"কারাবাখ শান্তিচুক্তি, কে কি পেল আর কি হারালো"
Advertisements

নাগোর্ন-কারাবাখ নিয়ে আজারবাইজান-আর্মেনিয়ার সংঘাত আপাতত শেষ হয়েছে। যুদ্ধের সংক্ষিপ্ত ফলাফল হল গত তিরিশ বছরে প্রতিবেশীর দুরাবস্থার সুযোগে রাজ্য, রাজকন্যা, ধনসম্পদ যা হাতিয়ে নিয়েছিল তার সব হারিয়ে আর্মেনিয়া এখন পথের ফকির।

গত পাঁচ সপ্তাহে যা হারিয়েছে তা অর্জন করতে আর্মেনিয়ার সময় লেগেছিল (১৯৯০-১৯৯৪) কমপক্ষে চার বছর। কারণ দুর্গম পাহার-পর্বতে ঘেরা, চড়াই-উৎরাইয়ের পাথুরে ভূমি নাগোর্ন-কারাবাখ যে কারো জন্য জয় করা খুবই দুরূহ ও সময় সাপেক্ষ। তাই যারা আজারবাইজানের জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী (অতি আশাবাদীরা যারা কল্পনায় বাঘ শিকার করে তারা বাদে) ছিলেন তাদেরও অনেকেরই ধারণা ছিল এই যুদ্ধ জিততে আজারবাইজানের সময় লাগবে কমপক্ষে এক বছর।

কিন্তু সাম্প্রতিক বছর গুলোতে তুর্কি সংশ্লিষ্ঠতায় পূর্ব-ভূমধ্য সাগর প্লাস আরো ৮টি অভিযান (যেমনঃ তুর্কির তার নিজস্ব ভুমিতে দিয়ারবাকিরে একটি, উত্তর ইরাকের দুটি, সিরিয়ার চারটি (আলবাব, আফ্রিন, রাশআলআইন-তালআবাইদ ও ইদলিব) এবং লিবিয়া) আমরা যারা ক্লোজলি পর্যবেক্ষন করেছি তাদের বিশ্বাস ছিল এই যুদ্ধ এক/দেড় মাসের বেশী স্থায়ী হবে না। কারণ কয়েক যুগ ধরে প্রতিষ্ঠিত মডার্ন এয়ার-ফেয়ারের প্রচলিত ধারনাটাই পাল্টে দিয়েছে তুর্কিরা।

আর্মেনিয়ানদের বিপক্ষে আজারবাইজানিদের সুপিরিওরিটি যুদ্ধের প্রথম দিন থেকেই আমাদের কাছে পরিস্কার ছিল। রাশিয়ান আর্মামেন্ট তুর্কির টেকনোলজির সামনে ভোঁতা প্রমাণিত হচ্ছিল। তুর্কি অফিসারদের তত্বাবধানে আজারবাইজানিদের যুদ্ধের প্ল্যান ও কৌশলের কাছে প্রথম কারাবাখের সিংহরা ক্রমাগত মার খাচ্ছিল।

এই যুদ্ধটা কতটা আগ্রাসী রূপ ধারণ করেছিল তা আমরা কিছুটা আঁচ করতে পারি আর্তসাখের (বিশ্ববাসীর কাছে যা নাগোর্ন-কারাবাখ নামে পরিচিত) স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট আরিক হারুতিউনিয়ানের ভাষায়, যার ভাবার্থ করলে মোটামুটি এরকম হয়ঃ
“আমি জানিনা ইতিহাস আমাদের সিদ্ধান্তকে (যুদ্ধবিরতি) কিভাবে মূল্যায়ন করবে। কিন্তু আমরা বাধ্য হয়েছি। যদি এই সংঘাত একই গতিতে চলত তাহলে রাজধানী স্টেপেনাকার্টসহ সমগ্র আর্তসাখের পতন ছিল মাত্র কয়েক দিনের ব্যাপার।
কয়েক দিন আগেও আমরা মনে করেছি যে কয়েক সপ্তাহের ড্রোনের ধ্বংস যজ্ঞ থেকে আমরা নিজেদের রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছি। তাই আমরা বিশ্বাস করতে পারিনি যে আমাদের যে জনবল ও সামরিক শক্তি অবশিষ্ঠ আছে তা দিয়ে যুদ্ধ কনটিনিউ করা অসম্ভব। কিন্তু গত দুদিনে, নতুন টেকনোলজি নাকি নতুন ড্রোনের সাহায্যে, আমি জানিনা কিভাবে শত্রুরা আমাদের উপর মহা ধ্বংসযজ্ঞ চালালো!

