্ঞা নাই। বলা যায়, দার্শনিকরা (দার্শনিক হিসাবে) যা করেন, যেভাবে করেন, তা-ই দর্শন …! এক একজন দার্শনিক দর্শনের এক একটি দিকের ওপর গুরুত্বারোপ করে দর্শনের সংজ্ঞা দেয়ার চেষ্টা করেছেন। সেসব বিতর্কে না গিয়ে দর্শনের লক্ষণগত একটা সংজ্ঞা বা পরিচয় এভাবে হতে পারে: কোনো মৌলিক বিষয়ের তত্ত্বগত দিকসমূহকে যুক্তি দিয়ে বিবেচনা করা। অন্যকথায়, যে কোনো প্রশ্নকে গ্রহণ করা ও তাত্ত্বিক যুক্তি (logical argument) দিয়ে নিজের কথা তুলে ধরা।
ধর্মতাত্ত্বিক ব্যাখ্যার বাইরে ইসলামের দার্শনিক ব্যাখ্যা হতে পারে কিনা– এই প্রশ্নের সম্ভাব্য উত্তর কি হতে পারে তা নিয়ে এবার আলোচনা করা যাক। আমার মতে, ইসলামের ধর্মতাত্ত্বিক এবং দার্শনিক দু’ধরনের ব্যাখ্যাই হতে পারে। ইসলামের দিক থেকেও তা হতে পারে, ইসলামের বাইরের দিক থেকেও তা হতে পারে। ইসলামের ভেতর থেকে ইসলামের দার্শনিক ব্যাখ্যার অনুমোদন থাকার মানে হলো– ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলোর পক্ষে বুদ্ধিগ্রাহ্য যুক্তিগুলো কী, তা আলোচনা করা। যেমন- তাওহীদ, রেসালাত, আখেরাত ইত্যাদির পেছনে কী ধরনের দার্শনিক যুক্তি রয়েছে, তা আলোচনা করা। এক্ষেত্রে দার্শনিক ব্যাখ্যা ও ধর্মতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা পরস্পর পরিপূরক (complementary) হিসেবে বিবেচিত হবে।
ইমাম গাজ্জালী’র এ দর্শন এই অর্থে একটি যথার্থ দর্শন
উদাহরণ হিসেবে ইমাম গাজ্জালীর ‘তাহাফাতুল ফালাসিফা’র কথা উল্লেখ করা যায়। তাঁর বিবেচনায়, তৎকালীন মুসলিম দার্শনিকদের গৃহীত ‘ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক’ ২০টি অনুসিদ্ধান্তকে তিনি দার্শনিক যুক্তি দিয়ে খণ্ডন করেছেন। ধর্মের বিষয়গুলোকে নিছক ধর্মগ্রন্থের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রমাণের প্রচলিত পদ্ধতির (ফকীহদের পদ্ধতি) পরিবর্তে দার্শনিকদের প্রমাণ-পদ্ধতিতেই তিনি ইসলামের মূল বিষয়গুলোকে সমর্থনে যুক্তি দিয়েছেন। এমন নয় যে, এতে তিনি কোরআন ও হাদীসের রেফারেন্স দেন নাই। কোরআন-হাদীসের রেফারেন্স উভয় পদ্ধতিতেই্ ব্যবহৃত হয়। তফাৎ হলো, ধর্মতাত্ত্বিক পদ্ধতিতে তা ‘দোহাই’ বা অবশ্য-মান্য হিসাবে আসে, আর দার্শনিক পদ্ধতিতে সংশ্লিষ্ট রেফারেন্সের গুরুত্ব অনুসারে তা ‘যুক্তি’ হিসাবে আসে। ইমাম গাজ্জালী নিজেকে কখনো দার্শনিক ভাবেন নাই। বইয়ের নামই দিয়েছেন, ‘দর্শনের খণ্ডন’! অতএব, বুঝা গেল, কোনো কিছু দর্শন হয়ে ওঠা, সেটির উপস্থাপনা-পদ্ধতির ওপর নির্ভর করে। ইমাম গাজ্জালী’র এ দর্শন এই অর্থে একটি যথার্থ দর্শন। অতএব, ইসলামী দর্শন বা এর দার্শনিক ব্যাখ্যা আলোচ্য অর্থে সম্ভবপর এবং তা ইসলামের দিকে থেকে গ্রহণযোগ্যও বটে। বরং বলা যায়, ইসলামী দর্শন ইসলামের একটি অপরিহার্য দিক।
সমস্যা হলো ইসলামী ধর্মতত্ত্বের আওতাবহির্ভূত স্বাধীন ও স্বতন্ত্র ‘দার্শনিক ব্যাখ্যা’র গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে। ধরা যাক, এ রকম একটি দার্শনিক ব্যাখ্যা-পদ্ধতিতে ইসলামকে অর্থাৎ ইসলামের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে মূল্যায়ন করা হলো। যেহেতু এটা ইসলামের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে দর্শন চর্চা, তাই এটি এক অর্থে ইসলামী দর্শনও বটে। ইসলামকে যিনি সমর্থন করেন তাকেও ইসলামিস্ট বলা যায়। আবার ইসলামকে যিনি ইসলামের ভেতরকার দিক থেকে মানেন না বা সমর্থন করেন না; কিন্তু ইসলাম নিয়ে কাজ করেন তিনিও নিজেকে ইসলামিস্ট দাবি করতে পারেন। অতএব, ইসলাম নিয়ে চর্চিত দর্শনমাত্রই ইসলামী দর্শন, হোক তা ইসলামকে সমর্থন করে কিম্বা তা না করে। ইসলামকে সামগ্রিকভাবে গ্রহণ না করে এর কোনো বিশেষ বিষয়কে (notion অর্থে) গ্রহণ করে বা তাকে ভিত্তি ধরেও দর্শন চর্চা হতে পারে। ইসলামকে locate করার সুনির্দিষ্ট বা অনতিক্রম্য (specific or predefined) কোনো ‘ইসলামী’ পদ্ধতি আছে কি-না এবং সেখানে কোন্ ধরনের দার্শনিক পদ্ধতির স্থান কী রকম – তা নিরূপণ করাই এই আলোচনার মূল বিষয়।
