চিন্তাশীলতার এক গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় হোল পরিভাষা নির্মাণ । বড় কোন ভাবকে এক বা একাধিক শব্দবন্ধে প্রকাশ ক’রে অর্থকে বিশেষত্ব দান করা পরিভাষার কাজ। ইসলামের জ্ঞানভাষ্যে পরিভাষা নির্মাণ কিংবা কোন বিস্তৃত কন্সেপ্টকে এক বা একাধিক শব্দবন্ধে ধরে রাখার জন্য প্রধাণত কোরআন হাদিসে ব্যবহৃত শব্দকে ব্যবহার করা হয়।
ফরয, সুন্নাহ, নফল, মুস্তাহাব, মুবাহ, মাকরুহ ইত্যাদি পরিভাষাগুলো কিন্তু পরবর্তীকালের তৈরি। নবি(সা:) এর যুগে নবিকে দেখেই সাহাবাগণ ওজু করতেন,নামাজ পড়তেন, তাঁকে অনুসরণ ক’রে এবং প্রয়োজনে জিজ্ঞাসা ক’রে অন্যান্য ইবাদত কার্য চালাতেন। যখন ইসলামের ইবাদতসমুহের পর্যায়ক্রম ও অগ্রাধিকার নির্ধারণের প্রয়োজন পরলো তখন এই পরিভাষা সমুহের নির্মাণ ঘটলো। এমনকি, ইসলামে বিশ্বাসসমুহকে সুসংবদ্ধ চেহারা দিতে আকীদা শব্দটিও হিজরি চতুর্থ শতকের আগে ব্যবহৃত হয়নি।
হাদিস অধ্যয়ন শাস্ত্রে ইতিমধ্যেই পরিভাষাসমুহ সুসংহত হয়ে গেছে । সনদ,মতন,সহিহ,হাসান,যয়ীফ,মুরসাল,
খবরে ওয়াহিদ হাদিস ইত্যাদি নামী পরিভাষা যখন কেউ ব্যবহার করে তখন এগুলো ইতোমধ্যেই যে সুনির্দিষ্ট অর্থ পরিগ্রহ করেছে সে অনুসারেই প্রয়োগ করতে ও বুঝতে হবে। ইসলামি আইনশাস্ত্রর পরিভাষাসমূহ যেমন, ইজমা, কিয়াস, মাসলাহা মুরসালাহ (জনস্বার্থ বিবেচনা), ইস্তিশাব (ধারাবাহিকতার অনুমিতি), সাদ্দ আল জারাই (অন্যায়ের পথবন্ধকরণ) ইত্যাদি পরিভাষাসমুহ আইন তৈরি ও সমাজভাবনায় মুসলিম চিন্তাশীলতা ও সাব্জেক্টিভিটির পরিচয় বহন করে।
ধরা যাক, সিয়াসত শব্দটি। বোখারি শরিফের একটি হাদিসে ব্যবহৃত ক্রিয়া “তাসুসু” থেকে এটি উৎপন্ন ব’লে কিছু আলিম মনে করেন । তাসুস মানে দেখাশোনা করা,পরিচালনা করা,ব্যবস্থা করা ইত্যাদি।আভিধানিক এই অর্থ পারিভাষিকভাবে রাজনীতি বা রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি হিশেবে ব্যবহৃত হয়। দশম-একাদশ শতাব্দীর ইরাকের চিন্তক আল মাওয়ার্দি(৯৭২—১০৫৮)তাঁর “আল-আহকাম আল-সুলতানিয়া”(The Ordinances of Government)গ্রন্থে সিয়াসতের সংজ্ঞা দিচ্ছেন এভাবে : “আস-সিয়াসাতুল ফীল ইসলাম হিয়া মাসলাহাতুল ইবাদ”[ইসলামের মধ্যে রাজনীতি হচ্ছে বান্দাদের(জনগণের) স্বার্থ রক্ষা] রাজনীতি শব্দটি ইসলামের সাথে যখন ব্যবহৃত হবে বা আস-সিয়াসাতুস শারিয়াহ যখন বলা হবে তখন তা প্রচলিত দলীয় রাজনীতি বোঝায়না বলেই আলেমদের এক বিপুল অংশের মত। তবে, ইসলামের সামগ্রিক জ্ঞান কাঠামোর আলোকে অনেকে সিয়াসা বলতে বোঝেন অস্তিত্বশীলতার সংগ্রামের পরবর্তী যে নৈতিক ব্যবস্থার বোঝাপড়া, তা-কে।
