জয়শঙ্কর চান চীনের বদলে জাপান
Advertisements

দেখানো উদ্দেশ্য ছিল, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আগামি ২৬ মার্চ ঢাকায় আসছেন, এটা নিশ্চিত করতেই নাকি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুব্রামনিয়াম জয়শঙ্কর গত ৪ মার্চ এক দিনের ঢাকা সফর করে গেলেন। কিন্তু এই সফরের যেসব মিডিয়া কাভারেজ রিপোর্ট ছাপা হয়েছে বাংলাদেশে বা ভারতে, তা দেখে আমরা পরিষ্কার যে, দুই দেশের মিডিয়াই “উদ্দেশ্যের বিচারে” পুরা বিভ্রান্ত। জয়শঙ্কর ঠিক কেন এসেছিলেন? যেমন – প্রথমত তাঁর এই সফরের মূল উদ্দেশ্য হওয়ার কথা, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে অতিথি হিসেবে মোদীর বাংলাদেশ সফরের কূটনৈতিক ব্যবস্থাদি চূড়ান্ত করা। কিন্তু প্রায় সব মিডিয়া রিপোর্টই এমন যে, এই প্রসঙ্গ নিয়ে কথাবার্তা কোথাও আছে কি না তা খুঁজতে হবে, খালি চোখে পাওয়া যাবে না। এমনই অবস্থা!

তাহলে ওসব মিডিয়া রিপোর্ট বা শিরোনাম কী নিয়ে? দুই দেশেরই বেশির ভাগ মিডিয়ার শিরোনাম ও রিপোর্টের ফোকাস হল – “সীমান্ত হত্যা”। যেন মোদীর সফর না, ‘সীমান্ত হত্যা’ ছিল আলোচনার মূল এজেন্ডা! আর সবচেয়ে ভয়ংকর যে কথা বলা হয়েছে সেখানে – বাংলাদেশ আর ভারত নাকি একমত হয়েছে যে, সীমান্তে অপরাধ হচ্ছে তাই হত্যা করতে হচ্ছে। অপরাধ ও হত্যা, একে অপরের কাউন্টার বা রিমেডি! এই প্রসঙ্গে বড় করে জয়শঙ্করের বাণী সামনে এনেছে বিডিনিউজ২৪। জয়শঙ্করের বরাতে তারা লিখছে, “আমি মনে করি, আমরা একমত হয়েছি, যে কোনো মৃত্যুই দুঃখজনক। কিন্তু আমাদের নিজেদের জিজ্ঞেস করতে হবে, সমস্যাটি কেন হচ্ছে এবং আমরা জানি, সমস্যাটি কী। সমস্যা হচ্ছে অপরাধ।… সুতরাং আমাদের মিলিত উদ্দেশ্য হওয়া উচিত ‘অপরাধহীন ও মৃত্যুহীন’ সীমান্ত। আমি নিশ্চিত, আমরা যদি এটা করতে পারি, অপরাধহীন ও মৃত্যুহীন সীমান্ত, তাহলে একসাথে এই সমস্যার সমাধান করতে পারব”।

বুঝা গেল ‘সীমান্ত হত্যা’ নিয়ে জয়শঙ্কর কথা সাজিয়ে এসেছিলেন ভালই, বলতে চেয়েছেন সীমান্তে অপরাধ হচ্ছে তাই হত্যা করতে হচ্ছে। অনেক মিডিয়া তাই সরাসরি কোট করে লিখেছে “অপরাধ নাই তো মৃত্যুও নাই” [India for ‘No crime, no death’ policy on border, says Jaishankar] কিন্তু তাতে সীমান্ত হত্যার “হত্যা” শব্দটা জয়শঙ্কর বেশ চাতুরির সাথে লক্ষণীয়ভাবে বদলে দিয়েছে আর বসিয়ে নিয়েছে “মৃত্যু”। কারণ “হত্যা হচ্ছে” মানে ভারতীয় বিএসএফ হত্যা করছে- এটা স্বীকার করা হয়ে যায়। তাই এবার শব্দ বদলে এক চাতুরী করা। ‘হত্যা’র বদলে ‘মৃত্যু’ শব্দ ব্যবহার করেছেন জয়শঙ্কর। তিনি বলেছেন, ‘নো ক্রাইম নো ডেথ’ এটাই নাকি তাদের সীমান্ত-নীতি। মানে না কিল, তো না ডেথ। আর তাতে মানে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশী হতভাগ্য নাগরিক-ব্যক্তিটার কেন সীমান্তে মৃত্যু হয়েছে, কে গুলি করেছে, এটা জয়শঙ্কর জানেন না বা সেটা যেন কোনো গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন নয়। অথবা সীমান্তে খুন হওয়া বাংলাদেশি নাগরিক-লোকটা যেন নিজেই বিএসএফকে গিয়ে বলেছেন তাকে গুলি করে মেরে ফেলতে!

