সাম্প্রতিক কালের চীন-ইরান ২৫ বছর মেয়াদী অংশীদারী রোডম্যাপ বা চুক্তি নিয়ে গ্লোবালী নানান কথাবার্তা বলা হচ্ছে। এই চুক্তি নিয়ে নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় ১৮ পৃষ্ঠার এক নিবন্ধ ছাপা হয়েছে। তবে চুক্তি নিয়ে সরকারীভাবে এখনো চীন বা ইরান কেউ কিছু প্রকাশ করেনি। এটি মূলত এখনো গোপন বা অপ্রকাশিত একটি চুক্তিনামা যা ইতিমধ্যে পশ্চিমা দুনিয়ায় আলোচনার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়বস্তুতে পরিনত হয়েছে।
নিউইয়র্ক টাইমস এবং ওয়াশিংটন পোস্ট বলছে ট্রাম্প (সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট) ইরানকে সর্বোচ্চ চাপসৃষ্টির ক্যাম্পেইন ফেইল করেছে। তেহরান একঘরে হয়নি বরং নীতিগতভাবে চীনের অংশীদার যখন চীন চালকের ভূমিকায়।
“New York Times and Washington Post see the deal as proof that Trump’s “maximum pressure” campaign against Iran has failed. Far from isolating Tehran, as intended, the policy has driven it into the arms of Beijing.”
এই চুক্তির দেন দরবার,নানান আলোচনা,যাচাই বাছাই শুরু হয়েছে ২০১৬ সাল থেকেই। যখন এটি পাবলিশড হলো তখন এটি প্রায় চুক্তি হিসেবে আবির্ভাবের আগ মুহুর্ত। চুক্তি নিয়ে নানান একাডেমিক নন একাডেমিক আলোচনা হচ্ছে। আমাদের মিডিয়াগুলো ভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গিকে হুবহু বা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে প্রচার করছে। ভারত এটাকে অন্যান্য সাধারণ চুক্তি হিসেবেই দেখছে। তবে দেখা হচ্ছে নানান এঙ্গেলে কেউ এই চুক্তিকে মার্কিন বিরোধের জায়গা থেকে দেখছেন কেউবা এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক পালা বদলের ইঙ্গিত হিসেবে দেখছেন। আসলে এসবই সারফেস লেভেলের কথাবার্তা। হতে পারে বুদ্ধিবৃত্তিক সক্ষমতার সংকট নয়তো হেয় করে দেখার মানসিকতা থেকে এভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে।
এক কথায় বললে, চীন – ইরান ২৫ বছর মেয়াদি চুক্তি গোটা গ্লোবাল অর্ডার বদলে ফেলার কাউন্টডাউনের ঘটনার সুচনা। ডলারের বদলে ইউয়ান এবং আমেরিকার বদলে চীন।ব্রিটিশ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের বদলে ইরান,চীন,রাশিয়া,তুরষ্ক,পাকিস্তান (যেটাকে গোল্ডেন রিং ব্লক বলা হচ্ছে। এটা অন্য আলাপ)। সেয়ানে সেয়ানে লড়াই করার জন্য মুখোমুখি যেভাবে দাড়াতে হয় আরকি। এর বাইরে বেল্ট এন্ড রোডে যারা সংযুক্ত তারাও কৌশলগত পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে এই এলায়েন্সের সাথে ব্যবসা,বানিজ্যে যুক্ত থাকবে। আর বিনিয়োগের জন্য আইএমএফের বিকল্প হিসেবে দাড় করানো হচ্ছে ব্রিকস ব্যাংককে। যেটার সদস্য দেশ ভারতও।তবে ভারতকে শুধুই সাইলেন্ট শেয়ার হোল্ডার হিসেবেই থাকতে হবে।