আবার, ইমান শব্দ দ্বারা প্রায়শই আমরা বিশ্বাস বুঝি। কিন্তু, ইমান শব্দের অর্থের ভেতরে আমান বা নিরাপত্তা-বোধ, যুক্তি-অভিজ্ঞতা ও বিশ্বাসের মিশ্রিতাবস্থা বিদ্যমান! তবে স্রষ্টার অস্তিত্ব, তাওহীদ, রিসালাত ও আখিরাতের বিষয়কে কোরান যুক্তি-বুদ্ধি দিয়ে বিচারের কথাই বলে, এগুলোর পক্ষে নানাবিধ যুক্তি কোরআন হাজির করে থাকে। সে যুক্তি কে মানবে আর মানবে না সেই প্রসংগ ভিন্ন।
গিবত, হক,ইনসাফ/আদল পরিভাষা হিশেবে প্রায় সার্বজনীনতা পেয়েছে। একটা বিশ্ববীক্ষা গ্রহণীয় হয়ে উঠে তার পরিভাষা ও ধারণাসমুহ যখন মানুষের শুভবোধকে নাড়া দেয়, যখন সার্ব্জনীন আকলের কাছে তা আবেদন রাখতে পারে। যেমন, সকল মানুষই ইসলামের ‘উম্মাহ’ ধারণার অন্তর্ভুক্ত। তবে, কেউ উম্মতে ইজাবাহ(মুসলিম), আর কেউ উম্মতে দাওয়াহ (মুসলিম-অমুসলিম সকলে)।
ইসলামী ডিস্কোর্সে পরিভাষা তৈরি কোন বদ্ধ প্রকৃয়া নয়। Arif Kemil Abdullah তাঁর অভিসন্দর্ভ The Qur’an and Normative Religious Pluralism: A Thematic Study of the Qur’an -এ কোরানের শব্দ দিয়ে পরিভাষা তৈরি ক’রে কিছু কনসেপ্টকে সামনে নিয়ে এসেছেন এবং অনুচ্ছেদের নামকরণ করেছেন। যেমন :
“Taaruf” : knowledge of the other ( সারা জগৎময় এতো এতো জাতিগোষ্ঠী তৈরির কারণ হিশেবে আল্লাহ চিহ্নিত করেছেন এই ‘তা’রুফ’-কে অর্থাৎ “যাতে তোমরা একে অপরকে চিনতে পারো”-এই ব্যাপারটিকে ।) তাছাড়া বিশেষ অর্থে মুসলিমসমাজ ও সাধারণ অর্থে মানব সমাজের সংহতির জন্যে প্রয়োজনীয় পারস্পারিকতাকে উল্লেখ করা হয়েছে “তা’ঊন”, “ফাস্তাবিক্বু আল-খাইরাত”, ” তাদাফু” শব্দাবলীকে। আরিফ কেমিল চ্যাপ্টার সমুহের নামকরণ করেছেন এভাবে : “Taawun” :cooperation with the other। “Fastabiqu al-khayrat” :competing with other in good works। “Tadafu”:Mutual support।
ঔপনিবেশিক শাসনের জুলুম ইসলামের অনেক ক্লাসিকাল পরিভাষায় অর্থগত কলুষের সৃষ্টি করেছে। উপনিবেশিক শাসন ইসলাম চিন্তায় কী ভায়োলেন্স ঘটিয়েছে, তার হদিস অন্বেষণও এ সময়ের জরুরি কাজ। তাছাড়া পশ্চিমের উত্তরকাঠামোবাদী চিন্তাও অর্থের বহুত্বের নামে ইসলামের অনেক পরিভাষার আদি অর্থের বিপর্যয় ঘটাতে প্রচেষ্টারত। যান্ত্রিক যুক্তিবাদের প্রভাবে ইসলামি বেশ কিছুকে ভাবের অর্থান্তর