কিন্তু এসব ছেঁদো আলাপে, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তিনি কী করছিলেন? মি. মোমেন যদি বুঝেই থাকেন যে তিনি জয়শঙ্করের সাথে বাতচিতে বাংলাদেশীদের সীমান্তে হত্যা ঠেকাতে পারবেন না, এ নিয়ে কথা তুলেও সুবিধা করতে পারবেন না, তাহলে এটাকে তিনি তাদের দ্বিপক্ষীয় আলোচনার ইস্যু করলেন কেন, হতে দিলেন কেন? কেন রাজি হয়েছেন এতে? এর মানে কী? কী আলোচনার ইস্যু হবে সেটাতেও সম্মতি দেয়া না-দেয়ার মুরোদও তিনি হারিয়েছেন? এটা আলোচনার ইস্যু না করলে আমাদের কী (বাড়তি) ক্ষতি হতো? তিনি কী ব্যাখ্যা করতে পারবেন? এ ছাড়া এখন এর চেয়েও বড় একটা প্রশ্ন উঠেছে!

প্রশ্নটা হল – বাংলাদেশের কোনো নাগরিক অপরাধ যদি করেও থাকে তাহলেই কী তাকে খুন-হত্যা করতে পারেন? করা যায়? জয়শঙ্করেরা তাকে হত্যা বা খুন করে ফেলবেন? এই হত্যাকে লুকিয়ে একে ‘মৃত্যু’ বলে ডাকতে পারেন? মি. মোমেন আপনি এটাকে ‘মৃত্যু’ বলে ডাকার কে? কেন একে ‘মৃত্যু’ বলতে জয়শঙ্করকে সম্মতি দিয়েছেন? এটা সিরিয়াস লিগ্যাল প্রশ্ন! এর জবাব কী?

বিডিআর ও বিএসএফ দুটোই পড়শিদেশের সিভিলিয়ান ফোর্সঃ
বর্ডার গার্ড (সাবেক নাম বিডিআর) ও বিএসএফ এ দুটোই পড়শি দুই দেশে সিভিলিয়ান ফোর্স হিসেবেই গণ্য, অর্থাৎ এটা যার যার দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে। মানে সামরিক বাহিনীর মত প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে নয়। বরং এটা পুলিশের সমতুল্য এক সিভিল প্রশাসন যাদের কাজ অপরাধীকে ধরে আদালতে পেশ করা। আত্মরক্ষার মতো পরিস্থিতি ছাড়া অতিরিক্ত (অ্যাকসেসিভ ফোর্স) বলপ্রয়োগ না করা, হত্যা না করা। সীমান্ত রক্ষীবাহিনী তাই স্থানীয় থানার মাধ্যমে আসামিকে আদালতে পেশ করতে পারে। সীমান্ত রক্ষীবাহিনী বিষয়ক দুই দেশের চুক্তি (যেটা পাকিস্তান আমল থেকেই চালু হয়েছিল আর স্বাধীন বাংলাদেশে সেটাকেই রিনিউ করে নেয়া হয়েছে) করার উদ্দেশ্যই ছিল মূলত দুটা। এক. সীমান্ত অপরাধের ইস্যুগুলোকে যেন সিভিল প্রশাসনের অধীনে রেখে পরিচালনা করা যায়; দুই দেশের নাগরিকের মধ্যে সদ্ভাব থাকে; দুই সীমান্ত রক্ষীবাহিনীই যেন অযথা এবং ‘অতিরিক্ত’ শক্তিপ্রয়োগ না করে। আর দুই. এতে সুবিধা হল, দুই দেশের সেনারা সীমান্ত থেকে বহুদূরে (সম্ভবত ২৫ কিলোমিটারের বাইরে) ব্যারাক গড়ে থাকতে পারে। এতে সীমান্তে টেনশন কমানোর সহায়ক পরিবেশ পাওয়া যায়। সেনাবাহিনীর এনগেজমেন্টের রুল ভিন্ন এবং তা সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে। একটা দেশের শত্রুর ব্যাপারে যেভাবে আচরণ করা উচিত সেভাবে। আর এখানে সবার উপরের কথা হল, সামরিক স্ফিয়ারের কোনো খুন বা ছোট-বড় গোলাগুলির ঘটনা কোনো দেশের আদালতে তোলার বিষয়ই নয়, আর তা এখতিয়ারেরও বাইরে। বড় জোর, কোন আভ্যন্তরীণ নিয়মভঙ্গ হলে নিজ নিজ দেশের সামরিক বাহিনীর অভ্যন্তরীণ কোর্ট অব এনকোয়ারি হতে পারে; তাও বিশেষ ক্ষেত্রে। তাই দেশের সীমান্ত যদি সেনাবাহিনী দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করার মানেই হল, সীমান্ত-সম্পর্কিত অপরাধীরা এক্ষেত্রে আদালত-বিচার ইত্যাদির সুবিধা পাবে না। তা দেয়া যাবে না। এটা এড়াতেই দুদেশে সীমান্তে সীমান্তরক্ষী বাহিনী বসানোর চুক্তি।