নিউইয়র্ক টাইমস বলছে, ইরানের তেল-গ্যাস, ব্যাংকিং, টেলিকম, বন্দরের উন্নয়ন, রেলওয়ের উন্নয়ন এবং আরো কয়েক ডজন গুরুত্বপূর্ণ খাতে চীন বিশাল বিনিয়োগ করবে।এই বিনিয়োগের পরিমাণ আগামী ২৫ বছরে কমপক্ষে ৪০০ বিলিয়ন ডলার।বাৎসরিক হিসেবে প্রায় ১৬ বিলিয়ন ডলার। যেখানে আইএমএফ সারা দুনিয়ার উন্নয়ন খাতের ঋনগ্রহীতার জন্য বরাদ্দ করে বাৎসরিক ৬০ বিলিয়ন ডলার। তার মানে আইএমএফের পুঁজির প্রায় পৌনে চারভাগের একভাগ ঋন পাচ্ছে ইরান।
এছাড়া এই চুক্তিতে সামরিক ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ‘যৌথ প্রশিক্ষণ, মহড়া, গবেষণা, যুদ্ধাস্ত্র তৈরি এবং গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদানের‘ কথা রয়েছে।
এই চুক্তির আওতায় চীন তাদের বিনিয়োগের সুরক্ষার জন্য ইরানে পাঁচ হাজার পর্যন্ত সৈন্য মোতায়েন রাখতে পারবে। তার মানে হলো ইরানের গায়ে কোন আচড় লাগলে সেটা মূলত চায়নাকেই আচড় দেয়া হবে। উল্লেখ্য পাকিস্তানের সাথে চীনের একই রকম চুক্তি আছে। তাতে একথা বলা যায় চীনের বানিজ্যিক অংশীদারিত্ব সামরিক সক্ষমতা দিয়ে ঘেরা। অংশীদার রাষ্ট্রের নিরাপত্তার সাথে চীনের স্বার্থ শুধু মিলেমিশে একাকারই নয় বরং আরো কিছু।
তাই এই চুক্তির মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে এই প্রথম সরাসরি চীনা সামরিক বাহিনীর উপস্থিতি নিশ্চিত হবে যা ইরানকে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক হুমকি মোকাবেলায় দারুন সহায়ক ও কার্যকরী ভূমিকা রাখতে সাহায্য করবে।তবে ইরান বলছে ইসলামী ইরান নীতিগতভাবে কখনোই অন্যকোন দেশের সৈন্যদের ইরানে রাখবে না।
“ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ নেতার উপদেষ্টা আলী আকা মোহাম্মদি বলেছেন, বাণিজ্য ক্ষেত্রে ডলারের লেনদেন বাদ দেয়া এবং অবৈধ ও একতরফা মার্কিন নিষেধাজ্ঞা এড়ানোর লক্ষ্য নিয়ে চীনের সঙ্গে কৌশলগত অংশীদারিত্ব চুক্তি করা হচ্ছে।তিনি বলেন, “২৫ বছরের এই রোড ম্যাপ চুক্তির চেয়েও বেশি কিছু। চুক্তিতে সুনির্দিষ্ট একটি বিষয় থাকে কিন্তু এই রোডম্যাপ আরো বেশি বিস্তৃত।”(পার্সটুডে বাংলা)”
এখানে সর্বোচ্চ নেতার উপদেষ্টা পরিষ্কার ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছেন। ইসলামী ইরানের গুরুত্বপূর্ণ পদের ব্যক্তিদের বক্তব্য সাধারণত সরকারের মতামতেরই প্রতিফলন হয়ে থাকে ।