ঘটানোর চেষ্টাও লক্ষ্মণীয়। এই চেষ্টাসমূহ ইসলামের ডিভিনিটিকে জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে নস্যাৎ করতে চায়। জি হা দ, জান্নাত, শহিদ, কেয়ামত ,হাশর,ওয়াহি,ফেরেস্তার ধারণা ইত্যাদি কন্সেপ্টগুলো ইতিমধ্যেই কতিপয় সুফি ঘরানা ও ‘উত্তরাধুনিকতাবাদ” চর্চাকারীদের হাতে প্রফেনেশনের স্বীকার। সবচেয়ে জুলুমের স্বীকার সম্ভবত ইসলামের পলিটিকাল ভোকাবুলারি।
বাংলাভাষায় ইসলামী উচ্চতর বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার সম্ভাবনা সুবিপুল, কিন্তু পাঠকদেরকে প্রস্তুত করবার ব্যাপার রয়ে গেছে। বাংলা ভাষায় আরবি ফারসির প্রভাব বহুকালের হওয়ায় এ ভাষায় ইসলামী বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় মোটেই পরিভাষা কোন বিঘ্ন নয়। তবে ইসলামি পরিভাষাগুলোর প্রফেনেশন ঘটানোর চেষ্টা চলবে, এ ব্যাপারে সতর্কতা প্রয়োজন। আমরা কিন্তু বর্তমানে এক বহুভাষিক পরিস্থিতিতে অবস্থান করছি, সুতরাং আরবি,ফারসি, ইংরেজি ও বাংলার মিশ্রণে ইসলাম নিয়ে লেখালেখির একাডেমিক ভাষা তৈরির ক্ষেত্র এদেশে বেশ উর্বর। তবে, অনারব সমাজে আরবি ভাষাকে জীবন্ত রাখা ইসলামি জ্ঞানের সুরক্ষার জন্যে জরুরি। জুমআর খুতবা আরবিতে দেয়ার পক্ষে অন্যতম যুক্তি এই যে, সমাজে যেন আরবি কিছুটা হলেও জীবন্ত থাকে এবং মানুষ ন্যুনতম আরবি-জ্ঞান লাভের উদ্যোগীও হয়।
খুব জরুরি হচ্ছে, ঐতিহ্যিক ইসলামকে বিশ্বের নতুন জ্ঞানগত পরিস্থিতিতে প্রাসঙ্গিক করে তোলা। ঐতিহ্যিক ইসলামের যে সামর্থ ও গতিশীলতার সম্ভাবনা তাকে সামনে আনা। ধর্মীয় চিন্তায় ও চর্চার পদ্ধতিগত দিক নিতে হবে সুন্নাহ থেকে ও “খাইরুল কুরুন” বা সাহাবা,তাবেয়ী বা তাবে তাবেয়িনদের যুগ থেকে। তাছাড়াও, দর্শন,মনোবিজ্ঞান, ভৌত বা প্রকৃতি বিজ্ঞান,সমাজবিজ্ঞান প্রভৃতি জ্ঞানের বিকাশের সাথে অর্থাৎ মানবীয় জ্ঞানের বিকাশের সাথে কোরান-সুন্নাহর অর্থ উন্মোচনের সম্পর্ক রয়েছে যার ইঙ্গিত লভ্য সুরা হামিম সাজদাহ-এর ৫৩ নং আয়াতে :
সানুরী হিম্ আ-ইয়া-তিনা-ফিল্ আ-ফা-ক্বি অফী য় আন্ফুসিহিম্ হাত্তা-ইয়াতাবাইয়্যানা লাহুম্ আন্নাহুল্ হাক্ব্; আওয়ালাম্ ইয়াক্ফি বিরব্বিকা আন্নাহূ ‘আলা-কুল্লি শাইয়িন্ শাহীদ্।
অর্থের অনুবাদ : বিশ্বজগতে ও তাদের নিজদের মধ্যে আমি তাদেরকে আমার নিদর্শনাবলী দেখাব যাতে তাদের কাছে সুস্পষ্ট হয় যে, এটি (কুরআন) সত্য…
এই আয়াতটি ইসলামে চিন্তার গতিশীলতাকে ইঙ্গিত করে।