কোন কোন কালে ব্যক্তি মানুষ বা গোটা জাতির জীবনে এমন সময় আসে যখন সে বা তারা আর বুঝতে পারে না প্রকৃতই তার অস্তিত্ব বিরাজমান আছে কি না? আমাদের গোটা জাতির জীবনে এখন যেরকম সময় বিরাজ করছে তাতে আমাদের দেশের মানুষ আদৌ অস্তিত্ববান কিনা সেই প্রশ্ন উঠছে। আমরা কি বিরাজ করি? আমাদের কি কোন অস্তিত্ব আছে? অস্তিত্বকে উপলব্ধি করার জন্য দুনিয়ার সাথে সত্যের সম্পর্ককে আগে রক্ষা করতে হয়। সত্য নিহত হলে আমরা যে মিথ্যার মধ্যে নিপতিত হই তাতে আমাদের অস্তিত্ব বিষয়ক কোন বোধ থাকে না। পশুর মতো হয়তো বেঁচে থাকা হয়, কিন্তু মানুষ হিসেবে অস্তিত্ববান থাকার যে গৌরব তা আর থাকে না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে নাৎসি বাহিনী যখন ফ্রান্স দখল করে নেয়, যখন চারদিকে ফ্যাসিবাদী চিন্তার জোয়ার তখন গোটা সভ্যতা ও জাতীয়তাবোধের এমন এক সংকট ফ্রান্স ও ইউরোপের মানুষের জীবনে হাজির হয়েছিল যে, মানুষ নিজের অস্তিত্ব ভুলে গিয়ে ফ্যাসিবাদের জোয়ারে ভেসে গিয়েছিল।
পপুলিস্ট/জনজোয়ারের সুবাদে ফ্যাসিবাদ শুধু ক্ষমতাই দখল করে না। দখল করে মানুষের মনোজগতও। গোটা জার্মান জাতির মনোজগতের এই দখল কায়েম করেই উত্থান ঘটেছিল একজন হিটলারের। ফলে মনোজগতের ওপর নিয়ন্ত্রণটা দূর করা না গেলে, আমাদের অস্তিত্ব নিয়ে টিকে থাকার বোধই উপলব্ধি করার ফুসরত হয় না। কারণ তখন ব্যক্তি মানুষের স্বাধীনতার বোধ নষ্ট হয়ে যায়। মিথ্যাকেই আদর্শ ও গৌরবজনক মনে হয় এবং এর মধ্যেই কোন রকমে বেঁচে থেকে যতটা পারা যায় দুনিয়াবি বা বস্তুগত বাসনা পূরণ করে নিজেকে সুখী করার চেষ্টা করে মানুষ।
নিজের প্রাণের সত্যের সাথে আপোষ করে ফ্যাসিবাদি সত্য যা মিথ্যার চেয়ে ভয়ংকর তার সাথে আপোষ করে বেঁচে থাকাই নিরাপদ মনে করেন বেশির ভাগ মানুষ
এই স্বার্থপরের মতো চিন্তা গোটা সমাজে যে পচন ধরায় সেটাই অত্যাচারের ধারাকে স্বাভাবিক করার সংস্কৃতি চালু করে। এটা সমাজে সংস্কৃতি হিসেবে চালু হওয়ার আগে ব্যক্তি পর্যায়ে আত্মসত্তা হারাবার ফলে যে সংকট তৈরি হয় তা মানুষ আর কোন ভাবে পূরণ করতে পারে না। তবে সেই জায়গাটা খালিও থাকে না, সেটা পূরণ হয় ভয় দ্বারা। ক্ষমতাকে ভয় পেয়ে নিজের অপছন্দের বিষয়গুলোও যখন মানুষ নীতি হিসেবে মেনে নিতে থাকে তখন শুরু হয় মিথ্যাকেই বিশ্বাস করা। ফ্যাসিবাদের প্রকল্পিত শত্রুকেই নিজের শত্রু মনে করা শুরু করে গোলামী চেতনার নাগরিকগুলো। এটা