দুদিন আগে আমরা শুশা হারিয়েছি। গতকাল মারতুনি এলাকায় আমাদের জনবলের সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয়েছে। শেষ কয়েক ঘন্টায় যা ঘটেছে তা অবর্ননীয়। আমাদের সৈনদের মনোবল নিঃশেষ হয়ে গেছে। আমরা বিশাল এলাকা ছেড়ে দেয়ার বিনিময়ে চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছি যাতে অবশিষ্ঠ আর্তসাখ রক্ষা পায় এবং আর কোন জান-মালের ক্ষতি না হয়। আমরা নির্দিষ্টভাবে শুধু আজারবাইজান বা তাদেরকে দেয়া তুর্কি সমরাস্ত্র ও সমন্বয়কারী কিছু সামরিক অফিসারের সাথে যুদ্ধ করিনি। সেখানে তুর্কির সক্রিয় সামরিক বাহিনী, বিভিন্ন দেশের সন্ত্রাসী ও ভাড়াটে সৈন্যের উপস্থিতিও সমানভাবে ছিল।”

রাজধানী স্টেপেনাকার্টের (আজেরি ভার্সনে এর নাম খানকেন্দি) কেন্দ্র থেকে মাত্র ৬ মাইল দক্ষিনে অবস্থিত নাগোর্ন-কারাবাখের ২য় বৃহত্তম শহর শুশা যা সেই অঞ্চলের সর্বোচ্চ উচ্চতায় অবস্থিত। স্টেপেনাকার্টের সাথে আর্মেনিয়ার সাথে যোগাযোগ কারী একমাত্র লাচিন কোরিডরটি এই শহরের ভিতর দিয়ে অতিক্রম করায় এর স্ট্রাটেজিক গুরুত্ব অপরিসীম। ৩০ বছর আগে শহরটি থেকে সংখ্যাগড়িষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠী বিতারিত করা হয়। সে শহরটি এখন তা আর্মেনিয়ার কাছে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক রাজধানী নামে পরিচিত। অনেক উঁচুতে অবস্থিত হওয়ায় শুশা শহরটি রাজধানী স্টেপেনাকার্টের জন্য সার্বক্ষনিক প্রাকৃতিক প্রহরীর মত ভূমিকা পালন করে। গত ৭ তারিখে আজেরি বাহিনী লাচিন কোরিডর সহ শুশা কব্জা করলে রাজধানীর পতন সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায় যেটা আর্তসাখের প্রেসিডেন্টের বক্তব্য থেকে বুঝতে পারি।

এই ২য় নাগোর্ন-কারাবাখ যুদ্ধে আজারবাইজানের পক্ষে বিভিন্ন মাত্রায় সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছে তুর্কি, পাকিস্তান ও ইসরাইল। মৌখিকভাবে সমর্থন দিয়েছে সৌদি, কাতার ও তুর্কি সমর্থিত সাইপ্রাস। আর আর্মেনিয়ার পক্ষে বিভিন্ন মাত্রায় সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহন করেছে রাশিয়া, ইরান ও সিরিয়া। সমর্থন দিয়েছে আরব আমিরাত, ভারত, গ্রীস, ফ্রান্স, গ্রিক সাইপ্রাস সহ পশ্চিমা অনেক দেশ। রাশিয়া মেডিয়েটেড যে চুক্তির মাধ্যমে এর পরিসমাপ্তি ঘটল মাত্র তিন পৃষ্টায় বর্নিত তার ধারাগুলোর সার সংক্ষেপ নিম্নরুপঃ