এসবের সার কথাটা হল, ভারত-বাংলাদেশ উভয়েই নিজ সেনাবাহিনীকে সীমান্তের ২৫ কিলোমিটার দূরে ব্যারাকে রেখে এবার নিজ নিজ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে গঠিত ও পরিচালিত নিজ নিজ সীমান্ত রক্ষীবাহিনী দিয়ে উভয়েই সীমান্ত নিরাপত্তা পরিচালনা করার চুক্তি করা হয়েছিল। যার মানেই, সীমান্তে কোনো “অপরাধ ঘটলে তা গুলি” করে সমাধান করা যাবে না। অপরাধ মানেই, গুলি করে হত্যা বা মৃত্যু নয়। কারণ সীমান্ত রক্ষীবাহিনী সেনাবাহিনী নয়। তারা অপরাধীকে প্রতিপক্ষ দেশে হস্তান্তর করতে পারে প্রটোকল থাকলে, চাই কী নিজ নিজ দেশের আদালতে পেশ করতে পারে। তাতে রায় সাপেক্ষে আসামিকে শাস্তি পেতে হতে পারে। তবে তা আর সীমান্ত বাহিনীর এখতিয়ারই নয়, সিভিল পুলিশের কাজ। তাহলে মি. মোমেন কিভাবে ‘নো ক্রাইম নো ডেথ’-জয়শঙ্করের এই সীমান্তনীতিতে সায় দিয়েছেন? এ প্রসঙ্গে, বিডিনিউজের রিপোর্ট দাবি করছে মোমেনকে পাশে নিয়ে জয়শঙ্কর বলেছেন … ‘আমরা একমত হয়েছি’…। তাহলে নিজের হাত পরিষ্কার রাখতে এখন মি. মোমেনের উচিত নিজে থেকে এ ঘটনার ব্যাখ্যা দেয়া, কেন তিনি একমত?

এক ধান্দালি শব্দ ‘কানেকটিভিটিঃ’
দুই দেশেরই মিডিয়ায় দ্বিতীয় গুরুত্বের ফোকাস ছিল ‘কানেকটিভিটি’ [Connectivity]। শব্দটা এবার প্রথম আলো বাংলা করেছে “সংযুক্তি”। সরি, এটা ভাল বাংলা হয় নাই। বিশেষত এই অনুবাদ কনটেক্সট বা প্রেক্ষিত থেকে দূরে চলে গিয়েছে, এতে বিচ্ছিন্ন সম্পর্কহীন হয়ে গেছে। ভাল বাংলা হতে পারত “সংযোগ”। মূলত শব্দটার অর্থ “অবকাঠামোগত সংযোগ”। কিন্তু এসব বাদ দিয়ে আরেক মূল সমস্যা এখানে দেখা দিয়েছে।

যেমন, অনেক মিডিয়া রিপোর্টে আবার ‘কানেকটিভিটি’ শব্দটাই নাই অথবা অর্থহীনভাবে দু-এক শব্দে আছে। যেমন- ভারতের দক্ষিণী- দৈনিক দ্য হিন্দু [thehindu], যা গত দুই জোড়া বছর ধরে মোদীর জাতিবাদের এক বড় প্রবক্তাই শুধু নয়, বিশেষ করে বাংলাদেশ ইস্যুতে ভারতের বিদেশ মন্ত্রণালয়ের খোদ ‘সাফাইদাতা মুখপত্র’ যেন এমন ভূমিকা রেখে চলেছে। বিশেষ করে ওর সুহাসিনী হায়দার বা কল্লোল ভট্টাচার্যের লেখা রিপোর্টগুলো। বলাই বাহুল্য, যা বিদেশ মন্ত্রণালয়ের বলার কথা সেই দায়িত্ব অযাচিত হয়ে একটা মিডিয়া পালন করতে পারে না। এটা মারাত্মক দৃষ্টিকটু শুধু নয় এটা সরকারের তোষামোদ। আর যা তোষামোদ করা তা আর ন্যূনতম কোনো স্বাধীন মিডিয়া কি না সে প্রশ্ন উঠবেই। দ্য-হিন্দুর অবস্থা এমনই! সময়ে মনে হয়েছে জার্নালিজমের ভূমিকা ভুলে গিয়ে ‘অতি দেশপ্রেমী-জাতিবাদী হিটলারের’ ভাই দ্য-হিন্দুর ওপর ভর করেছে। আমাদের চলতি সরকার ২০১৯ সালে গঠন হওয়ার পর থেকে ক্রমাগত দ্য-হিন্দু অবলীলায় এ কাজ করে চলছে, যা তার কাজই নয়। কিন্তু তামাসার দিকটা হল, মনে হচ্ছে এবার জয়শঙ্করের সফরে দ্য-হিন্দুকে ভারতের বিদেশ মন্ত্রণালয় ‘বেওয়াফা’ করে ছেড়েছেন, মানে ভাগাড়ে নামিয়ে দিয়েছেন। জয়শঙ্করের কানেকটিভিটি শব্দের গোপন অর্থ তাতপর্য কী তা দ্যা হিন্দু আমাদের কিছুই জানাতে পারে নাই। দ্য-হিন্দুর রিপোর্টে ‘কানেকটিভিটি’ শব্দটা অকিঞ্চিতকরও অর্থহীন, তবে হাজির আছে মাত্র। অথচ প্রতিদ্বন্দ্বি মিডিয়া এনডিটিভি [India Keen To Focus On Connectivity With Bangladesh: S Jaishankar] , ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস গ্রুপের মিডিয়াতেও [considering involving a third country like Japan in further expanding its connectivity ] তা যথেষ্ট অর্থপূর্ণভাবে রয়েছে।