সহনীয় করার জন্য সমাজের একটা গোষ্ঠী বা কমিউনিটিকেই তখন শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে তাকে দমন বা বিনাশ করার জন্য প্রয়োজনীয় সম্মতি ও সংহতি পয়দা করা হয়। এতে একশ্রেণির বুদ্ধিজীবী ও মিডিয়াও দরকারি ভূমিকা পালন করে। তাদের সহযোগিতায় সমাজের একটা অংশকে জাতিবিরোধী বা রাষ্ট্রবিরোধী, ঘৃণিত ও শত্রু হিসেবে হাজির করে বিপুল মানুষের সংহতি তৈরি করে গণহত্যার যে পরিবেশ তৈরি করা হয় তাতে মানুষের নিজের অস্তিত্বের বোধ পাকাপাকিভাবেই নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু যখন সে গোটা প্রক্রিয়াটি বুঝতে পারে এবং নিজের বিবেকের সামনে দাঁড়ায় তখন সে আসলে বুঝতে শুরু করে যে, সে নিজের জীবন যাপন করে না। সে ক্ষমতার নীতির আলোকে যে হুজুগে জীবনবোধকে তার ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে -সেই জীবনকেই নিজের জীবন মনে করে নিশ্চিন্ত ছিল। কখনও বা অন্যায়ের নীরব বা সরব সহযোগী হিসেবে ভূমিকা পালন করেছে। ফলে এটা যত দেরিতে মানুষ অনুভব করে ততই ক্ষতির পরিমাণ বাড়তে থাকে। নিজের অস্তিত্বহীনতার বোধ মানুষকে তখন এতোটাই বিপন্ন করে যে জীবনের আর কোন অর্থ থাকে না। চারদিকে নেমে আসে হতাশার কালো ছায়া। তাই আমাদের প্রধান সংগ্রাম হলো এই অস্তিত্বের বোধ ও মর্যাদাকে যা কিছু মুছে দেয়, ভুলিয়ে দেয়- তার বিরুদ্ধে চিন্তাশীল সংগ্রাম জারি রাখা। এটাই একজন চিন্তকের অত্যতম প্রধান কাজ।
করোনা মহামরি, রাজনৈতিক ও দার্শনিক পর্যবেক্ষণ
বিষয়টা আরও একবার অন্যভাবে বলি, ফ্যাসিবাদী শাসন আমাদের সমস্ত মূল্যবোধ ও নীতির ধারণাকে এমনভাবে হত্যা করে যে, তাতে একটাই মাত্র বাস্তবতা তখন মানুষের মনোজগত দখল করে। সেই বাস্তবতা হলো, শাসনের সহায়ক যুক্তিতে পয়দা হওয়া বাস্তবতা। সন্ত্রাসবাদী যুক্তিকেই আদর্শ হিসেবে প্রচার করা হয়। এই প্রচারকে সত্যে পরিণত করতে যত প্রকার মিথ্যা দরকার সবই নিষ্ঠার সাথে (সত্যের মোড়কে) উৎপাদন করা হয়। এই অবস্থায় গণ-মনোজগতেরও একটা ফ্যাসিবাদী রূপান্তর ঘটে। আর এমন অবস্থাতেই মানুষ হারিয়ে ফেলে তার অস্তিত্বের দায়-বোধ। মানে, আমি বা আমরা যে স্বাধীন সত্তা নিয়ে বেঁচে আছি সেই বোধই মরে যায়। দুর্নীতিই তখন নীতি হয়ে যায়। আমরা মনে করি, আমি যেটা ভাল মনে করি এর বাইরে আর কোন ভাল নাই। আমি যেটা মন্দ মনে করি সেটাই একমাত্র মন্দ। এই ভাবে মোরাল ব্লেইমের এক খেলাতে মেতে আমরা প্রকৃত বাস্তবের বহুমুখীন যে উপস্থিতি তার বোধই হারিয়ে ফেলি। হয়ে উঠি একচোখা প্রাণি।
