আর্মেনিয়া-আজারবাইজান কনফ্লিক্টে প্রায়ই প্রশ্ন উঠে ইরানের ভুমিকা নিয়ে। কেউ কেউ বলার চেষ্টা করেন ইরানের জাতশত্রু ইসরাইল আজারবাইজানকে সব ধরনের সমর্থনসহ প্রয়োজনীয় অস্ত্র ও রশদ সরবরাহ করে বলেই ইরান বাধ্য হয়ে আর্মেনিয়াকে সমর্থন করে।
কিন্তু ব্যাপারটা কি আসলে তাই? আমার মনে হয়নি। বরং বিষয়টা ইরানের ক্ষেত্রে নয় কিন্তু উল্টো ইসরাইলের ক্ষেত্রেই বেশি খাটে। অর্থাৎ ইরান আজারবাইজানকে শুরুতেই শত্রুভাবাপন্ন ভেবে যখন আর্মেনিয়ার পক্ষে দাঁড়িয়েছিল তখনই ইসরাইল সেই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে আজারবাইজানকে কাছে টেনে নেয়।
অনেকেই অবাক হন শিয়াদের রক্ষক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ইরানিরা সিরিয়া, লেবানন, ইরাক, ইয়েমেন, বাহরাইনসহ যেখানেই শিয়া দেখে সেখানেই তাদের পক্ষে আদাজল খেয়ে নামে। সে হিসেবে আজারবাইজানের পক্ষেও একইভাবে দাঁড়ানোর কথা, কারণঃ
১. তেল-গ্যাসে সমৃদ্ধ প্রতিবেশি আজারবাইজান মাত্র তিরিশ বছর আগে জন্ম নেয়া একটি মুসলিম অধ্যুষিত দেশ যার সাথে ইরানের পূর্ব কোন শত্রুতা নেই থাকার কথাও না।
২. আজারবাইজান শুধু যেনতেন মুসলিম দেশ নয় বরং শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম রাষ্ট্র (প্রায় ৭০% শিয়া)। তাও আবার ইয়েমেন, বাহরাইন ও সিরিয়ানদের মত বখে যাওয়া শিয়া নয়, বরং তাদের মতে খাটি টুয়েলভার শিয়া।
৩. আরো ইন্টারেস্টিং বিষয় হল সুন্নীইজম ত্যাগ করে পনেরো শতকে ইরানি পারসিয়ানরা যে ইসনা আশারিয়া (টুয়েলভার) শিয়াইজমকে বুকে টেনে নিল সেটার জন্মদাতা কিন্তু ইরানিরা নয় বরং আজেরিরা। কারণ বর্তমান ইরানের অতিত গর্বের রাজত্বকাল হল শাফাভি ইম্পায়ার। সেই শাফাভিরা জাতিতে কিন্তু আজেরী তুর্কি ছিল। অর্থাৎ আজেরিদের ফলোয়ার হওয়ার কথা সবার আগে ইরানি শিয়াদেরই!
৪. টোবাকো রেভুল্যুশন, কনস্টিটিউশনাল রেভ্যুলুশন, এবং খোমেনির নেতৃত্বে সংঘটিত ইসলামিক রেভ্যুলুশনসহ ইরানি শিয়াদের প্রতিটি বিপ্লবেই উত্তর ইরানে বসবাসকারি আজেরি শিয়াদের একটিভ পার্টিসিপেশন ছিল। সেটার কৃতজ্ঞতাস্বরূপ ইরানিদের উচিৎ ছিল যেকোন বিপদে আজেরিদের পাশে শক্তভাবে দাঁড়ানো।
কিন্তু সেটা কেন হলোনা? সেটার কারণ কয়েক মাস আগের একটা পোস্টে উল্লেখ করেছিলাম। এবং তা হল ইরানিরা সবার আগে পারসিয়ান, দ্বিতীয়ত শিয়া, এবং তৃতীয়ত হয়তো মুসলিম। অর্থাৎ অন্য কিছুর চেয়ে পারস্য জাতীয়তা তাদের কাছে সব থেকে গুরুত্বপূর্ন। আর হাজার বছর ধরে পারস্য জাতীয়তাবাদের প্রধানতম শত্রু হল তুর্কি জাতি।
আশ্চর্য বিষয় হল আজারবাইজান ও ইরানে অবস্থিত আজেরিরা শিয়া হয়েও ইরানের বন্ধু হতে পারেনি কারণঃ
১. আজেরিরা জাতিতে তুর্কি। সুন্নী সেলুজুক থেকে শুরু করে শিয়া শাফেভি, শিয়া আক কোইনল্যু, কারা কোইনল্যু ও শেষে শিয়া কাজার ডায়ানেস্টি এরা হাজার বছর ধরে ইরানিদের শাসন করে এসেছে। এরা ছিল জাতিতে সবাই তুর্কি। এর মধ্যে সেলজুকরা বাদে বাকি সবাই আবার আজেরি তুর্কি!