* মস্কোর সময় অনুযায়ী ১০ই নভেম্বর রাত ১২টায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হবে এবং তখন থেকে সকল প্রকার সংঘাত বন্ধ করতে হবে। ঐ সময় পর্যন্ত আজারবাইজান যা দখল করেছে তা তাদেরই থাকবে। যত শীঘ্র সম্ভব নিহতদের হস্তান্তর ও যুদ্ধবন্দী বিনিময় করতে হবে।
* প্রায় তিন দশক আগে নাগোর্ন-কারাবাখসহ সন্নিহিত আজারবাইজানের আরো ৭টি জেলা আর্মেনিয়া দখল করে নিয়েছিল। এর ৪টি জেলা কয়েক সপ্তাহের যুদ্ধে আর্মেনিয়ার কাছ থেকে ইতিমধ্যে হাতছাড়া হয়ে গেছে। বাকী ৩টি জেলা ডিসেম্বরের ১ তারিখের মধ্যেই আজারবাইজানের কাছে হস্তান্তর করতে হবে। অবশিষ্ট কারাবাখের নিয়ন্ত্রন থাকবে সেখানকার লোকাল এথনিক আর্মেনিয়ানদের হাতে। সেখানে বাস্তুচ্যুত মানুষরা যার যার বাড়ী ঘরে ফিরতে পারবে।
* অবশিষ্ট কারাবাখের চতুর্দিকের লাইন অব কন্ট্রোলে ও কারাবাখের সাথে আর্মেনিয়ার সংযোগ রক্ষাকারী লাচিন কোরিডরে রাশিয়ার প্রায় ২০০০ শান্তিরক্ষী হালকা অস্ত্র ও সামরিকযান সহ মোতায়েন থাকবে। তারা আটকে পড়া আর্মেনিয়ার সেনাবাহিনীর সদস্যদের প্রত্যাহারকালীন তদারকি ও নিরাপত্তা দেবে। চুক্তিবলে রাশিয়া পাঁচ বছরের জন্য তার শান্তিরক্ষি মোতায়েন রাখবে এবং পাঁচ বছর পুর্ন হওয়ার কমপক্ষে ৬ মাস আগে যদি বিবদমান কোন দেশ থেকে শান্তিরক্ষি প্রত্যাহারের আবেদন না আসে তাহলে শান্তিরক্ষী অবস্থানের মেয়াদ স্বয়ংক্রিয়ভাবে আরো পাঁচ বছর বৃদ্ধি পাবে।

* ৩ বছরের মধ্যে লাচিন কোরিডরের সমান্তরালে আরো একটি ট্রাসপোর্ট রোড আর্মেনিয়াকে তৈরী করতে দেয়া হবে যা শুশা শহরের বাহির দিয়ে যাবে। রাশিয়ার শান্তিরক্ষিরা লাচিন কোরিডর থেকে সেখানে রিডিপ্লয় করা হবে। আজারবাইজান সে নতুন রাস্তায় চলাচলকারী যানবাহন, মালামাল ও নাগরিকদের নিরাপত্তা চিশ্চিত করবে। কারাবাখসহ ঐ দুই দেশের মধ্যে সকল প্রকার যানবাহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা নিরবচ্ছিন্ন থাকবে।
* আর্মেনিয়ার পশ্চিমে অবস্থিত আজারবাইজান থেকে বিচ্ছিন্ন তুর্কি ও ইরান সীমান্তবর্তী আজারবাইজানী সিটমহল নাকচিভানে নাগরিক, যানবাহন ও মালামাল বাধাহীনভাবে চলচলের জন্য আর্মেনিয়াকে ট্রানজিট দিতে হবে। সেই ট্রান্সপোর্ট রোডের দেখাশোনা করবে রাশিয়ার সীমান্তরক্ষি বাহিনী। পরবর্তিতে আজারবাইজান বিদ্যমান রোডের সমান্তরালে আলাদা একটি ট্রান্সপোর্ট রোড তৈরি করতে পারবে।