দুনিয়ায় মার্কিন ইউনিপোলার সিসটেম এস্টাবলিশমেন্ট সম্ভব হয়েছে ডলারকে আন্তর্জাতিক বিনিময় মুদ্রার মাধ্যমে। ১৯৪৪ সালে আইএমএফ প্রতিষ্ঠার পরে এবং দুনিয়াব্যাপী উপনিবেশ ওঠার প্রাক্কালে মার্কিন পুঁজি ইনভেস্ট হয়েছিল মূলত মার্কিন ডলারে।তখন থেকেই মার্কিন আধিপত্য শুরু। পারমানবিক ক্ষমতা বা আধুনিক যুদ্ধাস্ত্র দিয়ে এটা সম্ভব হলে ডলারের বিকল্প অন্যান্য মুদ্রাও ব্যবহৃত হতো। কারণ সামরিক সক্ষমতায় মার্কিন মুল্লুকের কাছাকাছি আরো একাধিক দেশ দুনিয়ার বুকে বহাল আছে। তবে কখনো যদি গ্লোবাল লেনদেনের সত্তর শতাংশ অন্যকোন মুদ্রায় হয় তাহলে সেই মুদ্রা আন্তর্জাতিক বিনিময় মুদ্রার স্বীকৃতি পায়। এই শর্ত পূরণ করায় ইউয়ান ২০১৫ সালে আন্তর্জাতিক বিনিময় মুদ্রার স্বীকৃতি পেয়েছে।
চীনের প্রধানতম উদ্দেশ্য হচ্ছে গ্লোবাল লিডারশীপ হাতে নেয়া। এটা করতে গিয়ে সবচেয়ে বেশি দরকার গবেষণা,প্রযুক্তিগত,সামরিক,অর্থনৈতিক ও বানিজ্যিক প্রভাব বিস্তার।গত কয়েক দশক ধরে চীন গবেষণা, প্রযুক্তিগত ও সামরিক খাতে ব্যাপক উন্নয়ন করে ফেলেছে। এখন দুনিয়াব্যাপী জ্ঞান,গবেষণা,সামরিক বিস্তৃতির জন্য অর্থনীতি ও বানিজ্যিকে হাতিয়ার হিসেবে নিয়েছে। সেটা করতে গিয়ে প্রথমবারের মত নেপালের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিকেও তারা টেস্ট কেইস হিসেবে নিয়ে সফল হয়েছে। নেপালের বিগত তিনশত বছরের ইতিহাস খুঁজলে ব্রিটিশের আজ্ঞাবহ এবং পরবর্তীতে ভারতের একটি করদ রাজ্য হিসেবেই টিকে ছিলো। অথচ কল্পনাকেও হার মানিয়ে ভারত বিরোধী ইশতেহার দিয়ে খাগড়া প্রসাদ ওলির দল নির্বাচিত হয়ে জোটবদ্ধ সরকার গঠন করে। সরকার গঠন করেই চীনের সাথে গাঁটছড়া বেধে ভারতকে রীতিমত হুমকি ধমকি দিচ্ছে। তাই এটা পরিষ্কার যে, ধীরগতির চীন তার চলার পথকে মসৃণ করতে অনেক কিছুই করতে পারে এবং করবেই।
এই অঞ্চলে চীন বিরোধী মার্কিন মুখপাত্র ভারত। ভারত মূলত আমেরিকার হয়ে খেলছে যদিও এই খেলার কোন শেষ নেই, স্বার্থও নেই। সাধারণত জনবিচ্ছিন্ন সরকারগুলো ক্ষমতায় টিকে থাকাকে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার চেয়ে বড় করে দেখে। এই দেখা দেখতে গিয়ে বৃহৎ ক্ষমতাবান প্রভুর সাথে অসম লেনদেনকে ফুলিয়ে ফাপিয়ে জনগনের কাছে হাজির করে আর এটা করতে গিয়ে সমাজের দর্পণ মিডিয়াকে দখল করে এমনভাবে প্রচার করে যে তখন দর্পণ (মিরর) আর থাকে না গ্লাস (কাঁচ) হয়ে যায়। সেই গ্লাসের মধ্যে ফ্যাসিস্ট নেতার পোট্রেটকে মহান করে বাধাই করে রাখা হয় ফলে আয়নার সামনে যে চেহারার যেকোন ব্যক্তিই দাড়াক না কেন, নেতার ছবিই দেখবে। তেমনটিই ঘটছে ভারত আর ভারতের আজ্ঞাবহ দেশে।