মিথ্যাকেই আদর্শ ও গৌরবজনক মনে হয় এবং এর মধ্যেই কোন রকমে বেঁচে থেকে যতটা পারা যায় দুনিয়াবি বাসনা পূরণ করে নিজেকে সুখী করার চেষ্টা করে মানুষ
এমন অবস্থায় আমরা শাসনতন্ত্রের বাস্তবতার ভেতরই কেবল বেঁচে থাকি। নিজেদের কোন জীবন থাকে না। ফলে এই যে চৈতন্যহীন, অস্তিত্বহীন অবস্থা এটাকে বুঝতে পারার জন্য দরকার সত্যিকারের চিন্তাশীল কর্ম-তৎপরতা। যারা একই সাথে এই অবস্থার সুযোগে গজিয়ে ওঠা বিপুল ফ্যানাটিক/পপুলিস্ট এজেন্সির বিরুদ্ধেও ফাইট করবে। যে বিশাল আয়োজন ও প্রতাপের মাধ্যমে আমাদের অস্তিত্বের বোধকে নাই করে দেয়া হয়েছে তার বিরুদ্ধে সংগ্রামের ভেতর দিয়ে যাওয়া ছাড়া এমন সময়ে অস্তিত্ববান মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার কোন সুযোগ নাই। ফলে আমাদের প্রথম কাজ হলো, অস্তিত্বের বোধকে সজাগ করা। আমরা যে বেঁচে আছি এই সংবাদটি নিজেকে জানিয়ে দেয়া। যে ফ্যাসিবাদী বাস্তবতায় আমাদের নিজেদের রিয়েলিটিকে হত্যা করে আমাদের অস্তিত্বহীন, চৈতন্যহীন করে দেয়া হয়েছে তাকে দার্শনিকভাবে চিহ্নিত করতে চেষ্টা করা যে কোন চিন্তকের অন্যতম মূল কাজ- এই সময়ে।
এটা খুব সহজ কাজ নয়। এই কাজ করতে গিয়ে চরম মূল্য দিতে হতে পারে। কিন্তু এটা না করলে জ্ঞানচর্চার কোন মানেই থাকে না, থাকবে না ইতিহাসের কাছে। বাংলাদেশের মানুষ নিজের অস্তিত্ব নিয়ে আজ টিকে থাকার সামর্থ্য হারিয়েছেন। অস্তিত্বের যে গভীর বোধ দরকার তাও আমাদের চারপাশে গরহাজির। এই করোনার সময়েও আমরা দেখলাম আমাদের জীবন মৃত্যুর ভয় ও প্যানিকে বা শঙ্কায় ভরে উঠেছে। আমরা আমাদের জীবের জীবন নিয়ে এমনভাবে ব্যস্ত ছিলাম যে মানুষের অস্তিত্বময় উপস্থিতির চর্চা এই সময়েই বরং খুব বেশি দরকার ছিল তা বারবার মনে হচ্ছে। এই বোধ জারি থাকলে আমরা মৃত্যুর বোধ দ্বারা চালিত না হয়ে জীবনের সংগ্রামের জন্য এক মানবিক মর্যাদাময় ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম গড়ে তুলতে পারতাম যা এই কঠিন সময়কে মোকাবেলা করতে খুব সহায়ক ভূমিকা পালন করতো। প্লেগ উপন্যাসের চরিত্রগুলো যেমন লড়াই করেছিল। আমরা করোনার সময়ে এই উপন্যাসের কথা বার বার শুনছি কিন্তু কাজের বেলায় আগের চেয়ে অবস্থা খারাপই হয়েছে বলা যায়।
আমাদের অস্তিত্বময়তা মানে আমরা প্রকৃতভাবে যা সেই মৌল বোধকে ধারণ করে বাঁচা