ইসলাম নিয়ে স্বাধীন ও স্বতন্ত্র দর্শন চর্চার সমস্যা
আমরা জানি, ইসলামের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো তাওহীদ বা আল্লাহর এককত্ববাদ (unicity of God)। তাওহীদের ধারণা স্রষ্টার অস্তিত্ব, এককত্ব এবং তাঁর সে সমস্ত বৈশিষ্ট্যপূর্ণ গুণাবলিকে অন্তর্ভুক্ত করে, যা পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন সূরায় বর্ণিত। ইসলামী ধর্মতত্ত্বে ইসলাম-এর মৌলিক বিষয়গুলো যেভাবে বর্ণনা করা হয়েছে, ইসলামের দার্শনিক ব্যাখ্যায় তা যদি বাহ্যিক ও মর্মগত দিক থেকে হুবহু স্বীকার ও প্রত্যয়ন করা না হয় তাহলে দু’ধরনের সমস্যা হতে পারে:
১। ধর্মতাত্ত্বিকভাবে নির্ধারিত অর্থের বিপরীত অর্থ সাব্যস্ত হতে পারে। ইসলামের দৃষ্টিতে তা সরাসরি অস্বীকার করার নামান্তর বা কুফর।
২। এমন ব্যাখ্যা হতে পারে, যা দৃশ্যত ধর্মতাত্ত্বিক ব্যাখ্যার সাথে বিপরীত না হলেও শেষ পর্যন্ত তা ধর্মতাত্ত্বিক ব্যাখ্যার সাথে সাংঘর্ষিক। যু্ক্তি-পদ্ধতির যেমন নানা রকম মান ও মাত্রা রয়েছে; কোনো বিষয়ের ওপর উপস্থাপিত যু্ক্তিও নানা রকম মান ও মাত্রার হতে পারে। সামগ্রিকভাবে না দেখলে এবং প্রেক্ষাপট নির্ধারণ করা না থাকলে একই বিষয়ের বিপরীতমুখী ফলাফল হতে পারে। ১০ এর মান কত? এটি কোনো প্রশ্নই নয়। কারণ, কতো দিয়ে কী (যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ ইত্যাদি) করা হচ্ছে, তা পূর্বেই নির্ধারণ না করলে ১০-এর ভিত্তিতে বহু রকমের ফলাফল হতে পারে।
আরেকটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। মনে করুন, কেউ যুক্তি দিয়ে বললো যে, যেহেতু আল্লাহ বলেছেন তিনি দয়ালু ও ক্ষমাশীল, অতএব আল্লাহর সৃষ্ট কোনো মানুষকে তিনি দোযখে দিতে পারেন না। স্থায়ীভাবে দোযখে জ্বালানোর কথাগুলো মূলত রেটরিক। নিছক ভয় দেখানোর জন্য সেগুলো বলা হয়েছে…! এহেন যুক্তি বা যুক্তিধারা দর্শনসম্মত হলেও ইসলামসম্মত নয়। আপনারা জানেন, নামাজ, রোজা, হজ, যাকাত, হুদুদ ইত্যাদিসহ ইসলামী শরীয়াহ’র প্রতিটি বিষয়ের পেছনে কোনো না কোনো যুক্তি, উদ্দেশ্য বা মর্মার্থ রয়েছে; যা মানুষ চিন্তা করলে বুঝতে পারে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা) সেসব কারণ বা যুক্তির কথা উল্লেখও করেছেন। যেমন– নামাজের ব্যাপারে বলা হয়েছে, এটি মানুষকে অশ্লীল ও পাপ কাজ থেকে বিরত রাখে। এখন এই আয়াতকে ভিত্তি ধরলে যিনি অশ্লীল ও পাপ কাজ থেকে নিজেকে মুক্ত মনে করেন, দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে তার জন্য নামাজ পড়ার বাধ্যবাধকতা বহাল থাকে না। অথচ, নামাজ-রোজাসহ সকল ইবাদতের বিষয় এ জন্যই ফরজ যে আল্লাহ তা হুকুম করেছেন। যুক্তির সমর্থন বা উদ্দেশ্যের বিষয়গুলো পরিপূরক মাত্র। অতএব, ইবাদতের বিষয়গুলোকে মূলত ‘আল্লাহর হুকুম, তাই মান্য’– এভাবে গ্রহণ করা না হলে ইসলামের দিক থেকে তা গ্রহণযোগ্য হবে না।
ভাষ্য তৈরির বৈচিত্র্য ও বৈপরীত্য
ইসলামের দিক থেকে ধর্মতাত্ত্বিক বিষয়গুলোর ব্যাখ্যা ও ভাষ্য সদাসর্বদা কি অভিন্ন? না, তা নয়। তাহলে ইসলামসম্মত দার্শনিক ব্যাখ্যার সাথে আলোচ্য ইসলাম কর্তৃক অসমর্থিত দার্শনিক ব্যাখ্যা-ভাষ্যদান পদ্ধতির ফারাকটা কোথায়? ব্যাখ্যা-ধারার বৈপরীত্ব অর্থে ভিন্নতা (contradiction in interpretation) এবং বৈচিত্র্য অর্থে ভিন্নতার (plurality in interpretation) মধ্যে এই ফারাক নিহিত। বৈপরিত্য এক প্রকারের ভিন্নতা, আবার ভিন্নতাকেও এক অর্থে বৈপরিত্য বলা যায়। তবে এখানে ভিন্নতা ও বৈপরিত্যকে আমরা আলাদা করেই বুঝবো। একই পথের ডান পাশ, বাম পাশ ও মাঝখান বরাবর চলা– এই তিন ধরনের মধ্যে বৈচিত্র্য আছে, বৈপরিত্য নেই। একটি নির্দিষ্ট ধারার ব্যাখ্যা পদ্ধতির মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে ব্যাখ্যার বৈচিত্র্য অর্থে ভিন্নতা হতেই পারে। উল্টোভাবে, ভিন্ন আঙ্গিক বা ভিন্ন যুক্তিতে ভিন্নতর প্রক্রিয়ায় অভিন্ন সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব। এসবই হলো ইসলামের মধ্যে দার্শনিকতার ক্ষেত্র বা অবকাশ (scope of philosophy in Islam)। দার্শনিকতার অবকাশ থাকা মানে দর্শন চর্চার ইতিবাচক সম্ভাবনা। আবার ইসলাম ‘অনুমোদিত’ অবকাশকে অতিক্রম করে মুক্তভাবে দর্শন চর্চাও এক প্রকারের ইসলামী দর্শন চর্চা। এই উভয় প্রকারের দর্শন চর্চার পার্থক্য সম্পর্কে সম্যক ও স্বচ্ছ ধারণা ব্যতিরেকে ইসলামী দর্শনের ক্ষেত্র, সম্ভাবনা ও সমস্যাগুলোকে সঠিকভাবে অনুধাবন করা সম্ভব নয়।
দর্শন ও ডগমার ডিলেমা
এখানে স্বয়ং দর্শন সম্পর্কেই অধিকতর মৌলিক একটি প্রশ্ন এসে পড়ে। ইসলাম প্রসঙ্গে হোক বা অন্য কোনো বিষয়েই হোক, কোনো ধরনের আপ্তবাক্যকে (dogma) অলংঘনীয় বা ‘মৌলিক বিষয়’ হিসেবে অক্ষুন্ন রাখার শর্ত চাপিয়ে দিয়ে, সোজা কথায় চিন্তার সীমারেখা টেনে দিয়ে যুক্তি চর্চার নামে যা হবে, তা কি আদৌ দর্শন হবে? আপাতদৃষ্টিতে এটি অত্যন্ত সরল, অত্যন্ত জটিল ও অত্যন্ত স্বাভাবিক একটি প্রশ্ন। বিশেষ করে, যারা দর্শনকে দর্শনের ভেতর থেকে দেখেননি তাদের কাছে এটি একটি মৌলিক প্রশ্ন।
আচ্ছা, দর্শনে এমন কোনো তত্ত্ব, মতবাদ, যুক্তিধারা বা এমন কোনো দার্শনিক চিন্তাধারা আদৌ কি আছে বা হতে পারে, যা কোনো না কোনো পূর্বানুমানকে (pre-supposition) অবলম্বন করে সেটিকে বা সেগুলোকে স্বয়ং-সঠিক (self-justified) হিসাবে গণ্য না করে দাঁড়িয়েছে? এর উত্তর হ্যাঁ-সূচক হলে সেই তত্ত্বটির নাম কি? আদতে এ রকম তত্ত্ব বা এ জাতীয় কিছু নাই। কিছু বিষয়কে স্বতঃসিদ্ধ হিসাবে ধরে নিয়েই কোনো বিষয়কে যাচাই করতে হয়। বলা যায়, কোনো না কোনো ‘উত্তর’কে ইতোমধ্যে বা যে কোনো প্রকারে গ্রহণ করে নিয়েই ওই বিষয়ে নতুন কোনো প্রশ্ন করতে হবে। Every question does have some ‘answers’ and every answer does have some questions । এই যে ধরে নেয়া, দর্শনের ভাষায় এটাকে বলা হয় নির্বিচারবাদ (dogmatism)। নির্বিচারবাদের বিরুদ্ধে দর্শন, আবার দর্শনই কিছু নির্বিচারের ওপর নির্ভর করে। আশ্চর্যের ব্যাপার! তাই না? আসুন এ বিষয়কে একটা উদাহরণের মাধ্যমে বুঝার চেষ্টা করি।
জ্ঞানের উৎস সংক্রান্ত মতবাদগুলোর অন্যতম প্রধান দুটি হচ্ছে বুদ্ধিবাদ ও অভিজ্ঞতাবাদ। মূলধারার (পাশ্চাত্য) দর্শনে এ দুটিই মূলত নির্বিচারবাদ (dogmatism)। কেউ বুদ্ধিকে জ্ঞানলাভের অধিকতর গ্রহণযোগ্য উৎস হিসাবে মনে করলে তিনি বুদ্ধিবাদী। আর কেউ পঞ্চইন্দ্রিয় থেকে আগত অভিজ্ঞতাকে জ্ঞানের মূল বা প্রাথমিক উৎস গণ্য করলে তিনি অভিজ্ঞতাবাদের সমর্থক গণ্য হবেন। বুদ্ধিবাদ কীভাবে নির্বিচারবাদী হয়? জ্ঞানের উৎস সন্ধান বা যাত্রাপথেই যদি ‘ধরে নেয়া’ হয় যে, বুদ্ধিই জ্ঞানের প্রকৃত বা একমাত্র উৎস; তাহলে তা পথ চলার শুরুতেই গন্তব্যের মূল্যায়ন শেষ করার মতো ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। একই সমস্যা বা অভিযোগ অভিজ্ঞতাবাদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এ ধারায় আলোচনা করলে কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে এক এক করে সাপ বেরুবে।