চীন দেখেছে এশিয়ায় ভারত সবচেয়ে প্রভাবশালী মার্কিনপন্থী দেশ, যে চীনের চলার পথকে বাধাগ্রস্থ করছে। তাই সে ভারতকে একদিকে হুমকি ধমকি, হামলা করছে অন্যদিকে ঋণ দিয়ে নিজের বলয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছে। যদিও ভারত চীনের সাথে সব রকমের বাণিজ্য সংকুচিত করে আনছে। ভারত যদি চীনের দিকে আগায় তাহলে চীনের গ্লোবাল লিডারশীপ মেনে নিতে হবে। কিন্তু ভারত এই অঞ্চলের নেতৃত্ব নেয়ার অলীক কল্পনা করছে তাও মার্কিন সক্ষমতাকে ভর করে পূর্ণ সমর্থনের আশা নিয়ে।
গালওয়ান ক্রাইসিসের সময় বিশ্ববাসী দেখেছে ভারত কিভাবে আমেরিকার দিকে তাকিয়েছিলো। অথচ ভারত বুঝতেই চাচ্ছে না মার্কিন বন্ধুত্ব মূলত সামরিক অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম বিক্রির জন্য। ট্রাম্পের সাথে মোদীর সম্পর্ক কেবলই ব্যক্তিগত ও নির্বাচনী ক্যাম্পেইনের অথচ ভারতীয়দের দেখানো হয়েছে ভারত-মার্কিন গভীর সম্পর্ক হিসেবে। অথচ গালওয়ান ক্রাইসিসে আমরা মার্কিন মুল্লুকের ভূমিকা তেমন কিছু দেখিনি, দেখবোও না। অবশ্য এ বিষয়ে ইরানের সর্বোচ্চ নেতার একটি বহুল প্রচারিত উক্তি আছে, “আমেরিকা যার বন্ধু তার শত্রুর দরকার নেই।”
চীন বঙ্গোপসাগর থেকে ভারত মহাসাগর হয়ে পারস্য সাগর অবধি পৌছে গেছে। কৌশলগত চাবাহার বন্দর ভারত আমেরিকার পরামর্শে হাতছাড়া করে পাকিস্তানের সহযোগী ও অংশীদার চীনের হাতে পরোক্ষভাবে ছেড়ে চলে গেছে। ২০১৯ সালে ইরানের সফল পররাষ্ট্রমন্ত্রী তথা দুনিয়ার সবচেয়ে ঝানু পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভারতকে বুঝাতে গিয়ে ব্যর্থ হন যে এটা কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। বলতে হবে ইরান এখানে নীতিগত পেশাদারিত্বের সর্বোচ্চটুকু দেখিয়েছে। কিন্তু ভারত আর এগোয়নি এমনকি ইরানের ট্রান্সপোর্টে, ইরানের নিরাপত্তায়,স্বল্পমূল্যে তেল কেনার সুযোগও ভারত ছেড়ে দিয়েছে। সেই অর্থনৈতিক সংকটকালীন সময়ে ইরানের কাছ থেকে ভেনিজুয়েলা আর চীন কেবল তেল কিনে ইরানের পাশে দাড়িয়েছিলো। ২০১৯ সালে ইরানের উপর কঠোর অবরোধ দিয়ে যখন পরিস্থিতি খারাপ করার পায়তারা করছিলো তখন ভারত আমেরিকার সহযোগীর ভূমিকা নিয়েছিলো। আমেরিকা নাখোশ হোক ভারত কখনোই সেটা আশা করে না কিন্তু আমেরিকা খুশি থাকলেই ভারতের ফায়দা কি এটাও কেউ পরিষ্কার করে জানে না।
আমেরিকা দীর্ঘকাল তার এই ডলারের ক্ষমতাকে অন্যায় ও অমানবিকভাবে অপব্যবহার করে আসছে। গত ২০০৮ সাল থেকে আজ অবধি রাশিয়াকে ডলার-অবরোধ দিয়ে রেখেছে। ফলে রাশিয়ান মুদ্রা রুবলের মূল্যমান অর্ধেকে নেমে গেছে।শেষ রক্ষার জন্য বর্তমান ইরানের মত রাশিয়া চীনের সাথে এক এনার্জি চুক্তি করে অর্থনৈতিকভাবে ঘুড়ে দাড়ায়। এর বাইরে ব্রিটেন রাশিয়ান গ্যাস ক্রয় করে আর সেই গ্যাসের মূল্য থেকে পাওয়া আয় রাশিয়া ব্রিটিশ মার্কেটে ইনভেস্ট করে ফলে ব্রিটেন আমেরিকাকে অনুরোধ করে কেবল তার অর্থগুলো অবরোধ থেকে ছাড়িয়ে নেয় । তার মানে দাড়ালো আমেরিকা যাকে খুশি তাকে অবরোধ দিতেও পারবে তুলেও নিতে পারবে। তবে আমেরিকার এই একক রাম রাজত্বের দিন শেষ।