এটাকে বলা যায় জয়শঙ্করের ‘কানেকটিভিটি’ ট্যুরঃ

সত্যিকারভাবে বললে, এটা এখন কমবেশি পরিস্কার যে জয়শঙ্করের এই সফরের মূল উদ্দেশ্য ছিল “চীনের বদলে জাপান”! এ কথার মানে কী? মানে হল, গত ১২ বছরের শুরু থেকেই ঢাকা সরকার সবসময় চীনের একটা হাত ধরে রাখা না হলেও অন্তত একটা আঙুল ছুঁয়ে থাকা্র নীতিতে ছিল আমাদের সরকার, বিশেষত ২০১০ সালে সরকার প্রধানের প্রথম চীন সফরের পর থেকেই। অথচ বিপরীত দিকটা হল, “প্রো-ইন্ডিয়ান” হয়েই কিন্তু এই সরকার ক্ষমতায় এসেছিল। আর তাতে সরকারের দিক থেকে ভারতকে এই সাফাই-ব্যাখ্যা দেয়া হত যে (২০১২ সালে পদ্মা সেতুর দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্বব্যাংক লোন বাতিলের পর থেকে), বাংলাদেশের অবকাঠামো খাতে বিপুল ঋণ পাওয়া দরকার। যেটা দিবার মুরোদ ভারতের নাই তাই বড় উৎস হিসেবেই বিশ্বব্যাংকের বিকল্প চীনের সাথে এত যোগাযোগ শুরু করেছে। এমনকি ২০১৬ সালে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং-এর বাংলাদেশে সফর থেকে বাংলাদেশ প্রথম ২০ বিলিয়ন ডলারের নানান অবকাঠামো ঋণের কমিটমেন্ট পেয়েছিল। সেটা ২০১৯ সালের মধ্যে বরং বাস্তবে বেড়ে ২৬ বিলিয়নে পৌঁছেছিল। এতে যদিও সব প্রকল্পের সব অর্থ খরচ হয়ে যায় নাই, তবে সব অর্থ বিভিন্ন প্রকল্পে বরাদ্দ হয়ে গেছে ও প্রকল্প চলমান। তাই এমনকি গত বছর আরো প্রায় ৬-১০ বিলিয়ন ডলারের নতুন প্রকল্প নেয়ার কথা চলছে। সারকথায় বাংলাদেশের চীন-ঘনিষ্ঠ হওয়ার কারণটা ভারতকে মেনে নিয়েই এতদিন চলতে দেখেছি আমরা।

পালটা টানাপোড়েন শুরুর দিনঃ
কিন্তু এই চীনকে মেনে নেওয়া সম্পর্কের মধ্যেও ২০১৯ সালের শুরু থেকেই ভারত থেকে বাংলাদেশের আরো দূরত্ব তৈরি হয়েছে, যেটার আগমনবার্তা দেখেছিলাম আমরা – ২০১৮ সালের ২৬ মে মাসে ভারত সফর শেষে হাসিনা দেশে ফিরে ৩১ মে দৃশ্যত তাঁর খুবই হতাশ মন্তব্যে সেই বিখ্যাত উক্তি, “আমি ভারতকে যেটা দিয়েছি তারা তা সারা জীবন মনে রাখবে“। একটা ক্ষোভ থেকে এটা বলা হয়েছে অনুমান করা যায়। আর এথেকে এরই প্রতিক্রিয়ার বাস্তবায়নের শুরু ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে। সরকথায় এটা ছিল – এটা যতটা ভারত থেকে দূরে সরে যাওয়ার উদ্যোগ ততটাই যেন চীনের সাথে আগের চেয়েও এবং খোলাখুলি বেশি ঘনিষ্ঠ হওয়া। য়ার তা থেকে, তিস্তা নদীর নাব্যতা বা ধারণক্ষমতা বাড়ানোর প্রায় বিলিয়ন ডলারের প্রকল্প নেয়া হয়েছিল সেখানে। ইতোমধ্যে আমেরিকায় বাইডেন ক্ষমতায় আসার পরে আমরা লক্ষ করেছি আরো বেশি করে ত্রাতার মতই চীনকে আঁকড়ে ধরাও শুরু হয়েছিল।

কিন্তু এই সব কিছুকে উলটে দিয়ে দুই সপ্তাহ আগে আমরা আবার শুনছিলাম বিরহের সুর – চীনের হতাশ হয়ে করা কথাবার্তা যে, আমরা আর কখনো জুট বা জুট মিল (পুনর্বাসন) এবং বস্ত্রখাতে বাংলাদেশকে সহযোগিতার কথা তুলব না [Angered, China says will never back Bangladesh jute sector]। যদিও একটা নতুন ও অখ্যাত পত্রিকা [বিজনেসইনসাইডার-বিডি] ছাড়া আর কোথাও এই খবরটা দেখা যায় নাই। অথচ এক মাস আগেও চীনা উদ্যোক্তারা নাকি বাংলাদেশের বিনিয়োগ বোর্ডের শীর্ষে ভীড় করেছে তাই যৌথ বিনিয়োগে সম্ভাবনা দেখছে বাংলাদেশ-চীন বলে রিপোর্ট দেখছিলাম আমরা।

আবার এর পরপরেই আসে আরও প্রকাশ্য বিরোধের খবর। বিবিসি বাংলার এক রিপোর্টে পদ্মা সেতুর রেল প্রকল্পের চীনা ঠিকাদারকে বিল পে না-করা নিয়ে সরকারের সাথে এক বড়সড়-বিরোধ আমরা জানতে পারি। ঠিকাদার যখন বিল না পাওয়ার অভিযোগে বিবৃতি দিয়ে কাজ বন্ধ করে এটা খুবই অস্বাভাবিক কিন্তু চরম বিরোধের আভাস দেয়। অভিজ্ঞতা বলে, সাধারণত এটা দেনাপাওনার কিন্তু মারাত্মক বিরোধ। তখন থেকেই অনুমান বেড়ে চলছিল, এটা আবার চীনের থেকে বাংলাদেশের অনেক দূরে চলে যাবার ইঙ্গিত হয় কি না! মনে হচ্ছে সেসব অনুমানের সঠিকতাই প্রমাণ করতে যেন জয়শঙ্করের আগমন! এখানেই জয়শঙ্করের এই সফরকে ঠিক মোদীর সফরের আগমনবার্তার বাহক যতটা না, এর চেয়ে বেশি এটা জয়শঙ্করের ‘কানেকটিভিটি’ ট্যুর মনে হচ্ছে! কিন্তু ‘কানেকটিভিটি’ এই আজিব শব্দ কেন?