তাহলে দর্শনটাই কি সামগ্রিক ও অন্তর্গতভাবে নির্বিচারবাদী? অথচ আমরা জানি, নির্বিচারবাদ এবং দর্শন– উভয়ই পরষ্পরকে খণ্ডন করে। ব্যাপার হলো, দর্শনের কোনো চিন্তাপদ্ধতিই আদতে (in its fundamental level) নির্বিচারবাদমুক্ত (non-dogmatic) নয়। বলা যায়, দর্শনের ভিতরকার এই স্ববিরোধী পরিস্থিতিই মানুষের জ্ঞানতাত্ত্বিক নিয়তি (epistemic pre-dicament)। কোনো মাপকাঠির (scale) মাপকাঠি হওয়ার জন্য কোনো আদর্শ মাপ (standard measurement) না থাকা সত্ত্বেও ‘মাপকাঠি’ মাপকাঠি হয়েছে। হওয়াটা ঠিকই হয়েছে। ‘ধরে নেয়া’ ধ্রুবক দিয়েই আমরা যাচাই বা পরীক্ষা করি , অন্তত শুরুর দিকটা তা-ই। ধ্রুবক বা স্বতঃসিদ্ধ, সোজা কথায়, মাপকাঠি সম্পর্কে ‘কেন?’ জাতীয় কোনো প্রশ্ন চলে না। এ ধরনের সার্বজনীন ও মানবিক চিন্তাপদ্ধতির কারণেই জ্ঞান-গবেষণা সম্ভবপর হয়েছে। এই ধরনের চিন্তাধারার ছাঁচে ফেলেই ‘স্বেচ্ছাচারিতা’কে ‘স্বাধীনতা’র ধারণা হতে আলাদা করে বিবেচনা করা সম্ভব। অতএব, বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা মানেই কোনো না কোনো বিশেষ আঙ্গিকে চর্চা। স্বাধীন মানেই কোনো না কোনো সীমাবদ্ধ জাতীয় ‘কিছুর’ প্রেক্ষিতে স্বাধীন।
দর্শন, দার্শনিকতা ও দার্শনিক
দর্শন কোনো বিষয়েই একপাক্ষিক (biased) বা চূড়ান্ত (conclusive) কোনো কথা বলে না। যেমন, খোদার অস্তিত্ব প্রসঙ্গে দার্শনিক যুক্তি চার রকমের (category) হতে পারে–
১। মানুষ ও জগতের স্রষ্টা ‘আছে’ যারা মনে করেন তাদের মতটি হলো– আস্তিকতা (theism)।
২। স্রষ্টা ‘নাই’ যারা মনে করেন তাদের মতটি হলো– নাস্তিকতা (atheism)।
৩। মানুষ ও জগতের একজন বা একাধিক স্রষ্টার অস্তিত্ব থাকতেও পারে, নাও থাকতেও পারে; এখনো নিশ্চিত নন বা কখনোই নিশ্চিতযোগ্য নয়, তবে বিষয়টিকে একটি বিবেচ্য বিষয় হিসাবে যারা মনে করেন তাদের মত বা অবস্থানকে বলা যায়– অজ্ঞেয়বাদ (agnosticism)।
৪। অপরদিকে মানুষ ও জগতের স্রষ্টা থাকা কিম্বা না থাকা সংক্রান্ত পুরো বিতর্ক ও বিষয়টিকে যারা অপ্রাসঙ্গিক মনে করেন তাদেরকে আমরা নির্বিকারবাদ (irrelevantism)-এর ক্যাটাগরিতে বিবেচনা করতে পারি।
অজ্ঞেয়বাদের সাথে নির্বিকারবাদের পার্থক্য হলো, অজ্ঞেয়বাদ বিষয়টিকে (issue) স্বীকার (to take in cognizance) করে। সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে অজ্ঞেয়বাদের এই অবস্থানটা হলো ‘not yet’ ধরনের। খোদার অস্তিত্ব প্রশ্নে এ চারটি অবস্থা বা অবস্থানের বা মতের সব কয়টিই দর্শন-এর অবস্থান, মত বা তত্ত্ব। এগুলোর আলোচনা-পর্যালোচনা শেষে ব্যক্তি বিশেষের একটি অবস্থান শেষ পর্যন্ত উঠে আসে। সেটি হতে পারে আস্তিকতা, নাস্তিকতা, অজ্ঞেয়বাদ কিম্বা নির্বিকারবাদ। ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে যে কেউ এই সবগুলো তত্ত্বই পড়বেন। তা সত্ত্বেও, দর্শন চর্চাকারী ব্যক্তি তথা একজন দার্শনিকের অবস্থান সব সময়ই কোনো না কোনো একটি মতের পক্ষে থাকে, যেটিকে তিনি অধিকতর যুক্তিসঙ্গত মনে করেন। এমনকি জ্ঞানতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ হতে মাঝামাঝি বা নিরপেক্ষ অবস্থানও একটি পক্ষ, সাধারণ ভাষায় যাকে আমরা abstain করা বলি। রেফারি টাইপের কারো জন্য সেটিই সর্বাধিক যুক্তিসম্মত অবস্থান হতে পারে। এ ধরনের চিন্তার সূত্রে IBE (Inference to the best explanation)-এর মতো ‘মৌলিক সূত্র’ ব্যবহার করে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রশ্নে উপরের যে কোনো একটি পক্ষ, অবস্থান বা মতকে দর্শনসম্মত কিম্বা দার্শনিক মত হিসেবে গ্রহণ এবং অপরাপরগুলোকে বর্জন করা সম্ভব। আসলে দর্শনে তো কোনো ‘প্রমাণ’ নাই, হতে পারে না। অধিকতর গ্রহণযোগ্য যুক্তিকে (argument) আমরা প্রমাণ হিসাবে গ্রহণ, উপস্থাপন ও অনুসরণ করি।
যাহোক, দর্শন ও দার্শনিকের এই পার্থক্য যদি আমরা বুঝি তাহলে এতোক্ষণে এটা খুবই পরিষ্কার যে, ইসলামের ধর্মতাত্ত্বিক আওতাবহির্ভূত ‘দার্শনিক ব্যাখ্যা’ কেন এবং কোন্ যুক্তিতে ইসলামের দিক হতে গ্রহণযোগ্য নয়। ধর্মতাত্ত্বিকভাবে নির্ধারিত ইসলাম-এর আওতার মধ্যে থেকে কীভাবে ‘দর্শন-চর্চা’ সম্ভব, তাও উপরের আলোচনা থেকে বুঝা যায়।