চীনের প্রতিদিন তেলের চাহিদা ১০০০০০ ব্যারেল যেটা সে ইরানের কাছ থেকে স্বল্পমূল্যে পেতে পারে এবং দাম পরিশোধ করবে ইউয়ানে। এত বিশাল মূল্য পরিশোধ যখন ইউয়ানে নিয়মিত হতে থাকবে ডলারের প্রভাব আপনা আপনি কমতে শুরু করবে। তাহলে কি দাড়ালো? আমেরিকা চাইলেই যাদের উপর ডলার অবরোধ দিতো তাদের জন্য নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হলো। এই নতুন দিগন্ত উন্মোচন হতে যাচ্ছে চীন-ইরানের হাত ধরে। এটাকে খুব সরলভাবে দেখার সুযোগ নেই। বরং আমেরিকার অবরোধের রাজনীতিকে সজোরে থাপ্পড় দেয়া হলো। ইরান এবং চীন আমেরিকাকে মোটের উপর পাত্তাই দিলো না ব্যাপারটা এরকম।
“ইরান এর আগে বলেছে, চীনের সঙ্গে ২৫ বছর মেয়াদি একটি কৌশলগত চুক্তি সই করার বিষয়ে দু’দেশের মধ্যে ঘনিষ্ঠ আলোচনা চলছে। আমেরিকার একতরফা ও অবৈধ নিষেধাজ্ঞাকে পাশ কাটিয়ে দু’দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক লেনদেন চালানোর পাশাপাশি এই লেনদেন থেকে মার্কিন ডলার বাদ দেয়া হবে চুক্তির অন্যতম প্রধান দু’টি লক্ষ্য।”-(পার্সটুডে বাংলা)
গত বছরের শেষে ইরানের উপর দেয়া ডলারের অবরোধ শেষ হওয়ার কথা থাকায় মিঃ পম্পেই নতুন করে আবার নিষেধাজ্ঞা দেয়ার আভাস দিয়ে রেখেছিল অথচ দেখছে না চীন ভেটো দিলে এই অবরোধ আর দীর্ঘায়িত হবে না। চীন যে ভেটো দেবে সেটার আভাসও দিয়ে রেখেছে। এই চুক্তিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হবে ভারত। ভারতের এই চরম ক্ষতি কেউ পুষিয়ে দিতে পারবে না।
চাবাহার সমুদ্রবন্দর থেকে আফগানিস্তান সীমান্তবর্তী ইরানের জাহেদান শহর পর্যন্ত প্রায় ৬২৮ কিলোমিটার দীর্ঘ রেলপথ নির্মাণের জন্য ভারত, ইরান ও আফগানিস্তানের মধ্যে ২০১৬ সালে একটি ত্রিদেশীয় চুক্তি সই হয়েছিল। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তেহরানে উপস্থিত থেকে ইরান ও আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠক করেন এবং ত্রিপাক্ষিক চুক্তি সই করেন। এই প্রকল্পে ভারতের আইআরসিওএন বা ইন্ডিয়ান রেলওয়েজ কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের ১৬০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করার কথাও ছিল তাদের। কিন্তু তারা ওয়াদার বরখেলাপ করে ইরানের তরফ থেকে বারবার তাগাদা দেয়ার পরেও আমেরিকার পরামর্শে নিরবতা পালন করে।