বাংলাদেশের জন্য এক ক্ষতিকর শব্দ ‘কানেকটিভিটিঃ’
ভারতের হাতে ব্যবহৃত বহুরূপী শব্দ এই “কানেকটিভিটি”। একেক সময় ভারত একেক ধান্দায় এই শব্দটা ব্যবহার করেছে। কিন্তু কমন দিকটা হল এটা বাংলাদেশের জন্য সবক্ষেত্রেই এক মারাত্মক ক্ষতিকর শব্দ হয়েই থেকেছে। মজার কথা হল, গত ২০০৯ সালে এই সরকার ক্ষমতায় আসার আগে এই শব্দটা বাংলাদেশে পরিচিত শব্দটা ছিল না। তখন মানে ২০০৯ সাল থেকে সুনির্দিষ্ট করে এই শব্দের অর্থ ছিল – ভারতের পুরা নর্থ-ইস্টকে বাংলাদেশের পশ্চিমে, পশ্চিমবঙ্গের সাথে সংযোগ করে দেয়া (এটাই কানেকটিভিটি) এবং সব ধরনের যোগাযোগ ব্যবস্থা পরিপূর্ণভাবে এবং বিনাপয়সায় গড়ে দেয়া। আর সেটা আকাশ, রেল, সড়ক, মাটির নিচে পাইপ লাইনে, বিদ্যুতের খুঁটি দিয়ে এবং নদী ও সমুদ্রপথে- সম্ভাব্য প্রায় কিছুই বাদ না রেখে।

সবচেয়ে অবাক কাণ্ড হলো, আমাদের মন্ত্রীরাও ‘কানেকটিভিটি’ ‘কানেকটিভিটি’ বলে বেড়াতেন (সবচেয়ে বেশি বলতেন দীপুমনি যখন তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী) এমনকি কেউবা (প্রধানমন্ত্রীর এক উপদেষ্টা) করিডোর সুবিধায় দেওয়া সার্ভিসের অর্থ বা ভাড়াটাও “চাওয়া লজ্জার” বলে দাবি করেছেন। অথচ ‘কানেকটিভিটি’ শব্দের সাথে যুক্ত সব কিছুই ছিল চরম একপক্ষীয়ভাবে ভারতের চাহিদাপূরণ এবং তা বাংলাদেশের ক্ষতি ও নিজেদের অসুবিধা করে হলেও। আর এবার আমাদের সবাইকে অবাক করে দিয়ে গত পরশু সফরে এসে আবার জয়শঙ্কর ‘কানেকটিভিটির’ গান! সেই শব্দ আওড়াতে শুরু করেছেন। কেন?

এবার নতুন কী চানঃ
এবার জয়শঙ্কর নতুন কিছু চাচ্ছেন কিন্তু যার সাথে ‘কানেকটিভিটি’ শব্দটার আসলে আবার কোনই সম্পর্ক নেই। যেমন ‘প্রথম আলো’ প্রথম দিনই মানে ৪ মার্চেই যে রিপোর্ট করেছে – তাতে সে ‘কানেকটিভিটি’ শব্দটা নতুন কিছু আভাস পাবার মত করে, সে কথাই লিখেছে। যেখানে বাংলাদেশের অন্য মিডিয়ারা কিছু তেমন লিখে নাই বরং উপেক্ষা করে গেছে। হয়ত বুঝে নাই বা টের পায় নাই কিছু বলে। প্রথম আলো জয়শঙ্করের মুখভাষ্যে লিখেছে, “এমন কোনো ক্ষেত্র নেই, যেখানে আমরা একসাথে কাজ করছি না। যদি আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, ৫০ বছর পার হয়েছে এবং পরের ২০ বছর কী করা যেতে পারে, আমি বলব সংযুক্তি (‘কানেকটিভিটি’)। আমাকে আপনাদের প্রধানমন্ত্রী উদ্ধৃত করে বলেছেন যে, সংযুক্তি হচ্ছে উৎপাদনশীলতা। যদি আমরা বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সংযুক্তি ঠিকমতো করতে পারি, তবে এই অঞ্চলের সামগ্রিক ভূঅর্থনীতি পরিবর্তিত হয়ে যাবে। এ ক্ষেত্রে বঙ্গোপসাগর খুব কার্যকর। আমরা দুই পক্ষই বিশ্বাস করি, এটি করা সম্ভব”।
প্রথম আলো আরো লিখেছে, “সংযুক্তি প্রসঙ্গে এস জয়শঙ্কর বলেন, আজকের বৈঠকের বড় একটি সময় তারা এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন। তৃতীয়পক্ষকে এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত করার বিষয়েও তারা আলোচনা করেছেন। সম্ভাব্য দেশ হিসেবে জাপানের নাম এসেছে। কারণ, জাপানের সাথে বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশের সম্পর্ক যথেষ্ট ভাল। বঙ্গোপসাগরে জাপানের সংযুক্তি প্রকল্প রয়েছে। সম্পর্কোন্নয়নে তিনি সংযুক্তিকে বড় লক্ষ্য হিসেবে বিবেচনা করেন”।