আগেই বলেছি, ইসলামের সমর্থন এবং বিরোধিতা– উভয় প্রকারের দর্শনই ‘ইসলামী দর্শন’। সোজা কথায়, ‘ইসলাম নিয়ে দর্শন চর্চা’ মাত্রই তা ইসলামী দর্শন হিসেবে গণ্য হবে। যেমন, মনোদর্শন। যারা বস্তু অতিরিক্ত একটি স্বাধীন স্বতন্ত্র সত্ত্বা ‘মন’-এর অস্তিত্ব থাকার পক্ষে যুক্তি দেন, তারাও মনোদার্শনিক। আবার এ ধরনের কোনো ‘মন’-এর অস্তিত্বের সম্ভাবনার বিরুদ্ধে যারা যুক্তি দেন, তারাও মনোদার্শনিক হিসেবে গণ্য। ধর্মদর্শন হলো মূলধারার দর্শনের একটি পরিচিত শাখা। ধর্মকে প্রতিষ্ঠিত করা বা খণ্ডন করা– এর কোনোটিই ধর্মদর্শনের কাজ নয়। আবার ধর্মদর্শনের যত আালোচনা তার প্রত্যেকটি শেষ পর্যন্ত ধর্মের পক্ষ বা বিপক্ষেই যাবে। ব্যাপার হলো, ধর্মকে নিয়ে দর্শন চর্চা। তা ধর্মের পক্ষেও যেতে পারে, বিপক্ষেও যেতে পারে। যে কোনো অবস্থাতেই তা দর্শন, যদি তাতে যুক্তির ব্যবহার থাকে। এই যুক্তির উপস্থাপনায় ধর্মগ্রন্থের রেফারেন্স আসতে পারে। তবে, তা ধর্মের পদ্ধতিতে অর্থাৎ ব্যক্তিগতভাবে অবশ্য-মান্য (dogma) হিসাবে নয়।
ইসলাম ব্যাখ্যার ইসলামসম্মত পদ্ধতি
ইসলামের উন্মুক্ত ব্যাখ্যা-ভাষ্য পদ্ধতির ব্যাপারে ইসলামের মৌলিক দুটি উৎস কী বলে– এবার তা খানিকটা খতিয়ে দেখা যাক। ইসলাম স্বয়ং কোরআনকে বুঝা, ইসলামকে মানা বা বুঝা ও ইসলামের ব্যাখ্যাদান পদ্ধতি (way of interpretation) পরিষ্কারভাবে বলে দিয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
“পাঁচটি বিষয়ের উপর কোরআন নাযিল হয়েছে: (১) হালাল, (২) হারাম, (৩) মুহকাম, (৪) মুতাশাবিহ ও (৫) আমছাল (বিভিন্ন জাতির উত্থান-পতনের ঘটনাবলি সংক্রান্ত আয়াত)। সুতরাং তোমরা হালালকে হালাল জানবে। হারামকে হারাম মানবে। মুহকামের উপর আমল করবে। মুতাশাবিহের উপর ঈমান রাখবে এবং আমছাল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করবে।” (মেশকাত শরীফে বর্ণিত ১৭ নং হাদীস)
“করণীয় তিন প্রকারের: এমন করণীয় যা স্পষ্টতই ভালো, তা পালন করো। এবং এমন করণীয় যা সুস্পষ্টভাবে মন্দ, অতএব তা পরিহার করো। এবং সেই কাজ যা নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে, তা মহান ও মহিমান্বিত আল্লাহর উপর ন্যস্ত করো।” (মেশকাত শরীফে বর্ণিত ১৭৪ নং হাদীস)
পবিত্র কোরআনের বর্ণনা মোতাবেক কোরআনে দুই ধরনের আয়াত রয়েছে: (১) আয়াতে মুহকাম (সুস্পষ্ট আয়াত) এবং (২) আয়াতে মুতাশাবিহ (রূপক অর্থের আয়াত)। এ সংক্রান্ত পবিত্র কোরআনের আয়াতটি স্ব-ব্যাখ্যাত (self-explanatory)। আল্লাহ বলছেন,
“তিনিই তোমার প্রতি এই কিতাব অবতীর্ণ করেছেন, যার কিছু আয়াত ‘মুহকাম’, এগুলো কিতাবের মূল; আর অন্যগুলো ‘মুতাশাবিহ’, যাদের অন্তরে সত্য-লংঘন প্রবণতা রয়েছে শুধু তারাই ফিতনা এবং ভুল ব্যাখ্যার উদ্দেশ্যে মুতাশাবিহসমূহের পেছনে লেগে থাকে। আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ এর ব্যাখ্যা জানে না। আর যারা গভীর জ্ঞানী তারা বলে, ‘আমরা এগুলোর ওপর ঈমান এনেছি। এসবকিছুই আমাদের প্রতিপালকের কাছ থেকে আগত। এবং বোধশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তিগণ ছাড়া অন্য কেউ শিক্ষা গ্রহণ করে না।” (সূরা আলে-ইমরান: ৭)
উল্লেখ্য, “বল, আল্লাহ অদ্বিতীয়, তিনি অমুখাপেক্ষী, তিনি কারো পুত্র নন, কারো পিতাও নন। তার সমকক্ষ কেউ নাই।’’ কিম্বা, “তোমরা রুকুকারীদের সাথে রুকু কর’’ ইত্যাদি ধরনের আয়াত হলো মুহকাম আয়াত। আবার “আল্লাহ হলেন আলোর ভিতর আলো [নুরুন আলা নুর]’’ এ ধরনের আয়াতগুলো হলো মুতাশাবিহ আয়াত।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, মুহকাম আয়াতসমূহকে মান্য করতে হবে। কিন্তু সেগুলোর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ফকীহদের মধ্যে যেসব মতানৈক্য হয়েছে, তার কী হবে? আল-কোরআনকে সামঞ্জস্য (consistent) হিসাবে মানবো কি না, তা ঈমানের সাথে সম্পর্কিত। জীবন ও জগত সম্পর্কে স্বীয় যুক্তি ও বুদ্ধির দাবিকে মেনে নিয়ে যারা ইতোমধ্যে ঈমান এনেছে তাদের পরবর্তী কাজ হলো আপাত বিরোধের আড়ালে অন্তর্নিহিত সামঞ্জস্যতাকে খুঁজে বের করা ফিকাহ’র ভাষায় যাকে ‘তাহক্বীক’ বলা হয়। অতএব, ইসলামকে সামগ্রিকভাবে (holistically) গ্রহণ করাটা ইসলামের দিক থেকে অবশ্য কর্তব্য। ইসলামের কোনো একটা বা কয়েকটা দিককে গ্রহণ করে কোনো তত্ত্ব নির্মাণ করলে তা, এমনকি তার সবকটি উপাদান, স্বতন্ত্রভাবে ইসলামসম্মত হওয়ার মতো পরিস্থিতিতেও সর্বোপরি বিষয়টি ইসলাম-বহির্ভূত হিসাবে বিবেচিত হবে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলছেন, “… তোমরা কি (তাহলে) আল্লাহর কিতাবের একাংশ বিশ্বাস করো এবং আরেক অংশ অবিশ্বাস করো?” (সূরা বাকারা: ৮৫)