আমরা যদি নিজেদের অস্তিত্বের মর্যাদার ব্যাপারে সজাগ হতাম তখন হয়তো এই মহামারীই তৈরি হওয়ার সুযোগ পেত না। আমরা জীবনের জন্য পরিবেশ ও প্রাণের যত্ন নিতে শিখতাম। ফলে আমাদের মানুষী অস্তিত্বের অনুভবকে প্রতিমুহূর্তে চর্চার যে চিন্তাশীল অনুশীলন দরকার তার প্রয়োজন এখন আরও ব্যাপকভাবে হাজির হয়েছে। সবাই একধরণের চলতি ট্রেন্ডে ডুবে আছে, নিজের প্রাণের সত্যের সাথে আপোষ করে ফ্যাসিবাদী সত্য যা মিথ্যার চেয়ে ভয়ংকর তার সাথে আপোষ করে বেঁচে থাকাই নিরাপদ মনে করেন বেশির ভাগ মানুষ। এই জন্য প্রকৃত চিন্তকের পথ কঠিন। এই কঠিন পথে খুব কম মানুষ নিজেকে পরিচালিত করতে রাজি হন। ফলে অনেক মানুষ আমাদের এই গভীর সংগ্রামকে উপেক্ষা করে গোলামির জীবনের ভেতর দিয়ে নিজের সাথে প্রতারণার পথকে বেছে নিয়ে আমাদের সাথে শত্রুতার সম্পর্ক চর্চা করতে শুরু করবে- এতে অবাক হওয়ার কিছু নাই। ফ্যানাটিক বাস্তবতার গোলামীতে নিজেকে হাজির করে আত্মতৃপ্তিতে মজে থাকার বিরোধিতা করাই যেন আমাদের অপরাধ!
লেখাটাকে তাত্ত্বিক জটিলতার বাইরে রাখতে চেয়েছিলাম কিন্তু বিষয়টা পরিষ্কার করার জন্য ছোট করে কিছু কথা বলতেই হচ্ছে। বিং/অস্তিত্বময়তা অথবা এক্সিসটেন্স ও এসেন্সের সম্পর্কটা দার্শনিকভাবেও বুঝতে পারা দরকার। এক্সিসটেন্স বা অস্তিত্বময়তাকে সহজে বুঝতে পারা যায় যদি এভাবে বলতে চেষ্টা করি, being (what is) আর essence (isness)- যদি এই ভাবে বুঝি তা হলে জটিল বিষয়টাও সহজে বুঝতে পারা সম্ভব। বিং/অস্তিত্বময়তা বলতে বোঝায় আমরা কি (হোয়াট ইজ) আর আমাদের এসেন্স হলো এই ইজনেস মানে আমরা যা তাই আমাদের এসেন্স। এখন যখন আমরা নিজেদের চোখের সামনে ঘটতে থাকা মিথ্যা ও অন্যায়ের মধ্য দিয়ে নিজেদের পরিচালিত করতে থাকি, একটার পর একটা প্রজন্মকে বেড়ে উঠতে দিতে থাকি তখন বিং বা আমাদের অস্তিত্বময়তাকে যদি প্রশ্ন করা হয়, হোয়াট ইজ? এই প্রশ্নটা করলে তার উত্তর যেটা সমানে আসে, সেটা পুরাই ফেইক বা মিথ্যার দ্বারা আপদমস্তক পরিবেষ্টিত এক আমি। আসল বা প্রকৃত আমিকে পাওয়া যায় না। এবং আমির এসেন্স বা ইজনেসটাও হয় মিথ্যা। এভাবে আমাদের অস্তিত্বই নাই হয়ে যায়। অর্থাৎ মনে রাখতে হবে, আমাদের অস্তিত্বময়তা মানে আমরা খোদ/প্রকৃতভাবে যা সেই মৌল বোধকে ধারণ করে বাঁচা। এসেন্সের ভাল বাংলা না করে এটার অর্থ আমরা এভাবে করতে পারি, যেমন আমরা যে কারণে মানুষ সেই কারণটাকেই বলা যায় মানুষের এসেন্স। তাহলে দেখা যাচ্ছে, আমাদের অস্তিত্বময়তার এসেন্সকে রক্ষা করতে হলে সত্যকে রক্ষা না করে তা করা সম্ভব না। ফলে যখন মিথ্যার মধ্যে মানুষ থাকে তখন তার অস্তিত্বময়তায় (what is) বিষয়টা থাকে না। কিন্তু আবার যখন সে অস্তিত্ববান থাকার সংগ্রাম করেন তখন তার এসেন্স (isness) মানে যে কারণে সে মানুষ এই বোধটিকে ধারণ করতে সক্ষম হয়। ফলে সত্যের সাথে সংযোগ ছাড়া মানুষের অস্তিত্বময়তা যেমন কোন অর্থ বহন করে না তেমনি এসেন্সও থাকে না। সরল করে এতটুকুই থাক।
নিজেদের চোখের সামনে ঘটতে থাকা মিথ্যা ও অন্যায়ের মধ্য দিয়ে নিজেদের পরিচালিত করতে থাকি
আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার ধারণাটার দুটি ধরণ আছে। যেটাকে অস্তিত্ববাদী ফরাসী দার্শনিক, রাজনৈতিক ভাষ্যকার জাঁ পল সার্ত্র ১. ‘Being-for-itself’ (Poursoi; consciousness, cogito) এবং ২. ‘Being-in- itself’ (En-soi) -বলে আখ্যায়িত করেছেন। প্রথম ধারার অস্তিত্বের ধারণা সমৃদ্ধ মানুষ একজন মুক্ত ব্যক্তি হিসেবে নিজেকে ভাবেন। এবং সচেতন ও স্বাধীনভাবে নিজের অস্তিত্বকে প্রকাশ করেন। এটা নিজের মধ্যেই নিজেকে নির্মাণের একটা প্রক্রিয়া। অন্যদিকে দ্বিতীয় ধারাতে, জগতের সাথে তার অস্তিত্বের সম্পর্ক তিনি অনুভব বা প্রতিষ্ঠিত করতে সজাগ থাকেন।
অপরের সাথে এই অস্তিত্বের বোধটাকে তিনি সম্পর্কিত করতে সচেষ্ট থাকেন। এখানে সাবজেক্ট বা কর্তা থাকাতে এটাকে সাবজেক্ট-অবজেক্ট সম্পর্কের মতো দেখার সুযোগ আছে। বামপন্থিদের কর্ম প্রক্রিয়ায় এই সমস্যা দেখা যায়। এটাই মার্কসের শ্রেণির আলোচনার সাথে জ্যাঁ পল সাত্রের এই তর্ককে ভিন্নমাত্রায় সংযুক্ত করেছে। এর যথেষ্ট ক্রিটিকও কিন্তু আছে। এবং সহজ করে বললে এই যে, প্রথমে নিজেই নিজের অস্তিত্বের ব্যাপারে সজাগ হওয়া এবং পরে জগতের সাথে সম্পর্কের আলোকে এই অস্ত্বিত্বকে পরখ করে দেখা- এটা একটা যৌথ প্রক্রিয়া। কারণ, যে আমি বা সাবজেক্ট এটা করে সেও জগতেরই একটা অংশ। ফলে তার আছে এক নিজের আমি, আর আছে এই আমির সামনে একটা জগত। যেই জগতে তার মতো আরও বহু মানুষ আছেন। যেই মানুষগুলোও তার মতো এই জগতে আগে থেকেই হাজির আছে। তাদের নিজেদের মতো করে হাজির আছে। ফলে এখানে নিজেকে আলাদা বা সেরা মনে করার কোন কারণ নাই। তাই এই অস্তিত্বের সংগ্রাম কোন ব্যক্তি মানুষের একার সংগ্রাম না। এখানে একটা যৌথতা বা টুগেদারনেস