নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস
Advertisements

ড. দীনেশচন্দ্র সেন রায়বাহাদুর (১৮৬৬-১৯৩৯) ছোট-বড় ৬০টি গ্রন্থের জনক। ভূমিজ মনীষা বলতে যা বোঝায়, তার বেলায় তা যথার্থই বলা যায়। যে দায় ও দৃষ্টি নিয়ে প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের সাথে তিনি আমাদের পরিচিত করান, তার নজির বিরল। ১৮৯৬ সালে প্রকাশিত তার বঙ্গভাষা ও সাহিত্য আমাদের আত্মপ্রত্যক্ষণের বিশ্বস্ত এক আয়না। সত্যব্রতী এ লেখকের গুরুত্ববহ এক বই, ‘প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে মুসলমানের অবদান (১৯৪০)’। এতে আমরা দেখি, মুসলিম-পূর্বকালে এ দেশে নিম্নশ্রেণীর মানুষের পাশাপাশি বৌদ্ধদের ভয়াবহ দুর্ভোগের চিত্র। ব্রাহ্মণ্যবাদীদের দুঃশাসন তাদের জীবনকে নরকতুল্য করে চলছিল। বিশেষত বৌদ্ধদের ওপর বয়ে যায় গণহত্যা ও বিনাশের কী ঝড়! দীনেশ লিখেন, কর্ণসুবর্ণের রাজা শশাঙ্কের (শাসন ৫৯০-৬২৫) আদেশ ছিল- ‘সেতুবন্ধ হতে হিমগিরি পর্যন্ত যত বৌদ্ধ আছে বালক-বৃদ্ধ-নির্বিশেষে তাদের হত্যা করবে, যে না করবে তার মৃত্যুদণ্ড হবে।’ এভাবে বৌদ্ধদের ইতিহাস ও সংস্কৃতি উচ্ছেদের অভিযান চলে। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী (১৮৫৩-১৯৩১) দেখিয়েছেন, ‘যে জনপদে (পূর্ববঙ্গে) এক কোটির অধিক বৌদ্ধ এবং ১১ হাজার ৫০০ ভিক্ষু বাস করত, সেখানে একখানা বৌদ্ধগ্রন্থ ৩০ বছরের চেষ্টায় পাওয়া যায় নাই।’ এর পাশাপাশি এখান থেকে তিনি বৌদ্ধাধিকারের চিহ্নমাত্র লোপ করতে সচেষ্ট ছিলেন।

শশাঙ্কের পর চারশো বছরের মতো পাল রাজত্ব জারি থাকে। এগারো শতকে আবার ক্ষমতায় আসে শশাঙ্কের পথিক সেনবংশ। গোঁড়া ব্রাহ্মণ্যবাদে বিশ্বাসী এবং এর কঠোর প্রয়োগে অনমনীয় ছিলেন তারা। অন্য ধর্মের প্রতি একবিন্দুও সহিষ্ণুতা ছিল না। গণমানুষের অর্থনৈতিক বিপন্নতা, ভয়াবহ বর্ণাশ্রম প্রথা, প্রশাসনের উচ্চতর হতে শুরু করে নিম্নতর পর্যন্ত ব্রাহ্মণ্য অনুশাসন চরমে উপনীত হলো। বৌদ্ধদের তখন করুণ অবস্থা। তাদেরকে হয় দেশত্যাগ করতে হচ্ছিল, নতুবা চরম দুর্যোগের মধ্যে কোনোক্রমে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হচ্ছিল। নারী ও নিম্নবর্গের মানুষ হারিয়েছিল মানুষের মর্যাদা।

নলিনী নাথ দাশগুপ্ত ও ভিক্ষু সুনীথানন্দ দেখিয়েছেন, বৌদ্ধদের উপাসনালয় ও ঐতিহ্য বিনাশ চলছিল তুমুলভাবে। এমনকি তারা ‘বৌদ্ধদের ইতিহাসের উজ্জ্বলতম অধ্যায়কে এ দেশীয় ইতিহাসের পাতা থেকে চিরদিনের জন্য মুছে ফেলতে প্রয়াসী হয়েছিলেন’। এ অত্যাচার কী তীব্র আকার নেয় এবং বৌদ্ধজীবন কী ভয়াবহতায় উপনীত হয়, এর চিত্র দেখা যায় প্রাচীন ‘শঙ্কর বিজয়’ ও শূন্য পুরাণের মতো গ্রন্থে। সর্বনাশ সব দিকেই থাবা বসাচ্ছিল। সমাজ, সংস্কৃতি ছিল ভয়াবহতার হাতে বন্দী। এ পরিস্থিতিতে ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির (মৃত্যু-১২০৬) বঙ্গজয়।

