আমাদের অনেকের ধারণা – ধর্ম প্রচার করতে হলে মনে হয় মুখ শক্ত করে থাকতে হবে, হাসাহাসি করা যাবে না, কেউ হাসির কিছু বললে কটমট করে তাকিয়ে থাকতে হবে। আসলে ব্যাপারটা ঠিক না। আমরা যদি রাসূলুল্লাহর (ﷺ) সিরাতের দিকে তাকাই তাহলে দেখব তাঁর (ﷺ) সেন্স অফ হিউমার ছিল অসামান্য পর্যায়ের। তবে, জোক করেও তিনি কখনো মিথ্যা বা অশ্লীল কিছু বলতেন না। তাঁর সব জোক ছিল সত্য ও পরিচ্ছন্ন।
১. একবার এক বৃদ্ধা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কাছে এসে বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল, আল্লাহর কাছে দু’আ করুন যাতে তিনি আমাকে জান্নাতে প্রবেশ করতে দেন।” রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সিরিয়াসভাবে জবাব দিলেন – “জান্নাতে কোনো বৃদ্ধা প্রবেশ করবে না।” এটা শুনে বৃদ্ধা যখন কাঁদতে শুরু করলেন, তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হেসে বললেন – তুমি কি এই আয়াতটি পড়োনি – “নিশ্চয়ই আমি জান্নাতের নারীদের নতুনভাবে তৈরী করব; তারা হবে কুমারী, ভালোবাসাপূর্ণ ও সমবয়স্কা।” [কুরআন ৫৬:৩৫-৩৭)”]
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বৃদ্ধা মহিলাটিকে বুঝালেন যে – এই বৃদ্ধ, জীর্ণ শরীর কখনও জান্নাতে যাবে না। জান্নাতে তিনি প্রবেশ করবেন তরুণীর শরীর নিয়ে, নতুন জীবন নিয়ে। এটা শুনে বৃদ্ধা দ্বিগুণ পরিমাণ আনন্দিত হয়ে ফিরে গেলেন।
২. রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর চলে যাওয়ার ৪-৫ দিন আগের কথা। তিনি (ﷺ) তখন ভয়াবহ অসুস্থ অবস্থায় বিছানায় শায়িত। এর মধ্যে একদিন তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী আইশার (রা.) শরীরও ভালো যাচ্ছিল না – খুব মাথা ব্যাথা। ব্যাথায় তিনি বলে উঠলেন – “উফ আমার মাথা, উফ আমার মাথা!” রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কিছুটা কৌতুকের স্বরে বললেন – “বরং আমার বলা উচিত – উফ আমার মাথা, উফ আমার মাথা, আমার মাথা ব্যাথা তো তোমারটার চেয়েও বেশী।” রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এসময় খুব সম্ভবত জানতেন এটাই তাঁর মৃত্যুপূর্ব অসুস্থতা । তারপরেও তিনি (ﷺ) পরিস্থিতি হাল্কা করতে, তাঁর (ﷺ) স্ত্রীর মনকে খুশী করতে ভুলেননি। তিনি (ﷺ) যোগ করলেন – “আর তুমি এখন মরে গেলে কি-ই বা এমন হারাবে? তোমার গোসল করানো, তোমার জানাযা পড়ানো, তোমার কবর দেয়া – সব তো তখন আমার হাতেই হবে।” রাসূলুল্লাহর (ﷺ) কৌতুক বুঝতে পেরে আইশা (রা.) পাল্টা টিপ্পনী কাটলেন – “আমি নিশ্চিত আপনি চান এরকমটা হোক, কারণ তখন আপনি আমার থেকে মুক্ত হয়ে আপনার অন্য বউদের কাছে যেতে পারবেন!”
কঠিন পরিস্থিতিকে হাল্কা করার এরকম অসামান্য গুণ ছিল রাসূলুল্লাহর (ﷺ)। মজার ব্যাপার হলো – রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও আইশার (রা.) কৌতুকের এই হাদিস থেকে স্কলারেরা ফিকহ পর্যন্ত বের করেছেন। যেহেতু রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কখনোই মিথ্যা বলতেন না, কাজেই এই হাদিস থেকে বুঝা যায় যে, স্বামীর জন্য স্ত্রীর মৃত্যুর পর তার গোসল করানো জায়েয।
৩. জাহির নামে এক সাহাবীকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বেশ পছন্দ করতেন। একবার জাহির বাজারে কিছু একটা বিক্রি করছিলেন। হাতে বিক্রির মাল নিয়ে বলছিলেন – “কে নিবেন, কে নিবেন?”। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বাজারে ঢুকে দূর থেকে দেখলেন জাহিরকে, আর তখনই তাঁর মাথায় একটা বুদ্ধি আসল। তিনি (ﷺ) চুপি চুপি জাহিরের পিছনে যেয়ে দাঁড়ালেন, তারপর পেছন থেকে হঠাৎ করে জাপ্টে ধরলেন। জাহির কিছু বুঝে উঠতে না পেরে প্রথমে নিজেকে ছুটানোর চেষ্টা করলেন, কিন্তু যেই মাত্র বুঝতে পারলেন এটা রাসূলুল্লাহর (ﷺ) হাত, তখনই তিনি বরং নিজের শরীরকে রাসূলুল্লাহর (ﷺ) শরীরের সাথে ঘষা শুরু করলেন – বারাকাহ নেয়ার জন্য। আর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জাপ্টে ধরা অবস্থাতেই কৌতুক করে বলা শুরু করলেন – “এই আব্দকে কে নিবেন, এই আব্দকে কে নিবেন?”। (রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এখানে ‘আব্দ’ বলতে ‘আল্লাহর বান্দা’ বুঝিয়েছেন)।
জাহির বিনয়ের সাথে বললেন, “সেক্ষেত্রে আপনি খুব খারাপ মূল্য পাবেন হে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)?”
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জবাব দিলেন, “আল্লাহর দৃষ্টিতে তুমি অনেক মূল্যবান।”
লক্ষ্যণীয় হলো – রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কি নাটকীয়ভাবে জাহিরকে বুঝালেন যে তার মূল্য আল্লাহর কাছে অনেক। তিনি যদি জাহিরকে সরাসরি কথাটা বলতেন তাহলে বিষয়টা যতটা না মনে রাখার মতো হতো, তার চেয়ে অনেক বেশী মনে রাখার মতো হয়েছে রাসূলুল্লাহর (ﷺ) রসিকতাপূর্ণ উপস্থাপনার জন্য। মানুষের মনে দাগ কাটার মতো রসিকতা করার অসামান্য ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)।
সূত্র:
১) শেইখ ইয়াসির কাযির সিরাহ লেকচার – পর্ব ২
২) হাদিসগুলো পাবেন ইমাম তিরমিযী রচিত শামায়েল গ্রন্থের রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর কৌতুক অধ্যায়ে
৩) জাহির এর হাদিস: https://www.lastprophet.info/jokes-and-humor-of-prophet-muhammad