প্রথম কথা হল, ‘কানেকটিভিটি’ শব্দের আড়ালে এতদিন ভারত যেভাবে তার নর্থ-ইস্টকে ভারতের বাকি অংশের সাথে কানেক্ট বা যুক্ত করা – এটাই এর মূল অর্থ এবং ভারতের চরমতম একপক্ষীয়ভাবে সুবিধা নেওয়া। এবং এই কানেক্ট করা মানে সব মাধ্যমে একপক্ষীয় সুবিধায় বিনাপয়সায় জুড়ে নিয়েছে, এর অর্থ সেখানেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু এবারের ‘কানেকটিভিটি’ শব্দ দিয়ে আরও অন্য সুবিধা চাচ্ছে ভারত। তাই এবারের সাথে আগেকার ‘কানেকটিভিটি’ অর্থের কোনো মিল নাই। দ্বিতীয়ত, এর সাথে কথিত ‘তৃতীয় পক্ষ’ জাপানের সম্পর্ক কী? এর ন্যায্যতা ও প্রাসঙ্গিকতা কী? জাপানকে কেন আনতে হবে? তা জয়শঙ্কর এর কোন ন্যায্যতা বা সাফাই দেখাতেই পারেন নাই।

আসলে “জাপানের কথা” তাকে আনতেই হবে। আর এটাই ছিল তাঁর এই সফরের মুখ্য কিন্তু পরোক্ষে ও পিছনে রেখে দেয়া উদ্দেশ্য। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, খুব একটা হোমওয়ার্ক করে এরপর প্রসঙ্গটা তিনি আনেন নাই। পিছনের কারণ সম্ভবত এই যে, উদ্দেশ্যটা খুব একটা ‘স্বচ্ছ’ না। কিন্তু স্বচ্ছতার ঘাটতি থাকলেও হোমওয়ার্ক করে আসতে কোন অসুবিধা থাকার কথা না। তবে সারকথা হল, তিনি আমাদেরকে খুবই আন্ডার-এস্টিমেট করেছেন। ভেবেছেন যথেষ্ট ন্যায্যতা-সাফাই ছাড়া এভাবে ‘তৃতীয় পক্ষ’ বলে জাপানের নাম আনা তাও আবার অপ্রাসঙ্গিক ভাবে ‘কানেকটিভিটি’ শব্দের আড়ালে চাতুরিতে – যেন এটা আমাদের কাছে খুব ইজি-গোয়িং হবে। সরি, এটা তিনি না করলে ভাল করতেন। কানেকটিভিটির উসিলা একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে আছে। তিনি দাবি করছেন, “আজকের বৈঠকের (মানে ৪ মার্চের দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আলোচনা) বড় একটি সময় তারা এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন। তৃতীয় পক্ষকে এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত করার বিষয়েও তারা আলোচনা করেছেন। সম্ভাব্য দেশ হিসেবে জাপানের নাম এসেছে”। তবে জয়শঙ্করের এই কথাটা খুব একটা বিশ্বাসযোগ্য কথা না যে ঐ দিনই মানে বিমান থেকে তিনি নামার পর মাত্র এক ঘণ্টার আলাপের মধ্যে এই সব আলাপ করেছেন – না এটা মেনে নেয়া গেল না। এরপর আমাদের জন্য সবচেয়ে অস্বস্তিকর হল, – তাহলে দেখা যাচ্ছে, আমাদের মন্ত্রী আমাদেরকে আগে-পরে কখনই কিছুই জানালেন না। অথচ জয়শঙ্করের মুখেই প্রথম কথাটা শুনতে হচ্ছে। কিন্তু ঠিক কী বলতে চান বা বলেছেন জয়শঙ্কর?

জয়শঙ্কর সম্ভবত বলতে চান, ‘জাপানের সাথে তার কথা হয়েছে। বাংলাদেশ যেন তার প্রয়োজনীয় অবকাঠামো-ঋণ চীনের বদলে জাপান থেকে নেয়।’ এ কথাটাই জয়শঙ্কর কীভাবে বলবেন বুঝতে না পেরে এটাও নাকি ‘কানেকটিভিটির’ আলাপ এই সূত্র ধরে বলতে গিয়েছেন। তাহলে জয়শঙ্করের ‘কানেকটিভিটি’ মানে হল, চীন বাদ আর এর বদলে জাপানি ঋণ নিতে হবে – এই অনুমান সত্য ধরে নিয়ে এবার কিছু আলাপ করা যাক।