তো চুক্তির ধারাগুলো থেকেই পরিস্কার হয় যুদ্ধে আজারবাইজের অল আউট বিজয় হয়েছে আর আর্মেনিয়া ক্যাপিচুলেটেড হয়েছে। স্বভাবতই সমগ্র আজারবাইজানে চলছে উচ্ছ্বসিত জনতার বিজয় শোভাযাত্রা। তুর্কি ও পাকিস্তানে চলছে আনন্দ মিছিল। এ যেন ইতিহাসের পুনরাবৃতি। ১৯৯১-৯৪ সাল ছিল আর্মেনিয়ার জন্য আর ২০২০ সাল যেন শুধুই আজারবাইজানের জন্য। সেবার দুই দেশই সোভিয়েট থেকে স্বাধীনতা পেলেও স্বাধীনতা ও যুদ্ধ বিজয়ের আনন্দে ভেসেছিল শুধু আর্মেনিয়া। চরম রাজনৈতিক অস্থিরতা ও আজেরিদের উপর কারাবাখ যুদ্ধে বয়ে যাওয়া ধ্বংসলীলার কারণে তারা স্বাধীনতাকে উদযাপন করতে পারেনি।
অন্যদিকে যুদ্ধের ধূলিঝড় সেটেলড হওয়ার আগেই যথারীতি বোদ্ধা মহলে চলছে এর খুটিনাটি মূল্যায়ন ও বিশ্লেষণ। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক ও গবেষকরা খাতা-কলম নিয়ে ব্যস্ত বিবদমান পক্ষের কার কি লাভ-ক্ষতি হল সেই হিসাব নিয়ে।

তাদের মূল্যায়ন মোটামুটি এরকমঃ

আর্মেনিয়াঃ
———–
আর্তসাখকে (নাগোর্ন-কারাবাখক) আর্মেনিয়ানদের আইডেনটিটির টাচস্টোন (পরশ পাথর), রাজনীতির আঁতুড়ঘর, তথা রাজনীতির পরীক্ষাগার বলা হয়। আর্মেনিয়ার রাজনীতির মঞ্চে সফলতার জন্য যে কোন রাজনীতিবিদকে আগে সেখানে গিয়ে পলিটিক্যাল ইন্টার্র্নশিপ করতে হয়। আর্তসাখের আশেপাশের ৭টি আজেরি জেলাতো গেছেই সেই সাথে তাদের স্বাংস্কৃতিক রাজধানী শুশাসহ আর্তসাখের ৪০% এলাকা এখন আজেরি বাহিনীর হাতে। এর সাথে মরার উপর খরার ঘা হিসেবে এসেছে নাকচিভানের সাথে যোগাযোগের জন্য আজারবাইজানের করিডর। শোনা যাচ্ছে এই কোরিডর অর্থাৎ আর্মেনিয়ার বুকের উপর দিয়ে নাকি তাদের চিরশত্রু তুর্কিরা চলাফেরা করবে। যেখানে ১৯৯৩ সাল থেকেই আর্মেনিয়ার জন্য তুর্কির বিশাল সীমান্ত একেবারে সীল করা। তুর্কির সাথে আর্মেনিয়ার কোন কূটনীতিক সম্পর্কও নেই। এমনকি তুর্কিরা আর্মেনিয়ার অস্তিত্বকেও স্বীকার করতে চায় না। তাহলে এই হিউমিলেটিং চিজফায়ারের প্রতিক্রিয়া জনসাধারনের মধ্যে কি হতে পারে সেটা সহজেই অনুমেয়।

বিক্ষুব্ধ জনগন পার্লামেন্ট ভবন তচনচ করেছে। স্পিকারকে বউ-বাচ্চার সামনে গণপিটুনি দিয়ে অজ্ঞান করেছে। প্রধানমন্ত্রী পাশিয়ানানের স্ত্রী যুদ্ধরত সৈনদের উৎসাহ যোগাতে স্বয়ং ফ্রন্ট লাইনে অবস্থান করলেও উত্তেজিত জনতা তাদের ভাষায় বিশ্বাসঘাতক প্রধানমন্ত্রীকে খুজতে তার বাসভবনে চড়াও হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী আত্মগোপনে থেকে মাঝে মধ্যে টুইট করে পীঠ বাঁচানোর চেষ্টা করছেন। তার সরকার জনগনের রোষানল থেকে রক্ষা পাবে কিনা বিস্তর সন্দেহ আছে। ঠিক একই ঘটনা ঘটেছিল তিন দশক আগে আজারবাইজানে।