আছে দেখতে পাচ্ছি। ফলে যারা ভিন্নতা দেখেই অপরকে ঘৃণা করেন, নিজেকে সেরা মনে করেন তারা এই বৈচিত্র্যময় অস্তিত্বের ঐক্য ও এর রাজনৈতিক সম্ভবনাকে বুঝতে অক্ষম। অন্যদিকে সিলেক্টিভ মানবতাবাদও অস্তিত্বের হক আদায় করতে পারে না। এই জন্যই অস্তিত্ব সচেতন মানুষ নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থ দ্বারা চালিত না হয়ে বরং জগতের অন্যান্য সবার অস্তিত্বের মর্যাদার ব্যাপারে সজাগ হয়ে ওঠেন।
একদল দলদাস ও চিন্তার নামে ছদ্ম বুদ্ধিজীবী দিয়ে একটা ন্যারেশন/বয়ান তৈরি করা যায় খুব সহজে
ফলে এই বিষয়টি দার্শনিকভাবে বুঝতে পারা খুব জরুরি। এখানে নোট রাখার জন্য বলি, অস্তিত্ববাদের এই সাত্রীয় ধারণার ক্রিটিক করেছেন মহান চিন্তক মার্টিন হাইডেগার। তাঁর বিখ্যাত লেখা, লেটার অন হিউম্যানিজম মূলত সাত্রীয় সাবজেক্টিভ বা কর্তাবাদি অস্তিত্ববাদের ধারণার ক্রিটিক। অন্য একটি লেখায় এটা নিয়ে আলোচনা করবো বলে এই ক্রিটিক এখানে স্থগিত রাখলাম। এটা নিয়ে একটা কিস্তিই লিখার ইচ্ছে রইলো। এই অস্তিত্বের বিষয়টিকে গোটা জগতের সাথে জীবনের সম্পর্কের মূল বিষয় হিসেবে বিবেচনা করা হয় পোস্ট হাইডেগারিয়ান দর্শনের আলোচনায়।
যাক এই জটিল তাত্ত্বিক আলাপ উস্কে দিয়ে এখানে আপনাদের বিরক্ত করতে চাই না। তারপরেও এটা এখানে বলার কারণ হলো, এটা বুঝতে চেষ্টা করা যে, আমরা যা করতে যাচ্ছি/বলতে চাচ্ছি, সেই বিষয়ে আমাদের চিন্তাশীল, দার্শনিক ও ম্যাথডোলজিক্যাল ইনভেসটিগেজশন/নিরীক্ষণ সব সময় জারি আছে।
শেষ করার আগে আরও একটা প্রসঙ্গ ছোট করে বলি, একদল দলদাস ও চিন্তার নামে ছদ্ম বুদ্ধিজীবী দিয়ে একটা ন্যারেশন/বয়ান তৈরি করা যায় খুব সহজে। সেই বয়ানের মাধ্যমে গোটা জনগোষ্ঠীর চৈতন্যকে শাসন করে কায়েম করা হয় ফ্যাসিবাদ। তথ্য বা ফ্যাক্ট মানে ট্রুথ না। তাই আমরা এই বয়ান বা ইন্টারপ্রিটেশন এর রাজনীতিকে ডিকনসট্রাক্ট বা অবিনির্মাণ করতে চাই। এই নির্মাণের জন্য আগে দরকার আমরা আমাদের অস্তিত্বের যে বোধ হারিয়েছি তাকে উদ্ধার করা। আমরা যে আসলেই বিরাজ করি তা জানান দেয়ার জন্য দরকার যে বয়ান আমাদের অস্তিত্বকে নাই করে দিয়েছে তাকে দার্শনিকভাবে পরাজিত করা। এটা একটা যুদ্ধ। আর এই যুদ্ধের জন্য দরকার বুদ্ধিবৃত্তিক সততা। জীবন, মৃত্যু, অকলঙ্ক, অভাব, অপমান সব কিছু সহ্য করে সত্যের জন্য সংগ্রামই আমাদের সত্তার অস্তিত্বময়তাকে অর্থপূর্ণ করতে পারে।