২. আজেরিরা ফার্সী ভাষায় কথা বলে না। তাদের ভাষা আজেরি যেটা কিনা আবার তুর্কি ডায়ালেক্ট অর্থাৎ তুর্কি উপভাষা।
৩. সেলজুক, মামলুক, অটোমান তুর্কিদের কাছে সুন্নিইজম ও তুর্কি জাতিয়তার চেয়ে মুসলনানিত্ব বেশি প্রাধান্য পেলেও আজেরিরা অন্যকিছুর চেয়ে আবার তুর্কি জাতিয়তাকেই বেশি প্রাধান্য দেয়। সে ক্ষেত্রে ইরানিদের সাথে অবশ্য আজেরিদের কিছুটা হলেও সাদৃশ্য আছে।
৪. ইরানের এক তৃতীয়াংশ অর্থাৎ প্রায় তিন কোটি মানুষই আবার জাতীতে তুর্কি। এর মধ্যে প্রাদেশিক রাজধানী তাবরিজ ও উত্তর ইরান তথা পুর্ব আজারবাজান প্রদেশে অবস্থিত দুই কোটি মানুষ গর্বিত আজেরি তুর্কি! কিন্তু মজার ব্যাপার হল শিয়াইজম টুলস দিয়েও পারস্য ইরান এদেরকে পারসিয়ানাইজ করতে পারেনি। ফলে ইরানিদের কাছে এরা সাসপেক্টিভ। আজারবাইজানের অনেকেই মনে করে উত্তর ইরানের পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশ ইরানিরা অবৈধভাবে নিজেদের অধিকারভুক্ত করে রেখেছে। আর ইরান মনে করে ইরানি আজেরিরা আজারবাইজানের আজেরিদের সাথে যোগসাজস করে ভবিষ্যতে বৃহত্তর আজারবাইজান গঠন করবে। ইন্টারেস্টিং!
৫. ১৯৯১ সালে আজারবাইজান স্বাধীন হওয়ার পর ইরানের আশা ছিল তাদের মত করে আজারবাইজান ইসলামিক রিপাব্লিক গঠন করবে। কিন্তু ইরানকে আশাহত করে আজারবাইজানের তৎকালীন শাসকগোষ্ঠি কামাল আতাতুর্কের পশ্চিমা তোষণ সেকুলারিজম নীতিকেই গ্রহন করে।
৬. ব্যবসা, বানিজ্য ও অর্থনীতিতে ইরান ও আজারবাইজান পরস্পর পরিপুরক রাষ্ট্র নয় বরং একে অপরের প্রতিদ্বন্দী। কারণ ইরানের মত আজারবাইজানও তেল, গ্যাসে সমৃদ্ধ ও জ্বালানি রপ্তানিকারক দেশ। এছাড়া জ্বালানি সমৃদ্ধ কাস্পিয়ান সাগরের সীমানা নিয়ে দুই দেশের মধ্যে বিরোধ আছে।
উপরোল্লেখিত কারণে নতুন দেশটির জন্মলগ্ন থেকেই ইরানিরা আজারবাইজানের পিছে লেগে আছে। আজারবাইজানের জাতশত্রু আর্মেনিয়ার সাথে ইরান প্রতিরক্ষা সম্পর্ক রক্ষা করে চলছে। নব্বইয়ের প্রথমার্ধের নাগোর্ন্য-কারাবাখ যুদ্ধে ইরান আজারবাইজানের বিপরীতে আর্মেনিয়াকে সম্ভাব্য সব ধরনের সাপোর্ট দিয়ে গেছে। শুধু তাই না মূল ভূখন্ড থেকে বন্ধুরাষ্ট্র তুরস্ক ও আর্মেনিয়ার উল্টা দিকে তুর্কি সীমান্তে অবস্থিত বিচ্ছিন্ন আজারবাইজানী সিটমহল নাকচিভান প্রদেশে তেল-গ্যাস সরবরাহ করার জন্য ইরানের ভিতর দিয়ে খুবই সংক্ষিপ্ত ও লাভজনক পশ্চিমাঞ্চল পাইপলাইন ব্যবহার করতে দেয়নি ইরান। এছাড়া ইরানের জঙ্গি বিমানগুলো প্রায়শই আজারবাইজানের আকাশসীমা লংঘন করে। অন্যদিকে নাগোর্ন্য-কারাবাখের দক্ষিনে ইরান সীমান্ত সংলগ্ন আজারবাইজানের শেষ সীমায় কোন এয়ারক্রাফট দেখলেই আর্মেনিয়ার পক্ষ হয়ে গুলি করে দেয়।
অপরদিকে জাতশত্রু আর্মেনিয়ার সাথে প্রতিরক্ষা চুক্তির অংশ হিসেবে রশদ সাপ্লাইসহ এখন পর্যন্ত সব ধরনের সহযোগীতা করে ইরান। এই সহযোগিতার অবশ্য বেশকিছু যৌক্তিক কারনও আছে। যেমনঃ