আজারবাইজানঃ
—————-
জায়গাজমি, জানমাল, ধনসম্পদ, মানসম্মান, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা যা কিছু আর্মেনিয়া হারিয়েছে তাহাই সুদে আসলে ফেরত পেয়েছে আজারবাইজান। তাদের প্রেসিডেন্ট জনগনের উদ্দেশ্যে দেয়া টিভি ভাষণে বিজয় ডংকা বাজানোর পাশাপাশি আর্মেনিয়ানদের কাটা ঘায়ে লবন লাগাতে একটুও কসুর করেননি।
তিনি বলেছেনঃ “আমরা যা চেয়েছি তাই পেয়েছি। তুমি নিকল পাশিয়ান, আজ সম্পূর্ন পরাস্ত। তুমি বলেছিলে, এক ইঞ্চি আজেরি ভুমিও আমাদের ফেরত দেবেনা। বিনিময়ে এর পূর্বে আমরা কারাবাখকে পূর্ন স্বায়ত্বশাসন দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আজ? কারাবাখের স্বায়ত্বশাসনের কোন গ্যারান্টি চুক্তিতে উল্লেখ নেই। অর্থাৎ এটা আমাদের সম্পুর্ন দয়ার উপরে নির্ভর করবে।“

ইসরাইলঃ
———-
সফিস্টিকেটেড স্টেট-অব-আর্ট উইপন্স ও ডিপ্লমেটিক সাপোর্টের যোগানদাতা হিসেবে আজারবাইজানের এই বিজয়ে ইসরাইলের খুশি হওয়ার কথা। কিন্তু তাদের পত্রপত্রিকা ও বিশ্লেষণগুলো দেখলে স্পষ্টঃতই বোঝা যায় সেখানে উচ্ছ্বাসের পরিবর্তে ব্যথার বীন বাজছে। কারণটা স্পষ্ট এবং সেটা হল তুর্কি। রাশিয়ার মত ইসরাইলও তাই শাখের করাতের কবলে।

পাকিস্তানঃ
———-
বিজাতির সাথে যে কোন যুদ্ধে লাভ লোকসানের কথা না ভেবে ভাতৃত্বের বন্ধনে সামর্থ অনুযায়ী স্বজাতির পাশে দাঁড়ানো পাকিস্তানের চিরাচরিত ইতিহাস। সীমানা ও অর্থনৈতিক দুরাবস্থা এক্ষেত্রে তাদের বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়নি কখনো। এজন্য বিশ্ব পরাশক্তিগুলো কত দেশের হুমকি-ধামকি, চোখ রাঙ্গানি, তিরস্কার সইতে হয়েছে তার ইয়ত্তা নাই। পারমানবিক ক্ষমতার অধিকারী না হলে তাকে এতদিন আফগানিস্তানের ভাগ্য বরণ করতে হত। বরাবরের মত এবারও পাকিস্তান নিঃস্বার্থভাবে আজেরিদের পাশে দারিয়েছে। তুর্কি ও আজেরিরা হয়ত পাকিস্তানীদের মূল্যায়ন করতে ভুলবে না। কিন্তু বিশ্ব মিডিয়ায় পাকিস্তান এবারও আন্ডাররেটেডই থেকে যাবে।

ইরানঃ
——
যদিও ইরান আর্মেনিয়ার পক্ষে অথবা আজারবাইজানের বিপক্ষে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহন করেনি। পরক্ষভাবে কিছু করে থাকলেও সেটা প্রথম কারাবাখ যুদ্ধের তুলনায় অনেক কম ছিল বলা যায়। আর্মেনিয়ার জন্য যাওবা করেছে সেটাও খুব গোপনে। কিন্তু রাশিয়ার সমরাস্ত্র কাস্পিয়ান সাগর দিয়ে ইরান হয়ে ঠিকই আর্মেনিয়ায় ঢুকেছে।