কোন্ ব্যক্তিবর্গের আন্ডারস্ট্যান্ডিংকে ইসলামের কোনো বিশেষ বিষয়ে সঠিক মত হিসাবে নিতে হবে, সে সম্পর্কে ইসলামে পরিষ্কার ভাষায় দিক-নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। রাসূল (সা) বলেছেন,
“আমার পর তোমাদের মধ্যে লোকেরা শীঘ্রই নানা মতানৈক্য দেখতে পাবে। তখন তোমরা আমার সুন্নত এবং সুপথপ্রাপ্ত খোলাফায়ে রাশেদীনের রীতিনীতি দাঁতে কামড়ে ধরার মতো করে মজবুতভাবে আঁকড়ে ধরে থাকবে। সাবধান! দ্বীনের ব্যাপারে কোরআন-হাদীসের বাইরে কোনো নতুন কিছু গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকবে।” (আহমদ, আবু দাউদ, তিরমীযী ও ইবনে মাজাহ সূত্রে মেশকাত শরীফে বর্ণিত ১৫৮ নং হাদীস)
রাসূল (সা) আরো বলেছেন,
“আমি তোমাদের মধ্যে দু’টি জিনিস রেখে যাচ্ছি। যে পর্যন্ত তোমরা এ দু’টি মজবুতভাবে ধরে থাকবে, ততক্ষণ পথ হারাবে না। এ দু’টি হলো কোরআন ও হাদীস।” (মুয়াত্তা সূত্রে মেশকাত শরীফে বর্ণিত ১৭৭ নং হাদীস)
ইসলাম অনুসরণ করার ব্যাপারে বহুত্ব শুধু নয়, বৈপরিত্যও কোনো কোনো ক্ষেত্রে সমভাবে অনুমোদিত। সফরে রোজা রাখা না রাখা, বনু কুরাইযাতে পৌঁছতে গিয়ে আসরের নামাজ একদল কর্তৃক পথিমধ্যে পড়া আর একদল কর্তৃক কাযা করা, অবরোধ চলাকালীন শত্রুপক্ষের ফলবান খেজুর গাছ কাটা বা না কাটা ইত্যাদি এর উদাহরণ। ইসলামে ব্যাখ্যাগত বৈচিত্র্য দেখা যায় শরীয়াহর ক্ষেত্রে। কিন্তু আক্বীদার বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিন্ন। আক্বীদাগত তথা ফিলোসফিক্যাল আসপেক্টে ইসলাম কোনো প্রকারের সমঝোতা অনুমোদন করে না। বলা যায়, এই একটি ক্ষেত্রে ইসলাম সাদা-কালো নীতি অনুসরণ করে। এমনকি আস্তিকতার কেবল একটি সুনির্দিষ্ট ভাষ্যকেই ইসলাম অনুমোদন করে।
‘নিশ্চয়, আল্লাহর কাছে একমাত্র গ্রহণযোগ্য দ্বীন হলো ইসলাম’ অথবা, ‘তোমরা পূর্ণভাবে ইসলামে দাখিল হওয়ার পূর্বে মৃত্যুবরণ করো না’– এ ধরনের আয়াতসমূহের তাৎপর্য খুবই পরিষ্কার। আমলের ক্ষেত্রে অপারগ পরিস্থিতিতে কমবেশি করার অনুমোদন থাকলেও ইসলামের আক্বিদা তথা ফিলোসফিক্যাল আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ের ক্ষেত্রে এর অনুমোদন নাই। ইসলামের ফিলোসফিক্যাল আন্ডারস্ট্যান্ডিং নিজের মতো করে নির্ধারণ করার কোনো সুযোগ নাই। উপরের হাদীসগুলো ভালো করে পড়লে দেখা যাবে আল্লাহর রাসূল (সা) যেভাবে বলেছেন ও সাহাবাগণ যেভাবে বুঝেছেন– তার বাইরে গিয়ে ইসলামের কোনো ‘ফিলোসফিক্যাল আন্ডারস্ট্যান্ডিং’ হাজির করার এখতিয়ার ইসলাম কাউকে দেয় না।
“একবার হযরত ওমর (রা) রাসূল (সা)-এর নিকট এসে বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (সা)! আমরা ইহুদীদের নিকট তাদের বহু ঘটনা শুনে থাকি, যা অত্যন্ত চমৎকার মনে হয়। তার কিছু লিখে রাখতে আপনি আমাদের অনুমতি দেবেন কি?’ রাসূল (সা) জবাব দিলেন, ‘ইহুদী-খৃস্টানদের মতো তোমরাও কি দ্বীনের ব্যাপারে দ্বিধাগ্রস্ত? আল্লাহর কসম! আমি তোমাদের নিকট অত্যন্ত স্পষ্ট ও উজ্জ্বল দ্বীন নিয়ে এসেছি। হযরত মুসা (আ)-ও যদি জীবিত থাকতেন, তাহলে তাঁকেও আমাকে অনুসরণ করতে হতো।” (মেশকাত শরীফে বর্ণিত ১৬৮ নং হাদীস)
এই হাদীস অনুসারে দেখা যাচ্ছে, ইসলামের আন্ডারস্ট্যান্ডিং ইসলামের উৎস দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হতে হবে। দর্শন তো দূরের কথা অন্য ধর্মের কোনো গ্রন্থকেও প্রাইমারি সোর্স হিসাবে গন্য করা যাবে না।