কিন্তু খিলজির বিরুদ্ধে উঠেছে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের দ্বারা ৪২৭ সালে নির্মিত নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংসের অভিযোগ। মাটির তলে চাপাপড়া ধ্বংসস্তূপ থেকে ২০০৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয়টির অবশেষ উদ্ধার করা হয় এবং ২০১৫ সালে চালু হয় বিশ্ববিদ্যালয়টি।
কিন্তু কিভাবে ধ্বংস হয়েছিল সেটা? কখন? নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় কয়েকবার আক্রান্ত হয় বহিরাগতদের দ্বারা। চরম বৌদ্ধবৈরী মিহিরাকুলের দ্বারা আক্রান্ত হয় স্কন্দগুপ্তের সময়ে (৪৫৫-৪৬৭ খ্রি.)। ঘটে গণহত্যা। স্কন্দগুপ্ত ও তার স্থলবর্তীদের হাতে নালন্দা ঘুরে দাঁড়ালেও রাজা শশাঙ্ক মগধে প্রবেশ করে নালন্দা ধ্বংস করেন। চড়াও হন বৌদ্ধদের পবিত্র স্থানগুলোর ওপর। বিনষ্ট করেন বুদ্ধের পদচিহ্ন। শশাঙ্কের বিনাশযজ্ঞের বিবরণ পাওয়া যায় চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙয়ের (৬০২-৬৬৪) সফরনামায়। রাজা জাতবর্মা সোমপুর মহাবিহার আক্রমণ করে ধ্বংস করেন। মঠাধ্যক্ষ্য করুণাশ্রী মিত্রকে হত্যা করেন আগুনে পুড়িয়ে। হিন্দু রাজা ভোজবর্মার বেলাবলিপিতে রয়েছে যার বিবরণ।

বখতিয়ার খিলজি এখানে কী করলেন? ভারতের রাজ্যসভায় ২০১৪ সালে কংগ্রেস সদস্য করণ সিং ও সিপিএম সদস্য সীতারাম ইয়েচুরির মধ্যে নালন্দার ধ্বংস নিয়ে তর্ক হয়। করণ সিং জোরগলায় দাবি করেন বখতিয়ার খিলজির হাতে বিশ্ববিদ্যালয়টি ধ্বংস হয়। সেটা কবে? ভারতের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ জানাচ্ছে, ১১০০ খ্রিষ্টাব্দে বখতিয়ার আক্রমণ করেন। স্যার উলসলি হেগের মতে, বখতিয়ার ওদন্তপুরী আক্রমণ করেন ১১৯৩ সালে। স্যার যদুনাথ সরকারের (১৮৭০-১৯৫৮) মতে, ১১৯৯ সালে। কিন্তু বখতিয়ারের বঙ্গে আগমনের ঘটনা ঘটে ১২০৪ সালের ১০ মে! বাংলায় আসার ১০৪ বছর আগ থেকেই তিনি এখানকার বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস শুরু করেছিলেন? অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মতে, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস হয় ১১৯৩ সালে। কিন্তু তখনো খিলজির আগমনই ঘটেনি। যদুনাথ সরকার অবশ্য খিলজির আগমনকে ১২০৪ থেকে পিছিয়ে আনার চেষ্টা করেছেন। তার মতে, খিলজি এসেছিলেন ১১৯৯ সালে। কিন্তু তাতেও ১১৯৩ সালে নালন্দা ধ্বংসের দায় তার ওপর চাপে না!