কিন্তু তারপরও কারাবাখ যুদ্ধের ফলাফলে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্থদের তালিকায় ইরান। ইরানই একমাত্র দেশ যে কিনা বিবদমান দুই দেশ সহ পুরা কনফ্লিক্ট জোনটা তার সীমান্তে অবস্থিত। সেখানে তুর্কি, রাশিয়া এসে মাস্তানি করলেও সঙ্গত কারণেই ইরানকে চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া কিছু করার ছিলনা। মিত্র রাশিয়া নেগশিয়েশন টেবিলে ইরানকে একটু বসার ভাবনাটাও ভাবতে দেয়নি।

উল্টো ইরানের উপর আজারবাইজানের প্রধান ডিপেন্ডেন্সি উত্তর ইরানের ভেতর দিয়ে সড়ক যোগে নাকচিভানে যোগাযোগের একমাত্র ট্রানজিট রুট তথা আজেরিদের উপর ইরানি লিভারেজটাও রাশিয়ার কারণে হাতছাড়া হয়ে গেল। তুরস্ক ইরানকে বাইপাস করে তারই সীমানা ঘেঁষে কাস্পিয়ান সাগর পর্যন্ত যাবে এটা যে ইরানের কল্পনারও বাইরে। উত্তর ইরানের আজেরি তুর্কিরা তাদের তুর্কি ও আজেরি ভাইদের সাফল্যে উজ্জীবিত হয়ে স্বায়ত্বশাসন, এমনকি বিচ্ছিন্ন হয়ে বৃহত্তর আজেরি রাষ্ট্র গঠনের ডাক দেবে না এর নিশ্চয়তা কে দেবে?

গ্রীস, ভারত, আমিরাতঃ
———————-
ভারটুয়ালি এরা মূলত প্রোপাগান্ডা মেশিন। আর খেলার মাঠে এরা ক্লাউন বা ছাগলের তিন নাম্বার বাচ্চা। এদের ক্লাস অব ইন্টারেস্টটা মুলত তুর্কি অথাবা পাকিস্তান কেন্দ্রীক। অনাগত ভবিষ্যতের শঙ্কায় এরা আর্মেনিয়াকে মিডিয়া ও লিপ সার্ভিস দিয়ে গেছে। কিন্তু পাকিস্তানের মত ফিজিক্যাল সাপোর্ট দেয়ার হ্যাডম এদের হয়নি। এখন আর্মেনিয়ার পরাজয়ে এদের প্যান্ট আস্ত আছে কিনা সেটা তারাই নিশ্চিত করতে পারবে।

ওএসসি-মিনস্ক গ্রুপঃ
———————
ইউরোপিও নিরাপত্তা ও সহযোগিতা সংস্থার পৃষ্টপোষকতায় (বেলারুশের রাজধানী মিনস্ক-এর নামে ১৯৯২ সালে গঠিত) নাগোর্ন-কারাবাখের সংঘাতের প্রেক্ষাপটে গড়ে ওঠা একটি গ্রুপ যার স্থায়ী সদস্য রাশিয়া, ফ্রান্স ও আমেরিকা। সংঘাতের কেন্দ্রস্থল হল দক্ষিন ককেসাসে, পার্শ্ববর্তি এফেক্টেড দেশ তুর্কি, ইরান, রাশিয়া ও জর্জিয়া আর নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে ইউরোপ-আমেরিকা! এর মধ্যে ফ্রান্স সরাসরি আর্মেনিয়ার পক্ষে আর রাশিয়ার সামরিক ঘাটি আছে আর্মেনিয়ায়। ২৮ বছর ধরে মিটিং করে কার কি ছিড়ল এরাই জানে।