চীন বাদ আর এর বদলে জাপানি ঋণঃ
এক কথায়, এটা তুলনীয় বা সুবিধাজনক নয়, তাই অকার্যকর হয়ে পড়বে। আসলে জাপান নিজেও জানে, তার সুদের হার চীনের চেয়ে বেশি। আবার অন্যদিক থেকে, জাপানের সাথে আমাদের দেশের সম্পর্ক সেই জিয়ার আমল থেকেই সব আমলেই ভাল। ওদিকে জাপান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে শোচনীয় হারের পর থেকে আমেরিকার “ছায়ায় নিচে থেকে চলে বা চলতেই হয়” [যেমন কোন সামরিক বাহিনী না গড়ার শর্তও ছিল, জাপানে আমেরিকান আর্মি ব্যারাক স্থাপন সেই থেকে] বলে রাজনৈতিক দিকের দায়ও সব আমেরিকার। এসব জটিল দিক আছে। আবার যেমন জাপানি পণ্যের বিক্রি বাড়ানো কথা যদি ধরি। বাংলাদেশে জাপানি গাড়ির চাহিদা বাড়াতে গেলে এখানে রাস্তাঘাট, ব্রিজ অবকাঠামোর উন্নতি লাগবে। তাহলে এসব বিষয়ে বাংলাদেশে জাপানি প্রজেক্ট নিতে মানে তাতে ঋণ দিতে জাপানকে আগ্রহী হতে হবে। জাপানের দিক থেকে এর আবার আরেক দিক আছে। সেটা হল, এসব প্রকল্পগুলোতে জাপানই ঋণ না দিলে তাতে জাপানি কোম্পানিগুলো সরাসরি কিংবা তাদের শেয়ার কেন কোরিয়ান কনস্ট্রাকশন কোম্পানিগুলো এ দেশে কাজ পাবে কোথা থেকে? কাজেই এসব কিছুই মিলে হল, বাংলাদেশের সঙ্গে জাপানি সম্পর্কের ভিত্তি। এটা বহু আগে থেকেই অনেক গভীর সম্পর্কের। কাজেই এখন জাপানি অবকাঠামো ঋণ নিতে নতুন করে ভারতের দরকার কী? ভারতের ভুমিকা শতভাগই আলগা গায়ে পড়া এবং অপ্রয়োজনীয়। এখানে ভারতের ভূমিকা নিষ্প্রয়োজন ছাড়া আর কী?
আবার জয়শঙ্করও নিশ্চয় – ভারতের ক্ষেত্রেই জাপানি ঋণ পাওয়া প্রসঙ্গে এসব প্রশ্নের জবাব নিশ্চয় জানেন। যেমন – অবকাঠামো খাতে জাপানের চেয়ে চীনা ঋণ ভারতেও বেশি কেন? ভারতে মোদীই সবার আগে চীনকে ভারতে ডেকে আনেন, গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময়। কারণ তুলনামূলক বেটার শর্তের বলে তিনি চীনা অবকাঠামো ঋণ নিয়ে সম্পর্ক শুরু করেছিলেন। পরে কেন্দ্রীয় প্রধানমন্ত্রী হলে পুরানা ঋণ-গ্রহীতা সম্পর্ক কেন্দ্রীয় পর্যায়ে বাড়িয়ে তুলেন। একই পর্যায়ে মোদী জাপানি ঋণে আগ্রহী হন নাই কেন?

তাহলে জয়শঙ্কর জাপানকে চীন উপরে উঠিয়ে সে নাম প্রস্তাব করছেন কেন? কারণ, জয়শঙ্করের মনের এক বাসনা হল, এটা ভারতের চীনবিরোধী রাজনৈতিক ক্লাব (জোট) গড়ার স্বার্থ বা খায়েশ; তাই ধরেই নিলাম কোনো কথিত ‘ইন্দো-প্যাসিফিক জোটের আলাপ’ এটা। কিন্তু ভারতের (সাথে জাপানেরও) হাত ধরলেই কি বাইডেন – তিনি বাংলাদেশের সরকারকে কোলে উঠিয়ে জায়গা দিবেন? তাই কী!
তাহলে বাইডেনের কাছে, যে কাশ্মিরের হিউম্যান রাইটস ইস্যু কিংবা মুসলমান নির্যাতনের ধর্মীয় স্বাধীনতা লঙ্ঘনের কালো রিপোর্ট মোদীর নামে আছে যা বলাই বাহুল্য অসংখ্য কাঁটাযুক্ত, তার কী হবে? হিউম্যান রাইট নিয়ে একই অবস্থা আমাদেরও! এগুলো পাড় হবে কী করে?
তাহলে ব্যাপারটা শুধু চীনের চেয়ে জাপানের একটু না হয় সুদের হার বেশি, তা নয় অথবা ঋণ চীনের চেয়ে কতটা বেশি দিতে পারবে সে বিষয় থাকলেও ততটুকুই নয়। আরও বড় দিক আছে। কিন্তু এগুলোর চেয়ে বড় বিষয় হলো বাইডেনের ‘গায়ে কাঁটার’ জন্য ওর কোলে ওঠার সুযোগই নাই, এর কী হবে?

তবে সব কিছুর উপরে জয়শঙ্করের কথার বিরাট এক বিপদের ইঙ্গিত আছে। কথাটা হল, “……বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সংযুক্তি ঠিকমতো করতে পারি, তবে এই অঞ্চলের সামগ্রিক ভূঅর্থনীতি পরিবর্তিত হয়ে যাবে। এ ক্ষেত্রে বঙ্গোপসাগর খুব কার্যকর……”।