ঐতিহাসিক মিনহাজ উদ্দীন আবু ওমর বিন সিরাজউদ্দীন জুযানির তবাকাত-ই-নাসিরিতে রয়েছে, বখতিয়ারের সৈন্যদের ওদন্তপুরীর মঠে ভুলক্রমে আক্রমণের কথা। মিনহাজের ভাষ্য মতে, ২০০ সৈন্য নিয়ে বখতিয়ার বিহার দুর্গ আক্রমণ করেন। ওদন্তপুরীকে শত্রুদের সেনাশিবির মনে করেন। হামলায় বহু খুনোখুনি হয়। মূলত এটি সেনাশিবিরের মতোই ছিল। এর চার দিকে ছিল বেষ্টনী প্রাচীর। বিখ্যাত তিব্বতি ঐতিহাসিক লামা তারানাথ (১৫৭৫-১৬৩৪) লিখেছেন, সেন আমলে তুর্কি অভিযানের ভয়ে বৌদ্ধবিহারগুলোতে সুরক্ষার ব্যবস্থা নেয়া হতো।

তবকাতের অনুবাদক আবুল কালাম যাকারিয়ার (১৯১৮-২০১৬) মতে, লড়াই সম্ভবত একপক্ষীয় ছিল না, এখানে প্রচণ্ড প্রতিরোধ হয়েছিল, এমন সম্ভাবনা রয়েছে। রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ও (১৮৮৫-১৯৩০) দিয়েছেন বৌদ্ধ ভিক্ষু এবং সেনাদের যৌথ প্রতিরোধের বিবরণ। সেনারা চার দিক থেকে কোণঠাসা হয়ে এখানে এসে আশ্রয় নিয়ে থাকবে। ড. সুশীলা মণ্ডলের মতে, ‘ওদন্তপুর ছিল দুর্গম, সুরক্ষিত, শিখরস্থিত আশ্রম। এখানে স্বয়ং বিহার রাজা গোবিন্দপাল নিজের সৈন্যদের নিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করেন। ফলে বিহার জয়ের জন্য খিলজি রাজধানীর পরে এখানে আক্রমণ করেন। ফলে সৈন্যদের পাশাপাশি বৌদ্ধভিক্ষুরাও অস্ত্র ধারণ করেন। যুদ্ধে তারা পরাজিত হন এবং গোবিন্দ পাল দেব নিহত হন।’ প্রবল যুদ্ধ শেষে অতিকষ্টে পেছনের দ্বার দিয়ে অভ্যন্তরে ঢুকে বখতিয়ারের সৈন্যরা রক্তপাত করেন। এখানে বেশির ভাগ বাসিন্দা ছিল ন্যাড়া মাথা। বখতিয়ার যখন দেখলেন, সেখানে প্রচুর বই এবং জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পারলেন এটি দুর্গ নয়, তখন নিজেদের ভুল বুঝতে পারলেন।

ওদন্তপুর বা উদন্তপুর ছিল একটি বৌদ্ধবিহার; যা আগ থেকেই ছিল বিপর্যস্ত। পাল রাজা ধর্মপাল (৭৭০-৮১০) এর প্রতিষ্ঠাতা। নালন্দা মহাবিহার থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে মগধে এর অবস্থান।
কোনো কোনো গবেষক দাবি করেছেন, সেন রাজাদের ব্রাহ্মণ্যবাদী গুপ্তচররা তুর্কি বাহিনীকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে ওদন্তপুরীতে আক্রমণ করতে প্ররোচিত করে।

ড. দীনেশচন্দ্র সরকার (১৯০৭-১৯৮৪) দেখিয়েছেন, উদন্তপুর বৌদ্ধবিহার ধ্বংস হয় ১১৯৩ সালে। বিভিন্ন গবেষকের মতে ১১৯১-৯৩ সময়কালে। বলাবাহুল্য, বখতিয়ারের বঙ্গজয় এর পরের ঘটনা। বস্তুত ওদন্তপুরী আক্রমণও সংশয়পরিকীর্ণ।
তা হলে মিনহাজের ওদন্তপুরী নালন্দাকে প্রমাণ করছে না। বাংলাদেশের ইতিহাস গ্রন্থে রমেশচন্দ্র মজুমদার (১৮৮৮-১৯৮০) ঠিকই লিখেছেন, ‘খিলজির বাংলা জয় প্রশ্নে যত কাহিনী ও মতবাদ বাজারে চাউর আছে, সবই মিনহাজের ভাষ্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত। কারণ এ সম্পর্কে অন্য কোনো সমসাময়িক ঐতিহাসিক বিবরণ পাওয়া যায় নাই।’