ইসলামে দর্শনের পরিসর
তাহলে আগের সেই কথা, ইসলামে দর্শন চর্চার সুযোগ কিম্বা পরিসর কী? বুদ্ধিগত জ্ঞানকে চূড়ান্ত ধরে নিয়ে যেমন বুদ্ধিবাদ চর্চা হয়ে আসছে, অভিজ্ঞতাকে চূড়ান্ত ধরে নিয়ে যেমন অভিজ্ঞতাবাদের সব তত্ত্ব চর্চা হয়ে আসছে; তেমনিভাবে ইসলামের মৌলিক বিশ্বাসের অনুকূলে ইসলামী দর্শন চর্চা সম্ভব। এর বাইরে ‘ইসলাম’-এর বিষয়কে নিয়ে দর্শন চর্চা হতে পারে। তবে তা ইসলামসম্মত নয়। যদিও তা জানাটা ইসলামের ভেতরকার অবস্থান থেকে (ইসলামী) দর্শন চর্চার জন্য অপরিহার্য। উল্লেখ্য, অধিবিদ্যা, জ্ঞানতত্ত্ব, নীতিবিদ্যা ও যুক্তিবিদ্যার মতো মূল শাখাসমূহ ব্যতিরেকে দর্শনের অপরাপর সব শাখা ‘philosophy of something’ প্যাটার্নে পরিচিত, পঠিত ও চর্চিত হয়। যেমন, philosophy of language ইত্যাদি। এভাবে ইসলামী দর্শনও দর্শনেরই একটি শাখা বিশেষ। দর্শনের প্রচলিত বিষয়বস্তুর কোনোটিই ইসলামী দর্শনের আওতাবহির্ভূত নয়।
ইসলাম সম্পর্কে ইসলামের মৌলিক গ্রন্থসমূহ তথা কোরআন ও হাদীসে ব্যবহৃত মূল পরিভাষা হচ্ছে ‘দ্বীন’। দ্বীন অভিন্ন ও অবিভাজ্য। বাংলায় সাধারণত দ্বীনকে ‘ধর্ম’ হিসেবে অনুবাদ করা হয়, আর ইংরেজিতে religion। ধর্মীয় ব্যাখ্যা বা ধর্মনিরপেক্ষ ব্যাখ্যা– এটি আমাদের বলা বা উপস্থাপনাগত ব্যাপার। ইসলামের ভেতর থেকে ইসলাম একটি দ্বীন। কেউ মানুক বা না মানুক কিম্বা আংশিক মানুক, অথবা ‘আদ্-দ্বীন’-এর কিছু কিছু বিষয় নিয়ে কোনো ককটেল বানাক, সেটি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ব্যাপার। দ্বীন হিসাবে ইসলাম প্রথমত ধর্ম, এরপর দর্শন বা আর যা কিছু। ইসলামের দিক থেকে ধর্মতাত্ত্বিক ব্যাখ্যার মোকাবেলায় দার্শনিক ব্যাখ্যা তাই গ্রহণযোগ্য নয়। উপরে উল্লিখিত কোরআন এবং হাদীসের উদ্বৃতিসমূহ এ বিষয়কে নিশ্চিত করে। অবশ্য ইসলামের ওপর যারা স্বীয় মর্জি-মোতাবেক একটি ব্যাখ্যা চাপিয়ে দর্শনের নামে একে লেজিটিমেট করতে চাইবেন, তারা উপরোল্লিখিত সুস্পষ্ট ও স্বব্যাখ্যাত সূত্রগুলোসহ এ ধরনের তাবৎ দলীল-প্রমাণকে নিছক ‘ধর্মতাত্ত্বিক’ হিসেবে নাকচ করে দেয়ার ‘অধিকার’ (?) রাখেন!
ধর্ম ও দর্শনের সমন্বয় প্রচেষ্টা কি আদৌ নিরপেক্ষ?
ধর্ম ও দর্শনের সমন্বয়ের কথা যারা বলেছেন তারা ধর্মের ওপর দর্শনকে চাপিয়ে প্রকারান্তরে ধর্মকে নাকচ করেছেন। এ ধরনের ব্যক্তিবর্গ স্পষ্টত ধর্মবিরোধী। অজ্ঞেয়বাদ ও নির্বিকার যেমন করে মূলত নাস্তিকতাবাদ তেমন করে যারা ধর্মকে ফিলোসোফাইজ করতে চান, ধর্মের রেফারেন্সমুক্ত ইন্টারপ্রিটেশান দাঁড় করাতে চান তারা আদতে ধর্মেরই গোড়া কাটার লোক। ধর্মের সমর্থনে যদি দর্শন হতে না পারে তাহলে আল-গাজ্জালীকে দার্শনিক গন্য করাটা আগাগোড়াই ভুল। স্মরণ করা যেতে পারে যে, মুসলিম দর্শনের দুনিয়াজোড়া সব পাঠক-পণ্ডিতই মনে করেন, আবু হামিদ আল গাজ্জালি হলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট মুসলিম দার্শনিক।
যাহোক, ধর্ম ও দর্শনের সমন্বয় প্রচেষ্টাটির ইতিহাস অনুসন্ধান করলে ইবনে রুশদ-এর নামটি সবার উপরে ভেসে উঠে। তিনি ছিলেন অ্যারিস্টটলের অনুসারী। অ্যারিস্টটল দার্শনিক আলোচনা অনুধাবনের সক্ষমতা-অক্ষমতার নিরিখে মানুষকে চার ভাগে ভাগ করেছেন। অ্যারিস্টটলের শিক্ষক প্লেটো তার কল্পিত আদর্শ রাষ্ট্রের নাগরিকদেরকে চারভাগে বিভক্ত করেছেন। বিশিষ্ট peripatetic (pro-Greek) দার্শনিক হিসেবে ইবনে রুশদও নাগরিকদেরকে জ্ঞানগত তারতম্যের ভিত্তিতে তিন ভাগে ভাগ করেছেন–
১। আলঙ্কারিক (rhetoric) পদ্ধতি– জনসাধারণের পদ্ধতি
২। যুক্তিসিদ্ধ (dialectical) পদ্ধতি– ধর্মতাত্ত্বিকদের পদ্ধতি
৩। প্রতিপাদক (demonstrative) পদ্ধতি– দার্শনিকদের পদ্ধতি।
ধর্মতাত্ত্বিক ব্যাখ্যার বিকল্প হিসেবে ইসলামের দার্শনিক ব্যাখ্যাকে গ্রহণ করলে ইবনে রুশদের এই ব্যাখ্যাও মেনে নিতে হয়!