সমস্যার দ্রুত সমাধানে আজারবাইজানের দাবী ছিল গ্রুপটিতে তুর্কির অন্তর্ভুক্তি। কিন্তু ফ্রান্স, রাশিয়ার আপত্তি আর আমেরিকারও আগ্রহ ছিল না এতে। কিন্তু তাতে কি। তুর্কি এমন ফাঁদ ফেলেছে সেখানে রাশিয়া আটকে গিয়ে সে গ্রুপটিকেই খেয়ে দেয়ার বন্দোবস্ত করেছে। ফ্রান্সের একটির পত্রিকার সম্পাদকীয় ভাষ্য হচ্ছেঃ “ কারাবাখ যুদ্ধে তুর্কির পক্ষ থেকে আজারবাইজানকে অল আউট সাপোর্ট এবং এরদোয়ান ও পুতিনের মধ্যে কনস্ট্যান্ট কমিউনিকেশন পশ্চিমাদেরকে কারাবাখ কেন্দ্রীক “ডিপ্লমেটিক গেম” থেকে ছুড়ে ফেলেছে। এই শান্তিচুক্তি পরিস্কারভাবে মিনস্ক গ্রুপের জন্য চপেটাঘাত। এর বলে মস্কো সেখানে সেনা মোতায়েন করার সুযোগ পাবে এবং ফাইনালি আমেরিকা ও ফ্রান্স দৃশ্যপট থেকে বিতাড়িত হবে”। পত্রিকাটির মতে সিরিয়া ও লিবিয়া ইস্যুর পর নাগোর্ন-কারাবাখ ইস্যু তুর্কি বিরোধী ফ্রান্সের আরেকটি ব্যর্থতার দলীল।

কারাবাখের দৃশ্যপট থেকে বিতাড়িত হয়ে পশ্চিমারা এখন অভিশাপ দেয়া শুরু করেছে। তাদের মতে, শট টার্মের জন্য আজারবাইজান তার এই বিজয় নিয়ে সেলিব্রেট করতে পারে। কিন্তু আর্মেনিয়া আহত সিংহের মত জঙ্গলের আড়ালে ঘা চাটছে। আজারবাইজানের জন্য মোটেও এটা প্রকৃত বিজয় নয় বরং এটা সংঘাতের নতুন চ্যাপ্টার খুলে দিল। এটা হয়তো এখনই অথবা এক দশকের মধ্যে নাও আসতে পারে। কিন্তু তুর্কি ও আজারবাইজানে ঠিকই একসময় পলিটিক্যাল ভ্যাকুয়াম তৈরি হবে যেদিন এরদোয়ান ও আলিয়েভ মারা যাবে। তখন আর্মেনিয়ানদের জন্য প্রতিশোধ নেয়ার সুযোগ আসবে। কাজেই এটা কোন বিজয় নয়, জাস্ট বিগিনিং অফ এ নিউ চ্যাপ্টার!

তুর্কিঃ
—–
আজারবাইজান, আর্মেনিয়া ও রাশিয়া এই তিন দেশই পিচ এগ্রিমেন্টের শুধু সিগনেটরি পক্ষ সেখানে তুর্কি কেউ নয়। এমনকি চিসফায়ার ডকুমেন্টেও তুর্কিকে কোথাও রাখা হয়নি। তারপরেও আজারবাইজান ছাড়া বাকী বিশ্বে এই চুক্তিকে তুর্কির বিজয় বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ প্রথমতঃ তুর্কির আনকন্ডিশনাল, অলআউট ও সক্রিয় সহযোগিতা আজারবাইজানকে যুযোগ করে দিয়েছে কারাবাখ মুক্ত করার। দ্বিতীয়তঃ তুর্কির অনিবার্য ভুমিকাই যুদ্ধ নিরসনে নেগোশিয়েশনের গতি প্রকৃতিকে রেগুলেট করেছে।

এই শান্তিচুক্তি তুর্কিকে বেনিফিটেড করেছে নাকচিভানের জন্য নতুন করিডর দিয়ে কাস্পিয়ান সাগর পর্যন্ত যাওয়ার সুযোগ দানের মাধ্যমে। শান্তিচুক্তির কোন পক্ষ না হলে কি হবে, আজারবাইজানি প্রেসিডেন্টের টিভিতে দেয়া ভাষ্যমতে, কারাবাখের নতুন লাইন অব কন্ট্রোলে রাশিয়ার সাথে সাথে তুর্কি সৈন্যও মোতায়েন থাকবে।