বখতিয়ারের বাংলা জয়ের ৪০ বছর পরে মিনহাজুস সিরাজ বাংলা সফর করেন এবং এ সম্পর্কে প্রচলিত মৌখিক বক্তব্য ব্যক্তিগতভাবে সংগ্রহ করেন। রিচার্ড এম ইটন (১৯৬১-২০১৩) লিখেন, ‘১২০৪ সালে মুহাম্মাদ বখতিয়ারের সেন রাজধানী দখলের প্রায় সমসাময়িক একমাত্র বর্ণনা হচ্ছে মিনহাজের তবকাত-ই নাসিরি।’

‘বাংলার ইতিহাস’ গ্রন্থে সুখময় মুখোপাধ্যায় (মৃত্যু ২০০০ খ্রি.) ‘বাংলার ইতিহাস সুলতানি আমল’ গ্রন্থে ড. আবদুল করিম (১৮৭১-১৯৫৩), ‘বাংলাদেশের ইতিহাস’ গ্রন্থে রমেশচন্দ্র মজুমদার দেখান, তবকাতে নালন্দা অভিযানের কোনো বিবরণ নেই, বখতিয়ার আদৌ নালন্দায় অভিযান করেননি। বস্তুত কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানেও বখতিয়ারের নালন্দা আক্রমণের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
তবকাতের পরের দু’টি গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাসগ্রন্থ হচ্ছে, আবদুল মালিক ইসামি রচিত ‘ফুতুহ-উস-সালাতিন’ ও হাসান নিজামি (১৮৭৩-১৯৫৫) রচিত ‘তাজ-উল-মাসির’। এতেও নালন্দা অভিযানের কোনো উল্লেখ নেই। পরবর্তী ঐতিহাসিক গোলাম হোসেন সলিম (মৃত্যু-১৮১৭) কিংবা চার্লস স্টুয়ার্টও (মৃত্যু-১৮৮৮) নালন্দা অভিযানের কোনো সূত্র খুঁজে পাননি!

বস্তুত ধ্বংসের বহু দাগ গায়ে নিয়েও নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় নিজেকে বাঁচিয়ে রেখেছে খিলজির বঙ্গজয়ের অনেক পরেও। তিব্বত থেকে ধর্মস্বামীর যাতায়াতও ছিল এখানে। ১২৩৪-৩৬ এর মধ্যে তিনি আসেন নালন্দায়, দেখেন চালু আছে পাঠদান। মঠাধ্যক্ষ্য রাহুল শ্রীভদ্র পড়াচ্ছেন, পড়াশোনা করছেন ৭০ জন সাধু! খিলজির মৃত্যুর ২৯ বছর পরের ঘটনা এটি!
সরদার আবদুর রহমান দেখিয়েছেন, নালন্দা ধ্বংস আসলে হিন্দু-বৌদ্ধ সংঘাতের ফসল। তিনি দেখান, হিন্দু প্রচারক ও দার্শনিক শঙ্করাচার্যের (৭৮৮-৮২০) প্রচেষ্টায় বৌদ্ধধর্মের প্রভাব ক্ষয় হয়। ১২ বছর ধরে সূর্যের তপস্যা করে যজ্ঞাগ্নি নিয়ে নালন্দার প্রসিদ্ধ গ্রন্থাগারে এবং বৌদ্ধবিহারগুলোতে অগ্নিসংযোগ করেন ব্রাহ্মণ্যবাদীরা। ফলে নালন্দা অগ্নিসাৎ হয়ে যায়।

ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত (১৮৮০-১৯৬১) তার ‘বাংলার ইতিহাস’ গ্রন্থে নালন্দা ধ্বংসের জন্য ব্রাহ্মণ্যবাদীদের দায়ী করেন। বুদ্ধপ্রকাশ (জন্ম ১৯২৪) তার ‘আসপেক্টস অব ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি অ্যান্ড সিভিলাইজেশন’ গ্রন্থে এমন মতামতের পক্ষে জোরালো বয়ান হাজির করেন।
দীনেশচন্দ্র সেনের কাছে ফেরা যাক। তিনি বৌদ্ধদের প্রতি হিন্দুদের অত্যাচারের আলোচনা করেছেন বিস্তর। তার ‘বৃহৎবঙ্গ’ এর প্রথম খণ্ডে রয়েছে এর মর্মান্তিক ধারাবিবরণী। তার মতে, হিন্দুরা শুধু বৌদ্ধদের অত্যাচার ও তাদের ধর্ম নষ্ট করে ক্ষান্ত হননি, তারা এতকালের সঞ্চিত বৌদ্ধ ভাণ্ডারের সর্বৈব লুণ্ঠন করে লুণ্ঠিত দ্রব্যাদির ওপর স্বীয় নামাঙ্কের ছাপ দিয়ে সামগ্রিকভাবে সর্ববিধ নিজস্ব করে নিয়েছেন। হিন্দুদের পরবর্তী ন্যায়, দর্শন, ধর্মশাস্ত্র প্রভৃতির মধ্যে এ লুণ্ঠন পরিচয় পাওয়া যায়। অতএব ভিক্ষু সুনীথানন্দের মতে, এভাবে হিন্দু কর্তৃক বৌদ্ধধর্মের ঐতিহ্যময় ইতিহাস বিলোপপ্রাপ্ত হয়েছে। ‘বাংলাদেশের বৌদ্ধবিহার ও ভিক্ষু জীবন‘ গ্রন্থে ভিক্ষু দাবি করেন, ‘এর জন্য হিন্দুরাই একমাত্র দায়ী।’

ইসলাম ও মুসলিমরা এখানে কী করেছিলেন? জবাবটা শোনা যাক স্যার মানবেন্দ্র নাথ রায় (১৮৮৭-১৯৫৬) থেকে। তিনি লিখেন, ‘ব্রাহ্মণ্য প্রতিক্রিয়ায় বৌদ্ধ-বিপ্লব যখন পর্যুদস্ত হয়ে গেল আর তাতেই হলো ভারতের সমাজে বিশৃঙ্খলার উৎপত্তি; তখন অগণিত জনসাধারণ তা থেকে স্বস্তি ও মুক্তির নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচার জন্য ইসলামের বার্তাকেই জানাল সাদর সম্ভাষণ।’

‘মুসলিমবিদ্বেষী লেখক আর্নেস্ট হ্যাভেলকেও (১৮৬১-১৯৩৪) তাই ‘দ্য হিস্ট্রি অব এরিয়ান রুল ইন ইন্ডিয়া’ গ্রন্থে স্বীকার করতে হয়েছিল, ‘মুসলমান রাজনৈতিক মতবাদ শুদ্রকে দিয়েছে মুক্ত মানুষের অধিকার, আর ব্রাহ্মণদের উপরেও প্রভুত্ব করার ক্ষমতা।’
ইউরোপের পুনর্জাগরণের মতো চিন্তাজগতে এ-ও তুলেছে তরঙ্গাভিঘাত, জন্ম দিয়েছে অগণিত দৃঢ় মানুষের আর অনেক অত্যদ্ভুত মৌলিক প্রতিভার। পুনর্জাগরণের মতোই এ-ও ছিল আসলে এক প্রৌঢ় আদর্শ। এরই ফলে গড়ে উঠল বাঁচার আনন্দে পরিপূর্ণ এক বিরাট মানবতা। সেই মানবতার দ্বার উন্মোচনে বখতিয়ার খিলজির বঙ্গজয় ছিল প্রশ্নহীন এক মাইলফলক। বৌদ্ধদের জন্য সেটি ছিল অনেক বেশি গ্লানিমুক্তি। অনেকটা নবজীবন।

মুসলিম বিজয় তাদের কোনো কিছু ধ্বংস করেনি, বিপন্ন করেনি তাদেরকে। বরং খুলে দিয়েছে মুক্তির সদরদরজা। অতএব দীনেশচন্দ্র সেনের ভাষায়, ‘মুসলমানগণ কর্তৃক বঙ্গবিজয়কে বৌদ্ধরা ভগবানের দানরূপে মেনে নিয়েছিল।’
নালন্দার ধ্বংস মুসলিমদের হাতে হলে তবে মুসলিম বিজয়কে কেন বৌদ্ধরা ভগবানের অনুদান মনে করবেন?

লেখক : কবি, গবেষক

Advertisements