‘দার্শনিকদের জন্য আলাদা ও সর্বোচ্চ মর্যাদা’– এই পদ্ধতির দলীল হিসেবে তিনি উপরে উদ্বৃত সূরা আলে-ইমরানের ৭ নং আয়াতকে একটি মৌলিক পরিবর্তনসহ উল্লেখ করেন। উক্ত আয়াতে ‘আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ এর ব্যাখ্যা জানে না’ এরপর একটি ওয়াকফে লা’যেম (অত্যাবশ্যকীয় বিরতি চিহ্ন) রয়েছে। দুনিয়াতে আজ পর্যন্ত প্রকাশিত কোরআনের সকল কপিতেই এটি রয়েছে। কিন্তু ইবনে রুশদের প্রস্তাবনায় এই ওয়াকফে লা’যেম চিহ্নটি হবে ‘আর যারা গভীর জ্ঞানী’ এর পরে। তাতে করে আয়াতটির পঠন নিম্নরূপ দাঁড়ায়: ‘আল্লাহ এবং যারা গভীর জ্ঞানী, তারা ছাড়া অন্য কেউ এর ব্যাখ্যা জানে না’।
ধর্মতাত্ত্বিক ব্যাখ্যার বিকল্প হিসেবে ইসলামের দার্শনিক ব্যাখ্যাকে গ্রহণ করলে ইবনে রুশদের এই ব্যাখ্যাও মেনে নিতে হয়! মানুষের মধ্যে জ্ঞানগত পার্থক্য কি নাই? যদি থাকে তাহলে একে ভিত্তি ধরে মানুষের মধ্যে শ্রেণীবিভাগ কয় ধরনের হতে পারে? এসব প্রশ্ন তৈরি হওয়া যতটা স্বাভাবিক, এর উত্তরও ততটাই সহজ। জ্ঞানগত দিক থেকে মানুষে মানুষে বেশ-কম হওয়া স্বাভাবিক ব্যাপার। এ বিষয়টি সঠিক হওয়া সত্ত্বেও এর ভিত্তিতে মানুষের শ্রেণীবিন্যাসকরণ ভুল।
উপরোক্ত ধরনের শ্রেণীবিন্যাস করার বিষয়টি ভুল। জ্ঞানের ভিত্তিতে মানুষেকে তিন বা চার ভাগে ভাগ করার পরিবর্তে তা চার, পাঁচ, ছয়, সাত ইত্যাদি অনেক ভাগেই ভাগ (category) করা সম্ভব। তবে এই বিভাজন ও প্রত্যেক গ্রুপের নিজেদের মতো করে টেক্সট ব্যাখ্যার বৈধতা থাকলে ইসলাম বা অনুরূপ তাৎপর্যপূর্ণ কোনো বিষয়েরই স্বাতন্ত্র্য ও স্বকীয়তা অক্ষুণ্ণ থাকে না। এ বিষয়ে অর্থাৎ ব্যাখ্যার বৈচিত্র্যের সাথে ব্যাখ্যার বৈপরিত্যের পার্থক্য প্রসঙ্গে ইতোমধ্যে আলোচনা করা হয়েছে।
মানুষের জ্ঞানগত পার্থক্যকে ইসলাম বাস্তবসম্মত মনে করে। কোরআন ও হাদীসের প্রচুর রেফারেন্স রয়েছে যাতে জ্ঞান, জ্ঞানচর্চা ও জ্ঞানীর উচ্চ মর্যাদার কথা বলা হয়েছে। ইসলামের দৃষ্টিতে জ্ঞানগত দিক থেকে মানুষ দুই ধরনের: যারা জানে আর যারা জানে না। যারা জানে না, তাদের দায়িত্ব হলো যারা জানে তাদের কাছ হতে জেনে নেয়া। কে জানে আর কে জানে না, তা সংশ্লিষ্ট বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল। অতএব, এমনও হয় কিম্বা হতে পারে যে, কেউ কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে অন্যদের তুলনায় বেশি জানে। অথচ একই ব্যক্তি অন্য কোনো বিষয়ে কম জানে।
অতএব, কে বেশি জানে আর কে কম জানে তা জানার কোনো বিষয় ও প্রেক্ষাপট নিরপেক্ষ পদ্ধতি নাই। মানুষের জ্ঞানগত মর্যাদা নিরূপণের বিষয়ে ইসলাম অধিকতর বস্তুনিষ্ঠ (objective)। যিনি (বেশি) জানেন তিনি স্বীয় জ্ঞানের দাবী অনুসারে কাজ করবেন বা করতে চাইবেন। সংশ্লিষ্ট বাস্তব পরিস্থিতিই প্রমাণ করবে, তার উক্ত দাবী সঠিক কিনা বা কতটুকু সঠিক। আলেমে দ্বীন, ফকীহ, মুজতাহিদ ইত্যাদি মর্যাদাপূর্ণ শব্দাবলীর মাধ্যমে কোনো বিশেষ ব্যক্তি বা গোষ্ঠী কর্তৃক স্বাধীন ও স্বতন্ত্রভাবে ইসলামের ব্যাখ্যা ও ভাষ্য রচনার অধিকারকে (authority) বুঝায় না। বরং কিছু ব্যক্তির জ্ঞানগত আধিক্য ও পরিশুদ্ধিকে নির্দেশ করে মাত্র।