আংকারা বলেছে আজারবাইজান কর্তৃক নতুন করে নিয়ন্ত্রনে নেয়া কারাবাখ অংশে তুর্কি-রাশিয়া যৌথ কেন্দ্রীয় সেল গঠন করা হবে যার কাজ হবে শান্তি প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন ঠিক মত বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না সেটা দেখাশোনা করা। বিশ্লেষকদের মতে, এই প্রক্রিয়ায় তুর্কি অফিসিয়ালি নতুন দৃশ্যপটে হাজির হল আর মিনস্ক গ্রুপ তথা পশ্চিমাদের বিদায় ঘটল। এর ফলে নিঃসন্দেহে ককেশাস ছাড়িয়ে মধ্যএশিয়া পর্যন্ত শক্তিশালী তুর্কি প্রভাব বলয়ের সূচনা ঘটল। কে জানে এর মাধ্যমেই হয়তো তুর্কির বহুদিনের স্বপ্ন মধ্যএশিয়া ও ককেশাশের তুর্কিভিত্তিক দেশগুলো নিয়ে প্যান-তুর্কিক সেই ‘তুরান আর্মির’ (তুর্কির ন্যাটো ভার্সন) অভ্যুদয় ঘটবে।

রাশিয়াঃ
——-
বেশীরভাগ ভাষ্যকারদের মতে কারাবাখ সংঘাতে রাশিয়াও লাভবান হয়েছে। গুরুত্বপুর্ন খেলোয়াড় হিসেবে তুর্কির উত্থান ঘটলেও রাশিয়া আবারো প্রমাণ করেছে যে এ অঞ্চলে তারাই ডিসিশন মেকার, তারাই ডীল ব্রোকার। আর্মেনিয়া মিনস্ক গ্রুপের অন্য দুই সদস্য ফ্রান্স ও আমেরিকার দিকে তাকিয়ে থাকলেও এটা এস্টাবলিশ হয়েছে যে এতদঞ্চলে তাদের নিরাপত্তার একমাত্র গ্যারান্টর মস্কো। এছাড়া ভেলভেট রেভিউলেশনের (মস্কোপন্থী প্রধানমন্ত্রী সার্ঝ সাগেসিয়ানকে উৎখাত করে ২০১৮ সালের নির্বাচনের) মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা পশ্চিমাপন্থী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নিকল পাশিয়ানকে ভ্লাদিমি পুতিন উচিৎ শিক্ষা দিতে পেরেছে এই চুক্তির মাধ্যমে।

কিন্তু অনেক আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক এই চুক্তিকে রাশিয়ার পরিস্কার জিওপলিটিক্যাল ভিক্টোরি বলে মেনে ইচ্ছুক নয়। তাদের মতে, আজারবাইজান কর্তৃক দুই পাইলটসহ রাশিয়ান সু-২৫ ভুপাতিত করার মাত্র কয়েক ঘন্টার মধ্যে (সেটাকে হজম করে) চুক্তি করাটাকে বিজয় বলে না বরং এটাকে ‘এন এটেম্পট টু ম্যানেজ ইটস ডিক্লাইন’ অর্থাৎ রাশিয়া তড়িঘড়ি করে এই চুক্তি ডিক্লেয়ার দিয়ে আরো বড় সংঘাতের রাস্তাকে এড়িয়ে চলার পথ খুজে নিয়েছে।

মস্কোভিত্তিক এক আর্মেনিয়ান তো বলেই ফেললঃ “আর্মেনিয়া মস্কোর ন্যাটো ভার্সন সিএসটিও (কালেক্টিভ সিকুরিটি ট্রিয়েটি অর্গানাইজেশন)-এর সদস্য। এছাড়া রাশিয়ার সাথে আর্মেনিয়ার মিউচুয়াল ডিফেন্স প্যাক্ট আছে। আর্মেনিয়ায় রাশিয়ার দুটি সামরিক ঘাটি বিদ্যমান। এছাড়া রাশিয়ার সাথে ধর্মীয় দিক থেকেও অনেক মিল। এর অনেক কিছুই তুর্কির সাথে আজারবাইজানের নেই। তারপরও তুর্কি তার মিত্রকে বিশ্বস্ততার পরাকাষ্টা দেখাচ্ছে। একদিকে আজারবাইজান ও তুর্কি আর্মেনিয়াকে লজ্জাজনক পরাজয় উপহার দিয়ে বিজয় পকেটে ভরছে, অন্যদিকে মস্কো সেটাকে নিশ্চিত করে গ্রাউন্ডে শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠাচ্ছে। হাউ ফানি!”

Advertisements