এখন এই প্রজেক্ট ইরান নিজের অর্থায়নে করার ঘোষণা দিয়েছে। চুক্তি সম্পন্ন হলে (চুক্তির মূল খসড়া দলিল প্রস্তুত এখন শুধু দুই দেশের পার্লামেন্টে পাশ করিয়ে প্রেসিডেন্টের সই নিতে বাকি আছ) শিগগিরই ইরানের হাতে বিশাল অংকের টাকা আসবে যা ইরানের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে তুলবে। হিসেব করলে ইরান পঞ্চাশের দশক থেকেই মার্কিনীদের হাতে ধুঁকছে। নির্বাচিত মোসাদ্দেক সরকারকে হটিয়ে গনতান্ত্রিক আমেরিকা শাহের হাতে ক্ষমতা দেয়। বিনিময়ে ইরানের ক্রুড ওয়েল নিয়ে নেয় পানির দামে নানান ফন্দি ফিকির করে। যেটা তারা বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যের শাসকদের সাথে করছে নিরাপত্তা ও রাজতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখার শর্তে। তারপর ১৯৭৯ সালের মহান ইসলামী বিপ্লবের পরপরই ইরাককে দিয়ে ইরানের উপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেয় একই সাথে ইরানের উপর অবরোধ চাপায়, ইসরাইলী স্নাইপার, মার্সেনারি দিয়ে ইরানের বহু নেতা, ডক্টর,ইঞ্জিনিয়ারকে হত্যা করে। অনির্দিষ্টকালের জন্য ইরানের উপর নিষেধাজ্ঞা চলছেই। এতসব অন্যায়ের বিরুদ্ধে ইরান-চীন এমনভাবে ঘুরে দাড়াচ্ছে যে মার্কিন গ্লোবাল লিডারশীপ হুমকির মুখে পড়ে গেছে।
এছাড়া চীনের “বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ ” যে মহাপ্রকল্প হাতে নিয়েছে সেটারও বাইরে থেকেছে ভারত। এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে সংযুক্ত হবে ৭০টিরও অধিক দেশ। এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের অনেকগুলো দেশ সংযুক্ত হবে এই নেটওয়ার্কে। সংযুক্ত দেশগুলোর জনসংখ্যা পুরো পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক। এই দেশগুলোর সম্মিলিত জিডিপি পৃথিবীর চার ভাগের এক ভাগ। উদ্দেশ্য ৩ মহাদেশব্যাপী যোগাযোগ অবকাঠামো নির্মাণ ও আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক অঞ্চল ও করিডোর প্রতিষ্ঠা।
গোটা দুনিয়াকে মার্কিন প্রভাব বলয়ের বাইরে নিয়ে আসার চর্চা চলছে। ভারতের আশে পাশের সবাই প্রায় চীনা বলয়ের মধ্যে এই অবস্থায় মার্কিন সমর্থনপুষ্ট হয়ে ভারত কতটুকু সুবিধা করতে পারবে অথবা পারবে কিনা সেটা সময় বলে দেবে। যদি কখনো ভারত নিজের প্রয়োজনে অবস্থান পরিবর্তন করেও তাতে খুব একটা যুতসই অবস্থান নেয়া আর সম্ভব হবে না, এজন্যই যে চীনের হাত ধরে চির বৈরি পাকিস্তান দাড়িয়ে আছে।
আগামীর বৈশ্বিক বদলে এবং নেতৃত্বে যেসব প্রভাবশালী দেশের নাম চীনের পরেই আসে সেগুলো যথাক্রমে ইরান,তুরষ্ক,পাকিস্তান এবং রাশিয়া। এই পাঁচটি দেশ “গোল্ডেন রিং ব্লক” নামে অর্থনৈতিক,বানিজ্যিক ও সামরিক নিরাপত্তা চুক্তির কথা শোনা যাচ্ছে।
লেখকঃ আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিষয়ে কলাম লেখক