১. সোভিয়েত আমলের দক্ষিন ককেশাসের তিনটি দেশ জর্জিয়া, আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান। তার মধ্যে আর্মেনিয়াকে গড়ে তোলা হয়েছিল শিল্প সমৃদ্ধ প্রদেশ হিসেবে। জর্জিয়াকে রাখা হয়েছিল কৃষিপন্য উৎপাদনের জন্য। এবং আজারবাইজান ছিল জ্বালানি উৎপাদনের জন্য। অর্থনৈতিক কারনে ইরান ও এনার্জি হাঙ্গার আর্মেনিয়া আজারবাইজানের চেয়ে অনেক বেশি ব্যবসা বান্ধব ও পরিপুরক।
২. ইরান ও আর্মেনিয়া উভয়ের এক্সিস্টেনশিয়াল গ্যারান্টর হল রাশিয়া। ককেশাসে ন্যাটো ও তুর্কিকে চেক দেয়ার জন্য রাশিয়ার দুইটি সেনাঘাটির উভয়টিই অবস্থিত আবার আর্মেনিয়ায় এবং তুর্কি সীমান্ত পাহারা দেয় রাশিয়া। ল্যান্ডলকড আর্মেনিয়া আবার তুর্কি ও আজারবাইজান দিয়ে পরিবেষ্টিত। তাই রাশিয়ার ইচ্ছার কাছে ইরান বাধ্য ছিল আজারবাইজানের বিপরীতে আর্মেনিয়াকে বন্ধু হিসেবে বেছে নিতে।
৩. খ্রিষ্টান ও পশ্চিমাদের স্নেহভাজন হয়েও আর্মেনিয়া নিঃশর্তভাবে সকল ইন্টারন্যাশনাল ফোরামে ইরানকে সাপোর্ট করে। বিপরীত পক্ষে রাশিয়াকে খুশি করতে ইরানও তাই করে।
৪. আর্মেনিয়া ও ইসরাইল উভয়েই তুর্কির শত্রু হলেও শুধুমাত্র ইরানের কারনে ইসরাইল আর্মেনিয়ার জাতশত্রু ও তুর্কির পরম বন্ধু আজারবাইজানকে বন্ধু হিসেবে বেছে নিয়েছে।
তো আজারবাইজানের সাথে ইরানের শত্রুতার এই সুযোগ ইসরাইল ভালভাবেই নিয়েছে। যেমনঃ
১. ইসরাইল তার মোট চাহিদার ৪০% তেল আমদানি করে আজারবাইজান থেকে।
২. মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র আজারবাইজানই ইসরাইলের সফিস্টিকেটেড অস্ত্র কিনতে পারে।
৩. বিনিময়ে আজারবাইজানের বিশাল সীমান্তে ইরানের বিরুদ্ধে ইসরাইল গোয়েন্দা নজরদারী করার সুযোগ পায়।
৪. প্রয়োজনে উত্তর ইরানের পারমানবিক ও সামরিক স্থাপনায় অঘোষিত নাশকতা ও হামলা করার অনুমতি নিয়ে রেখেছে বলে বাজারে গুজব চালু আছে।
তো যারা এখনো মনে করেন যে মূলত ইসরাইলের কারণে ইরান আর্মেনিয়ার পক্ষে দাঁড়ায় ও কথা বলে তাদের জন্য সম্পুরক আরো কিছু তথ্যঃ
১. যে আর্মেনিয়াকে ইরান তার পেয়ারের দোস্ত মনে করে সেই আর্মেনিয়া ও ইসরাইল অনেক দিন হল স্ব স্ব দেশে দুতাবাস খুলে কুটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছে। কিন্তু অপরদিকে এত দোস্তালির পরেও আজারবাইজান ইসরাইলের সাথে কুটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেনি অর্থাৎ এখনো দুতাবাস খোলেনি।
২. বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে ইরান মুসলিমদের শত্রু আর্মেনিয়াকে প্রকাশ্যেই সমর্থন করে। কিন্তু আজারবাইজান কখনো কোন ইন্টারন্যাশনাল ফোরামে মুসলিমদের জাতশত্রু ইসরাইলের পক্ষে কোন সমর্থন দেয় না। বরং বেশিরভাগ সময় ইসরাইলের বিরুদ্ধে ওআইসির রেজুলেশনে স্বাক্ষর করে।