এই কথার মধ্যে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সংযুক্তি মানে কানেকটিভিটি – এই অংশটাই ধরা যাক; এর মানে কী? ভৌগলিকভাবে বললে এটা অর্থহীন কথা। কারণ, সারা ভারতের সাথে তার নর্থ-ইস্ট ভালভাবে কানেকটেড নয়। কারণ মাঝখানে বাংলাদেশ আছে। কাজেই ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে কানেকটিভিটির কিছু নাই। বাংলাদেশ ভারত ছাড়াই, ভারত পেরিয়ে যাওয়া ছাড়াই আমরা বাইরের দুনিয়ার সাথে কানেকটেড; এবং তা এক নেপাল ও ভুটান ছাড়া। যা ভারত আমাদের দেয় নাই। এখাস্ন থেকে এটা কী যথেষ্ট না ভারতের কানেকটিভিটি বলে কী বুঝাতে চায়? এটা চরমভাবে সব সুবিধা এক পক্ষীয়ভাবে ভারতের নিয়ে নেয়া ছাড়া অন্য কোন অর্থ নাই। তাহলে আগামি বিশ বছর “সামগ্রিক ভূঅর্থনীতি পরিবর্তিত” হতে দেখার জন্য অপেক্ষা করার কী আছে? বাংলাদেশের গত বারো বছর কী উদাহরণ হিসাবে যথেষ্ট নয়? বার বার রেললাইনে মাথা দিয়ে নতুন করে আর কী বুঝব যে মাথা কাটা যায় কিনা? তাহলে জয়শঙ্করের “বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে আবার কানেকটিভিটি” কথাটার এবারের মানে কী ভারতের ভিতর দিয়ে বিদেশের সাথে সম্পর্ক করা? যার ঠোটকাটা মানে হল বাংলাদেশের ভারতেরই এক ভেসেল স্টেট হওয়া? আর একদম খাড়া সোজা অর্থ হল, ভারতেরই একটা রাজ্য বনে যাওয়া? যেটা আমাদের হতে বাকি আছে?

জয়শঙ্কর ‘বঙ্গোপসাগরের’ কথা তুলেছেনঃ

জয়শঙ্কর সেই সাথে “বঙ্গোপসাগরের” কথা তুলেছেন। সাথে ভারতের আগামি ২০ বছরের স্বপ্ন! এর আবার মানে কী? বহুদিন থেকেই জানা যায়, আমেরিকান নেভির বঙ্গোপসাগরে সেভেন্থ ফ্লিট এর স্থায়ী মোতায়েনের একটা খায়েশ আছে – এর সংশ্লিষ্ট কিছু কী হবে? ভারত কী বাংলাদেশকে বগলে রেখে আমেরিকাকে দূরে রাখার বাসনা করছে; এভাবে কী ভারত নিজেই মাতবর হওয়ার খায়েশ পুরা করবে? আর তাতে আমরা হব দুধ ভাত অথবা গুটি? কিন্তু আমরা আগেই জানি এসব যত সম্ভাব্য চিত্রই আঁকা হোক না কেন সব চিত্রই একপক্ষীয়ই , সেটা এককভাবে কেবল ভারতের স্বার্থেই সাজানো হবে। গত বারো-চৌদ্দ বছরের য়ামাদের অভিজ্ঞতা বলে ভারতের “কানেকটিভিটি” শব্দের বাস্তব অর্থ ও পরিণতি এর বাইরে যায় নাই। আর কেউ কেউ ‘ক্ষমতায় থাকা গিয়েছে’ এই এক ব্যক্তিস্বার্থের বিনিময়েই ভারত সমর্থন হাসিল করেছে। আর সেখান থেকেই কী ভারত সাহসী হয়ে উঠে এবার আবার আরও ২০ বছরের গল্প-প্রস্তাব ফেরি করতে এসেছে! এখনও সেসব যথেষ্ট স্পষ্ট নয়।

চার শিফটের কাজঃ
একটু তামাশা নেয়া যাক, আলোচনা অনেক সিরিয়াস হয়ে যাচ্ছে। জাগোনিউজ আর বাংলা ট্রিবিউন লিখছে, “ড. জয়শঙ্কর জানান, করোনাভাইরাসের প্রভাব কাটিয়ে ভারতের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে এবং সেখানে শিল্প কারখানাগুলোয় আগে যেখানে তিন শিফটে কাজ হতো, এখন সেখানে চার শিফটে কাজ হয়”। আল্লাহ’র দুনিয়ায় একেকটা দিন মাত্র ২৪ ঘন্টার। এর মধ্যে কারখানার শিফট করা যায় মাত্র তিনটা, আট ঘন্টা করে। তাহলে এর ভিতরে চারটা শিফট তারা কীভাবে সম্ভব করতেছে! প্রো-ইন্ডিয়ান চামচামিতেও কী কিছু লাগাম থাকা উচিত না তাই না? দালালি আসলেই মহান ও ক্রিয়েটিভ!

তাই আপাতত ইমিডিয়েট বাস্তবতায় ফিরে আসি। আবার যদি ধরা যাক কোনো জাদুবলে বাংলাদেশ বাইডেনের আমেরিকার কোলে উঠেই গেল? কিন্তু বর্তমান সরকার কী নিজে আমেরিকাকে আস্থায় নিতে পারবেন? কাজেই এটা শেষে আবার কিছু দিন-বছর ভারতের উদ্যোগে ফেরে আমাদের নাকে দড়ি বেঁধে ঘুরানো ঘটনা হবে? বড় বিপদই আসতেছে! যদিও মনে হচ্ছে আপাতত অপরিষ্কার অংশগুলো পরিষ্কার দেখতে আমাদের আরো কিছু দিন অপেক্ষা করতে হবে।

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com

Advertisements